কি শিরোনামটা একটু কেমন কেমন হয়ে গেল? আমাদের পুরানো ঢাকায় খুব খুশী বা আনন্দের কোন মুহূর্ত, ক্ষণ বা দিনকে বুঝাতে আমরা এই শব্দটি ব্যাবহার করে থাকি... “কিরে পুরাই চাঁন রাইত?”। আর আজতো সত্যি সত্যি ঈদুল ফিতরের চাঁদ রাত। চাঁদ রাত মানেই খুশীর জোয়ার, আনন্দঘন একটি দিনকে বরণ করে নেয়ার ব্যাপক প্রস্তুতি। আর এই চাঁদরাতকে ঘিরে জীবনে থাকে মজার মজার সব স্মৃতি। আসলের চেয়ে যে সুদে মজা বেশী, ( ) গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান বেশী মজার বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে... ঠিক তেমনি আমার কাছে চাঁদরাতকে বেশী আনন্দের মনে হয়। আজকের লেখার বিষয় এই চাঁদরাতকে ঘিরে আমার কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি।
(১) তখন ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়ি, ২৯ রমজানের ইফতার শেষে ছাদে উঠে ঈদের চাঁদ দেখলাম, খুশীতেই কিনা... নাকি অজানা কোন রহস্যময় কারণে শাওয়াল মাসের নতুন চাঁদ দেখে আমার বুকটা হুহু করে উঠলো। আমি কান্না করা শুরু করে দিলাম। বড়দের সবাইকে গিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে মাফ চেয়ে কাঁদতে লাগলাম। সবাই খুব অবাক হল, কিরে কাঁদিস কেন? আজও মনে প্রশ্ন জাগে, কি সেই অনুভূতি যা সেই কিশোর বয়সে এমন খুশীর দিনে কাঁদিয়েছিল?
(২) শিশু বয়সের আরেক চাঁদ রাতের কথা, নানুর বাসায় তখন। ছোট খালা বিকেল থেকে পাটা-পুতা (শিলপাটা) নিয়ে বসে গেছে কাঁচা হলুদ, মেন্দি আর সোন্দা নিয়ে বাঁটাবাঁটি করতে। কেউ আমায় জিজ্ঞাসিবেন না সোন্দা কি জিনিষ । যাই হোক, আমি বায়না ধরলাম আমিও ঐ তিনটা শরীরে লাগাবো। খালা-নানু আমায় যতই বুঝায় আর ধমকায় সোন্দা আর হলুদ মেয়েরা মাখে, আমি ততই জেদ ধরি ঐ দুটো মাখবোই। আহারে এখনতো আবার এই বয়সেও সোন্দা মাখতে মুঞ্চায়... সোন্দা প্লিজ...
(৩) ক্লাস নাইন-টেন এ ওঠার পর শুরু হল চাঁদ রাতে নতুন অডিও ক্যাসেট কেনা এবং তা ফুল ভলিউমে বাজানো। আগে সাউন্ডটেক আর সঙ্গীতা (দুটি অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান) থেকে প্রতি ঈদে বিভিন্ন ব্যান্ড আর একক এ্যালবাম বের হত। নতুন ক্যাসেট কিনে এনে র্যাপিং খোলা, কাভার দেখা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাভারের গায়ে ছাপানো সব ইনফো পড়া... সাথে ফুল ভলিউমে গান শোনা। হাজারো বকুনিতেও গানের ভলিউম কমানোর নাম নিতাম না, প্রয়োজনে দরজা জানালা বন্ধ করে গান শুনতাম। গান শোনা কিন্তু শুরু হত বিখ্যাত, 'ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে...' দিয়ে।
(৪) চাঁদ রাতে গান শোনা নিয়ে আরেকটা ঘটনা বলি। তখন সবেমাত্র বন্ধু মহলে দুয়েকটি কমপিউটার প্রবেশ করেছে। চাঁদ রাতে সেই সৌভাগ্যবান বন্ধুরা পড়লো মহা বিপাকে। বিভিন্ন সার্কেলে মেলামেশা থাকায় সব সার্কেলই দাবী করল তাদের সাথে কমপিউটার নিয়ে চাঁদ রাতে সারা রাত গান শুনতে হবে। শুরু হল মহা ক্যাচাল। সবচেয়ে মজা হয়ছিলো দুজনের পিসি নিয়ে, একটা বোধহয় ৭১২ মেগা হার্টজ প্রসেসর ছিল অন্যটা ৮৫৬ মেগা হার্টজ। দুই গ্রুপে সেই কি কাড়াকাড়ি ৮৫৬’রটা নিয়ে। মনে পড়লেই হাসি পায় এখন।
(৫) চাঁদরাতে রিকশায় করে ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে। সাথে কোন এক বন্ধু কাউকে নিয়ে ঘণ্টা হিসেবে চুক্তি করে ঘুরে বেড়ানো। একবার রিকশা নিয়ে এর বাসা থেকে তার বাসা, তার বাসা থেকে ওর বাসা... এই করে করে ঘণ্টা পার করে দিলাম। সবাই ব্যাস্ত! শেষে রাগ করে বাসায় এসে দিলাম ঘুম।
(৬) ২০০০ সালের আগে বা পরের সময়কার ঘটনা, ২৯ রোজার দিন পর্যন্ত কোন পাঞ্জাবী কিনবো ঠিক করতে পারি নাই। সেদিন তিন দোকানে তিনটা পাঞ্জাবী চয়েস করে রেখে রাত দশটায় মাত্র বাসায় ঢুকলাম, মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিতে লাগলো... ‘শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেছে... আগামীকাল পবিত্র ঈদুল ফিতর...’। কি আর করা আবার ছোট মার্কেটের দিকে, রাস্তায় মানুষ আর মানুষ, ঢল নেমেছে যেন! রিকশা, সিএনজি কিছুই না পেয়ে সবাই পায়ে হেঁটে রওনা দিল। অনেক কষ্টে আসাদগেট পৌঁছে দেখি দোকান তিনটাই বন্ধ!
(৭) আরেক চাঁদরাতের কথা, তখন মনে হয় সবেমাত্র গ্রাজুয়েশন শেষ করলাম। চাঁদরাতে এক বন্ধুর সাথে শপিং করতে গেলাম ঢাকা কলেজের উল্টো দিকের মার্কেটে। বদরুদ্দোজা সুপার মার্কেট পেরিয়ে গোল্ডেন গেইট শপিং সেন্টার পার হতে দেখি ‘গ্যালাক্সি’ নামক আবাসিক হোটেল সংলগ্ন একবারের কাছ হতে প্রায় শ’খানেক লোকের লম্বা লাইন। আমি বন্ধুরে জিজ্ঞাসা করলাম,’মামু ঘটনা কি? লাইন কিসের?’। বন্ধু মুচকি হাসে, সামনে ইশারা করতে দেখি আমার স্কুল লাইফের এক বন্ধু সেখানে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। ঘটনা আবিষ্কৃত হল, সবাই এলকোহল কিনতে লাইন দিছে, শুদ্ধ ভাষায় ‘মদ’!! এক মাস সিয়াম সাধনার পর একটু গলা ভিজাতে। ইসলামে মদ সম্পূর্ণ হারাম আর চাঁদরাত বছরের পাঁচটি শ্রেষ্ঠ ইবাদত বান্দেগির রজনী। আমরা কোথায় যাচ্ছি???
(৮) আরেক চাঁদরাতে সারা রাত জাগ্রত ছিলাম, এই মসজিদ... সেই মসজিদ করে ঘুরছিলাম। গোলাম মখদুম মসজিদ, আগাসাদেক রোড (বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান এর বাসার সাথে, অতি প্রাচীন মসজিদ) এ সেই চাঁদ রাতে মাঝরাতে জামাতের (নামাজের জামাত,তাবলীগ জামাত না) সাথে ‘তাহাজ্জুদ’ অথবা ‘সালাতুল তাজবিহ’ এর নামাজ আদায় করেছিলাম। ফজরের নামাজ বাসার কাছের মসজিদে পড়ে বাসায় এসে গোসল করে প্রথম এবং এখন পর্যন্ত শেষবারের মত জাতীয় ঈদগাহে নামাজ পড়তে গেলাম। নামাজ শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে সেখানে পৌঁছই, সামনের দিকে বসে পড়ি, কোরআন তেলাওয়াত শুরু হতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি। নামাজের ইকামত শুরু হতে পাশেরজনের ধাক্কায় ঘুম ভাঙ্গে এবং নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে যাই। আমার যে অজু ভেঙ্গে গেছে সে খেয়ালই ছিল না। অনেক বছর পর এই গল্প একজনার কাছে করার সময় বিষয়টা আমার কাছে ধরা পড়ে...।
আসলেই আগে চাঁদরাতের মজাই ছিল অন্যরকম। আসলের চেয়ে সুদের মিষ্টি বেশী বলেই হয়তো চাঁদরাতে এতো ভালোলাগা মিশে থাকতো। চাঁদরাতে চাঁদ উঠার পর পাড়ার ছেলেরা পটকা ফূটাতো, দল বেঁধে আড্ডা দেয়া, ফুল ভলিউমে গাণ বাজানো, মেহেদী-সোন্দা-কাঁচা হলুদ বাটা নিয়ে মায়েদের ব্যস্ততার মাঝে ঘুরঘুর করা...... আহা সেই দিনগুলি কই? এখন চাঁদরাতে মোবাইলে এসএমএস করা, ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া, ব্লগে ঢু মারা এইসব করে কেটে যায় চাঁদরাত।