মহররমের প্রথম তারিখ হতে পুরাতন ঢাকার নারিন্দা হতে শুরু করে বংশাল, চকবাজার, লালবাগ হয়ে মোহাম্মদপুর, অর্থাৎ বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে ঢাকার যে আদি জনপদ সেই অঞ্চলব্যাপী শুরু হয়ে যায় ঢোলের উপর লাগাতার বাড়ি দিয়ে সুর তুলে ছেলে-ছোকড়ার দলের মিছিল করা এবং মহররমের শিন্নী’র জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তোলা। আমার জীবদ্দশায় কমপক্ষে তিনযুগ ধরে আমি এই ঘটনা দেখে আসছি। ভরদুপুর অথবা সন্ধ্যার অলস লগ্নে হঠাৎ এই বাদ্যের শব্দ আসলেই খুব বিরক্তিকর। মজার ব্যাপার এই ঘটনা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ঐতিহ্য হিসেবে বয়ে চলেছে। তবে ঢাকা শহরের মূল আশুরার কেন্দ্রস্থল “হোসাইনি দালান” এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট শিয়া সম্প্রদায়ের এইসবের সাথে কোন যোগসূত্র নেই বলেই জানি। তবে এতটুকু পড়ে কেউ আমায় ভুল বুঝবেন না, আমার আজকের লেখা কোন ধর্মীয় আঙ্গিকে নয়; পুরাতন ঢাকার শতবর্ষ পুরনো এই ঐতিহ্যবাহী আশুরার “তাযীয়া মিছিল” এর ইতিহাস খোঁজ করাই মুখ্য উদ্দেশ্য। বলতে পারেন পুরাতন ঢাকার ইতিহাসের খোঁজের একটি অধ্যায় এই লেখাটি।
আসুন প্রথমে শুনি আশুরার উৎসবকে কেন্দ্র করে চলমান প্রচলিত এবং অধুনা লুপ্ত কিছু প্রথা’র কথা। মহররমের চাঁদ দেখা গেলেই শুরু হয়ে যায় আশুরার উৎসব। মহররম মাসের এক তারিখ আরবি ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন, এই দিন এবং এই মাসের অত্যন্ত তাৎপর্য এবং মর্যাদা রয়েছে পবিত্র ইসলাম ধর্মে। কিন্তু সেই কথায় না গিয়ে প্রসঙ্গে থাকা যাক। কোন মতবাদের পক্ষে বা বিপক্ষে লেখা আমার উদ্দেশ্য নয় একথা আগেই বলেছি। আল্লাহর অনুসরণের সঙ্গে মুহাম্মদ (স.)-আলী-ফাতেমা-হাসান ও হোসাইন (রা.) স্মরণের মাধ্যমে বিশ্বের শিয়া সম্প্রদায় মহররম মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিন ব্যাপী পবিত্র আশুরা পালন করে থাকেন। বাংলাদেশের শিয়া মুসলিমগণও সেই ধারাবাহিকতায় পহেলা মহররম থেকে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠান, তাজিয়া মিছিল, শোকসভা, শোক মজলিস, মর্সিয়া মাতম ও ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে পালন করেন এই শোকৎসব। প্রচলিত কিছু রীতি বা আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিলঃ মহররম মাসের শুরুতে সন্তানের মঙ্গলের জন্য বাবা-মা মানত করে সন্তানকে প্রতীকী এক বিশেষ রূপ দিতো/দেয় যাদের এই প্রতীকী অবস্থার নাম 'বেহেস্তা'। বেহেস্তারা মহররম মাসের এক তারিখ থেকে দশ তারিখ পর্যন্ত মাছ খায় না। লালসালু কোমরে পেঁচিয়ে জরি-বাদলার ফুলের সাদা-লাল-কালো রঙের সুতার বিশেষ সাজ লালসালুর চারদিকে এবং শরীরের উপরের অংশে পেঁচিয়ে হাতে লম্বাটে ত্রিকোণ লাল-সবুজ জরি লাগানো পতাকা হাতে মহররমের মিছিলে এবং নানা কর্মকাণ্ডে তারা অংশ নিতো/নেয়।
আশুরা পালনের মুখ্য অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ৬ মহররমের তাজিয়া মিছিল ও সব আমল যা বিবি জয়নবের পুত্র আউন ও মুহাম্মদের স্মরণে পালন করেছেন। তাছাড়া ৭ মহররম রাত ১০টায় বিশেষ করে ইমাম হাসানের পুত্র কাসেম ও ইমাম হোসাইনের মেয়ে ফাতেমা কুবরার সঙ্গে যে বিয়ে হয়েছিল, ঐ দিনকে স্মরণে মেহেদী অনুষ্ঠান পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে মেহেদী, ফুল-ফল, শিরনি ও মিষ্টি নিয়ে সকলে হাজির হয়। আর তাই ৭ মহররমকে কাসেমের দিবসও বলা হয়। ৮ মহররম দুপুরবেলা ইমামবাড়ায় জিঞ্জির মাতম বা ছুরি মাতম অনুষ্ঠিত হয়। আর মিছিলের মধ্যে ৮ মহররম মাগরিবের পর (যা সন্ধ্যা রাতের মিছিল নামে পুরাতন ঢাকায় সুপরিচিত) ও ৯ মহররম রাত ২টায় (যা ভোর রাতের মিছিল নামে পুরাতন ঢাকায় সুপরিচিত) হোসেনী দালান থেকে বিরাট শাহি মিছিল বের হয়। এ মিছিলে সম্মুখভাগে দুই কাতার করে ঝান্ডাবাহী ভিস্তি (মশক সরবরাহকারী) থাকে। আর এই মিছিলে স্থানীয় বিভিন্ন এলাকার দল লাঠিখেলা, তলোয়ার খেলাসহ নানা রকমারি যুদ্ধের খেলা প্রদর্শন করতো সড়কের মোড়ে মোড়ে যা এখন প্রায় দেখাই যায় না। স্থানীয় ভাষায় এসব দলকে 'আখাড়া' বলা হতো। সব শেষ এবং প্রধান মিছিলটি হয় ১০ মহররম, আশুরার দিনে এবং সেই মিছিল শেষে তাজিয়া বিসর্জন হতো কারবালার ঝিলে (পুরানা পল্টন লাইনের কাছে), সে ঝিল এখন আর নেই। মহররমের আশুরাকে ঘিরে বসতো মহররমের মেলা। আমার বাসার আশেপাশে এই মেলা বসতো আজিমপুর ছাপরা মসজিদের পেছনের মাঠে (লিটল এঞ্জেলস স্কুলের সামনের মাঠ জুড়ে) যা এখন ইতিহাস।
আশুরার করুন ইতিহাস মোটামুটি সবারই জানা। ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে পৃথিবীর নির্মমতম ঘটনার অবতারণা হয়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেন (রা.) মাত্র ৭২ জন সহযোগী নিয়ে এজিদের বিশাল বাহিনীর সঙ্গে জিহাদ করে শহীদ হন। তার আগে এজিদ বাহিনীর ঘাতকরা একে একে হত্যা করে ইমাম হোসেন (রা.)-এর স্ত্রী, পুত্র ও সকল নিকটাত্মীয়কে। মুসলিম জাহানের তৎকালীন স্বঘোষিত খলিফা ইয়াজিদ দায়িত্ব তুলে দেয়ার কথা বলে কুফা নগরীতে আমন্ত্রণ জানায় হযরত ইমাম হোসেন (রা.)-কে। পথে কারবালা প্রান্তরে অবরুদ্ধ করা হয় তাদের। তৃষ্ণার্ত ইমাম হোসেন (রা.)-কে ফোরাত নদীর পানি পর্যন্ত পান করতে দেয়া হয়নি। তার সব সঙ্গী ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শহীদ হওয়ার পর নির্মম সীমারের হাতে শহীদ হন ইমাম হোসেন (রা.)। এজিদ ঘোষিত পুরস্কারের লোভে সীমার এ বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
ভারত বর্ষের উত্তর প্রদেশে তৈমুর লং নামে এক বাদশা ৬০০ বছর আগে তাজিয়া মিছিল শুরু করেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল ইতিহাসকে জানানো এবং অমুসলিমকে মুসলিমে রূপান্তর করা। ধারনা করা হয় এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও শুরু হয় তাজিয়া মিছিল। ঠিক কবে থেকে মহররম উৎসব ঢাকায় পালিত হয়, তা সঠিক জানা না গেলেও ঢাকায় বেশকিছু পুরনো ইমামবাড়ার সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রথম ইমামবাড়াটি ছিল ফরাশগঞ্জে। বর্তমানে যে হোসনি দালানটি আমাদের পরিচিত তা ১৬০০ শতকে মীর মুরাদ নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। মীর মুরাদ সুলতান মোহাম্মদ আজমের সময় নওয়াব মহলের দারোগা ও অট্টালিকাগুলোর তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। ইমারতটি হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর পৌত্র হোসেন (রা.) এর কারবালার প্রান্তরে শাহাদাতবরণের স্মরণে নির্মিত। এর পোশাকি নাম ইমামবাড়া হলেও হোসনি দালান নামেই এটি সর্বাধিক পরিচিত। শিয়া সম্প্রদায়ের মহররম উদযাপনের কেন্দ্র বলা যায় একে। কারও মতে শিয়া সম্প্রদায়ের নবাব নসরত জঙ্গ ১৮০০ শতকে সুরম্য এ ভবনটি নির্মাণ করেন। ১৮২৩ সালে মৃত্যুর পর এখানেই সমাহিত করা হয় তাকে। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে হোসনি দালানের বড় অংশই ধ্বংস হয়ে যায়। পরে নওয়াব স্যার আহসানুল্লাহ ৯৯ হাজার টাকা ব্যয়ে এটি পুনর্নির্মাণ করেন। পিতলের তৈরি পুরনো হোসনি দালানের মডেলটি জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। হোসনি দালান প্রাঙ্গণে অনেক অভিজাত শিয়ার কবর রয়েছে।
হোসেনী দালান ইমামবাড়া ছাড়াও ঢাকা শহরে শিয়া মসজিদ ইমামবাড়া, মিরপুর কারবালা ইমামবাড়া, মগবাজার বেলালবাগ ইমামবাড়া, পল্টন খোজাশিয়া ইমামবাড়া, বড় কাটরা নবাব শায়েস্তা খাঁ ইমামবাড়াসহ বেশ কয়েকটি ইমামবাড়া রয়েছে। এছাড়া ইরান কালচারাল সেন্টারেও পহেলা মহররম থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা হতে ৯টা পর্যন্ত শোক মজলিস ও মর্সিয়া পাঠ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার বাইরে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম, মানিকগঞ্জের গড়পাড়া, নীলফামারীর সৈয়দপুর, কুষ্টিয়া, পাবনার ঈশ্বরদী, খুলনার খালিশপুরসহ আরও অনেক জায়গায় মহররমের তাযীয়া মিছিল এবং মেলার আয়োজন হয়ে থাকে।
সবশেষে শিরোনামের প্রসঙ্গে একান্ত ব্যাক্তিগত কিছু কথা বলি। ইসলামের শুধু নয়, মানব ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে আশুরা, তাঁর শোক প্রকাশ করতে গিয়ে সময়ের পরিক্রমায় একসময় এটা উৎসবে পরিণত হয়েছে। একসময় মহররমের তাযীয়া মিছিলে ধারালো অস্ত্রের প্রকাশ্য প্রদর্শনী হত এবং শত্রুতা বশে প্রতিপক্ষকে আঘাত, যার ফলশ্রুতিতে আহত, নিহত পর্যন্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। গত রোববার প্রিন্ট মিডিয়াতে এসেছে তাযীয়া মিছিলে এক যুবকের কব্জি কেটে ফেলেছে প্রতিপক্ষ... কত নির্মম!!! এরকম ঘটনা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, ভাগ্য ভালো... কখনো প্রতক্ষ্য করতে হয় নাই। তাই সবশেষে একটা কথা বলি যে কোন শোকানুষ্ঠানই কখনো যেন উৎসবে পরিণত না হয়। ইদানীং শোক প্রকাশের ব্যানারে দেখি লেখা থাকে “শোকাভিভুত”... হায়রে... শোকে মানুষ মর্মাহত না হয়ে অভিভূত হয় বর্তমানে।
তথ্যসূত্রঃ
১) শিয়া সম্প্রদায়ের মহররম – দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ Click This Link
২) শোক আবহে মেহেদী উত্সব ও তাজিয়া মিছিল – দৈনিক ইত্তেফাক Click This Link
৩) দৈনিক সমকাল http://www.samakal.net/print_edition/
৪) পুরান ঢাকার উৎসব-পার্বণ – দৈনিক সংবাদ Click This Link
৫) নতুনবার্তা - Click This Link
ছবিঃ পুরাতন ছবিগুলো সব আলম মুসাবগ্ধীর/আলম মুসাওয়ার এর আঁকা যিনি ঊনিশ শতকের ঢাকার একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী যিনি তাঁর শিষ্যদের সমভিব্যবহারে ঢাকার প্রসিদ্ধ ঈদ ও মুহররম মিছিল এর ওপর চিত্ররাজি অংকন করেন। এগুলি ঢাকার সবচেযে় পুরানো জলরং এর ছবি। বর্তমানে এ ছবিগুলি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। কে বা কারা এগুলোর সফটকপি প্রথম অন্তঃজালে নিয়ে এসেছে তা অনেক খোঁজ করেও পাওয়া যায় নাই। আর বাকী দুটো ছবি “প্রথম আলো” পত্রিকা হতে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:২৩