Inside Out দেখতে যাওয়ার সময় কোন এক্সপেকটেশন নিয়ে যাই নি বলেই বিশাল ধাক্কা খেয়েছি। পিক্সারের বাকি ম্যুভিগুলোর মতোই ক্রিয়েটিভ পার্ট ভীষণ ব্যতিক্রমী, থট প্রভোকিং আর নাড়া-লাগানো! পিক্সার ব্রেইনচাইল্ড হিসেবে একটা ফর্মূলায় ফেলে দেয়া যায় কিন্তু তারপর-ও কোনভাবেই কোন অভিযোগ ওঠে না। ডিজনির এনিম্যাশন সাপোর্ট পাওয়াতে ভিজ্যুয়ালি-ও ভীষণ সুন্দর আর নিখুঁত ম্যুভিটা। আমার কাছে পারফেকশনের দিক থেকে ম্যুভিটা দশে নয়!
এবার আসি প্লটে।
“Meet the little voices inside your head.”- ছিল ম্যুভিটার ট্যাগলাইন। আমাদের ভেতরের অনুভূতিগুলো রক্ত-মাংশের একেকটা চরিত্র হলে আর আমাদের ঠিক সামনেই তাদের দাঁড় করিয়ে দিলে বিষয়টা ক্যামন হতো সেটার একটা ডিমনস্ট্রেশন হচ্ছে ইন্সাইড আউট। মিনেসোটায় জন্ম নেয় ছোট্ট রাইলি আর তাঁর জন্মের পর চোখ খুলে প্রথম মা-বাবাকে দেখার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় ম্যুভিটা। মানুষের মস্তিষ্কের ভেতরের কাজকর্মগুলো খুব সুন্দর কিছু মেটাফোর দিয়ে দেখানো হয়েছে ম্যুভিটায়। রাইলির জন্মের পর তার মাথায় পাঁচটা মৌলিক অনুভূতি জন্ম নেয়। Joy, Sadness, Fear, Disgust আর Anger. আনন্দ, দুঃখ, ভয়, বিরক্তি আর রাগ। এরা রাইলির মাথার হেডকোয়ার্টারে বসে একেকজন একেকসময়ে কন্ট্রোলরুমের কন্ট্রোল নেয়। এদের একেকজনের একেক রং। উজ্জল-ঝিলমিল হলুদ আনন্দ, গাঢ় নীল দুঃখ, ভুষভুষে বেগুনি ভয়, ঘিনঘিনে সবুজ বিরক্তি আর টকটকে লাল রাগ। এদের একেকজনের সাথে রাইলির যেসব স্মৃতি হয় সেসব যায় গোল গোল মার্বলে করে বাগাডুলির আইলের মতো কাঁচপাইপে করে জমা হয় মেমরি ব্যাংকে। ছোট্ট একেকটা মেমরি অর্ব বা মার্বলের মধ্যে স্মৃতিগুলো থাকে। আনন্দের, ভয়ের, দুঃখের, বিরক্তির বা রাগের স্মৃতি। মেমরি ব্যাংকের মধ্যে কোর মেমরি, টেম্পোরারি মেমোরি আর লং টার্ম মেমোরিগুলো থাকে। সেখান থেকে যোগসূত্র ধরে রাইলির ব্যক্তিত্ব গড়তে থাকে কিছু দ্বীপ। ফ্যামিলি আইল্যান্ড, অনেস্টি আইল্যান্ড বা হকি আইল্যান্ড। একজন মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বনগুলো। আমরা তো ওমন দ্বীপ আঁকড়েই বেঁচে থাকি। এছাড়াও সাবকনশাস রুম, ড্রিম প্রোডাকশন ফ্লোর বা এবস্ট্রাক্ট জোনগুলাও দেখানো হয়েছে খুব হিউমারাস ভাবে।
এবার একটু ওদের পাঁচজনকে চিনি।
“We can't focus on what's going wrong. There's always a way to turn things around.”
- Joy
জন্মের পর রাইলির মাথার ভেতর প্রথম জন্ম নেয় ‘Joy’। এটা খুব বোধগম্য কারন জীবনের শুরুটা হয় তো আনন্দ দিয়েই। আবছা শোনা মায়ের আদুরে গলার গান অথবা গমগমে গলার বাবাকে প্রথম দেখা! নতুন একটা পৃথিবী আর সেই পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালবাসার দু’জন মানুষ যারা দুর্গের মতো সব ঝুট-ঝামেলা-দুঃখ থেকে আমাদের দেয়াল দিয়ে রাখেন। দেয়ালের ভেতরে আনন্দ ছাড়া আর কেউ প্রবেশাধিকার পায় না। ঝলমলে আভা, স্বভাবগত উচ্ছাস আর আলো নিয়ে রাইলির ভেতর ‘আনন্দ’ থাকে মধ্যমণি হয়ে। বাকি বন্ধুদের আশা আর আলোর গল্প শোনায় সে। ভীষণ এনার্জেটিক জয় রাইলিকে আত্মবিশ্বাস দেয়। অহং দেয়। যেকোনকিছু অর্জন করার ক্ষমতা দেয়। রাইলির সিস্টেমে কোন ঝামেলা হলে সব্বাইকে সামলে নিয়ে পথ দেখায় দায়িত্বশীল জয়। যেকোন ঝড়-তুফানে রাইলির টলমলে নৌকার হাল ধরে বসে জয়। এতোকিছুর পর-ও জয়ের মধ্যেও আছে দুর্বলতা। সে সেটা জানে না। সে ভাবে সে নিজেই রাইলিকে বাঁচিয়ে দেবে সবকিছু থেকে তার সুখস্মৃতি দিয়ে। তার মধ্যেও একসময় বোধোদয় হয় যে সেই একমাত্র কাণ্ডারি না। আমরা প্রগলভ হয়েও অনেক ভুল করে বসি। জয়ের-ও দুঃখের হাত ধরতে হয় পরিস্থিতির প্রয়োজনে।
“I'm too sad to walk.”
- Sadness
তারপর গগনবিদারী কান্না নিয়ে আসে Sadness। কষ্টে নীল হয়ে থাকা ভীষণ অভিমানী মোটাসোটা মায়াবী স্যাডনেস। স্যাডনেসকে অন্য কেউ বোঝে না তেমন। তারা ভাবে স্যাডনেস খালি নাকিকান্না ছাড়া আর কিছু দিতে পারে না রাইলিকে। স্যাডনেসের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব সবার চেয়ে বেশি। সে-ও চায় রাইলিকে খুশি রাখতে। সে চায় আশাবাদী হতে। কিন্তু তার চরিত্র থেকে বের হয়ে সে জয়ের মতো উচ্ছল হতে পারে না। সাহায্য করতে এসেও তাই সে ঝামেলাই বাঁধিয়ে ফেলে। সবাই চায় সে রাইলির মেমোরি ব্যাংক থেকে দূরে থাকুক। স্যাডনেসকে দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে আমরা কেউ আসলে দুঃখের স্বরূপটা বুঝি না। কেউ বোঝে না যে কান্নাও সুখের হয়। কান্নাতেও থাকে স্বস্তি। কেঁদেও মানুষ হালকা হয়ে যায়। ভেতরের মেঘ ঝড়িয়ে দিয়ে মানুষকে কান্নাই সুখি করে দেয়। আর আলোর মাহাত্ম্য অন্ধকার ছাড়া বোঝা যায় না যেমন তেমনি সুখের অস্তিত্ব-ও দুঃখ ছাড়া অসম্পূর্ণ। স্যাডনেস সবসময় চায় অতীতের সুখস্মৃতিগুলোকে ছুঁয়ে দিতে। সেটাই আমাদের নস্টালজিয়া। আমরা সুখস্মৃতি মনে করি। সুখের মতো ব্যথায় আচ্ছন্ন হই। কারন সেই সোনালী অতীত ফিরে আসবে না আর। আরো একটা জায়গায় স্যাডনেস সবার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে আমার কাছে। আমরা খুশিতে, রাগে-দুঃখে, বিরক্তি বা ভয়ে কেঁদে ফেলি। স্যাডনেস ছাড়া কোন ইমোশন-ই যেন সম্পূর্ণ না। দিনশেষে আমাদের সবকিছুর মধ্যে একটু-আধটু কষ্ট-হতাশা মিলেমিশে থাকে। তাই জয় বা আনন্দের এঁকে দেয়া ছোট্ট গণ্ডিতে আঁটকে থাকতে পারে না স্যাডনেস। প্রতিবার-ই সে ছুঁয়ে দেয় বাকি সবগুলো অনুভূতিগুলোকে। সবকিছু মিলিয়েই স্যাডনেস নিঃসন্দেহে আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র।
“But I'll have you know I'm not scared of everything.”
- Fear
রাইলির ভেতরের গার্ডিয়ান হচ্ছে ফিয়ার। সে সবকিছু থেকে রাইলিকে বাঁচিয়ে দেয়। সে খুব সাবধানী আর ভীষণ ভীতু। তার সবকিছুতেই ভয়। সবকিছুতেই সাবধানতা। নতুন কোন পরিবেশে তার ভয়, চ্যালেঞ্জে তার ভয়, সিদ্ধান্তে তার ভয়, অনিশ্চয়তায় তার ভয়। সবার আগে তার সমাধান হচ্ছে “হাল ছেড়ে পালাই”। আমরা কিন্তু তাই করি আসলে। অনিশ্চয়তায় বা দ্বিধায় আমরা ভয় পাই। আমরা পিছু হটি। আমরা হেরে যাই। আবার ভয়ের জন্যে আমরা অনেক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচেও যাই। বিপদ দেখলে আমরা নিজেদের বাঁচাই এই ভয়ের জন্যেই। ভয় রাইলির স্বপ্নেও থাকে দুঃস্বপ্ন হয়ে। ভয় থেকে কাপুরুষ, ভীতু, লাজুক হতে পারে মানুষ। আবার ভয় থেকেই সাবধানী, পরিশ্রমী বা দূরদর্শী হয় মানুষের চরিত্র।
“When I'm through, Riley will look so good the other kids will look at their own outfits and barf.”
- Disgust
ডিজগাস্ট হচ্ছে রাইলির ভেতরের ভীষণ সৎ, মাতবর আর সবকিছুতেই নাক গলানো সত্ত্বা। সে ভীষণ নাক উঁচু। আশেপাশের সব মানুষের মধ্যে রাইলিকে সবচেয়ে নিখুঁত ভাবে খুঁজে না পেলে তার খুঁতখুঁতে ভাব যায় না। ডিজগাস্টের থেকে রাইলি সবার মধ্যে কথা বলার শক্তি পায়। লড়াই করে বাঁচার শক্তি পায়। আবার ডিজগাস্টের বাড়াবাড়ির জন্যেই রাইলি কিছুটা হিংসুটে-অহংকারীও হয়। সবকিছুতেই নাক উঁচু থাকে তার। বাকি সব অনুভুতির মতামতেই থাকে দ্বিমত। এর মধ্যে থাকে ম্যানিপুলেশন। আমরা ঠিক যেমন বিরক্তি থেকে রেগে যাই আর ঝামেলা থেকে বাঁচার খুব কার্যকর আইডিয়া পেয়ে যাই ঠিক তেমনি ইনি মাঝে মাঝে ‘রাগ’-কে রাগিয়ে দিয়ে রাইলিকে বাঁচিয়ে দেয় অনেক ধরনের ভাঙন থেকে।
“Congratulations San Francisco, you've ruined pizza! First, the Hawaiians, and now you!”
- Anger
এংগার হচ্ছে স্যাডনেসের পর আমার প্রিয় চরিত্র। এংগার আমাদেরকে দেয় শক্তি। আবার এংগার থেকেই আমরা বড় বড় ভুলগুলো করি। “রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন”- ওখান থেকেই আসে। এংগার অধৈর্য, অস্থির আর আক্ষরিক অর্থেই আগ্নেয়গিরি। রেগে গেলে তার মাথা থেকে আগুন বিস্ফোরন হতে থাকে। তাকে খুব একটা কন্ট্রোল দেয়া হয় না তাই। তবে ইনি সবসময় দেখেন রাইলির সাথে সব ঠিকঠাক হচ্ছে কি না। সংগত কিছু না হলেই রেগে আগুন হয়ে যায় রাগ। রাগ-কে রাগিয়ে দিয়ে ডিজগাস্ট আর ভয় মাঝে মাঝেই নিজেদের কাজ করে নেয়। আমরা যেমন বিরক্তি আর ভয় থেকে রেগে যাই। শক্তি পাই। ঠিক তেমন। আবার রাগের মাথায় আমরা ভুল সিদ্ধান্তগুলো পাই বা ভুল পথেও হাঁটা দেই। তখন আমাদের লজিকের সুইচটা বন্ধ করে দেই। অন্যকোন অনুভূতিও কাজ করে না যতক্ষণ ইনার তান্ডব না থামে। এমন-ই গুরুত্বপূর্ণ একজন হচ্ছেন এংগার।
এই পাঁচজন মেজর ক্যারেকটার রাইলির ১১ বছরের জীবনে অনেক টানাপোড়েনে থাকে। এদের নিজেদের একেকজনের চরিত্র-ও দেখার মতো। ম্যুভিটাতে দেখা যায় যে রাইলির এগারো বছরের জীবনের পরিবর্তনগুলো এরা কিভাবে সামাল দেয়। কিভাবে পাঁচজন মিলে ওকে পথ দেখায় বা মাঝে মাঝে নিজেদের-ই হারিয়ে ফেলে। কিভাবে একটা বাচ্চার ভেতর থেকে সরলতা বা ইনোসেন্স কমতে থাকে। তার ব্যক্তিত্ব কিভাবে বদলায়। কোন কোন বিষয় সে অবলীলায় ভুলে যায় যা তার কাছে একসময় বিশাল কিছু ছিল। আবার কোন কোন নতুন বিষয় তার কাছে প্রাধান্য পায়। কিভাবে সে পুরোনো স্মৃতি থেকে শক্তি খুঁজে পায়। কিভাবে সে তার দুঃসময় কাটিয়ে ফিরে আসে বাবা-মার কাছে। ম্যুভিটা বাচ্চাদের জন্যে বানানো কমেডি থ্রিলার হলেও অনেক অনেক চিন্তার খাবার থাকে আমাদের মতো দর্শকের জন্যেও। এজন্যেই দিনশেষে ক্রিয়েটিভ মাথাগুলো বাহবা পায় আমাদের থেকে। আমরা এনিমেটেড পৃথিবীতে ঢুকে রাইলির ছোট্টবেলার কাল্পনিক বন্ধু (ইমাজিনারী ফ্রেন্ড) বিং বং-এর হারিয়ে যাওয়ার জন্যে কাঁদি। যেটা আসলে শিশুর হারিয়ে যাওয়া শৈশব। আমরা সবাই এখানে আমাদের শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ দেখি। নিজেদের পেছনে ফেলে আসা সময়টা খাতার মতো খুলে অনেক কিছু মনে করিয়ে দেয়। আমাদের ভেতরের মায়াবী নীল স্যাডনেস হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। সবমিলিয়ে অসাধারণ একশো মিনিট। প্রতিটা মিনিট অসাধারণ। কোথাও ফ্লো ছুটে নি। একটু সুর কেটে যায় নি।
হাসি-কান্না-রাগ-বিরক্তি-দুঃখ সব-ই লেগেছে ম্যুভিটা দেখে। যেকোন বয়সের যেকোন মানুষের জন্যে হাইলি রেকমেন্ডেড।
সবশেষ কথা – আমাদের ভেতরের সবগুলো অনুভূতি চিনে গেছি। এখন রেগে গেলে বুঝি অকাজটা কার। কাঁদলে দেখি স্যাডনেসের ভীষণ মায়াবী মুখ। পিক্সারকে আন্তরিক ধন্যবাদ নিজেকে এতো সুন্দর ভাবে, নতুন ভাবে চিনিয়ে দেয়ার জন্যে!
হ্যাপি ম্যুভি টাইম!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১৫ রাত ১১:৪০