আগের পর্বঃ বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০১)
বিরিয়ানি’র প্রাণ হলো মশলা, মশলাতেই লুকিয়ে আছে এর স্বাদের রহস্যের প্রায় পুরোটুকু। অন্যান্য মশলাদার খাবারে মশলার হেরফের করে নানান পদ তৈরী হয়। যেমন মাংসের নানান পদ। কিন্তু বিরিয়ানি’তে পারফেক্ট পরিমাণে পারফেক্ট মশলার সংমিশ্রণ না হলে তা বিরিয়ানি’র যে আবেদন তা হারায়। মজার ব্যাপার উপমহাদেশের যে “বিরিয়ানি” নামক ব্যাপক জনপ্রিয় খাবারটি, তা কিন্তু একেবারে মৌলিক খাবার নয়। আমাদের এই উপমহাদেশের মানুষ যে কোন খাবারকে নিজেদের মত করে পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত করে এমন করে আপন করে নেয় যে, এক সময় মনে হয় এটাই মূল খাবার ছিলো। যেমন ভারতের মুম্বাই এবং এর আশেপাশের এলাকার পাওভাজি বা বারাপাও, দুটোই পাউরুটি দিয়ে তৈরী খাবার, আর এই পাউরুটি ভূভারতের আদি কোন খাবার নয়। এটি এসেছে মধ্যপ্রাচ্য এবং তার ওপার থেকে, নানান সময়ে এই ভূখণ্ডে উপনিবেশ স্থাপনকারীদের হাত ধরে। বিশ্বে প্রথম পাউরুটি মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে মিশরে, খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ বা তার কাছাকাছি সময়ে তৈরি করা হয়েছিল। এই ভারতীয় উপমহাদেশে এটির আগমন পর্তুগিজদের হাত ধরে। তারা এখানে এসে নানান স্থানে বাণিজ্য কুঠি তৈরি করে এবং সাধারণ মানুষদের সাথে মিলেমিশে যায় সমাজের নানান স্তরে। পাউরুটি শব্দটাই এসেছে পূর্তগীজ ভাষা থেকে যার শাব্দিক অর্থ ছোট গোল রুটি। অথচ মুম্বাই এবং এর আশেপাশের মানুষের সিগ্নেচার আইটেম হয়ে গেছে এই পাওভাজি বা বারাপাও। একই অবস্থা নুডুলস, চাওমিন, এবং পাস্তার। চাইনিজ'রা ভারতের নুডুলস আর ইতালিয়ানরা ভারতের মাশালা পাস্তা দেখলে জ্ঞান হারাবে নির্ঘাত।
ধান ভানতে শিবের গীত বন্ধ করে যেখানে ছিলাম সেখানে ফিরে আসি। বিরিয়ানিনামা’র প্রথমপর্ব লেখার আগে পরের স্টাডি থেকে বুঝা গেল মূলত মধ্যপ্রাচ্য, এর উত্তরের সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান সংলগ্ন এলাকা আর দক্ষিণে ভূমধ্য সাগর পেড়িয়ে মিশর, সুদান, লিবিয়া প্রমুখ অঞ্চলে পোলাও জাতীয় খাদ্য এবং এর সাথে সিদ্ধ মাংসের খাবার ছিল বিরিয়ানি’র আদি পুরুষ। নানান নামের স্বাদের সেই খাবার এই ভূভারতে এসে নানান মশলা আর প্রাণীজ তেল ঘি এর মিশেলে রূপ নিয়েছে আজকের উপমহাদেশীয় নানান স্বাদের নানান নামের বিরিয়ানি’তে। পাকিস্তানের সিন্ধি বিরিয়ানি হয়ে দিল্লী বিরিয়ানি, লখনৌ বিরিয়ানি ঘুরে হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি হয়ে ঢাকাইয়া বিরিয়ানি… মশলার কারিকুরিতে নানান স্বাদ গন্ধ নামে ভিন্নতা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই বিরিয়ানির বিশাল জগত। মূল সুগন্ধি চাল আর মাংসের সাথে নানান মশলার নানান কৌশলে ব্যবহার এই বৈচিত্রের সম্ভার তৈরী করেছে বিরিয়ানিনামায়।
গত পর্বে বলেছি বিরিয়ানির অন্যতম ব্যবহৃত নানান মশলার মাঝে রয়েছে পেয়াজ, আদা, রসুন, কাঁচা মরিচ, সাদা গোলমরিচ, কালো গোলমরিচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, ছোট এলাচ, বড় এলাচ, কালো এলাচ, আলুবোখারা, শাহী জিরা, গরমমশলা, জায়ফল, জয়ত্রী, কাবাব চিনি, মৌরি, পোস্তদানা, তেজপাতা, জাফরান, কাজু বাদাম, পেস্তা বাদাম, কিসমিস প্রভৃতি। মধ্যপ্রাচ্যে যেখানে মাংস রান্নায় ব্যবহৃত হতো জলপাই, জয়তুন, তিল, বাদাম, সূর্যমুখি এসব উদ্ভিজ তেল, রান্না করা হতো দীর্ঘ সময় আঁচে রেখে; সেখানে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাণীজ তেল, ঘি, মাখন এর ব্যবহার বিরিয়ানির মাংসের স্বাদে এনেছে বৈচিত্র এবং অতিরিক্ত স্বাদ। এর সাথে নানান পদের মশলা যা সেই আদি কাল হতেই ভারত হতে সুমাত্রা, এই অঞ্চলব্যাপী ব্যাপক ফলন ছিল, যুক্ত হয়ে বিরিয়ানি’কে দিয়েছে সর্বোচ্চ স্বাদ, গন্ধ আর নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।
পশ্চিমে মাংস বা বিরিয়ানি’র আদি ভার্সন রান্নায় যেখানে প্রাধান্য ছিলো জাফরান, বাদাম, কিসমিস, ড্রাইফ্রুট এর, সেখানে এই অঞ্চলে এসে আদা-রসুন-দারুচিনি-এলাচ দখল করে মূল আসন। দক্ষিণে স্বরে গিয়ে যোগ হয়ে জিরা, গোলমরিচ, লবঙ্গ’র ব্যবহার, তেমনি পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বিবর্তিত হওয়ার সময় বিরিয়ানি রান্নায় যোগ হয়েছে মৌরি, পোস্তদানা, তেজপাতা এসবের ব্যবহার। আবার ঢাকায় মুঘলদের সরাইখানায় ঢুঁকে ফের যোগ হয়েছে আলুবোখারা, কাজুবাদাম, কিসমিস এগুলো। আর এই সব মশলার সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়ে গড়ে উঠেছে যে বিরিয়ানি, তা হলো কাচ্চি বিরিয়ানি। বিরিয়ানিনামায় মনে হয় যত পদের মশলা আছে তার কোনটাই বাদ যায় না এই রান্নায়। আমি বাসায় একবার কাচ্চি বিরিয়ানির জনা ত্রিশের আয়োজন করার বাজার করতে গিয়ে দেখি চাল মাংসের বাজেটের চাইতে তেল মশলার বাজেটই বেশী এই কাচ্চি বিরিয়ানি রান্নায়। এমন অনেক মশলার নাম জেনেছি তখন আগে যা কখনোই শুনি নাই।
লক্ষ্য করলে দেখবেন বিরিয়ানি রান্নায় ইরানের দিকে যে মূল মশলা জাফরান, তার সাথে জয়ত্রী, কিসমিস, বাদাম, এসবের ব্যবহার আমাদের এই বাংলা এবং এর আশে পাশে খুব কম। কারণ, এখানে এই মশলাগুলোর উৎপাদন ছিলো খুবই সীমিত এবং এগুলোর মূল্য অধিক চড়া। মধ্যপ্রাচ্যের বিরিয়ানিতে ভাঁজা পেঁয়াজ, ভাঁজা আলু, বাদাম, কিসমিস এসবের ব্যবহার এর সাথে মশলার ব্যবহার একেবারেই নগণ্য, সেখানে এই উপমহাদেশীয় বিরিয়ানির মূল কারিগরই হল মশলা, মাংস বা সুগন্ধি চাল এখানে গৌণ হয়ে দাঁড়ায়। দই, দুধ এসবের ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান হয়ে হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানিতে ব্যাপক পরিমাণে। বাংলার বিরিয়ানি রান্নায় অনেকেই দুই, দুধ ব্যবহার করেলও তা অনেকটা ঐচ্ছিক, আবশ্যিক নয়।
বিরিয়ানি কলকাতা হয়ে ঢাকা পাড়ি দিয়ে সিলেট-চট্টগ্রাম অঞ্চলে গিয়ে চরম বিবর্তিত আরেক রূপ আখনি পোলাও। যেখানে মাংস ছোট টুকরো করে ধুয়ে আদা, রসুন, জিরা, টক দই, বাদাম বাটা, পেঁয়াজ, লবণ, গরম মসলা, তেজপাতা ও তেল দিয়ে কষিয়ে নিয়ে সুগন্ধী চাল তেলে ভেজে তাতে এই কষানো মাংস আলু, গাজর, মটরশুঁটি, আলুবোখারা, কাঁচামরিচ দিয়ে নেড়ে-চেড়ে পরিমাণমতো গরম পানি দিয়ে চাল আধাসেদ্ধ করা হয়। এরপর পানি শুকিয়ে এলে পাত্রের নিচে পুরোনো তাওয়া দিয়ে দমে রেখে চাল সেদ্ধ হয়ে ঝরঝরে হলে তাতে কেওড়া জলে গোলানো দুধ দিয়ে মিনিট পাঁচেক চুলায় রেখে রান্না সম্পূর্ণ করা হয়।
তো সব কথার উপর যে কথা মুখ্য, তা হলো আমাদের জনপ্রিয় যে খাবার বিরিয়ানি, তা কোন আদি বা মূল খাবার না হলেও নানান মশলার মিশেলে সংকরায়িত হয়ে সারা বিশ্ব দরবারের খাদ্য রসিকদের কাছে আলাদা কদর অর্জন করে নিয়েছে মূলত এই মশলার কল্যাণেই। মশলাই এই সংকরজাত খাবারকে এনে দিয়েছে মৌলিকত্বের স্বীকৃতি। আজ বিরিয়ানি নিজে নিজের নামে পরিচিত, যার মূল অলংকার হরেক স্বাদের, হরেক ঝাঁঝের, বৈচিত্রে ঠাসা নানান পদের মশলা। তাই বিরিয়ানি এমন এক খাবার যাকে বলা যায়, মাশালাজাদে মাশালাদার… অপূর্ব এক খাবার।
গত পর্বে বলেছিলাম, বিরিয়ানিনামা’র আগামী পর্বে থাকবে পুরাতন ঢাকার এমন কিছু বিরিয়ানি দোকানের বিশেষ বিরিয়ানির কথন, যা আপনার “Must Taste” লিস্টে থাকবে। হুট করেই এই সিরিজকে দীর্ঘায়ু প্রদান করতে মন চাইলো। তাই আজ বিরিয়ানির মশলা নিয়ে বিরিয়ানিনামা লেখা হলো, আগামী পর্বে থাকবে বিরিয়ানির ধরণ প্রকৃতি নিয়ে বিরিয়ানি কাহন। তারপর… আরো অনেক কিছু লিখিত হবে এই বিরিয়ানিনামায়। আর তাই, সাথেই থাকুন বিরিয়ানিনামা সিরিজের।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০২২ দুপুর ১:৪৫