শান্তিনিকেতনের প্রথম দিককার শিক্ষক ক্ষিতিমোহনবাবু। তাঁর ছিল প্রচুর স্বাস্থ্য ও প্রচুরতর পাণ্ডিত্য। শিক্ষক যখন কোনো প্রতিষ্ঠানে সদ্য যোগদান করেন, তখন তাকে যাচাই করে নেয়া ছাত্রমহলে একটা সনাতন বিষয়। ক্ষিতিমোহনবাবু যেদিন প্রথম ক্লাস নিচ্ছেন, একটি ছেলে নিজের জুতাজোড়া ক্লাসের মধ্যে রাখল। তখন শান্তিনিকেতনে জুতা পড়ার নিয়ম ছিল না, অসুস্থ হলে কেউ কেউ পড়তো।
জুতা রাখার দৃশ্য দেখে ক্ষিতিমোহনবাবু ছাত্রটিকে বললেন, 'জুতাজোড়া বাইরে রাখো।' ছেলেটি নতুন শিক্ষককে বাজিয়ে দেখার মানসে বলল, 'আমাদের এখানে ক্লাসের ভেতর জুতা রাখাই নিয়ম। ক্ষিতিমোহনবাবু বললেন,'ওরকম অবাধ্যতা করলে মার খাবে।' ছাত্রটি এবারে আশ্রমের অব্যর্থ ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করল, 'এখানে আশ্রমের ভেতর মারার নিয়ম নেই।'
এ কথা শুনে ক্ষিতিমোহনবাবু ছাত্রটির এক কান ধরে শূন্যে তুলে ফেললেন, বললেন, 'এখন তো তুমি আশ্রমের বাইরে!' এই বলে এক গালে এক চড়, আবার আরেক কান ধরে শূন্যে তুলে অন্য কানে চড়। তারপর ছাত্রটিকে আবার আশ্রমের মাটিতে 'প্রতিষ্ঠিত' করে দিলেন।
তারপর কোনো ছাত্র তাঁকে আর যাচাই করবার সাহস দেখায়নি।
আরেক ঘটনা শোনা যায় জগদানন্দ রায়ের ব্যাপারে। বিজ্ঞানের এই ধ্যানী শিক্ষক ছাত্রদের প্রতি অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। কাউকে ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু বলেছেন, এমন ইতিহাস বিরল। একদিন কাকে যেন মৃদু চড় বা কিল কিছু একটা দিয়েছেন। ছাত্রকে প্রহার করার পর তিনি ভীষণ মনকষ্টে ভুগতে লাগলেন। সেই ছাত্রটিকে ডেকে তার হাতে কয়েকটা বিস্কুট দিলেন। এটাই জগদানন্দ রায়ের জন্য বিপদ হল, বিস্কুটপ্রাপ্তির ঘটনা ছাত্রমহলে রটে যাওয়ায় সবাই উনার হাতে মার খাবার জন্য উমেদারি আরম্ভ করল। কিন্তু কী বিপদ! উনি যে আর কারো গায়ে হাত তোলেন না!
শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক কেমন হতে পারে, এ বিষয়ে বিশ্বকে দৃষ্টান্ত দেয়ার মতো প্রতিষ্ঠান হিসেবে শান্তিনিকেতন গড়ে উঠেছিল। শারীরিক বা মানসিক শাস্তি নয়, মানব মনীষার সর্বোচ্চ ও স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশই ছিল এর লক্ষ্য। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হিসেবে শান্তিনিকেতনের উচ্চতা অঙ্গুলি নির্দেশে দেখিয়ে দেয় শিক্ষক রবীন্দ্রনাথকে, অবশ্য তাঁর গল্প এই স্বল্প পরিসরে শেষ হবার নয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৬ রাত ১২:১৫