কখন প্রথম ‘ঈদ’ শব্দটি বুঝতে শিখেছি মনে নেই। শিশুকালে প্রথম ঈদ বলতে মনে পরে খুব ভোর বেলা নতুন সুগন্ধি সাবান দিয়ে গোসলটাকে, কেননা অন্যদিন এতো ভোরবেলা গোসল করানো হতো না। প্রথম ঈদের নামাজ কবে পড়েছি মনে নেই। মনে পরে পাড়ার মাইকে ফজরের পর থেকে শুরু হয়ে যেত ‘ঈদের জামাতের সময়সূচী’ জানানোর ঘোষণা। ঢাকায় জন্ম এবং বেড়ে ওঠায় ঈদগাহ তেমন আশেপাশে কম ছিল, মূলত আমরা মসজিদের ইট-সুরকির দেয়ালের গণ্ডিতেই বেশীরভাগ ঈদের নামাজ আদায় করেছি। তবে ঈদগাহ যে একেবারেই ছিল না, তা কিন্তু না। খোলা খেলার মাঠগুলোতে অনেক জায়গাতেই ঈদের জামাত হতো পার্শ্ববর্তী মসজিদের উদ্যোগে। এখনতো সিটি কর্পোরেশন এর উদ্যোগেই ঢাকা শহরের প্রতিটি খেলার মাঠে ঈদের জামাত হয়।
সেই শৈশব থেকে আজ অবধি ঈদের নামাজ পড়তে গিয়ে দুটি বিষয় নিয়ে আমি অস্বস্তিতে থাকি। একটি হল ঈদের নামাজের অতিরিক্ত ছয় তকবির, আরেকটি হল নামাজ শেষে কোলাকুলি করা। যাই হোক শৈশবে আমি নামাজ শেষ করেই ভোঁ দৌড় দিতাম বাসার দিকে, ঈদের সেমাইয়ের জন্য মুখে লোল পড়ছে যে... । অনেক সময়তো নামাজ পড়তে যাওয়ার আগেই এক ডোজ খেয়ে নিতাম। সেমাই খাওয়া শেষ করে আশেপাশের আত্মীয়স্বজনদের বাসায় বেড়াতে যেতাম, যার মূল আকর্ষণ ছিল ‘সেলামী’ তথা ঈদি। সেই লোভে খুঁজে খুঁজে গুনে গুনে আত্মীয়স্বজনদের বাসায় যেতাম... কি বেহায়া ছিলাম ছোট বেলায়! আর এখন অনেক দাওয়াত পাওয়া সত্ত্বেও যাই না, বসে থাকি নিজের ঘরের চার দেয়ালের মাঝে!
বেলা বারোটা বাজলেই বাসায় এসে পোলাও-কোরমা খাওার বায়না। রান্না হয়তো চুলোয়, তারপরও আমার ঘ্যানর ঘ্যানর চলতেই থাকতো। বড়রাতো বুঝতো না, কত কাজ ঈদের দিন আমার! যাই হোক, কোনমতে পোলাওটা খেয়ে বেড়িয়ে পড়তাম বাসা থেকে একটু দূরের আত্মীয়দের বাসাগুলোর উদ্দেশ্যে। এই করে করে বিকেল হত। সব বাসায় এটা সেটা খেয়েও ক্লান্ত হতাম না, কীভাবে যেন সব হজম হয়ে যেত? আর সারাক্ষণ মনের মাঝে চলতো কত টাকা ঈদ বখশিস পেলাম তার হিসেব।
বিকেল হলে ছুটে যেতাম “চকবাজারের ঈদের মেলা”য়। পুরাতন ঢাকার চকবাজারে বসতো জমাট এক ঈদের মেলা। এখনো নামকাওয়াস্তে একটা বসে, কিন্তু সেই মেলার জৌলুশ আর কোথায়? মেলায় প্রধান আকর্ষণ ছিল নাগরদোলায় চড়া। এখন চকবাজারে যে সিটি কর্পোরেশন মার্কেট (ইমিটিশন মার্কেট) আছে, সেখানে একসাথে তিন-চারটি নাগরদোলা বসতো। এর সামনেই বসতো হরেক রকমের সুস্বাদু আচারের দোকানগুলো। এখান হতে আচার কিনে নিয়ে লাইন দিয়ে উঠে পরতাম নাগরদোলায়, আর নামার নাম নেই। কয়েক চক্কর ঘোরার পর নীচের ছেলেপেলেদের প্রতিবাদের মুখে নেমে এসে আবার লাইন দিতাম। শেষে মেলা ঘুরে পছন্দের কোন একটা খেলনা কিনে নিতাম। এভাবে মেলায় ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যা হলে বাসার দিকে পা বাড়াতাম।
সন্ধ্যার পর সেমাই-জরদা খেয়ে ঢুলু ঢুলু চোখে এঘর ওঘর করতে থাকতাম। ছোট ভাইকে জেরা করতাম, আমার কোন ঈদ সেলামী তার কাছে কেউ দিয়েছে কি না? আগে, কোন বাসায় আমাদের দুই ভাইয়ের একজন না গেলে, অন্যজনের কাছে তার ঈদ বখশিস দিয়ে দেয়া হতো। দিনশেষে মা’র কাছে সব ঈদ সেলামী জমা রেখে তার হিসেব মিলাতাম, ‘তোমার কাছে মোট এত টাকা জমা রেখেছি। এই ঈদে এত, আগের ঈদে এত, তার আগের ঈদে এত......’।
রাতে বড়দের সাথে বসতাম ঈদের নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখতে। কিন্তু ঘুমকাতুরে আমার ঐ বসা পর্যন্তই সারা, কখন যে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যেতাম টেরই পেতাম না।
============
লেখাটি ব্লগার জাফরুল মবীন এর আহবানে “সামুর ব্লগারদের শৈশবের ঈদ” সংকলনে আপনার গল্প পাঠান প্লিজ'র জন্য লিখলাম। পাঠকের ভালো লাগবে কিনা জানিনা। কেননা ইহা একান্তই আমার নিজস্ব স্মৃতিকথা।