সৃষ্টির সেই আদিকাল থেকেই মানুষের মাঝে পশু প্রবৃত্তির বসবাস, এটা একবাক্যে স্বীকার করতেই হবে। আপনি ধর্ম অনুসারী হন আর বিবর্তনবাদী হন না কেন। তাইতো যুগে যুগে সমাজ ব্যবস্থার কঠিন প্রলেপ দিয়ে মানুষ সেই পশুত্বকে দমন করার চেষ্টা করে এসেছে যুগে যুগে। কিন্তু সেই পশুত্ব রূপ সর্বদা তার স্বরূপ দেখিয়েছে, চিনিয়েছে মানুষের অন্ধকার চরিত্রগুলোকে। সম্প্রতি রাজিন হত্যা, সেই পশুত্বের চরম বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। কি বর্বর, কি অমানবিক, কি নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড! এর জন্য আপনি কাকে দায়ী করবেন? অপরাধীদের নাকি আমাদের সমাজব্যবস্থাকে? আমার বিবেচনায় কিছু কথা বলার জন্যই এই পোস্ট। আর রাজিনের জন্য বলব, Rajon, we are sorry. we could not give you protection, we fail to secure you and save your life. Please excuse us...
মানবিকতাঃ প্রথমেই বলব মানবিকতা আজ সমাজ থেকে উঠে যাচ্ছে, নইলে এমন ঘটনা ঘটানো আদৌ কি সম্ভব হত? কোন বিন্দুমাত্র মানবিকতা থাকলে এরকম বর্বর ঘটনা ঘটানো কি সম্ভব? উত্তরে বলবেন নিশ্চয়ই না। কিন্তু এমনটা ঘটছে প্রতিনিয়ত। কারণ আমাদের মধ্যে থেকে মানবিকতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, বন্দী হয়ে যাচ্ছে সামাজিক মিডিয়ার বাক্সে। কারণ, হিসেবে আমি মনে করি যান্ত্রিক জীবন ব্যবস্থা আমাদের মানবিক সত্ত্বাকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করে দিচ্ছে। নাহলে চিন্তা করুন, একটি বাজার এলাকার গ্যারেজে দীর্ঘ সময় ধরে ১৩ বছরের শিশুটিকে পেটানো হল, কেউ কি তখন দেখে নাই? তাদের মাঝে মানবিকতাবোধ প্রবল হলে নিশ্চয়ই এসে বাঁধা দিত, যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন আসামীরা। প্রথম কারণ হিসেবে আমি মনে করি আমাদের মানবিকতার ক্রমহ্রাস পাওয়াকে।
মানসিকতাঃ দ্বিতীয়ত আমি মনে করি আমাদের মানসিকতায় সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে যা খুব চিন্তার বিষয়। আজ আমাদের মানসিকতা হল নিজে বাঁচলে বাপের নাম টাইপের। যতটুকু পারা যায় নিজেকে বাঁচিয়ে চলা। এই মানসিকতা অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের সমাজে। আজ থেকে দশ বিশ বছর আগেও এই মানসিকতা ছিল না। একটি পাড়াতে অচেনা কোন ছেলেকে দেখা গেলে সবাই জিজ্ঞাসা করত কি পরিচয়? সেখানে কি চায়? কেন এসেছে? প্রভৃতি। কিন্তু, আজকের দিনে আমার পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে তাই আমি জানি না। মানসিকতার এই পরিবর্তনের কারনেই কিন্তু হাজারো মানুষের ভিড়ে রমনা বটমূলে এমন কাজ করে আসামীরা চলে যেতে পারে। পারে রাজনকে দীর্ঘ সময় ধরে পিটিয়ে সেই দৃশ্য ভিডিও করতে, কারণ আশেপাশের সবাই তখন কালো চশমা পরিহিত ছিল।
মূল্যবোধঃ মূল্যবোধ অনেক উচ্চমার্গের বিষয়। আমাদের মূল্যবোধ একেবারে শিশু বয়সেই খুন হয়ে যায়। কারণ, আমাদের পরিবার, সমাজ থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যাবস্থা সকল জায়গায় মূল্যবোধের শিক্ষাটা কতটুকু হয়? বর্তমানে আমাদের শেখানো হয় জিপিএ ফাইভের লড়াইয়ে কিভাবে টিকে থাকতে হবে, কিন্তু শেখানো হয় না মনুষ্যত্ব বলতে প্রকৃত অর্থে কি বোধ হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। ন্যায় অন্যায়ের ফারাক শেখানো হয় না, হয় যে কোন উপায়ে সাফল্য পাওয়ার উপায়। মূল্যবোধের এই অভাবের কারনেই আমরা প্রতিনিয়ত নিজের ভেতর এক ভয়ংকর পশুত্বকে ধারণ করছি। আর সময় সুযোগ পেলেই সেই পশু হামলে পড়ে রাজনদের উপর।
সুশাসনের অভাবঃ এই কারণটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, কয়েকবছর আগে ঢাকার গাবতলীর আমিনবাজার এলাকায় বেড়ীবাঁধ সংলগ্ন স্থানে ছয় যুবককে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা। প্রতিনিয়ত এমন খবর আমরা কিন্তু দেখতে পাই, টিভিতে নিউজ চ্যানেলের স্ক্রলে, পত্রিকার পাতায়, অনলাইন নিউজ পোর্টালে। এসবের কারণ কি? কারণ আমাদের শাসন ব্যবস্থার উপর আস্থাহীনতা। আমরা বিশ্বাস করি, অপরাধীকে আইনের হাতে তুলে দিলে সে সাজাপ্রাপ্ত হবে না। তাইতো সামান্য জুতাচোর থেকে শুরু করে ডাকাত, একবার হাতের কাছে পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ি উত্তম মধ্যম দিতে। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের শাসন ব্যবস্থা আমাদের আস্থা অর্জন করতে পারছে না, এমন ঘটনা কিন্তু বাড়বেই। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, রাজন আসলেই গাড়ী চুরি করতে এসেছিল। কিন্তু শাসন ব্যবস্থার প্রতি যদি আস্থা থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হত।
সমাজ ব্যবস্থাঃ আজকের সমাজ ব্যবস্থায় শুধু নয়, অতি প্রাচীনকাল থেকেই ক্ষমতাধরদের সমাজ ব্যবস্থায় আধিপত্য কায়েম করতে দেখা গেছে। আজও তাই অব্যাহত আছে, ভবিষ্যতেও হয়ত থাকবে। রাজনের ঘটনার পর এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে আসামীপক্ষের লোকগুলো এলাকায় প্রভাবশালী ছিল, তাই হয়ত কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে নাই। সমাজ ব্যবস্থায় যে পর্যন্ত সাম্যাবস্থা আনা সম্ভব হবে না, ততদিন ক্ষমতাশালীদের দ্বারা দুর্বলেরা অত্যাচারিত হয়েই যাবে। এটাই বাস্তবতা।
সামাজিক কাঠামোঃ আজকের সামাজিক কাঠামো কিন্তু অপরাধ প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে দিন দিন। যৌথ পরিবার ব্যবস্থাগুলো ভেঙ্গে গিয়ে আজ ব্যক্তিকেন্দ্রিক এক সমাজে আমরা বাস করছি। আর সামাজিক কাঠামোর এই পরিবর্তন কিন্তু অপরাধপ্রবণতাকে দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমার পাশের ঘরে আমার ছোট ভাই দরজা বন্ধ করে কোন ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে আমি নিজেও হয়ত জানি না। তাই সামাজিক কাঠামোর এই পরিবর্তন অনেকাংশে দায়ী এইসব ঘটনাগুলোর জন্য।
জীবনযাত্রার পরিবর্তনঃ আজকের জীবনযাত্রায় ভোগ এবং বিলাস লক্ষ্য হিসেবে ধরা দিচ্ছে যা পাশ্চাত্য থেকে আমাদের সমাজে ঢুঁকে পড়েছে। জীবনের লক্ষ্য কি? একটা সুন্দর সংসার, দুই হাজার স্কয়ার ফিটের একটা ফ্ল্যাট, দামী কোন গাড়ী, এই তো আর কি চাই? ফলে উপরে বলা মূল্যবোধ, মানসিকতা আর মানবিকতার উন্মেষ ঘটার সুযোগ কোথায়? তাইতো একের পর এক ঘটনা ঘটে যায়, আমরা গলাবাজি করে দিন শেষে ফিরে যাই নিজের সুখের সংসারে। আগে দেখেছি পাশের ঘরের বউটিকে রাগী স্বামী মারধর করলে মা’খালারা সেই স্বামীর সাথে গিয়ে ঝগড়া করছে, স্বামীর কাছ থেকে বউটিকে সরিয়ে নিয়ে এসে কয়েকদিন নিজেদের ঘরে রেখে দিচ্ছে স্বামীকে সায়েস্তা করতে। আর আজকের জীবনযাত্রার সেই পরিবর্তনের কারণে পাশের ফ্ল্যাটে স্ত্রীকে খুন করে রেখে দেয় স্বামী, লাশের দুর্গন্ধ না বের হওয়া পর্যন্ত কেউ টের পায় না।
স্বার্থপরতাঃ স্বার্থপরতা আজ সমাজের বিশাল ভয়াবহ ব্যাধি। নিজের স্বার্থের জন্য মানুষ নিত্য নিজেকে কতটা নীচে নামিয়ে আনতে পারে তা বর্তমানের বিভিন্ন অপরাধের খবর শুনলেই দেখতে পাওয়া যায়। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ স্বার্থ, হাসিল করার জন্য নির্বিকারে হত্যার মত ঘটনার সংখ্যা সমাজে বেড়ে গেছে। কারণ, সমাজ আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে স্বার্থপরতা, তাই নয় কি? স্বার্থপর হয়ে যাওয়া মানুষের বিবেক কতটুকু বেঁচে থাকে? আর মৃত বিবেকহীন মানুষেরা রাজনদের পিটিয়ে মারতে উল্লাসিত হবে এটাই স্বাভাবিক।
দৃষ্টিভঙ্গিঃ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অতিদ্রুত বদলে গেছে, যে কোন কিছুতে সন্দেহপ্রবণতা বা অবিশ্বাস আজ দানা বেঁধেছে। আমরা আজ সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো হিসেবে দেখতে চাই না, সাদা কালো মিশিয়ে ঘোলাটে ধুসর একটা রূপ খুঁজতে থাকি। দৃঢ়চিত্তে ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলতে আজ আমরা দ্বিধাবোধ করি। তাইতো ধর্ষণের পর খুঁজে দেখা হয় নারীটির চলন-বলন-পোশাক কেমন ছিল?
প্রযুক্তির অপব্যবহারঃ চিন্তা করুন, একটি ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলে সেটা ভিডিও করা হয় এবং সামাজিক মিডিয়ায় সেটা পোস্ট করে প্রচার করা হয়। কিছুদিন আগে একটা ভিডিও দেখলাম কতগুলো হরিণকে খাঁচার মাঝে আটকে রেখে একজন বয়স্ক লোক গুলি করে মেরে জবাই করে হাসি মুখে ভিডিওতে পোজ দিচ্ছেন। নিজের স্ত্রীর সাথের একান্ত সময়ের ভিডিও করে বিকৃত সুখ লাভ করছেন আজ ভদ্র সমাজের মুখোশধারী মানুষেরা। রুচির কি কুৎসিত বিকৃতি!! এগুলো সবই প্রযুক্তির অপব্যবহারের কুফল। প্রযুক্তির সাথে শুধু কল্যাণই আমাদের সমাজে প্রবেশ করে নাই, তারচেয়ে অনেক বেশী বোধহয় অকল্যাণকর বিষয় ঢুঁকে পড়েছে। তাইতো আজ গুগলে ‘মা’ লিখে সার্চ দিতে ভয় পেতে হয়।
এতোকথা বলার একটি কারণ, রাজন হত্যাকে পৃথক কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখলে হবে না। এটি আমাদের সমাজের গভীরে প্রোথিত এক বিষের প্রতিক্রিয়া। বহু আগে হতেই এই বিষ ধীরে ধীরে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে, তা যে কারনেই হোক না কেন। তাই সময় এসেছে, ভেবে দেখার, নিজেকে বদলানোর। শুধু দুঃখ প্রকাশ আর অনলাইনে অফলাইনে প্রতিবাদের ঝড় তুললেই হবে না। যেতে হবে আরও গভীরে, অন্বেষণ করতে হবে মূল কারণগুলো। আর সেই কারণগুলো যে পর্যন্ত চিহ্নিত করে সমুলে উৎপাটন করা যাবে না, সে পর্যন্ত এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে। কখনো রাজনের হত্যার রূপে, কখনো বিকাশের হত্যার রূপে, কখনো কোন গৃহবধূর লাশের মাঝে
আর অতি অবশ্যই, হত্যায় প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ'ভাবে জড়িত সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, যাতে করে অপরাধ করার আগে দুবার ভাববে যে কোন অপরাধী।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ৩:০৩