গতবছর ঈদেই তো, মনে আছে সবার নিশ্চয়ই? মোবাইল ফোন কোম্পানি রবি সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের ঈদের জামা দেয়ার একটা কর্মসূচী দিল। যেখানে মোবাইল গ্রাহকদের টাকা পাঠানোর আহবান করা হল। তারপরের কথাতো সবারই জানা আছে তাই না? লালরঙ্গা নিজেদের লোগো সম্বলিত ফতুয়া টাইপের জামা বিশ হাজার সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হল। গ্রাহকের টাকায় কোম্পানির মার্কেটিং করার কি সুচতুর বুদ্ধি। আসলেই এটাই হচ্ছে তথাকথিত সিএসআর (কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি)। ঠিক একই কাজ এবার শুরু করেছে মোবাইল কোম্পানি গ্রামীণ ফোন। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের হাতে পৌঁছে দিতে চাচ্ছে মোবাইল ফোন! আপনি আপনার পুরানো বা অব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি তাদের কাছে পাঠিয়ে দিবেন, তার বদলে তারা সেই ফোনে তাদের সিম ভরে একটি প্যাকেজ বিনে পয়সায় দিয়ে সুন্দর মোড়কে মুড়িয়ে (যেখানে বড় বড় করে হাইলাইটেড হবে তাদের নাম এবং লোগো) পৌঁছে দেবে সেইসব মানুষের হাতে যারা মোবাইল সুবিধা হতে বঞ্চিত। হাসি ফুটবে তাদের মুখে, তার সাথে গ্রামীণ ফোনের মুখেও কিন্তু। কিভাবে? প্রথমত তারা ফোনটা সুবিধাবঞ্চিতদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে, এটা নিয়ে বিশাল মার্কেটিং শুরু করে দিয়েছে, পরেও করবে। আর তাদের প্যাকেজ শেষে সেই মোবাইল প্রাপ্ত মানুষগুলো কিন্তু তাদের গ্রাহক হিসেবে থেকে যাবে, সেখান থেকে তাদের রেভেনিউ কি কিয়দংশ হলেও গ্রো করবে না?
আসলে বর্তমান সময়টাই হল শো অফ। কিন্তু কষ্ট হয় এই শো অফ করতে গিয়ে যখন অসহায় সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের দেদারসে ব্যবহার করা হয়। পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খেয়ে বাঙালী হওয়ার মত রমজান আর ঈদ আসলে শুরু হয়ে যায় সুবিধা বঞ্চিতদের নিয়ে ইফতার, আর ঈদের জামা প্রদানের হিড়িক। সারা বছর এই মানুষগুলোর কোন খোঁজ কয়জন নেই? এদের ভাগ্য উন্নয়েনের নিমিত্তে কতটুকু কতজন ভেবেছে? সেদিন দেখলাম এক ফেসবুক সেলিব্রেটি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ইফতার করাচ্ছেন, যাদের বয়স ৫-৭ বছর সর্বোচ্চ দশ বছর। আচ্ছা এই বয়সের শিশুরা কয়জন রোজা রাখে? একজন যুক্তি দিলেন একবেলাতো ভালো খাবার খাচ্ছে তারা। আমার কথা হল ঠিক আছে, ভালো কাজ; তো ফলাও করে অনলাইনে ছবি তুলে প্রচার কেন? উত্তরে যা পেলাম, আরও সবাই উৎসাহিত হবে। আচ্ছা উৎসাহ দেয়াই যদি লক্ষ্য হয়ে থাকে তবে সেইসব শিশুদের সাথে নিজের ছবি তোলা কেন? তাদের আহারের ছবি তুলে বললেই তো হত আসুন এভাবে অসহায় শিশুদের মুখে একবেলা আহার তুলে দেই।
আসলে এসব হচ্ছে নিজেদের প্রবঞ্চনা দেয়া, আমি খুব ভালো কাজ করছি। আসলে এগুলোর পেছনে কাজ করে নিজস্ব আত্মতৃপ্তি আর প্রচারণা। আপনি যদি ইসলাম ধর্ম অনুসারী হয়ে থাকেন, তবে জেনে রাখুন, ইসলামে বলা আছে যে, দান এমনভাবে কর যেন ডান হাত দান করলে বাম হাত টের না পায়।
ঈদ আর শীত, এইদুটো হল বর্তমানে মানবদরদী হওয়ার পিক সিজন। কিন্তু আপনি আমি যদি একটি শিশুর সারা বছরের শিক্ষার দায়িত্ব নেই তবে শিশুটির ভাগ্য স্থায়ীভাবে বদলে যেতে পারে। একবেলার ভরপেট দামী খাবার হজম হওয়ার পর কিন্তু নর্দমাতেই মিশে যাবে। আপনি বলতে পারেন কোন শিশুকে সাহায্য করবেন, কিভাবে করবেন আরও অনেক প্রশ্ন আপনার থাকতে পারে। কিন্তু একটু সচেষ্ট হলে কি সম্ভব নয়। ধরুন, আপনি যে স্কুলে পড়ালেখা করেছেন সেই স্কুলের হেডমাস্টারকে গিয়ে বললেন, স্যার কোন ছেলে/মেয়ে যদি খুব দরিদ্র থাকে যে টাকার অভাবে পড়ালেখা চালাতে পারছে না, তাহলে তাকে আমি প্রতিমাসে একটা নির্দিষ্ট টাকা বৃত্তি দিব। দেখবেন আপনার খুঁজতে হচ্ছে না, আপনাকেই সাহায্যপ্রার্থী খুঁজে নিবে। তাই বলে আবার, ঐ কিছু যাকাতদাতাদের মত হয়ে যাবেন না, যারা যাকাত দেয়ার সময় পদপিষ্ট হয়ে মানুষ মারা যায়।
সবশেষে বলি, কর্পোরেট দালালদের এসব মানবতার বয়ানে কান না দিয়ে, আপনার আশেপাশে চোখ বুলালে নিজের পরিমণ্ডলে অনেক অভাবী মানুষ পাবেন। সে হয়ত আপনার কোন নিকট অথবা দূরের আত্মীয়, প্রতিবেশী, কর্মচারী, বন্ধু অথবা অপরিচিত কেউ, সহকর্মী, গ্রামের কোন লোক; একটু খুঁজে দেখুন অনেক অনেক মানুষ খুঁজে পাবেন যারা এতোটুকু সাহায্য প্রাপ্তির জন্য মুখিয়ে আছে, কিন্তু কাউকে বলতে পারছে না কিছুটা আত্মসম্মান বোধে, কিছুটা লজ্জায়। তাদের খুঁজে, একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন তাদের দিকে, যেন তাদের আত্মসম্মানবোধে এতোটুকু আঁচড় না লাগে। তাই শিরোনামের কথাটা আবার বলি, কর্পোরেট মানবতায় না ঝাঁপিয়ে খুঁজে ফিরুন আশেপাশের মানুষের জন্য মানবতা। দেখবেন সেইটাই হবে সবচেয়ে কার্যকর এবং সবচেয়ে আনন্দের।