আশির দশকের শেষাংশ হতে শুরু করে নব্বই এর দশকের প্রায় পুরোটা সময় বাংলা টেলিভিশন নাটকের জয়যাত্রা অব্যাহত ছিলো। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় হতে ঘরে ঘরে ডিশ এন্টেনা তথা কেবল নেটওয়ার্কের কারনে ধীরে ধীরে ভিন্ন দেশীয় এবং ভিন্ন ভাষার চ্যানেলগুলো জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করলে অনেকটাই থমকে যায় সেই জয়যাত্রা। তবে সেই সময়ের অভিনেতা অভিনেত্রীদের অভিনয়ের রেশ দর্শক হৃদয়ে রয়ে গেছে অনেক অনেকটা সময় ধরে, যা আজো সেই সময়কার দর্শকদের নস্টালজিক করে তোলে। ওরা চারজন (পেছনে ফিরে দেখা) সিরিজের আজকের পর্ব থাকছে সেই সময়ের চার নাট্যশিল্পীকে নিয়ে, নায়ক চরিত্রের সকলের প্রিয় চারমুখ আজিজুল হাকিম, তৌকির আহমেদ, জাহিদ হাসান, শহীদুজ্জামান সেলিম'কে নিয়ে। যদিও এই তালিকায় মাহফুজ আহমেদ বা টনি ডায়েস'ও জায়গা করে নিতে পারেন অনায়াসে, আমার ব্যক্তিগত পছন্দে মাহফুজ এগিয়ে থাকলেও শহীদুজ্জামান সেলিমকে এই তালিকায় নেয়া হল সেই সময়কার সামগ্রিক নাট্য পরিসর বিবেচনা করে।
তো আসুন শুরু করি আজকের পোস্টঃ
===========================================================================
আজিজুল হাকিম
ইমদাদুল হক মিলনের "কোন কাননের ফুল" নাটক দিয়ে নব্বই দশকে নাট্য জগতের অভিনেতাদের মধ্যে নিজেকে আলোচনায় নিয়ে আসেন অভিনেতা আজিজুল হাকিম। মঞ্চ নাটক দিয়ে নিজের অভিনয় জীবনের শুরু করা এই গুণী অভিনেতাকে ইদানীং আবার পর্দায় ফিরতে দেখা যাচ্ছে, করছেন ওটিটি প্লাটফর্মে কাজ। ১৯৫৯ সালের ১৫ মে কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায় জন্ম নেয়া আজিজুল হাকিমের পিতা প্রকৌশলী আ. হাকিম এবং মাতা মহিজুন্নেসা। ১৯৭৭ সালে ‘আরণ্যক’ নাট্যদলের হয়ে মঞ্চ নাটকের অভিনয় জীবন শুরু করেন আজিজুল হাকিম, পরবর্তীতে ঢাকা পদাতিক, ঢাকা থিয়েটার, পদাতিক নাট্যদলের হয়েও মঞ্চে অভিনয় করেছেন এই অভিনেতা। মঞ্চ নাটকে তার উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেঃ 'ওরা কদম আলী', 'ইবলিশ', 'মানুষ', 'গিনিপিগ', 'আগুণমুখা', 'খেলা খেলা', 'জয় জয়ন্তি' ইত্যাদি। ১৯৮১ সালে বিটিভির ‘এখানে নোঙর’ নাটকে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে টিভি নাটকে যাত্রা করে করেছেন শতাধিক একক এবং ধারাবাহিক নাটক যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ ‘নোঙর’,'কোন কাননের ফুল', 'সংশপ্তক', 'সময় অসময়', 'দিনরাত্রির খেলা', 'নক্ষত্রের রাত', 'একা', 'কোথায় সে জন', 'কাছের মানুষ' প্রভৃতি। আজিজুল হাকিম একসময় বাংলাদেশ বেতারেও নিয়মিত অভিনয় শিল্পী ছিলেন। হুমায়ুন আহমেদের 'শঙ্খনীল কারাগার' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আজিজুল হাকিমের বড় পর্দায় অভিষেক। কাজ করেছেন 'পদ্মা নদীর মাঝি', 'জয়যাত্রা', 'গুলই' এর মত চলচ্চিত্রে। পরিচালক হিসেবেও বেশ সফল আজিজুল হাকিম, নির্মান করেছেন 'সে আমায় ভালোবাসে না;, 'তবুও রংধনু', 'সকাল সন্ধ্যা রাত', 'নিজ গৃহে পরবাসী' সহ অনেক নাটক যেগুলো প্রশংসিত হয়েছে দর্শক মহলে। ব্যক্তি জীবনে নাট্যকার জিনাত হাকিম এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৯৩ সালে। তাদের রয়েছে এক ছেলে এবং এক মেয়ে।
===========================================================================
তৌকির আহমেদ
তৌকীর আহমেদ ১৯৬৫ সালের ৫ মার্চ ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে লন্ডনের রয়্যাল কোর্ট থিয়েটার থেকে মঞ্চ নাটক পরিচালনার প্রশিক্ষন গ্রহণ এবং নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমি থেকে চলচ্চিত্রে ডিপ্লোমা করে তিনি নাট্য ও চলচ্চিত্র পরিচালনা শুরু করেন। ১৯৮০'র দশকের শেষের দিকে "ফিরিয়ে দাও অরণ্য" নাটকের মধ্য দিয়ে তার অভিনয় জীবনের শুরু হয়। তবে ইমদাদুল হক মিলনের লেখা নাটক 'যত দূরে যাই'তেও অভিনয় করে আলোচিত হয়েছিলেন, তবে তুমুল জনপ্রিয়তা পান একই লেখকের সাড়া জাগানো ধারাবাহিক নাটক 'রূপনগর' দিয়ে। পরবর্তীতে 'হারজিৎ', 'ভালবাসি তোমাকে', 'হাসুলি', 'ঐখানে যেওনাকো তুমি', 'বেলি', 'প্রত্যাশা', 'দোলা' সহ শতাধিক নাটকে অভিনয় করেন এই গুণী অভিনেতা। তৌকির আহমেদ অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র তানভীর মোকাম্মেলের 'নদীর নাম মধুমতি'। এরপর তিনি অভিনয় করেন 'চিত্রা নদীর পাড়ে', 'লালসালু', 'রাবেয়া', 'প্রিয়তমেষু', 'জালালের গল্প', 'প্রার্থনা', 'ফিরে এসো বেহুলা'র মত চলচ্চিত্রে। এর বাইরে তিনি একজন সফল নির্মাতা হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেন, নির্মান করেন অনেকগুলো নাটক এবং কিছু আলোচিত সিনেমা। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে 'জয়যাত্রা', 'দারুচিনি দ্বীপ', 'অজ্ঞাতনামা' এর মত সিনেমা। বর্নাঢ্য ক্যারিয়ারে পেয়েছেন পাঁচটি জাতীয় পুরস্কার, নির্মাতা হিসেবে পেয়েছেন একাধিক মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার। তৌকির আহমেদ ১৯৯৯ সালের জুলাইয়ের ২৩ তারিখে অভিনেত্রী বিপাশা হায়াতকে বিয়ে করেন। দাম্পত্য জীবনে তাদের রয়েছে এক মেয়ে আরিশা আহমেদ ও এক ছেলে আরীব আহমেদ। এসবের বাইরে গাজীপুরের শ্রীপুরে প্রায় ১০ বিঘা জমির উপর দাঁড়িয়ে তৌকির-বিপাশা দম্পতির আধুনিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্ট ও কনফারেন্স সেন্টার।
===========================================================================
জাহিদ হাসান
হুমায়ুন আহমেদ এর "আজ রবিবার" নাটকের আনিস চরিত্রে জাহিদ হাসানের অভিনয় কার না মনে আছে। শাওন আর শীলা'র সাথে তার "তিতলি ভাইয়া, কংকা ভাইয়া" ডায়লগ আজও কানে ভাসে। এর পরে জাহিদ হাসান আরো অনেক মনে রাখার মত চরিত্র করেছেন, তবে কৌতুকপূর্ণ চরিত্র করে তিনি সবচাইতে বেশী জনপ্রিয় হয়েছেন। জাহিদ হাসান ১৯৬৭ সালের ৪ অক্টোবর সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইলিয়াস উদ্দিন তালুকদার এবং মা হামিদা বেগম। ১৯৮৪ সালে ১০ আগস্ট বাংলাদেশ টেলিভিশনে "সাত পুরুষের ঋণ" নামক মঞ্চ নাটক এর প্রচারনার মধ্য দিয়ে ছোটপর্দায় এই গুণী অভিনেতার যাত্রা শুরু। ১৯৮৬ সালে আবদুল লতিফ বাচ্চুর পরিচালনায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার যৌথ প্রযোজনার "বলবান" ছায়াছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে জাহিদ হাসানের বড় পর্দায় অভিষেক হয়। ১৯৮৯ সালে তিনি বিটিভির অডিশনে উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৯০ সালে তার অভিনীত প্রথম টিভি নাটক ‘জীবন যেমন’ প্রচারিত হয়। 'নক্ষত্রের রাত', 'আজ রবিবার', 'আরমান ভাই সিরিজ', 'গ্র্যাজুয়েট' সহ অসংখ্য নাটকে তিনি তার অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। বড়পর্দায় তার উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ 'শ্রাবণ মেঘের দিন', 'মেড ইন বাংলাদেশ', 'আমার আছে জল', 'শঙ্খনাদ', 'প্রজাপতি', 'হালদা' প্রভৃতি। অভিনয়ের বাইরে জাহিদ হাসান একজন সফল নির্মাতাও বটে। তার 'পুস্পিতা প্রডাকশন লিমিটেড' নামক একটি প্রযোজনা সংস্থা রয়েছে। তার পরিচালিত নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ 'লাল নীল বেগুনি', 'ঘুঘুর বাসা', 'চোর কুটুরি', 'একা', 'ছন্নছাড়া', 'রুমঝুম', 'বোকা মানুষ', 'ব্যবধান', 'স্বপ্নের গ্রহ', 'অপু দ্য গ্রেট', 'প্রাইভেট ডিটেকটিভ', 'বাউন্ডুলে এক্সপ্রেস' প্রভৃতি। ব্যক্তিজীবনে প্রসিদ্ধ মডেল সাদিয়া ইসলাম মৌ এর সাথে সুখী দাম্পত্য জীবন কাটাচ্ছেন, তাদের দুই সন্তান রয়েছে। মেয়ের নাম পুস্পিতা এবং ছেলের নাম পূর্ণ। তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সহ বেশ কয়েকবার মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার পেয়েছেন এই গুণী অভিনেতা।
===========================================================================
শহীদুজ্জামান সেলিম
হুমায়ুন ফরিদী'র পর আমার কাছে বাংলা টেলিভিশন নাটকে সবচাইতে ভার্সেটাইল অভিনেতা মনে হয় শহীদুজ্জামান সেলিমকে। ছাত্রজীবনে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনিমিক্স এ অধ্যয়নের সময় শহীদুজ্জামান সেলিম নাট্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে তিনি ঢাকা থিয়েটারে মঞ্চ অভিনেতা হিসেবে যোগ দেন এবং অদ্যাবধি এই দলের অধীনে অনিয়মিতভাবে মঞ্চে অভিনয় করে আসছেন। অপরদিকে ১৯৮৯ সালে, বাংলাদেশ টেলিভিশনের "জোনাকি জ্বলে" নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তার টিভি নাটকে যাত্রা। এরপর একে একে বহু জনপ্রিয় এবং আলোচিত নাটকে তিনি অভিনয় করেছনে। তার উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছেঃ ‘৬৯’, ‘চলছে চলবে’, ‘চোরের বউ’, ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘পথের দাবি’, ‘প্রিয়’, ‘সাংরিলা’, ‘বক্সার কবি’, ‘বাজিকর’, ‘চোর এলো মোর ঘরে’, ‘সব বাঁধা পেরিয়ে’, ‘হাফিজ মামা’, ‘অপেক্ষা শুধু বর্ষণের’ ‘নিঝুম রাত্রি’ ইত্যাদি। ছোট পর্দার পাশাপাশি বড় পর্দায়ও সমান তালে কাজ করে চলেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম। তার উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছেঃ ‘মেড ইন বাংলাদেশ’, 'চোরাবালি', 'অজ্ঞাতনামা', ‘মেঘমল্লার’, ‘বাপজানের বায়োস্কোপ', ‘চন্দ্রগ্রহণ’, ‘দেবদাস’, ‘এই তো প্রেম’, ‘ইউটার্ণ’, ‘পদ্ম পাতার জল’, ‘সুলতানা বিবিয়ানা’, ‘নবাব এল এল বি’ সহ আরও অনেক সিনেমা। সর্বশেষ ঈদে একসঙ্গে তিনটি সিনেমা নিয়ে হাজির হলেন শহীদুজ্জামান সেলিম। ‘সুড়ঙ্গ’, ‘প্রিয়তমা’ ও ‘লাল শাড়ি’এই তিন সিনেমায় তিন ধরনের ভিন্ন চরিত্রে তাঁকে দেখা গেছে। ব্যক্তিগত জীবনে শহীদুজ্জামান সেলিম ১৯৯৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশী মঞ্চ এবং টেলিভিশন অভিনেত্রী রোজী সিদ্দিকীকে বিয়ে করেন; দুই কণ্যা সন্তান এর জনক এই দম্পতি। শহীদুজ্জামান সেলিম তার অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ দুবার অর্জন করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। অভিনয়ের পাশাপাশি অতিথি শিক্ষক হিসেবে ফিল্ম এন্ড মিডিয়া বিষয়টিতে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এই সিরিজের আগের পোস্টগুলোঃ
(০১) Four Handsome, বাংলাদেশী মডেলিং জগতে যাদের তুলনা ছিল শুধুই তারা - ওরা চারজন (পেছনে ফিরে দেখা)
(০২) Four Beautiful Ladies, বাংলাদেশী মডেলিং জগতে যাদের তুলনা ছিল শুধুই তারা - ওরা চারজন (পেছনে ফিরে দেখা)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০২৩ বিকাল ৩:৫৮