পাকিস্তানে বিদ্রোহ গুঁড়িয়ে দিয়েছে ট্যাংক
৭০০০ নিহত: বাড়িঘর ভস্মীভূত
সাইমন ড্রিং
(ঢাকায় সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারচেষ্টা ফাঁকি দিয়ে তিনি ব্যাংককে এসে পৌছেছেন)
অনুবাদ: আ-আল মামুন
এক ঈশ্বর এবং এক পাকিস্তানের নামে শপথ করে বলছি, ঢাকা আজ একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত শঙ্কিত জনপদে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৪ ঘণ্টা ধরে ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংস গোলাবর্ষণের ফলে অন্তত ৭০০০ লোক নিহত; শহরের ব্যাপক এলাকা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। দেশের সামরিক সরকারের প্রধান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যদিও দাবি করেছেন যে অবস্থা এখন শান্ত হয়ে এসেছে তবু হাজার হাজার লোক শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকার রাস্তাগুলো প্রায় জনশূণ্য এবং প্রদেশটির অন্যান্য অঞ্চলে এখনও হত্যাকাণ্ড চলছে।
নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সেনাবাহিনী কমবেশি সবগুলো শহর ও প্রধান জনবসতিকেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে এবং বাঙালীদের পক্ষ থেকে তাদেরকে নামমাত্র প্রতিরোধ করা হচ্ছে। আর, এ-পর্যন্ত সীমিত প্রতিরোধের ব্যবস্থাও ব্যর্থ হয়েছে। তবুও সামান্যতম উস্কানিতেই জনগণকে গুলি করা হচ্ছে, বিল্ডিংগুলো নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে এবং প্রতিদিন যেন সামরিক বাহিনী ৭৩ মিলিয়ন বাঙালীর ওপর আরও কড়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধ পরিকর হচ্ছে।
নিরীহ জীবন
এ-পর্যন্ত কতো নিরীহ জীবন নিভে গেলো তা সঠিকভাবে নিরূপন করা কঠিন। তবে ঢাকার বাইরের অঞ্চল থেকেও রিপোর্ট আসতে শুরু করেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর ও কুমিল্লা মিলিয়ে অন্তত ১৫,০০০ লোক নিহত হয়েছে। সামরিক আঘাতের বিভীষিকা সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে- ছাত্ররা তাদের বিছানাতেই নিহত হয়েছে, দোকানের মধ্যেই কসাই নিহত হয়েছে, নারী এবং শিশুরা তাদের ঘরের মধ্যেই পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে, পাকিস্তানের হিন্দু ধর্মের লোকদের ধরে নিয়ে গিয়ে গণহারে হত্যা করা হয়েছে, হাট-বাজার-মার্কেট আগুনে ভষ্মীভূত হয়েছে এবং ঢাকা শহরের প্রতিটি বিল্ডিং-এ এখন উড়ছে পাকিস্তানী পতাকা।
সামরিক বাহিনীর হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি, তবে অন্তত একজন অফিসার নিহত হয়েছে এবং দুজন সৈনিক আহত হয়েছে। বাঙালী অভ্যুত্থান সাময়িকভাবে অবদমিত হয়েছে। শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনী দ্বারা উঠিয়ে নিয়ে যেতে দেখা গেছে এবং তার আওয়মী লীগের প্রায় সকল শীর্ষস্থানীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
প্রথম টার্গেট
নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অনেক নেতাকে হত্যা করা হয়েছে এবং শেখ মুজিবের আন্দোলনকে সমর্থন করার দায়ে দুটো সংবাদপত্র অফিস ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু ২৫শে মার্চ রাতে সেনা ট্যাংকগুলো যখন ঢাকার রাস্তায় নেমে এলো তখন তাদের প্রধান টার্গেট ছিল মূলতঃ ছাত্ররা। এক হিসেব অনুযায়ী, ঢাকা আক্রমণের জন্য তিন ব্যাটেলিয়ান সৈন্য ব্যবহার করা হয়েছে- একটি ট্যাংক বাহিনী, একটি গোলন্দাজ বাহিনী ও একটি পদাতিক বাহিনী। রাত ১০টার কিছুক্ষণ আগে তারা ব্যরাক ত্যাগ করে শহরের দিকে যাত্রা শুরু করে। রাত ১১টা নাগাদ গুলিবর্ষণ শুরু হয়। যে-সব ব্যক্তি তরিঘরি করে গাড়ি উল্টিয়ে, গাছের গুঁড়ি ফেলে বা কংক্রিটের পাইপ ফেলে ব্যারিকেড দেয়ার চেষ্টা করেছিল যাতে সেনাবাহিনী শহরে ঢুকতে না পারে, তারাই প্রথম শিকারে পরিণত হয়।
২০০ ছাত্র নিহত
মধ্যরাতের কিছুক্ষণ পরই আমেরিকার সরবরাহকৃত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এম-২৪ ট্যাংকের নেতৃত্বে একদল সৈন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাত্রা করে। সৈন্যদল বৃটিশ-কাউন্সিল-লাইব্রেরি দখল করে সেটাকে পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে গোলাবর্ষণের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। ছাত্ররা সম্পূর্ণ হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। সরকার-বিরোধী জঙ্গী ছাত্র ইউনিয়নের প্রধান ঘাঁটি ইকবাল (বর্তমান জহুরুল হক হল- অনুবাদক) হলে প্রায় ২০০ ছাত্র নিহত হয়েছে।
দুদিন পরও পুড়িয়ে দেয়া কক্ষগুলোতে ছাত্রদের মৃতদেহ একটু একটু করে পুড়ছিল। অনেক মৃতদেহ বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, অবশ্য হলের পার্শ্ববর্তী পুকুরেই বেশিরভাগ মৃতদেহ ভেসে ছিল। চারুকলার একজন ছাত্রের মৃতদেহ পড়ে ছিল তার ইজেলের পাশেই হাত-পা ছড়িয়ে। ৭ জন শিক্ষক নিহত হয়েছেন। বাইরের ঘরে লুকিয় থাকা ১২ সদস্যের এক পরিবারের সকলকেই হত্যা করা হয়েছে। সৈনিকরা অনেক মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে। ইকবাল হলে এখনও ৩০টি মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। এই হলের করিডোরে যে-পরিমাণ রক্ত জমাট বেঁধে আছে তা নিশ্চিতভাবেই এই ৩০ জনের চেয়ে অনেক বেশি মৃতদেহের রক্ত। অন্য একটি হলে (জগন্নাথ হল- অনুবাদক) মৃতদেহগুলো দ্রুত গণকবর খুঁড়ে পুঁতে রেখে তার ওপর ট্যাংক চালিয়ে মাটি সমান করে দেয়া হয়েছে।
বাজার এলাকা ধ্বংসপ্রাপ্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে বসবাসকারীদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণের সময় রেললাইন বরাবর ২০০ গজ জুড়ে গড়ে ওঠা কুঁড়েঘড়গুলোর ধ্বংস করা হয়েছে। টহলদার সেনাবাহিনী এখানকার একটা বাজার ধ্বংস করেছে এবং এর ঘুমন্ত দোকানমালিকদেরও হত্যা করেছে। দু’দিন পর যখন রাস্তায় বেড়িয়ে এসব দেখার সুযোগ ঘটলো তখনও অনেক মানুষের মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে- তাদের কাপড় গলার কাছে উঠে এসেছে।
একই এলাকার ঢাকা মেডিকেল কলেজে সরাসরি বাজুকা দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে। একটি মসজিদ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ধ্বংসলীলা চলছে তখন একদল সৈন্য শহরের অন্য প্রান্তে পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের হেডকোয়ার্টার রাজারবাগ আক্রমণের জন্য চলেছে। প্রথমে ট্যাংক থেকে ভারী গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। তারপর সৈনিকরা পুলিশের ঘুমন্ত কোয়ার্টারগুলোকে মাটির সাথে গুঁড়িয়ে দিয়েছে অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করে। রাজারবাগ হেডকোয়ার্টারের পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজনও জানে না ঠিক কতোজন পুলিশ নিহত হয়েছে। ১১০০ পুলিশের মধ্যে খুব কমসংখ্যকই হত্যা এড়াতে পেরেছে বলে মনে হয়।
গৃহপরিবেষ্টিত
এসব যখন ঘটছে তখন সেনাবাহিনীর অন্য একটা ইউনিট শেখ মুজিবের বাড়ি ঘিরে ফেলে। রাত ১টার কিছুক্ষণ আগে তার সাথে যখন আমাদের কথা হয় তখন বলছিলেন, তিনি যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণের আশঙ্কা করছেন এবং কর্মচারী ও দেহরক্ষী ছাড়া সকলকেই নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাঁর একজন প্রতিবেশী জানালো, রাত ১:১০টায় একটি ট্যাংক, একটি অস্ত্রসজ্জিত কার ও এক ট্রাকভর্তি সৈনিক বাড়িটির দিকে এগিয়ে আসে ফাঁকা গুলি করতে করতে। সৈন্যবহর বাড়িটির বাইরে এসে থামলে একজন অফিসার ইংরেজিতে ডাক দিল, “শেখ সাহেব, আপনি বেরিয়ে আসুন”। এই আহ্বানের জবাবে তিনি ব্যলকনিতে বেরিয়ে এলেন এবং বললেন, “হ্যাঁ। আমি প্রস্তুত। কিন্ত গুলিবর্ষণের কোনো প্রয়োজন নাই। টেলিফোনে আহ্বান করাই যথেষ্ট ছিল। আমি নিজে গিয়ে হাজির হতাম”। এরপর অফিসারটি বাড়ির বাগানের মধ্যে হেঁটে গিয়ে বললেন, “আপনাতে গ্রেপ্তার করা হলো”।
তিনজন কর্মচারী, একজন সহযোগী ও একজন দেহরক্ষীসহ তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো। দেহরক্ষীকে বেদম প্রহার করা হলে তিনি অফিসারটিকে গালি দিতে শুরু করলেন। পার্শ্ববর্তী বাড়ির নৈশ্যপ্রহরী প্রাচীরের আড়ালে লুকোতে গেলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হলো।
গুলি করে পতাকা নামিয়ে ফেলা হয়েছে
সম্ভবত সেনা সদরদপ্তরের উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবকে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার পরই সৈন্যরা তাঁর গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সকল ডক্যুমেন্ট সরিয়ে ফেলা হয়, দৃষ্টিগোচর সবকিছু ভেঙে গুঁড়ো করা হয়, বাগানের দরোজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয় এবং সবুজের বুকে লাল-হলুদ ‘বাংলাদেশ’ পতাকা গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। অতঃপর সৈন্যরা চলে যায় ২টা নাগাদ। শুক্রবার সকালে সারা নগরজুড়েই আগুন জ্বলছিল; সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকা দখল করে রেখে লুকিয়ে থাকা ছাত্রদের খুঁজে বের করে হত্যা করতে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে দিতে ব্যস্ত থাকে।
কিছু কিছু এলাকায় তখনও ভারী গোলাবর্ষণ করা হচ্ছিল। তবে গোলাগুলির গতি অনেক হ্রাস পেয়েছিল। ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান শেরাটন হোটেল- অনুবাদক) হোটেলের উল্টোদিকে দ্যা পিপল সংবাদপত্রের ফাঁকা অফিসে একদল সৈন্য ঝড়ের বেগে ঢুকে পড়ে। এই অফিসসহ আশেপাশের অনেক বাড়িই জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং একজন নৈশ্যপ্রহরীকে হত্যা করা হয়। ভোর হওয়ার কিছুক্ষণ আগে সব গোলাগুলি থেমে যায় এবং যখন সূর্য উঠে আসে, এক রহস্যময় নীরবতা শহরটিকে ঢেঁকে রাখে। কাকের কর্কশ ডাক কিংবা বাঙালী নির্মূল অভিযান চালাতে মাঝেমধ্যে সামরিক কনভয় বা দু’তিনটি ট্যাংকের ঘরঘর করে এগিয়ে চলার শব্দ ছাড়া পুরো শহরটি জনশূণ্য এবং একবারেই মৃত হয়ে থাকে।
অবস্থার আরও অবনতি হবে
কিন্তু ঘোর সংকট আসতে তখনও বাকি ছিল। দুপুর ২টায় কোনোরূপ সতর্কীকরণ ছাড়াই সৈন্যরা পুরোনো ঢাকায় অভিযানে নামলো। ঘিঞ্জি গলি-উপগলির এই পুরনো ঢাকা দশ লক্ষাধিক লোকের বাস। পরবর্তী ১১ ঘণ্টা ধরে তারা সুশৃঙ্খলভাবে ব্যাপক এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালালো। ঢাকার অধিবাসীদের মধ্যে পুরনো ঢাকাতেই শেখ মুজিবের সমর্থন সবচেয়ে বেশি ছিল।
ইংলিশ রোড, ফ্রেন্স রোড, নয়া বাজার, সিটি বাজার- অর্থহীন কিছু নামের সমষ্টি। কিন্তু এখানেই হাজার হাজার লোকের বসতি। সবকিছু আগুনে পুড়িয়ে ধূলিস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে। নয়া বাজার এলাকার একজন অধিবাসী জানালেন, “হঠাৎ করেই রাস্তার মাথায় সৈন্যদের গাড়ি দেখা গেল। অতপর প্রতিটি বাড়ি তাক করে গুলি করতে করতে তারা এগিয়ে এলো”। অগ্রবর্তী বাহিনীর পিছনে ক্যানভর্তি পেট্রল নিয়ে আরেকটি দল আসছিল। যারা পালাতে চেষ্টা করলো তাদেরকে গুলি করা হলো। আর যারা গৃহাভ্যন্তরে থেকে গেল তারা জীবন্ত পুড়ে কয়লা হয়ে গেল। ১২টা থেকে ২টার মধ্যে সেখানে ৭০০ নারী-পুরুষ-শিশু নিহিত হলো। অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটনো হলো অন্তত আরও তিনটি এলাকায়।
পুলিশ আক্রান্ত
একস্থানে অভিযান শেষ করে যতোগুলো পারা যায় মৃতদেহ ট্রাকে নিয়ে সৈন্যরা তাদের পরবর্তী লক্ষে আঘাত হানতে অগ্রসর হচ্ছিল। পুরনো ঢাকার পুলিশ ফাঁড়িগুলোতেও আক্রমণ চালানো হয়। শনিবার সকালে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর একটি বাজারে তার লোকেদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলো; বলল, “আমি আমার কনস্টেবলদের খুঁজছি। আমার থানায় ২৪০ জন কনস্টেবল ছিল। এপর্যন্ত আমি ৩০ জনকে খুঁজে পেয়েছি। বাকিরা নিহত হয়েছে”।
ঢাকার অভিযানগুলোর মধ্যে নৃশংসতমটি ছিল পুরনো ঢাকার হিন্দু এলাকায়। সেখানে সৈন্যরা অধিবাসীদেরকে প্রথমে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াতে বলে। তারপর তাদেরকে দলবদ্ধভাবে গুলি করে হত্যা করে। বাড়িগুলোও এরপর ধ্বংস করা হয়। সৈন্যরা বাঙালী ইনফর্মারদের সাথে নিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যকাণ্ড চালাতে শুক্রবার প্রায় রাত ১১টা পর্যন্ত পুরনো ঢাকায় অবস্থান করে। সৈন্যরা সংকেত দিলেই বাঙালী ইনফর্মাররা আওয়ামী লীগের গোঁড়া সমর্থকদের বাড়ি চিনিয়ে দেয়। সাথে সাথে বাড়িটি ধ্বংস করা হয় ট্যাংক চালিয়ে দিয়ে, রিকয়েলস্ রাইফেলের গুলিতে কিংবা এক ক্যান পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে।
এদিকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের ঢাকার শিল্প এলাকা হিসেবে খ্যাত নারায়নগঞ্জ ও টঙ্গীর দিকে অভিযানে ব্যবহার করা হয়েছে। ঢাকা থেকে প্রায় দশ মাইল দূরবর্তী এই দুটো উপশহরই শেখ মুজিবের বামপন্থী সমর্থকদের কেন্দ্রস্থল।
টার্গেট সংবাদপত্র
শনিবার সকালেও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গুলিবর্ষণ চলছিল। তবে অভিযান শুরু করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ শুক্রবার মধ্যরাতের মধ্যেই অভিযানের বৃহদাংশ শেষ হয়েছিল। অভিযানের শেষের দিকের একটি টার্গেট ছিল বাংলা ভাষার সংবাদপত্র দৈনিক ইত্তেফাক। গোলাগুলি শুরু হলে প্রায় চার শত লোক ইত্তেফাক অফিসে আশ্রয় নিয়েছিল। শুক্রবার বিকেল চারটায় ইত্তেফাক অফিসের উল্টেদিকের রাস্তায় এসে দাঁড়ায় চারটি ট্যাংক। বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ বিল্ডিংটি একটি নরককুণ্ডে পরিণত হয়। শনিবার সকালে দেখা গেল অফিসের ভেতরের কক্ষে মৃতদেহগুলোর দগ্ধ অবশিষ্টাংশ শুধু পড়ে আছে।
সৈন্যরা যেমন দ্রুত এসেছিল তেমন দ্রুততার সাথেই চলে যায়। শনিবার সকালে রেডিওতে ঘোষণা করা হয়, বিকেল চারটে থেকে কারফিউ উঠিয়ে নেয়া হবে। পূণঃপূণঃ ঘোষণা দেয়া হতে থাকে: মার্শাল ’ল রেগুলেশান সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে। প্রেস সেন্সরশিপের ঘোষণা দেয়া হয়, সকল সরকারি কর্মচারিকে কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয় এবং সকল ব্যক্তিগত অস্ত্র কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেয়া হয়।
আতঙ্ক বাড়ছে
ভোজবাজীর মতো শহরে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এলো এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। সকাল দশটা নাগাদ শহরের রাস্তাগুলো মানুষে মানুষে ভরে উঠলো। সবাই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে; আর তখনও পুরনো ঢাকার ব্যাপক অংশে আকাশজুড়ে কালো ধোঁয়া ভেসে বেড়াচ্ছে এবং শহরের বাইরের শিল্প এলাকা থেকে ধোঁয়া উঠছে। কারে করে, রিক্সায় করে লোকজন শহর ছেড়ে যাচ্ছে। তবে অধিকাংশ লোকই জিনিসপত্র সাথে নিয়ে পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। ঢাকার লোকজন পালাচ্ছে। দুপুর নাগাদ হাজার হাজার লোক শহর ছেড়ে যেতে থাকলো। “আমি একজন বুড়ো মানুষ, দয়া করে গাড়িতে আমায় একটু জায়গা দিন”, “আমার সন্তানগুলোকে দয়া করে নিয়ে যান”। কেউই হাসছে না তারা। নীরবে জনতার ঢল শহর থেকে চলে যাচ্ছে। আর যেতে যেতে দেখছে সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ। এটা ছিল এক নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ। সযত্নে পরিকল্পিত এবং অনুসুক্ষভাবে বাস্তবায়িত ধ্বংসলীলা। তারা চারপাশ দেখতে দেখতে হাঁটতে থাকলো।
একটি বাজারের কাছে গুলির শব্দ শোনা গেল। সেকেন্ডের মধ্যে আতঙ্কগ্রস্ত ২,০০০ লোক দৌড়াতে শুরু করলো। তবে, সৈন্যবহরে যোগ দিয়ে অস্ত্র নেয়ার সময় হঠাৎ গুলি বেড়িয়ে গেলে এই শব্দ হয়। সরকারি অফিসগুলো প্রায় জনশূণ্য। অফিসে যোগদানের নির্দেশ অমান্য করে অধিকাংশ কর্মচারীই নিজ গ্রামে যাওয়ার জন্য শহর ত্যাগ করছে।
সাংবাদিক গ্রেপ্তার এড়ালো
শেখ মুজিবুর রহমানের ২৫ দিনের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ধূলিস্যাৎ করতে সেনাবাহিনী যখন অভিযানে নামে সেই সময় থেকেই পূর্বপাকিস্তানে অবস্থানরত সকল বিদেশী সাংবাদিককে অস্ত্রের মুখে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। এবং পরে সবাইকে ধরে প্লেনে উঠিয়ে করাচিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতা সাইমন ড্রিং হোটেলের ছাদে লুকিয়ে থেকে গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন; যদিও তাঁকে গ্রেপ্তার করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালানো হয়েছে। সাইমন ড্রিং ছাড়া কেবল এ্যসাসিয়েটেড প্রেস-এর ফটোগ্রাফার মাইকেল লরেন্ট গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাইমন ড্রিং জ্বলন্ত ঢাকা শহরে ব্যাপকভাবে ঘুরে দেখার সুযোগ পান। গতকাল একটি প্লেনে করে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে আসতে সক্ষম হন। দু’দুবার তার বস্ত্র উন্মোচন করে তল্লাশী চালানো এবং তার লাগেজ পরীক্ষানিরীক্ষা করা হলেও, কৌশলে তিনি ঢাকায় নেয়া নোটগুলোসহ সোমবার সকালে ব্যাংকক পৌঁছে এই রিপোর্ট পাঠান।
দ্যা ডেইলি টেলিগ্রাফ, ২৭শে মার্চ ১৯৭১
[২৫শে মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সাংবাদিকরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সরেজমিনে ঘুরে দেখা সাইমন ড্রিংয়ের এই রিপোর্টটিই প্রথম বিদেশের পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং পাকিস্তানী শাসকবর্গের মিথ্যাচারের বিপরীতে বাঙালী গণহত্যার বিভীষিকাময় চিত্র তুলে ধরে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর মওদুদ এলাহী সম্পাদিত এ্যস্যাইনমেন্ট বাংলাদেশ ’৭১ গ্রন্থে এই রিপোর্টটি সংকলিত হয়েছে। সম্ভবত এখানে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ছাপানোর তারিখ ভুল দেয়া আছে। অনুবাদক, সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। অনুবাদটি আমি করেছিলাম ৭ বছর আগে।]