আগের পর্বঃ "লামাহাট্টা" হয়ে "রাংগপো" (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ১০)
আমরা যারা কর্মজীবী, বিশেষ করে চাকুরীজীবী, তাদের ভারত ভ্রমণ এর পরিকল্পনা করতে হয় লম্বা ছুটিকে মাথায় রেখে। আর আমাদের দেশের লম্বা ছুটি মানেই দুই ঈদের ছুটি, তাও বেশীরভাগেরই তিন দিন এর ছুটি হয়ে থাকে। তাই সেবারের দার্জিলিং ভ্রমণ এর পরিকল্পনা হয়েছিলো ঝুম বর্ষায়। বর্ষায় পাহাড়ী এলাকায় ভ্রমণ সব সময়ই কিছুটা রিস্কি হয়ে থাকে, যার অন্যতম হল ল্যান্ড স্লাইড হয়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়া। তো আমাদের সেবারের ভ্রমণে দার্জিলিং হতে সিকিম বর্ডার এলাকা “রাংগপো” ভ্রমণ শেষে আমাদের গন্তব্য ছিলো “লাভা”। সেখান থেকে সন্ধ্যে নাগাদ “লোলেগাও” গিয়ে রাত্রী যাপন। রাংগপো হতে দর্শন পর্ব সমাপ্ত করে আমরা রওনা হলাম লাভা’র উদ্দেশ্যে। ততক্ষণে সূর্য মধ্যাকাশে অবস্থান নিলেও মেঘের ঘনঘটার কারণে তা ছিলো দৃষ্টির আড়ালেই। প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর আমরা একটা যাত্রা বিরতি দিলাম দুপুরের খাবার সেরে নেয়ার জন্য "রামাধুরা" নামক এক ছোট্ট পাহাড়ী গ্রামে; কেননা লাভা হয়ে লোলেগাও পৌঁছুতে সন্ধ্যে পেড়িয়ে যাবে।
“রামাধুরা” ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কালিম্পং জেলার কালিম্পং সদর মহকুমার কালিম্পং ২ য় সিডি ব্লকের একটি গ্রাম। শিলিগুড়ি অথবা দার্জিলিং যে দিক থেকেই হিসেব করেন প্রায় আশি কিলোমিটার দূরে প্রকৃতির কোলে দাঁড়িয়ে থাকা এই নিরিবিলি এই পাহাড়ি গ্রামটি আপনাকে মুগ্ধ করবে। তবে হ্যাঁ, রামাধুরা বেড়ানোর পরিকল্পনা করলে কালিম্পং থেকে করাই শ্রেয়, কারণ কালিম্পং থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে রামধুরা। যারা অফবিট ডেস্টিনেশন পছন্দ করেন তারা কালিম্পং মূল ষ্টেশন রেখে রিশপ, রামাধুরা, লাভা, লোলেগাও নিয়ে চমৎকার একটি ভ্রমণ পরিকল্পনা করে ফেলতে পারেন। আমি পরবর্তীতে এই এলাকায় গেলে আমার এরকম একটা প্ল্যান আছে। রিশপের ঠিক কোল ঘেঁষেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের “নেওড়া জাতীয় উদ্যান”।
যাই হোক রামাধুরা নামের এই ছোট্ট গ্রাম, যা সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের মাঝে অবস্থিত। এই গ্রামের পাশ দিয়ে তিস্তা নদী বয়ে গেছে। গোটা গ্রাম জুড়ে পাহাড়ি ফুলের চাষ হয়। প্রাকৃতিক শোভা দেখার জন্য এই জায়গায় ভ্রমন করতেই হবে। আমরা এখানে একটি পাহাড়ি বাঁকে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট খাবার দোকান দেখে গাড়ী থামালাম। চারিদিকে ধোঁয়ার মত মেঘে ঢাকা। ফুট পঞ্চাশেও দৃষ্টিসীমা পৌছাচ্ছে না। রেস্টুরেন্টটিতে ঢুঁকে দেখি অপর পাশের জানালা দিয়ে চমৎকার পাহাড়ী ভিউ দেখা যায়, যদিও মেঘের কারণে প্রায় অংশই অদৃশ্য। বেশ কিছুটা সময় কাটানোর পর একসময় খুব অল্পক্ষণের জন্য মেঘের দল সরে গেলে অপূর্ব এক ভিউ দেখতে পেলাম।
এদিকে পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। সবাই নিজেদের মত করে অর্ডার করে দিলো, কেউ আলু পরাটা, কেউ চাউমিন, কেউ ফ্রাইড রাইস। আমি দেখলাম মেন্যুতে “থুকপা” নামে একটা জিনিশ রয়েছে। আমি এর আগে এই পাহাড়ী খাবারটি কখনো চেখে দেখিনি, এমনকি নামও তখন পর্যন্ত শুনি নাই। তাই শখ করে অর্ডার করলাম “থুকপা”। আসলে ভ্রমণে গিয়ে অচেনা খাবার খাওয়ার শখ আমার রয়েছে। কিন্তু এবারের শখ পূরণ করা অসাধ্য হয়ে গেল। কিছুটা পাতলা স্যুপি-নুডুলস এর মাঝে অনেকটা কাঁচা সালাদ (বাধাকপি আর মুলো কুচি হতে পারে) দিয়ে যে খাদ্যটি পরিবেশন করা হল, তা এক চামচ মুখে দিয়ে আমার কাছে “অখাদ্য” মনে হল!!! দুঃখিত, আসলে আমার মুখের স্বাদে তা কোনমতেই গ্রহণযোগ্য হল না বিধায় “অখাদ্য” উপমা দিতে হল। আমার অবস্থা দেখে দলের সবাই মজা পেল, শুরু হয়ে গেল আমায় খ্যাপানো। রাগ করে আমি আর কিছু খেলামই না। ধুর, বাইরে গিয়ে প্রকৃতি দেখি…
বাইরের রাস্তায় ছবি তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম, চারিধারে মেঘের কুয়াশার আঁচলের বাঁধাহীন বয়ে চলা। সেই আঁচলের তলা থেকে হুশহাশ করে গাড়ী দ্রুত বের হতে দেখে পাশে সরে এলাম। অদ্ভুত এক প্রকৃতি, এরকম জায়গায় গেলে মনে হয় শহুরে জীবনে আমরা কতটাই না অভাগা। এরকম পরিবেশে থাকলে জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসেবগুলো অনেক সহজ হয়ে যায়। যান্ত্রিক শহর আমাদের জীবনটাকে তার মতই যন্ত্রের জটিলতায় ভরে রেখেছে। শহর ছেড়ে এরকম প্রকৃতির মাঝে কয়েকটাদিন থেকে এলে এরকম মনে হয় আমার। মানুষের বাস করার জায়গা তার জীবনবোধ এবং আচার আচরণে অনেক প্রভাব রেখে যায়। তাই দেখা যায়, শহর, মফস্বল, গ্রামাঞ্চল, প্রত্যন্তাঞ্চল, দ্বীপ, পাহাড় এই এলাকাগুলোর মানুষের জীবনবোধ এবং আচার আচরণে সুস্পষ্ট বিস্তর ফারাক।
যাই হোক দুপুরের খাবার এবং চা পাণ সেরে লাভার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে জানতে পারলাম লাভা’র রাস্তায় ল্যান্ড স্লাইড হয়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো এখান থেকেই তথ্যটি জানা গেল, নইলে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছে আবার বিপরীত পথে ফিরতি যাত্রা করতে হতো। তো আমরা রওনা হয়ে গেলাম সরাসরি “লোলেগাও” এর উদ্দেশ্যে।
লাভা সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৭,২০০ ফুট (২,১৯৫ মিটার) উচ্চতায় অবস্থিত একটি ছোট্ট জনপদ যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কালিম্পং জেলার আলগড়া হয়ে কালিম্পং শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার (১৯ মাইল) পূর্বে অবস্থিত। শীতকালে পশ্চিমবঙ্গের যে কয়েকটি জায়গায় তুষারপাত হয় তার মধ্যে লাভা অন্যতম। লাভা এই অঞ্চলের অন্যতম জনপ্রিয় একটি পর্যটন কেন্দ্র, এর গা ঘেঁষে রয়েছে নেওড়া জাতীয় উদ্যান। জঙ্গল ট্রেকিং, বার্ড ওয়াচিং, পিকনিক প্রভৃতির জন্য প্রচুর পর্যটক লাভা’ ভ্রমণ করে থাকেন। তো আমাদের যাত্রা আজ লাভা নয়, লোলেগাও। লোকে বলে, বর্ষার সময়টুকু ছাড়া বাকী যে কোন সময় লোলেগাও ভ্রমণের জন্য আদর্শ সময়। আর আমরা কি না গিয়ে হাজির গলাম ঘোর বর্ষায়। শেষ বিকেলে লোলেগাও পৌঁছে আগে থেকে বুক করে রাখা হোমস্টেতে চেক করার সময় বুঝলাম, ছোট্ট একটা গ্রাম, চারিদিকে একটা স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ, ঘোর বর্ষায় যাওয়াতেই বুঝি আরও বেশী চোখে লাগছিলো। চারিদিকে মেঘের দলের রাজত্যের মাঝে পাইনবনে ঘেরা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম, কাছেই একটা উঁচু ভিউ পয়েন্ট হতে অদূরেই দাঁড়িয়ে থাকা কালিম্পং শহর এবং তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি পাহাড় মিলে অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্যপট তৈরী করে। শেষ বিকেলের আলোয় আমরা অপলক তাকিয়ে রইলাম।
কেউ কেউ আশেপাশে ঘুরে দেখলো, কাছেই একটা মন্দির মত ছিলো, দু’তিন জন সেখান থেকে ঢুঁ মেরে এলো।
এরপর পাহাড়ী গ্রামে রাতে আর কিছু করার থাকে না, তার উপর দুপুরে ভাল মত খাওয়া হয় নাই। তাই রাত আটটার আগেই আমরা সেরে নিলাম রাতের খাবার। যে হোমস্টে তে ছিলাম, তার গৃহকর্তী রান্না করেছিলো, সুস্বাদু গরম গরম ভাত রুটি সবজি ডাল খেয়ে নিয়ে যার যার রুমে গেলাম কম্বলের তলায় আশ্রয় নিতে। এরপর হুট করেই ঘুমের কোলে কখন হারালাম মনে নেই
সকালে প্ল্যান ছিল ঘুম থেকে উঠে লোলেগাও সান রাইজ পয়েন্ট থেকে সূর্যোদয় দেখব। কিন্তু ভাগ্যে থাকলে ঠেকায় কে? মেঘলা আকাশে সূর্যি মামার দেখা পেলাম না। কিন্তু যার দেখা পেলাম, সে অতি কাংখিত "কাঞ্চনজংঘা"। ভোরের কাচা সোনা রোদে ঝলমল করে দেখা দিল সেই অপরুপা... আমরা নির্বাক, দিশেহারা! ছবি তুলব নাকি ভিডিও করব? যারা তখনো হোটেলের নরম বিছানায় শায়িত তাদের ডাকব? নাকি শুধু চুপচাপ সেই রূপসূধা পাণ করে যাওয়া উত্তম? ভাবনাগুলো সব গোলমাল হয়ে গেল ক্ষণিকের জন্য....
আমরা দু’তিন জন তখন ছবি তুলছিলাম, হুট করেই চোখে পড়তে সে কি চিৎকার। আরেকজন ছুটে গেল হোমস্টে’তে, বাকীদের ডাক দিতে। কিন্তু বাকীরা আসার আগেই মেঘের চাঁদর ঢেকে দিয়েছে পূব আকাশের পুরোটা।
এরপর নাস্তা শেষে লোলেগাও'কে বিদায় জানাবার পালা। চিরহরিৎ বন আর দিগন্ত রেখায় পাহাড়ের সারি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা "লোলেগাও", পর্যটন নির্ভর একটি ছোট্ট গ্রাম। এখানে আসার পর আপনি বারবার ফিরে আসতে চাইবেন এখানে। যদিওবা এখানকার মূল আকর্ষণ প্রাচীন চিরহরিৎ বন আর সেখানকার ঝুলন্ত ব্রীজ দেখা হল না এবার, বৃষ্টি আর জোকের কারনে। আশা রাখি ভবিষ্যৎ এ কোন একদিন দেখা হবে।
ভ্রমণকালঃ জুলাই ২০১৬
এই ভ্রমণ সিরিজের আগের পর্বগুলোঃ
উদ্ভট যাত্রার আগের গল্প (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০১)
যাত্রা হল শুরু; রক্ষে করো গুরু (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০২)
দার্জিলিং মেইল এর যাত্রা শেষে মিরিকের পথে (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৩)
মিরিকের জলে কায়ার ছায়া (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৪)
কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা টাইগার হিল হতে বাতাসিয়া লুপ (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৫)
ঘুম মনেস্ট্রি হয়ে রক গার্ডেন (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৬)
দার্জিলিং পিস প্যাগোডা ভ্রমণ (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৭)
দার্জিলিং জু (পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুওলজিক্যাল পার্ক) ভ্রমণ - (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৮)
মাউন্টেনিয়ারিং ইনিস্টিটিউট এবং অন্যান্য (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ০৯)
"লামাহাট্টা" হয়ে "রাংগপো" (দার্জিলিং এ বর্ষাযাপন - পর্ব ১০)
এক পোস্টে ভারত ভ্রমণের সকল পোস্টঃ বোকা মানুষের ভারত ভ্রমণ এর গল্পকথা
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০২২ বিকাল ৩:২৬