হুট করে পরিবার ছেড়ে দূরে কোথাও পড়তে আসা ছেলেমেয়েগুলোর গল্প ; হঠাৎ বদলে যাওয়া কোনো জীবনের গল্প ।
মা-বাবার আদরের ঘর ছেড়ে হঠাৎ এই ছেলেমেয়েগুলো একসমুদ্র বাস্তবার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ হিমশিম খায়। কেউ সহজেই মানিয়ে নেয়, কেউবা দিনের পর দিন না জানা কোনো গল্পের চরিত্র হয়ে নিজেকে মানিয়ে ফেলে একসময় । এদের মানিয়ে নিতে হয় ।
সেই ছোটবেলায় কেড্স পায়ে দিয়ে স্কুলে পড়তে যাওয়া থেকে শুরু ; সকালের অরুচিটায় জোর করে খাইয়ে দিতে মায়ের কতো চেষ্টা!!
এই ছেলেগুলোই এখন একটা ১০টাকার বন মুখে গুজে পানি দিয়ে গিলতে-গিলতে ভার্সিটির সকাল ৮টার ক্লাস করতে দৌড়ায়। কেউ হয়তো তাও করতে পারেনা দিনের পর দিন।
কলেজে যাবার সময় যেই ছেলে/মেয়েটা খুঁজলেই বাবার কাছে একশটাকার বা তারও বেশি নোট পেয়ে যেতো,
তারাই হুট করে খেয়াল করতে শুরু করে, দিনের পর দিন শুধু মাত্র যাওয়া আসার রিকশা ভাড়াটুকু অথবা শুধু পায়ে হেটেই ক্লাস করে তারা রুমে এসে দুপুরের খাবারটুকু খেয়ে নিচ্ছে। কারো ল্যাব থাকে-কারো বা কুইজ থাকে। সন্ধ্যা হয়ে যায় ফিরতে অনেকের। দুপুরের খাওয়াটুকু সেই সন্ধ্যে বেলায় হয়তো সেরে নিতে হচ্ছে। অনেকে হয়তো তাও আর পেরে উঠেনা। তাতের পেট পুরিয়ে দেয় অন্য কোনো দশটাকার একটা বন অথবা দুটো পরটা আর একবাটি ডালভাজি।
এই ছেলেমেয়েগুলো হুট করে খেয়াল করতে শুরু করে, দিনের পর দিন হাত খালি থাকা সত্ত্বেও এরা ফোন করে একটাবার বলতে পারছেনা, "বাবা ৫০০ টা টাকা দরকার। সকালে নাস্তা খাইনা গত এক সপ্তাহ। "
বরং দিনের পর দিন বাবা-মা থেকে দূরে থাকা ছেলেমেয়েগুলো মেকি হাসির অভিনয় করে চলে, "আলহামদুলিল্লাহ্। ভালো আছি আম্মা। এমনি ফোন দিলাম। কেমন আছো তোমরা??"। দু-তিনবার ফোন করেও বলতে পারেনা, পকেটটা একেবারে শূন্য।
মেসে থাকা ছেলেগুলোর জীবন যেন বাস্তবতায় আরো পদদলিত হবার অভিশাপ। একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পাবার অভিশাপ।
দিনের পর দিন রান্না না হওয়া সত্ত্বেও, যখন রাতে মা ফোন করে জিজ্ঞেস করে, "বাবা কি খেয়েছিস? " । গলার কাছে কে যেন তাদের একদলা কাদা এঁটে দেয়, আর বলে দেয়, " এইতো আম্মা, মুরগি ছিলো আজ। সাথে সবজি আর ডাল। নতুন বুয়ার রান্না অনেক ভালো আম্মা। পেটপুরে খেতে পারি। "
রাতে খেতে যার একসময় ইচ্ছে করতো না, সেই ছেলেমেয়েগুলোই হুট করে দুটো বিস্কিট খেয়ে রাত পার করে দেয়া শিখে যায়।
একসময় আলসে লাগতো বলে যেই মা মশারি টানিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতো, সেই জীবনটা আজ একটা শক্ত চৌকিতে ঘুমানোর অভ্যেশ করে ফেলেছে । মশার কামড়,পোকামাকড় আর বাতাসহীন ফ্যানের ঘটর ঘটর আওয়াজে কিভাবে ঘুমাতে হয়, তা তারা শিখে ফেলে একদিন।
ক্লাস-ল্যাব-কুইজ-প্রেজেন্টেশন-রিপোর্ট দিনের পর দিন এসবে শূন্য বা মোবাইলের ডিজিট সম নম্বর পেতে-পেতে, ক্যারি ক্লিয়ারেন্স বা ব্যাকলগের খাতায় দুচারখানা সাবজেক্ট এড করা প্রচন্ড ডিপ্রেস্ড এই ছেলেমেয়েগুলো বালিশে মুখ চেপে কান্না লুকিয়ে একসময় ভাবতে শেখে, "আমরা কি বাবা-মায়ের সাথে বিট্রে করছি?? নাকি জীবনের সাথে? "
এমনই এক একটা বদলে যাওয়ার গল্প বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এই ছেলেমেয়েগুলোর।
দিনের পর দিন ঘুমকাতর আর কালি পড়ে যাওয়া চোখ নিয়ে ফোনের ওপাশটায় বদলে যাওয়া ছেলেমেয়েগুলো বলে , "ভালো অাছি, মা। "
এমনই নিরবে বদলে যাচ্ছে প্রতিটা ছেলেমেয়েগুলোর জীবন। যিনি নিরবে এসব গল্পের সাক্ষী হয়ে আছেন, তিনি যেন নিরবেই একদিন প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলেমেয়ের জীবন খুব ভালোভাবে বদলে দিয়ে যান।
.
- হিমুরাজ রিয়াজ
২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:০৮