[মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১০]
অনুবাদ: আ-আল মামুন
আমাদের বিদেশ সংবাদদাতা
শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন স্বাধীকার আন্দোলন দমন করার জন্য সরকারি বাহিনী নামিয়ে দেয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে ব্যাপক সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার হিসেবে দাবিকারী একটি গুপ্ত রেডিও থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সীমান্ত সংলগ্ন ভারতীয় শহর আগরতলা থেকে গুপ্ত রেডিওর এই সংবাদ মনিটর করা হয়। এই রেডিও থেকে দাবি করা হয়েছে, চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য কয়েকটি স্থানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও সমস্ত পুলিশ বাহিনী পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘিরে রেখেছে। রেডিও থেকে বল হয় যে যুদ্ধ চলছে। এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সৈন্যদের প্রতিরোধ করার জন্য যার যা অস্ত্র আছে তাই নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ার জন্য জনগণকে আহবান জানানো হয়।
রেডিওতে শেখ মুজিবুর রহমান নিজে এই ঘোষণা দেননি। তিনি গুপ্ত স্থানে চলে গেছেন বলে জানা গেছে। রেডিওর ঘোষণাকারী বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ‘স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ঘোষণায় বলা হয়, “বাংলাদেশের জনগণের একমাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। পশ্চিম পাকিস্তানী নিষ্ঠুর স্বৈরশাসকদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে সবাইকে শেখ মুজিবের প্রতিটি নির্দেশ পালন করতে হবে। শত্রু বাহিনীর শেষ সৈন্যটি নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত জনগণকে স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।”
সীমান্ত থেকে প্রাপ্ত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে অল ইন্ডিয়া রেডিও বলেছে, ঢাকা শহর যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। দু’পক্ষেই ব্যাপক হতাহত হয়েছে। কুমিল্লা, যশোর, বরিশাল এবং খুলনাতে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কোলকাতা থেকে প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী আরও অন্তত ১০,০০০ পাকিস্তানী সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানের বন্দরে অবতরণ করেছে; ফলে পূর্ব পাকিস্তানে এখন পশ্চিম পাকিস্তানের মোট সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ালো ৭০,০০০-এ। পূর্ব পাকিস্তান জোনের মার্শাল ’ল প্রধান লে. জেনারেল টিক্কা খান ঢাকা রেডিও থেকে সম্প্রচারিত এক ঘোষণায় স্বীকার করেছেন যে, “পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।” কিন্তু তিনি যুদ্ধের বিস্তারিত কোনো বিবরণ দেননি। অবশ্য পরবর্তীতে ঢাকা রেডিও থেকে সম্প্রচারিত এক ঘোষণায় দাবি করা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি কর্তৃপক্ষের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
অপরিহার্য্য
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দেশোদ্রোহিতার অভিযোগ আনার পরপরই শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্ট রেডিওতে সম্প্রচারিত এক ভাষণে বলেন, “পরিস্থিতি খুব নাজুক হয়ে পড়েছে, আর তাই অতিদ্রুত আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা অপরিহার্য্য হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেন, “শেখ মুজিব সরকারি কর্তৃপক্ষের সাথে প্রতারণা করেছেন এবং দেশের স্বার্বভৌমত্বকে আঘাত করেছেন।” তিনি বলেন, “শেখ মুজিবের এই অপরাধ ক্ষমা করা হবে না।” পাকিস্তানের সকল নাগরিককে তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, “আমার উদ্দেশ্যে একটাই- জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেই আমি এই লক্ষ্য পুরণে নতুন করে পদক্ষেপ নেব।” তিনি বলেন, “কিন্তু দেশে আজ যে সংকটময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে আমি দেশে সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
প্রেসিডেন্ট বলেন, “দেশের ঐক্য ও সংহতিকে শেখ মুজিব আঘাত করেছে; তার অসহযোগ আন্দোলন শুরু করাটা ছিল দেশোদ্রোহিতা। শেখ মুজিব ও তার দল গত তিন সপ্তাহ ধরে আইসম্মত কর্তৃপক্ষকে অবমাননা করেছে। তারা পাকিস্তানী পতাকার অসম্মান করেছে এবং জাতির পিতার ফটোগ্রাফ সরিয়ে ফেলেছে। তারা একটি বিকল্প সরকার প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার চেষ্টা করেছে। তারা নৈরাজ্য, সন্ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।”
ক্ষমতার লোভ
ক্রোধান্ধ কণ্ঠে প্রেসিডেন্ট বলে, “কোনো ক্ষমতালোভী স্বৈরাচারকে তিনি পাকিস্তান ধ্বংস করতে এবং এর ১২ কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলা করতে দিতে পারেন না। সরকারের কর্তৃত্ব পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনে সেনাবাহিনী কী পদক্ষেপ নেবে কিংবা সেনাবাহিনী কী ধরনের বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে সেসব ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি।
পাকিস্তানের অধিক উন্নয়ন সুবিধাভোগী পশ্চিম অঞ্চলগুলোর বিরুদ্ধে পূর্বাঞ্চলের ক্ষোভ দীর্ঘদিন ধরেই দেশটির ঐক্যের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করেছিল। দেশের প্রশাসনিক রাজধানী ইসলামাবাদ পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত এবং পশ্চিম পাকিস্তন সব সময়ই সরকারের কাছ থেকে অধিক সুযোগ-সুবিধা লাভ করেছে। নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য ঢাকা জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক বাতিলের ঘোষণা সাম্প্রতিক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সৃষ্টি করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে তাদের ছয় দফা দাবির অন্যতম দাবি ছিল- স্ব-শাসন।
গত সপ্তায় শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা গমন করেছিলেন এবং এ সপ্তায় পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির নেতা ভূট্টো তার সাথে যোগ দিয়েছিলেন। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে- আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। সরাসরি ঢাকা থেকে পাওয়া শেষ খবর অনুযায়ী রংপুর ও চট্টগ্রাম জেলায় পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে অন্তত ৩৫ বাঙালি নিহত এবং ১০০ বাঙালি আহত হয়েছে।
দি গার্ডিয়ান
২৭ মার্চ, ১৯৭১
পাকিস্তান ভারতকে উভয়-সঙ্কটে ফেলেছে
ইন্দোর মালহোত্রা
বোম্বে মার্চ ২৬: ভারতের বিধান সভায় বিরোধী দলীয় নের্তৃবৃন্দ গতকাল পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। তবে, ভারত সরকার এ ব্যাপারে এখনও নিশ্চুপ থাকার পথ অবলম্বন করছে। পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ রোধের জন্য কিছু সাংসদ চান যে ইন্দিরা গান্ধী জাতিসংঘকে হস্তক্ষেপ করতে বলুক। অন্য সাংসদরা বলেন, ভারতের উচিত শ্রীলঙ্কাকে পূর্ব পাকিস্তানে পাশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য পাঠানোর ট্রানজিট সুবিধা না দিতে সম্মত করানোর জন্য। বাঙালির স্বায়ত্বশাসন আদায়ের সংগ্রামকে অধিকাংশ ভারতীয়ই ন্যায়সঙ্গত মনে করে। দু’একজন কট্টরপন্থী ছাড়া ভারতের কেউই চায় না যে পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাক কিংবা সেখানে নৈরাজ্য বিরাজ করুক। পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত ভারতেও সংক্রমিত হতে পারে তাই এই প্রবণতা নিরুৎসাহিত করা দরকার। তথাপি, দিল্লীর দৃষ্টিতে পাকিস্তানের বর্তমান সংকটের জন্য সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের ক্ষমতালোভী চক্রটিই দায়ী এবং তাদের কারণেই আজ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে শেখ মুজিবের সাথে সমঝোতা করতে এগিয়ে আসতে হয়েছে।
ইয়াহিয়া খানের বিশ্বাসঘাতকতার পর শেখ মুজিব ও তার আওয়ামী লীগের সামনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করা অথবা সমূলে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না। শেখ মুজিব যদি প্রতিবেশীদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান তাহলে ভারত খুব জটিল ও বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা ভারতের মৌলনীতির পরিপন্থী। আর ভারত হস্তক্ষেপ করলে পূর্ব পাকিস্তান এমনকি কাশ্মীরেও চীনের উপস্থিতির আশঙ্কা বেড়ে যাবে। আবার পূর্ব পাকিস্তানীরা যখন নির্বিচারে নিহত হচ্ছে তখন নিশ্চুপ থাকাও দুরূহ। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানীদের মধ্যে না থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে ভারতের প্রতি আস্থা রয়েছে।
বিভ্রান্তিকর সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা ত্রিপুরায় ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করেছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু কোলকাতা ও দিল্লীর সামরিক কর্তৃপক্ষ তৎক্ষণাৎ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
দি অবজরভার
২৭ মার্চ, ১৯৭১
রেড ক্রসের পরিদর্শন
আমাদের বিদেশ সংবাদদাতা
জেনেভায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির প্রধান কার্যালয় থেকে গতকাল জানিয়েছেন যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি তারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য মানবিক সাহায্য প্রদানের বিষয় বিবেচনা করছেন। একজন মুখপাত্র জানালেন পূর্ব পাকিস্তানে বর্তমানে রেডক্রসের কোনো প্রতিনিধি নেই, তবে লীগ অব রেডক্রস কমিটির অফিসের সাথে যোগাযোগ রয়েছে। লীগ অব রেডক্রস সোসাইটির একজন প্রতিনিধি গত বছরের প্রলঙ্করী বন্যার পর থেকে ঢাকায় অবস্থান করছেন। তার কাছে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও অন্যান্য সাহায্যের সাপ্লাই আছে বলে জানা গেছে।
আশাহত
পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা জুলফিকার আলী ভূট্টো কলম্বোতে জানিয়েছেন যে ঢাকায় আলোচনা ভেঙ্গে যাওয়ায় তিনি আশাহত হয়েছেন। করাচী যাওয়ার পথে কলম্বো বিমান বন্দরে যাত্রাবিরতিকালে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে তিনি একথা বলেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিবের অনড় অবস্থান গ্রহণের ফলে আলোচনা ভেঙ্গে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রস্থ পূর্ব পাকিস্তান লীগের সভাপতি কে. এস. আহমেদ পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ জানিয়েছেন। একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, প্রায় পাঁচজন আমেরিকান ও আমেরিকায় অবস্থানরত পূর্ব পাকিস্তানী নিয়ে এই প্রতিনিধিদল গঠিত।
প্যারিস থেকে জানা গেছে যে ফ্রান্সের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চারদিনের পূর্ব পাকিস্তান সফর বাতিল করতে বলেছে পাকিস্তান সরকার, যা আজ থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল। ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ বলেছে ‘সংকটজনক পরিস্থিতিই এর কারণ’।
দি অবজারভার
২৭ মার্চ, ১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ২
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৩
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৪
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৫
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৬
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৭
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৮
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৯