হুমায়ুন আজাদের "নারী"-র কিছু লাইন লিখলাম ওপরের অংশে। আমি তার কোন নিয়মিত পাঠক বা ভক্ত না। তারকিছু লেখা আমার কাছে আপত্তিকর-ও, তবে তার এ বইটার কিছু লাইনে একজন পুরুষ হিসেবে তার উপলব্ধিগুলো দেখে চমকে গিয়েছি।
কিছু পুরুষ পোস্টের প্রথম লাইনগুলো দেখেই রোমাঞ্চে শিহরিত হয়ে রগরগে কিছু পড়ার লোভে দাবিয়েছেন "বাকিটুকু পড়ুন" বাট্নটা। আমার আজকের কথাগুলো বিশেষ করে এই পুরুষ অংশের জন্য উৎসর্গিত।
*********
রাজশাহী মেডিক্যাল হাসপাতালের নিজের ঘরটায় ব্যস্ত হয়ে হাঁটছেন ডা. হাফিজ। তিন-চার মাস হলো জয়েন করলেন এখানে, ঢাকার বাইরে এই প্রথম পোস্টিং। গুছিয়ে নিয়ে ও.টি. দেখছেন আর রিপোর্টগুলোতে ফাইনাল সিগনেচার দিচ্ছেন ক'দিন ধরে। এর মধ্যই হঠাৎ এই উটকো আদেশটা মানতে পারছেন না। তিনি আমাদের স্টিরিওটাইপড্ ডাক্তারদের নিয়মের বাইরে কিছু নিয়ম মানেন। এ পর্যন্ত কখনো কোনো রোগীকে ভুল টেস্ট করান নি, অযথা ঘোরান নি; দরকারে অপারেশনের টাকার কিছু অংশ-ও দিয়ে দিয়েছেন গরীব রোগীটাকে। এসব যে মহত্ব দেখানোর জন্য করেন তা না, ব্যপারটা স্বভাবগত। সেজন্যই এখন এই অদ্ভুত অর্ডার না মানার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন বেশ পাকাপোক্ত ভাবে। তাঁর পিওন জহির নক দিলে হালকা চমকে যান ডা. হাফিজ... "স্যার, চেয়ারম্যান সাহেবের লোক আসছে"। একটু গম্ভির এবার ডাক্তার... "হুমম, আসতে বলো।"
সবুজ-গোলাপী মেশানো বাহারী শার্ট গায়ে এক ছেলে উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়ায় দরজায়..."কি ব্যপার ডাক্তার ? এখনো রিপোর্ট হয় নাই ?"
- বসুন। আমি রিপোর্টে লিখবো কেন মিথ্যেটা এটা আগে বলুন?
- চেয়ারম্যান সাহেবের ইচ্ছা, তাই লিখবেন।
- আমি একটা মেয়ের মিসক্যারিয়েজ নিয়ে মিথ্যা কেন লিখবো ? মেয়েটা কি রেইপড্ ? তার বাচ্চাটাকে কিভাবে মারা হলো বা এমন কিভাবে হয় যে বাচ্চাটা ভেতর থেকে নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেল ??
-ডাক্তার আপনে লিখবেন যেটা চেয়ারম্যান সাহেব লিখতে বলছে, এতো জানন ভাল না। কম জানবেন, নিজে-ও ভাল থাকবেন, বাকিরাও ভাল থাকবে।
- চেয়ারম্যান সাহেব কে বলুন আমি "মিসক্যারিয়েজ রিপোর্ট" দিয়ে দিবো। এত বড় খবর গুম করা সম্ভব না।
- তাহলে আসি ডাক্তার। ও জ-হি-র! নয়া ডাক্তাররে বুঝা, তার দিন ভাল না।
এরপর বহুদিন যায়। ডাক্তার ব্যস্ত হন অন্য কাজে। মাঝে মাঝেই এক রিপোর্টার আসে ইদানিং, হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীদের পরিসংখ্যান নেয়, ঘরে বসে। তার ডা. হাফিজের সাথে এক ধরনের সখ্যতা গড়ে ওঠে।কথায় কথায় ডাক্তার রিপোর্টারকে বলেন মেয়েটার কথা। রিপোর্টার উৎসুক হয় মেয়েটার ব্যপারে, বলে খোঁজ করে দেখবে।
এরপর আরো কয়েকমাস যায়। রিপোর্টারটা গায়েব-ই হয়ে গেল এক প্রকার। ডাক্তার জহিরকে বলে ওর ঠিকানা জোগাড় করতে। রাজশাহী শহর বেশ ছোট, ২-৩ দিনেই ঠিকানা বের হয়। ডাক্তার নিজেই যান সে ঠিকানায়। রিপোর্টার "আরে! স্যার আপনি! আমাকে খবর দিলেই চলে আসতাম..." বলতে বলতে ভেতরে নেয় তাকে। ডাক্তার চোখ বুলিয়ে নেয় ভেতরটায়... নিম্ন মধ্যবিত্তের মলিন-নুয়ে পড়া আসবাবপত্রের উপরে বেশ বেমানানভাবে চকচক করছে নতুন একটা টেলিভিশন আর একটা ঝকঝকে নতুন সিরিজের নোকিয়া। রিপোর্টার একটু অপ্রস্তুত হলো তাতে। ডাক্তার সরাসরি প্রশ্ন করে, "মেয়েটার ব্যপারে জেনেছো কিছু?" রিপোর্টার আবারো একটু অস্বস্তিতে নড়ে-চড়ে বসে..."স্যার! মেয়েটা অভাগা, ভয়াবহ কাহিনী স্যার! জীবনে অনেক কাহিনী রিপোর্ট করেছি তবে এতোটা নির্মম দেখিনি কখনো!" ডাক্তারের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে রিপোর্টার পাশের এলোমেলো টেবিল ঘেঁটে এক তাড়া কাগজ বের করে... "লিখেছিলাম এখানে স্যার। তবে ঐ চেয়ারম্যান আমাকে ত্রিশ হাজার নগদ গুনে দিলো। তারপর কিভাবে ছাপি ?" ডাক্তারের কপালের রগ ফুলে ওঠে রাগে, কাগজগুলো কেড়ে নিয়ে দুদ্দার করে সিঁড়ি ভেঙে রাস্তায় নামেন। তার কিছুক্ষণের মধ্য ঝকঝকে নতুন সেই নোকিয়া থেকে চেয়ারম্যানের কাছে ছোট্ট একটা সতর্কবাণী যায়, "ডাক্তার থেকে সাবধান"।
হাতের সব কাজ ঠেলে ডাক্তার এবার রিপোর্টারের কাগজগুলো নিয়ে বসেন পড়তে। রিপোর্ট না, বরং দিনলিপি লেখার মতো টানা লেখা...
"আজকে নিতান্তই অজপাড়াগায়ের এক মেয়ের জীবনকাহিনী বলি। মেয়েটার নিজের কথাগুলো বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি, আর এমন গেঁয়ো ফ্যালনা মেয়ে নিয়ে কথা কে বলে! তাই ভাবলাম আমি-ই বলি। রাজশাহীর এক গ্রামের মেয়ে। পূজো আসলেই ঘরে ঘরে ডাক পড়ে যায় মেয়েটার, পূজোর যাবতীয় কাজ একাই সামলে নেয় ও। কুমারী পূজোয় সেজে-গুজে বেদীতে বসে প্রতিমা। দেখতে নিখুঁত দেবীদের মতো হওয়ায় বাবা নাম রাখে প্রতিমা। ও হ্যা, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, মেয়েটা সমাজের বেশ নিকৃষ্ট স্তরের, হিন্দু মেয়ে। জাত না বলে লেখা শুরু করায় দুঃখিত, তাতে হয়তো মেয়েটার সম্মান কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল।"
"সে গ্রামের চেয়ারম্যানের নাতি ইয়াসিন। সে বংশে বা মর্যাদায় ও'যুগের রাজপুত্রের চে' কম না। ইয়াসিনের দু-এক বছরের ছোট হবে প্রতিমা। প্রতিমার বাবা পূজোর মূর্তি গড়েন, মা ওর জন্ম দিয়েই মারা যান। ইয়াসিন তার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে মূর্তি গড়া দেখতে আসে সেই ছোট্টবেলা থেকেই...ভাবে..."কি সুন্দর আঙুলের চাপে খাঁজে খাঁজে চোখ-মুখ বসে যায়... আর রং দিলেই যেন কথা বলা-চলা মানুষের মতো জীবন পেয়ে বসে!" প্রতিমা তাকে দেব-দেবী চেনায়, তাদের গল্প শোনায়। ইয়াসিন মুগ্ধ হয়ে শোনে আর ভাবে... "আরে! প্রতিমা-ও তো সে দেবীটার মতোই একজন!"... এভাবে ইয়াসিন-প্রতিমার বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে সেই বছর পাঁচ-ছয় থেকে। "
"বয়সের সাথে সাথে মুগ্ধতা বা ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। প্রেম জন্মাতেও সময় নেয় না বেশি। ইয়াসিনের কাছে প্রতিমা হয়ে ওঠে "মায়া" আর প্রতিমা-র কাছে ইয়াসিন হয় "বিষ্ণু"। বিষ্ণু একসময় বিয়ের আশ্বাস-ও দেয় মায়াকে। এ সময় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান ইয়াসিনের বাবা জলিল খাঁ। বাবাকে সব কথাই বলে ইয়াসিন। আর ইয়াসিন বলার অনেক আগের থেকেই জানেন সব কথা তিনি। জলিল ইয়াসিনকে বুঝান, "মালাউনের মেয়ের সাথে রং-তামাশা করা যায় বাপ, তারে বিয়া করন যায় না। তোমার যা করতে মন চায় করো, পুরুষ মাইনষের গায়ে দোষ লাগে না। কেউ কিছু বলবে না, কিন্তু আমার বাড়ির বৌ মালাউন হইতে পারবে না।" ইয়াসিন কিছুটা আশ্বাস পেয়ে এবার খোলাসা করে..."আব্বা, অর পেটে আমার বাচ্চা!" এবার জলিল খাঁ-র ভুরু কুঁচকে ওঠে..."কয়জনে জানে এইটা? কয়মাস?" ইয়াসিন মাথা নিচু করে, "এখনো কাউরে কৈ নাই। শুধু মায়া, আমি আর আপনে। দুইমাস হইতেসে।" এরপর বাবা-ছেলেতে আরো কিছুক্ষণ পরামর্শ চলে, তৈরী হয় অসাধারন এক ধ্বংসনামা। ইয়াসিন তার বাবার চৌকস বুদ্ধিতে অভিভূত হয়... তাইতো! কি পাপ-ই না করে ফেলেছে সে! মালাউনের জাতের সাথে তাদের তুলনা! যাহোক...এবার কঠিন প্রায়শ্চিত্তে নামবে সে। পুরুষ মানুষের গায়ে দোষ লাগে না। "
"পরদিন প্রতিমাদের উঠোনে গিয়ে দরাজ গলায় তার "মায়া"কে ডাকে ইয়াসিন। মায়া অসাধারন হেসে দাঁড়ায় ওর সামনে। ইয়াসিন সাবধানী চোখে দেখে ওকে... নাঃ! এখনো বোঝা যায় না!...হাত ধরে মায়াকে বসায় আর বোঝায়; তার বাবা ঠিক করেছে মায়াকে ঘরে তুলবেন। কিন্তু বাচ্চার কথাটা বিয়ের আগে কাউকে বলা যাবে না, হাজার হোক চেয়ারম্যানের ইজ্জতের প্রশ্ন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে হয়ে যাবে। ইয়াসিন আরো জানতে চায়, মায়া কাউকে জানায় নি তো বাচ্চার কথা!...জবাবে "না" শুনে আশ্বস্ত হয়। আরো বলে আজ সন্ধ্যায় মন্দিরের পেছনের ঝোপে ওর অপেক্ষা করবে। মায়া জানতে চায় কারনটা...ইয়াসিন হাসে... "আমার বৌটারে চান্দের আলোয় দেখবার মন চায়!" মায়া লাল হয়... আসবে বলে আশ্বাস দেয়। তখনের মতো বিদায় নেয় ইয়াসিন।"
"সন্ধ্যায় প্রতিমা বেশ আয়োজন করে সাজতে বসে। লাল বড় একটা টিপ দেয়, কাজল দেয়, শাখা পড়ে। কি ভেবে একটু সিঁদুর টেনে দেয় সিঁথিতে। নিটোল দেবীদের মতো মাধুর্য আসে ওর মধ্য, আর কেমন একটা নিষ্পাপ আনন্দে ঝলমল করে মুখটা! পা টিপে টিপে পেছনের মন্দিরের রাস্তায় নামে ও। বেশ নিরিবিলি অংশটায় জংলামতো জায়গাটায় দাড়াতেই পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে নাকে রুমাল চেপে ধরে ইয়াসিন। এলিয়ে পড়ে মেয়েটা... এরপর পেছন থেকে বেড়িয়ে আসে এক দাই। সে এসে বেশ বন্য পদ্ধতিতে ভেতরের ভ্রুণটা মেরে ফেলে আর প্রানের অংশটা যাচ্ছে-তাই ভাবে বের করে আনে গর্ভ থেকে চেঁছে-ছেঁচড়ে। টুকরো-টুকরো বাচ্চাটাকে কবর দেয়া হয় বনের মধ্য। তারপর দাই বিদায় নেয় সেখান থেকে। ক্ষত-বিক্ষত ছিন্ন-ভিন্ন মায়া পড়ে থাকে অচেতন। ইয়াসিন ওকে তুলে নিয়ে ওর বাড়িতে রেখে আসে... শাখা-সিঁদুর দেখে সেদিন হয়তো ইয়াসিন বিদ্রুপ করে হেসেছিল-ও একটু।"
"জ্ঞান হবার পর মায়া দেখে তার সারা শরীর রক্তে ভেজা, কাপড় ছিঁড়ে আছে এখানে সেখানে। একটা অজানা আশঙ্কায় ওর বুক হিম হয়ে যায়। একমাত্র মেয়েটাকে ডাক্তার দেখাতে মেডিক্যাল নিয়ে যায় বাবা। ততদিনে গ্রামে রটিয়ে দেয়া হয়... মেয়ের চরিত্র খারাপ। যার-তার সাথে রাত-বিরেতে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। এক দাই বুড়ি কসম কেটে বলে সে এই মেয়েকে একসাথে অনেক পুরুষ নাচাতে দেখেছে। হিন্দু মেয়েদের অত রাখ-ঢাক নেই। "
"মেডিক্যাল থেকে গ্রামে এসে বিহ্বল বাবা দেখে তাদের একঘরে করা হয়েছে। দিন-রাত তাদের বাড়ির আশে-পাশে চেয়ারম্যানের চরেরা ঘুরঘুর করে তক্ষকের মতো। প্রতিমার বাবা-র আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেল, মন্দিরে-ও তাকে ঢুকতে দেয়া হয়না। একঘরে-দের কোথাও জায়গা নেই, পরমাত্মার কাছেও না। এদিকে তার মেয়েটাও পাগলের মতো সারা রাত-দিন চেঁচিয়ে বেড়ায়..."বাবা! বিষ্ণু আমার মেয়েটারে মাটিতে খুঁড়ে দিসে, আমি জানি বাবা.. আমি সব জানি... আমার মেয়েটা কাঁদে বাবা... ও মরে নাই বাবা... বাবা বিশ্বাস করো আমি সব জানি! মা-আ-আ! আমি আসবো মা! তোকে মরতে দেবো না..."। না খেয়ে-দেয়ে, এতোবড় কলঙ্ক নিয়ে মরার চে' গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করে প্রতিমার বাবা। কলঙ্কিত নষ্ট মেয়েটাকে নেয় না সে, নিজেই নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সেদিন রাতেই ইয়াসিন তার দলবল নিয়ে আসে প্রতিমার ঘরে... পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করা হয় মেয়েটাকে সারারাত ধরে। ভোর হতেই মেয়েটাকে জঙ্গলে নিয়ে টুকরো-টুকরো করে কবর দেয়া হয়। ইয়াসিন বীরদর্পে তার প্রায়শ্চিত্ত সেরেছিল সেদিন... হয়তো অট্টহাসি দিয়ে বলেছিল... "নষ্টা মা আর মেয়েটাকে একই সাথে গেড়ে দিলাম!"
পরিশিষ্ট : আমাদের সেই ডাক্তার কাগজগুলো পড়া শেষ করে পুলিশের সাথে দেখা করে। প্রমান দেখায়, তাতে পুলিশ ইন্সপেক্টর তাঁকে এসব এড়িয়ে যাওয়ার বুদ্ধি দেন, জিজ্ঞেস করেন ডাক্তার কত চান। ডাক্তার কিছুতেই ক্ষান্ত নাহলে তার পরের মাস-ই তাঁর বদলী হয়ে যায় কোন এক অজপাড়াগাঁয়।
*********
|| আমরা একসময় শিখেছি "অনেকের মধ্য শ্রেষ্ঠ যে এক = অন্যতম"; আজকে আমার মনে হয় "পশুদের মধ্য শ্রেষ্ঠ যে এক = পুরুষতম"। নাঃ! আমি ভুল বললাম, পশুরা তো শিকার করে তাদের বেঁচে থাকার তাগিদে আর এসব পুরুষ শিকার করে তাদের অমানবিক ক্ষমতা জাহির করার তাগিদে, আজন্ম এক নোংরা শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের তাগিদে ||
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০০৯ দুপুর ১:৩০