এই সিরিজের আগের পর্বগুলোঃ
বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০১)
মাশালাজাদে মাশালাদার… বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০২)
বিরিয়ানি'র বাহারি রকমফের - বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০৩)
বিরিয়ানির অমর সব রন্ধনশিল্পীরা - বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০৪)
বিরিয়ানি কি শুধু পুরাতন ঢাকা বা দিল্লীর চাঁদনীচকেই তার স্বাদ এর মায়াজাল বিস্তৃত করেছে? উঁহু, এক্কেবারেই না। পূর্বে ইন্দোনেশিয়া হতে মধ্যপ্রাচ্য পেড়িয়ে দক্ষিন আফ্রিকা হয়ে ইউরোপ, চারিদিকে বিরিয়ানির এই মায়াজাল বিস্তৃত হয়েছে। যেখানে এই উপমহাদেশের মানুষ বসত গেড়েছে সেখানে এই বিরিয়ানি'র বিস্তৃতি ঘটেছে। ব্যাপারটা কিছুটা অবাক, কারণ বিরিয়ানির আদি আঁতুড়ঘর মধ্যপ্রাচ্যের লোকেদের চাইতে উপমহাদেশের লোকেদের মাঝেই যেন এই বিরিয়ানির জাদু বেশী প্রভাব ফেলেছে। আর তাইতো আজ, বেশ কিছু দেশের নানান স্বাদের নানান পদের কিছু বিরিয়ানির গল্প তুলে ধরা হবে "বিরিয়ানিনামা"র এই পর্বে। তো চলুন শুরু করা যাক।
(০১) ভারতীয় বিরিয়ানি
আগের পর্বগুলোতে আমরা জেনেছি ভারত উপমহাদেশে মোঘলদের হাত ধরেই বিরিয়ানি’র প্রচলনের পক্ষে সবচেয়ে বেশী মত প্রচলিত রয়েছে, তবে অনেকেই দাবী করেন তারও আগে সমুদ্রপথে বাণিজ্য করতে আসা আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের বণিকদের হাত ধরে বিরিয়ানির স্বাদ প্রথম পেয়েছে এই ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ। তো সে যাই হোক, ভারতে কিন্তু বিরিয়ানি’র অসংখ্য রকমভেদ রয়েছে। রসনা বিশারদগণের নানান তথ্য উপাত্ত ঘেটে দেখা যায় শুধু হায়দ্রাবাদ বা লখনৌ এলাকাতেই ত্রিশ থেকে চল্লিশ রকমের নানান স্বাদের, নানান পদের বিরিয়ানি পাওয়া যায়। তবে এই বিরিয়ানি ভারতের উত্তর হতে দক্ষিণে একেবারেই ভিন্নতর, আবার উত্তর-পূর্বে এসে তা পেয়েছে অন্য রূপ। উত্তর ভারতে অধিকাংশ মানুষ ভেজিটেরিয়ান বলে সেখানে আধিপত্য দেখা যায় ভেজ বিরিয়ানি’র। তবে দিল্লী, মুম্বাই, কাশ্মীর এ ব্যতিক্রম রয়েছে। সেই অনুপাতে দক্ষিণে হায়দ্রাবাদ থেকে কেরালা হয়ে কণ্যাকুমারী; এই এলাকার বিরিয়ানি একেবারেই ভিন্নতর। আবার পূর্বের কলকাতা হয়ে আসাম এর দিকে বিরিয়ানিতে মসলা এবং মাংসের আধিক্য দেখা যায়। ভারতের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিরিয়ানিগুলোর মধ্যে রয়েছে হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি, দিল্লি বিরিয়ানি, কলকাতা বিরিয়ানি, সিন্ধি বিরিয়ানি, লক্ষ্ণৌ বিরিয়ানি, মুঘলাই বিরিয়ানি, কোর্গি মাটন বিরিয়ানি, ভাটখালি বিরিয়ানি, আম্বুর/ভানিয়াম্বাদি বিরিয়ানি, ভাতকলি/নববতী বিরিয়ানি, বোহরি বিরিয়ানি, চেট্টিনাদ বিরিয়ানি, দেহ কি বিরিয়ানি, ডিন্ডিগুল বিরিয়ানি, থালাশ্বেরী বিরিয়ানি, মেমনি/কচি বিরিয়ানি, কল্যাণী বিরিয়ানি, গুজরাটি বিরিয়ানি, বোম্বে বিরিয়ানি, খোজাস বিরিয়ানি, বোরিস বিরিয়ানি, রাওথার বিরিয়ানি, আওরঙ্গবাদী বিরিয়ানি, অসমিয়া কামপুরি বিরিয়ানি প্রভৃতি।
(০২)পাকিস্তানি বিরিয়ানি
পাকিস্তানি বিরিয়ানির মধ্যে অন্যতম প্রসিদ্ধ হলো সিন্ধি বিরিয়ানি এবং লাহোরি বিরিয়ানি। সিন্ধি বিরিয়ানি মাংস, বাসমতি চাল, শাকসবজি এবং বিভিন্ন মশলার মিশ্রণে তৈরি করা হয়। সিন্ধি বিরিয়ানি পাকিস্তানের সবচাইতে জনপ্রিয় বিরিয়ানি যা প্রায়শই পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা (পিআইএ) এর আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে পরিবেশন করা হয়। অপর দিকে লাহোরি বিরিয়ানি হচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একটি বিরিয়ানি যেখানে প্রচুর মশলা এবং ঝোল ব্যবহার করা হয়। অন্য কোন বিরিয়ানিতে “ঝোল” তথা গ্রেভী না থাকলেও লাহোরি বিরিয়ানি এটির জন্যই স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানে এর বাইরে জনপ্রিয় বিরিয়ানিগুলোর মধ্যে রয়েছে পাঞ্জাবী বিরিয়ানি, বোহরি বিরিয়ানি, আফগানী বিরিয়ানি, মুঘলাই বিরিয়ানি, হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি, মুরাদাবাদী বিরিয়ানি প্রভৃতি। আর হালে আলোড়ন তুলেছে “চকলেট বিরিয়ানি” আর “স্ট্রবিরিয়ানি”। পাকিস্তান যেতে পারলে চেখে আসা যেত
(০৩) শ্রীলঙ্কি বিরিয়ানি
প্রায় দু’শত বছর আগে ভারতের দক্ষিণে যখন সমুদ্রপথে ভিনদেশী বণিকেরা ব্যবসা করতে আসতো, তাদের মাধ্যমেই দ্বীপ দেশ শ্রীলঙ্কায় বিরিয়ানির প্রচলন হয়েছিলো। তবে সেখানে বিরিয়ানি’কে ডাকা হয় “বুরইয়ানি” নামে। নানান মশলার সহজলভ্যতা এবং প্রথাগত ব্যবহারের কারনেই এই শ্রীলঙ্কি বিরিয়ানিতে মসলার আধিক্য দেখা যায়। এর সাথে নারিকেলের দুধ, কারি পাতা, স্টার মসলা সহ বেশকিছু উপাদান এই বিরিয়ানিকে দেয় ভিন্নতর স্বাদ; আমাদের দেশীয় অনেকের কাছেই যা খুব একটা সুবিধের ঠেকে না। তবে জিহবা ভিন্ন ভিন্ন পদের খাবারে অভ্যস্ত হলে এই বিরিয়ানির ব্যতিক্রমী স্বাদ ভোজন রসিকের কাছে অতি অবশ্যই আকর্ষণীয় ঠেকবে।
(০৪) মায়ানমার
মায়ানমার এর বিরিয়ানির নাম বার্মিজ ভাষায় “ডানপাউক” যা মূলত একটি পার্সিয়ান শব্দ থেকে এসেছে। এর মূল অর্থ অল্প আঁচে দমে বসিয়ে ধীরে ধীরে রান্না করা। এই বিরিয়ানিতে কাজুবাদাম, কিসমিস, দই, মটরশুটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং পরিবেশন করা হয় পেয়াজ, শসা, গ্রেভি জাতীয় স্যুপ সহযোগে। এর বাইরে "এমব্রোসিয়া" নামক আরেক ধরনের বিরিয়ানি মায়ানমারে জনপ্রিয় যেখানে নানান ড্রাইফ্রুট এবং মাখন এর ব্যবহার হয়ে থাকে।
(০৫) সৌদি আরব
সৌদি আরবের ‘কাবসা’ বা ‘খাবসা’ উচ্চারণ ভিন্নতায় যাই নাম হোক না কেন, এটাকে পুরোপুরি বিরিয়ানি না বলে বিরিয়ানি’র তুতো ভাই বলা যেতে পারে। বড় বড় টুকরোর মাংস ভালো মত ধুয়ে নিয়ে চাকু দিয়ে মাংসের টুকরোগুলো কে চিরে দেয়া হয় যাতে সেখানে ভালমত মাংস প্রবেশ করে। এরপর দারচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, গোলমরিচ, জিরে, ধনে, স্টার অ্যানাইস, জয়িত্রি ভালো করে ভেঁজে নিয়ে গুড়ো করে তৈরী করা হয় কাবসা মসলা যা দিয়ে মাংসগুলোকে মেরিনেট করা হয়, সাথে দেয়া হয় আদা-রসুন বাটা, লঙ্কাগুঁড়ো, নুন, এবং পাতিলেবুর রস। মাংস অর্ধেক সেদ্ধ হয়ে এলে তাতে আগে থেকে ধুয়ে রাখা চাল দিয়ে দেয়া হয়ে। পরে একটি পাত্রে মাখন দিয়ে মাংসগুলোকে আলাদা করে ভেঁজে সেগুলো ফের চালের সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়; সাথে দেয়া হয় ভাঁজা বাদাম এবং কিসমিস। মধ্যপ্রাচ্যের সবচাইতে জনপ্রিয় খাবার হল এই কাবসা।
(০৬) ইরান
বেশীরভাগ ঐতিহাসিক সূত্র মতেই বিরিয়ানি’র আদি আঁতুড়ঘর ইরান তথা পারস্য অঞ্চল। বিরিয়ানি শব্দের উৎপত্তি ফার্সি শব্দ ‘বিরিযঁ’ অথবা ‘বেরিয়ান’ থেকে। বিরিযঁ - অর্থ চাল এবং বেরিয়ান - অর্থ ভাজা। তার সেই শাব্দিক অর্থের ভিত্তিতে ‘বিরিয়ানি’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘ভাঁজা চাল’। তো সে যাই হোক, ইরানি বিরিয়ানির সাথে অন্য সাধারণ বিরিয়ানির পার্থক্য কিন্তু এই ‘ভাঁজা চাল’ এর মধ্যেই। ইরানি বিরিয়ানিতে বিরিয়ানির চাল ভাল করে ধুয়ে নিয়ে তা ঘি বা পছন্দমাফিক তেলে ভালো মত ভেজে নেয়া হয়। অনেক সময় আগে ভেজে নিয়ে পরে ধোয়া হয়ে থাকে। এই ভাঁজা ততক্ষণ পর্যন্ত চলে যতক্ষণ পর্যন্ত চালের রঙ স্বচ্ছ না হয়ে যায়। একইভাবে বিরিয়ানির মাংসও ভালো মত তেলে ভেজে মাংসের ঝোল রান্না করে সেই ঝোলে চাল সেদ্ধ করে মাংস দিয়ে রান্না শেষ করা হয়। ইরানি বিরিয়ানিতে পুদিনা পাতা, ধনেপাতা, লেমন গ্রাস বেশ পরিমাণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনেক সময় ইরানি বিরিয়ানি’তে সেদ্ধ ছোলার ডাল ও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
(০৭) ইরাকি বিরিয়ানি
ইরাকের বিরিয়ানির বিশেষত্ব হল জাফরান এর বিশেষ ব্যবহার। ইরাকি বিরিয়ানিতে ভাজা পেঁয়াজ, ভাজা আলুর কিউব, বাদাম এবং কিসমিসের সাথে চাল ও মাংস যা দই, গুল্ম, মশলা, শুকনো ফল যেমন কিসমিস, ছাঁটাই বা ডালিমের বীজের সাথে আগে থেকে মেরিনেট করে রাখা হয়ে থাকে। এই ইরাকি বিরিয়ানি সেখানকার খুবই জনপ্রিয় খাবার বিশেষ করে কুর্দিস্তানে।
(০৮) আফগান বিরিয়ানি
মধ্যপ্রাচ্যের গা ঘেঁষে থাকা সত্ত্বেও আফগানি বিরিয়ানি পেয়েছে ভিন্নতা। প্রাচ্যের অতিরিক্ত মশলার ব্যবহার এখানে দেখা যায় না। তার বদলে প্রচুর পরিমাণে ড্রাইফ্রুট এর ব্যবহার দেখা যায়। বেশ ঝরঝরে এই বিরিয়ানিতে মাংসও পরিমাণে কম দেয়া হয়। আর হ্যাঁ, গাজর দিয়ে বিশেষভাবে গার্নিশ করা হয়ে থাকে আফগানি বিরিয়ানি রান্না শেষে, সাথে আরেকদফা ড্রাইফ্রুটও দেয়া হয়।
(০৯) ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়া’র বিরিয়ানি’র নাম “নাসি কেবুলি” যার রন্ধন প্রক্রিয়া এবং স্বাদ পশ্চিমের ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্য’র বিরিয়ানি হতে পৃথক। সাধারণত বড় দানার চাল, বিশেষ করে বাসমতি চালকে সেদ্ধ করে তাতে আগে থেকে রান্না করা মাটন এর সাথে দুধ এবং ঘি দিয়ে দম দেয়া হয়। এই নাসি কেবুলি মূলত আফগানি কাবুলি পোলাও এবং আরবীয় কাবসা হতে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতীয় বিরিয়ান গোত্রীয় একটি খাবারের বিবর্তিত রূপ। এই বিরিয়ানি রান্নাতে সাধারণত পানি ব্যবহার করা হয় না, তার পরিবর্তে ছাগলের দুধ অথবা নারিকেলের দুধ দেয়া হয়। মাংস রান্না করা হয় নানান মশলা এবং টমেটো সহযোগে। এটি অনেক সময় “মারাক স্যুপ” নামক ছাগল বা ভেড়ার মাংস দিয়ে রান্না করা পদ দিয়ে পরিবেশন করা হয়ে থাকে।
(১০) মালয়েশিয়ান ‘নাসি বিরিয়ানি’
মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে নাসি ব্রিয়ানি খাবারগুলি খুব জনপ্রিয়। প্রথমে স্টার আনি, এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, জিরা এবং রসুন ভেজে তাতে আগে থেকে ধোয়া বাসমতি চাল ভেজে এর মধ্যে নারিকেলের দুধ, লেমন গ্রাস এবং চিকেন স্টক দিয়ে ভালমতো রান্না করে লেমন গ্রাস তুলে ফেলে পেয়াজ বেরেস্তা, কিসমিস, ভাঁজা কাজুবাদাম এবং ধনেপাতা ছিটিয়ে দেয়া হয়। এরপর আলাদাভাবে নারিকেল তেল বা ভেজিটেবল অয়েল দিয়ে স্টার আনিস, এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, রসুন ছেঁচা, বড় পেঁয়াজ-কুচি ভেজে নিয়ে টমেটো কুচি দিয়ে আগে থেকে মেরিনেট করে রাখা মুরগির মাংস চিকেন স্টেক দিয়ে রান্না করা হয়। রান্নায় আরও ব্যবহার করা হয় জায়ফল গুঁড়া,লাল মরিচ, হলুদ। সব শেষে মাংস হয়ে এলে পেঁয়াজ বেরেস্তা এবং ধনেপাতা দিয়ে রান্না শেষ করা হয়। এখন ইচ্ছে করলে রাইসের সঙ্গে মাংসটা মিশিয়ে অথবা রাইস ও মাংস আলাদা করেও পরিবেশন করা যায়। দুটো পদ্ধতিই সেখানে সমান জনপ্রিয়।
এর বাইরে ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্তৃত হয়েছে এমন অঞ্চলের মধ্যে মরিশাস, দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, দুবাই প্রভৃতি অঞ্চলের ভিন্নতর স্বাদ এবং রন্ধনপ্রণালী'র বিরিয়ানি ভোজন রসিকদের রসনাবিলাস মিটিয়ে চলেছে। আজ এই পর্যন্তই, "বিরিয়ানিনামা"র আগামী পর্বে হাজির হবো নতুন কোন বিরিয়ানি কথন নিয়ে। সেই পর্যন্ত সাথেই থাকুন, পাশেই থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০২২ রাত ১১:০৬