[মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১৫]
অনুবাদ: আ-আল মামুন
মার্টিন এডিনি
ঢাকা থেকে সবেমাত্র ফিরে তিনি আলোচনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন যা ক্রমে গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে।
একক পাকিস্তান এর নাম করে সামরিক সরকার সর্বতোভাবে নিরস্ত্র জনগণের ওপর নির্মম আক্রমণ চালিয়ে নিশ্চিত করেছে যে পাকিস্তানের দুই শাখা আর একসাথে থাকতে পারবে না। দুবছর লাগুক, পাঁচ বছর লাগুক কিংবা দশ বছর লাগুক দেশটি বিভক্ত হতে যাচ্ছে। তবে এই মুহূর্তে সম্ভত চট্টগ্রাম ছাড়া পুরো এলাকাই সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আধুনিক স্বয়ংক্রিয় রাইফেলে সজ্জিত এবং এই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহারে তারা খুব একটা দ্বিধা করছে না। সেনাবাহিনী জনগণের ব্যাপক প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। কিন্তু অসংগঠিত জনগণের হাতে খুব কম আগ্নেয়াস্ত্র আছে। এদের মধ্যে সম্ভবত আঞ্চলিক আধা সামরিক বাহিনী ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের কয়েকটি ইউনিট রয়েছে যারা ১৯৩৯ মডেলের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে। এই আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যসংখ্যা প্রায় ২৭,০০০। যাদের ৮০ শতাংশই বাঙালি। কিন্তু এই বাহিনীর অফিসারদের ৮০ শতাংশই পাশ্চিম-পাকিস্তানী। ২৫ মার্চ রাতেই ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের কিছু পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারকে নিরস্ত্র করা হয়েছে। কিছু কিছু ইউনিট সেনাবাহিনীর অবস্থানের নিকটবর্তী স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে সতর্কতার সাথে সেনাবাহিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে।
পূর্ব বাংলায় এখন সক্রিয় নক্সালবাদী গেরিলা গ্রুপের সংখ্যা খুবই কম, অসংগঠিত এবং তাদের হাতে খুব সামান্যই আগ্নেয়াস্ত্র আছে। সেখানে এমন সব লোকের দেখা পাওয়া যাবে যারা চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল বা বার্মা সীমান্ত দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের চালান চোরাপথে আসছে বলে আলোচনা করছে এবং অনেকেই আধুনিক অস্ত্র আদান-প্রদান করে বলে দাবী করে প্রতারণা করছে। কিন্তু এখনও ব্যাপক অস্ত্রশস্ত্র দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেনি বলেই অনুমান করা হচ্ছে। ২৫ মার্চ শ্রমিকদের মিছিল আয়োজন করেছিল এমন একটি নক্সালবাদী দলের একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য তার দল কর্তৃক সংঘটিত সামান্য কয়েকটি সশস্ত্র লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত আমার কাছে তুলে ধরতে পারল এবং স্বীকার করল যে, “আমরা এখনও খুব দুর্বল।” এমনকি সীমান্তের ওপারে পশ্চিম বাংলায়, যেখানে রাজনৈতিক সহিংসতায় এবছর প্রতিদিন গড়ে আধ ডজন করে লোক নিহত হয়েছে, লক্ষণীয় যে, সেখানে পুলিশ কর্তৃক যে সব অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে তার মধ্যে মাত্র দু’একটা আধা-আধুনিক অস্ত্র রয়েছে। উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে বর্শা, হাতে তৈরি পাইপ গান যা দিয়ে পনেরো ফুট দূরে পর্যন্ত কিছু করা যায় এবং হাতে তৈরি বোমার বারুদ। অবশ্য এতে কোনো সন্দেহ নেই যে গেরিলা কার্যক্রম বৃদ্ধি পাবে এবং অস্ত্রের সরবরাহও বৃদ্ধি পাবে, তবে তা ঘটবে খুব ধীর গতিতে।
অন্যদিকে, গত একমাস ধরে সেনাবাহিনী সংগ্রহ বাড়িয়ে চলেছে। পিআইএ বিমানের প্রতিদিন তিনটি নিয়মিত ফ্লাইট, সম্ভবত প্রতিবার ১৩০ জন করে সৈন্য নিয়ে আসছে; পিআইএ বিমানে এসেছে এমন কিছু লোক আমার চেনা। মালবাহী প্লেনও নিয়মিত আসছে। ঢাকার বেসরকারি পেট্রল ব্যবসায়ীদেরও অতিরিক্ত পেট্রল সরবরাহের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
গুরুতর সংকট
পূর্ব পাকিস্তানে এখন আনুমানিক তিন ডিভিশন সৈন্য সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। ঢাক, কুমিল্লা (একটি আর্টিলারি রেজিমেন্টসহ), রংপুর (অতিরিক্ত একটি আর্মারড রেজিমেন্টসহ) এবং যশোরে এক ব্রিগেডের বেশি সৈন্য রাখা হয়েছে। ঢাকা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরবর্তী জয়দেবপুরে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য রাখা হয়েছে। প্রধান বন্দরনগরী চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী সবচেয়ে বড় বাধার সম্মুখীন হয়েছে, সেখানে পাকিস্তানী সেনাশক্তি বেশি নেই। মার্চের প্রথম দিকে যখন শহরটিতে ভীষণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় তখন সেনাবাহিনী প্রায় দুহাজারের মতো লোককে হত্যা করে এবং শত শত কলোনি উচ্ছেদ করে। এরপর সেনাবাহিনীকে অবাঙালি পরিবারগুলোর প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োগ করা হয়। ২৪শে মার্চ বাঙালিরা শহরের বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড দিয়ে বন্দর থেকে সামরিক সরবরাহ আনার ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীকে বাধা দেয়; শহরজুড়ে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়। প্রায় একমাস ধরে সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে জাহাজটি বন্দরে অপেক্ষা করছিল। পরদিন সকাল নাগাদ সৈন্যরা সামরিক সরঞ্জাম খালাস করতে সক্ষম হয়, তবে জনগণ চট্টগ্রাম-ঢাকা সংযোগ রোড বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
দৃশ্যত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ধৈর্য্য ভেঙ্গে পড়ার ক্ষেত্রে এই ঘটনাই হয়তো চূড়ান্ত ইন্ধন জুগিয়েছে। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে অসহযোগ আন্দোলন চলার পুরো সময় ধরেই সামরিক বাহিনী শেখ মুজিবের রাজনৈতিক অনানুগত্যের সামরিক সমাধানের পরিকল্পনা করছিল। জয়দেবপুর, সৈয়দপুর এবং সবশেষে চট্টগ্রামের ঘটনা সেনাবাহিনীর কাঙ্ক্ষিত আক্রমণ চালানোর অজুহাত তৈরি করে দিল। আর সেনাবাহিনী এই পদক্ষেপ নেয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশের শক্তিশালী দলের নেতা ভূট্টো, যার সাথে সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে, এখন ঈশ্বরের কাছে শুকরিয়া আদায় করছে।
আওয়ামী লীগ নিজে থেকে এসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কতোটা ইন্ধন জুগিয়েছে সেটা বিবেচনা করা জরুরি। স্বীকার করতেই হবে যে শেখ মুজিব তার জাতীয়তাবাদী এবং কিছুটা উগ্র স্বাদেশীক আন্দোলন চালানোর সময় অবাঙালির ওপর এর প্রভাব যে পড়তে পারে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা চেষ্টা করেননি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভারতীয় উপমাহাদেশের সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার লক্ষ্য শুধু পাকিস্তানী শোষকরাই ছিল না, অযৌক্তিকভাবে এটা বিহারী উদ্বাস্তুদের ওপরেও পরিচালিত হয়েছে। মুজিব এসব ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ করেছেন এবং ইয়াহিয়ার পূর্ব পাকিস্তানে আগমনের দিন একজন পাঞ্জাবীর মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের তৈরি রোডব্লক ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সার্বিকভাবে বলা যায়, আওয়ামী লীগ পর্যাপ্ত মাত্রায় আইন-শৃঙ্খলা বজায়ে রেখেছিল। মার্চের প্রথম দিকে চট্টগ্রামে পরিস্থিতি শান্ত করতে অবশেষে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবী দল সহায়তা করেছিল। ঢাকায় সন্ধ্যাবেলায় সেচ্ছাসেবী দলের নিরাপত্তা প্রহরা অনেক সময় ক্লান্তিকর হয়ে উঠত যখন তারা গাড়ীগুলো থামাতো; কিন্তু কদাচিৎ তাদের ব্যবহার বিদ্বেষপারায়ন ছিল, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনুরোধে তারা কোনো কোনো অবাঙালির নিরাপত্তাও দিয়েছে। আওয়ামী লীগের চার সপ্তাহব্যাপী শাসনে কিছু ফ্যাসিস্ট উপাদানেরও আভাস পাওয়া গেছে। তারা লাঠিসোঁটাসহ গুণ্ডাদের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে, ছাত্রলীগের সদস্য পরিচয় দিয়ে কেউ কেউ ফোন করে অবাঙালিদের হুমকি দিয়েছে। এই চার সপ্তাহে একদলীয় দেশে আওয়ামী লীগের ফান্ডে অর্থদাতাদের তালিকা করে চাঁদা চাওয়া হয়েছে।
পূর্ণ ঐক্যমত্য
“পৃথিবীর ইতিহাসে এমন আর একটাও আন্দোলন দেখা যায়নি। কোনো দেশের মানুষ এতোটা ঐক্যবদ্ধ হয়নি।” ঢাকার যে অনুষ্ঠানেই আমি গিয়েছি, আমার অসংখ্য বন্ধু এবং অপরিচিত ব্যক্তিরা এসব কথা বলেছে আমাকে, “সেনাবাহিনী যদি সত্যি সত্যিই অভিযান শরু করে তবে তাদের সহযোগী কোনো বিশ্বাসঘাতক এখানে পাওয়া যাবে না।” অসহযোগ আন্দোলনের সেই চার সপ্তাহে অফিস ও কারখানাগুলোতে আওয়ামী লীগারদের বাধা দেয়া অবশ্যই সুবিবেচনাপ্রসুত হতো না। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের কাছেই অনুমতি চাওয়া হয়েছে গ্রামের উদ্দেশ্যে জলযানগুলো চলাচল করবে কিনা। কেউ সন্ধিহান হতে পারেন বটে, বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিদের একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তিতে বিরক্ত হতে পারেন বটে, কিন্তু এটাই সত্য যে অসহযোগের চার সপ্তাহেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা নিজেদের শাসনাধীনে বাস করছে বলে মনে করেছে। সবসময় একটা ভয় ছিল সামরিক বাহিনীর ওপর আস্থা রাখা যাবে না; যদিও জনগণ বার বার বলছিল যে তাদের দাবী আদায়ের পথ এবং তাদের অধিকার আদায়ের চেতনায় তারা সামরিক সমাধানে বিশ্বাসী নয়, তবু ভয় ছিল যে সামরিক বাহিনী যেকোনো সময় হস্তক্ষেপ করতে পারে।
শেষ পর্যন্ত সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করলো। হতে পারে যে সমঝোতায় পৌঁছাতে মুজিবের ব্যর্থতার কারণ ছিল এই যে তিনি আসলে সমঝোতায় পৌঁছাতে চাননি। দশ বছর বা অনুরূপ সময়ের লক্ষ্য নিয়ে তিনি হয়ত আশা করছিলেন এ সময়ের মধ্যে ঘটনা তাঁর পক্ষে মোড় নেবে। এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে নিজেকে তিনি দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত বিবেচনা করতেন। আমার সাথে এবং অন্যান্য সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে সবসময় তিনি বলতেন, “তারা যদি আমাকে গ্রেপ্তার করতে আসে, আমি এখানেই থাকব, অন্যান্য বিপ্লবী নেতাদের মতো আমি পালাব না।” তিনি দুহাত পিঠের দিকে ঘুরিয়ে দেখাতেন, যেন বাঁধা হয়েছে। তিন যেটা আশঙ্কা করেছিলেন এখন তাই ঘটল। তিনি জীবিত থাকুন কিংবা সামরিক বাহিনীর হাতে নিহত হন- যাই হোক না কেন এখন নেতৃত্ব এমন লোকদের হাতে চলে যাবে (আর এই পরিস্থিতিতে কে-ই বা যুক্তি দিয়ে তাদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করবে) যাদের বিবেচনায় সহিংসতাই একমাত্র পথ। আপাতত এখানকার পরিস্থিতি ভিয়েতনামের চেয়ে সাইপ্রাসের সাথেই বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ। জনপ্রশাসন আবার পরিচালিত হতে থাকবে, লোকজন চাপা ক্রোধ নিয়ে অফিসে ফিরে যাবে। গত চার সপ্তাহের ক্ষয়ক্ষতির কারণে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি আরও মন্দাভাবে চলতে থাকবে এবং চেকোস্লোভাকিয়ার মতো এখানকার জনগণের অনীহার করণে উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।
বস্তুত, প্রাকৃতিক সংকটগুলো - জনসংখ্যার চাপ, বন্যা ও ঘূর্ণীঝড়ের প্রাবল্য - পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান নৈরাশ্যজনক স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ‘আমার স্বপ্নের বাংলা’ হিসেবে শেখ মুজিব যে দেশকে আখ্যায়িত করেন সে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে গেলে জনগণের মতোই তারও স্বপ্নভঙ্গ ঘটবে। আর একারণেই তিনি হয়তো সমঝোতায় না গিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করে দিলেন।
দ্যা গর্ডিয়ান
২৯ মার্চ, ১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ২
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৩
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৪
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৫
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৬
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৭
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৮
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৯
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১০
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১২
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১৩
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১৪
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১২ রাত ৮:২০