জন্ম এবং বেড়ে ওঠা পুরাতন ঢাকার লালবাগে হওয়ার দরুন কেল্লা শব্দটা মাথার মধ্যে গেঁথে গেছে সেই শৈশবের শুরুতেই। স্কুল ছুটির পর প্রায়দিনই চলে যেতাম লালবাগ কেল্লায়। তখন কোন টিকেট সিস্টেম ছিল না, সকলের জন্য প্রবেশ ছিল উন্মুক্ত আর বিনামূল্যে। কৈশোর আর তারুণ্যের শুরুর অনেকটা সময় জুড়ে লালবাগ কেল্লা ছিল অবসর সময় কাটানোর অভয়ারণ্য। আর তাই বুঝি ভ্রমণ মন আজ বলে উঠলো কেননা কেল্লা তথা ‘দুর্গ’ নিয়ে একটি লেখা লিখে ফেলি। সেই ভাবনা থেকেই আজকের লেখা। আসুন দেখে নেই কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন – ‘কেল্লা’ বা ‘দুর্গ’।
লালবাগ কেল্লাঃ
পুরাতন ঢাকার প্রাণকেন্দ্র লালবাগে অবস্থিত মোঘল স্থাপত্য’র অন্যতম প্রত্নতত্ত্ব হল ‘লালবাগ কেল্লা’। লালবাগের কেল্লার আদি নাম ‘কেল্লা আওরঙ্গবাদ’। মোঘল আমলে স্থাপিত এই ঐতিহাসিক দুর্গটি’র নির্মাণ কাজ শুরু করেন মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর তৃতীয় পুত্র আজম শাহ্। ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে যখন তিনি ঢাকার সুবেদার থাকা অবস্থায় সুবেদারের বাসস্থান হিসেবে এই দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। দুর্গের নকশা তার করা। কিন্তু নির্মাণ কাজ শুরু করার এক বছরের মাথায় মারাঠা বিদ্রোহ দমনের জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লি ডেকে পাঠালে এর নির্মাণ কাজ স্থগিত হয়ে যায়। ১৬৮০ সালে নবাব শায়েস্তা খাঁ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে ঢাকায় এলে পুনরায় এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। কিন্তু বিধিবাম, দুর্গের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই নবাব শায়েস্তা খাঁ’র কন্যা পরী বিবি’র মৃত্যু হলে এই দুর্গের নির্মাণকাজ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এই পরী বিবির সাথে শাহজাদা আজম শাহের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। পরী বিবিকে দরবার হল এবং মসজিদের ঠিক মাঝখানে সমাহিত করা হয়। শায়েস্তা খাঁ দরবার হলে বসে রাজকাজ পরিচালনা করতেন। ১৬৮৮ সালে শায়েস্তা খাঁ অবসর নিয়ে আগ্রা চলে যাবার সময় দুর্গের মালিকানা উত্তরাধিকারীদের দান করে যান। ১৮৪৪ সালে ঢাকা কমিটি নামে একটি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্গের উন্নয়ন কাজ শুরু করে। এ সময় দুর্গটি লালবাগ দুর্গ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯১০ সালে লালবাগ দুর্গের প্রাচীর সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে আনা হয়। অবশেষে নির্মাণের ৩০০ বছর পর গত শতকের আশির দশকে লালবাগ দুর্গের যথাসম্ভব সংস্কার করে এর আগের রূপ ফিরিয়ে আনা হয় এবং দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
প্রশস্ত এলাকা নিযে লালবাগ কেল্লা অবস্থিত। কেল্লার চত্বরে তিনটি স্থাপনা রয়েছে – (১) কেন্দ্রস্থলের দরবার হল ও হাম্মাম খানা, (২) পরীবিবির সমাধি এবং (৩) উত্তর পশ্চিমাংশের শাহী মসজিদ। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্বাংশে সুদৃশ্য ফটক, এবং দক্ষিণ দেয়ালের ছাদের উপরে বাগান রয়েছে। মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খানের প্রিয় কন্যা পরীবিবির সমাধি বাংলাদেশের একমাত্র ইমারতে যা মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর ও বিভিন্ন রং এর ফুল-পাতা সুশোভিত এবং চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে নির্মিত। অভ্যন্তরীণ নয়টি কক্ষ সুনিপুন কারুকার্যে অলংকৃত করা হয়েছে। কক্ষগুলির ছাদ কষ্টি পাথরে তৈরি। মূল সমাধি সৌধের কেন্দ্রীয় কক্ষের উপরের কৃত্রিম গম্বুজটি তামার পাত দিয়ে আচ্ছাদিত। ২০.২ মিটার বর্গাকৃতির।
ইদ্রাকপুর কেল্লাঃ
ইদ্রাকপুর কেল্লা মুন্সীগঞ্জ জেলার মুন্সীগন্জ শহরে অবস্থিত একটি মোঘল স্থাপত্য। বাংলার সুবাদার ও সেনাপতি মীর জুমলা ১৬৬০ খ্রীস্টাব্দে বর্তমানে মুন্সীগন্জ জেলা সদরে তদানীন্তন ইছামতি নদীর পশ্চিম তীরে ইদ্রাকপুর নামক স্থানে এই দুর্গটি নির্মান করেন। দুর্গটি নারায়নগন্জের হবিগন্জে ও সোনাকান্দা দূর্গের চেয়ে আয়তনে কিছুটা ছোট। ৮২ মি. বাই ৭২ মি. আয়তাকার নির্মিত ইটের তৈরি এই দূর্গটি তৎকালীন মগ জলদস্যু ও পর্তুগিজ আক্রমণের হাত থেকে ঢাকা ও নারায়নগন্জ সহ সমগ্র এলাকাকে রক্ষা করার জন্য নির্মিত হয়। সুরঙ্গ পথে ঢাকার লালবাগ দুর্গের সাথে এই দুর্গের যোগাযোগ ছিল বলে একটি জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। সুউচ্চ প্রাচীর বিশিষ্ট এই দুর্গের প্রত্যেক কোনায় রয়েছে একটি বৃত্তাকার বেষ্টনী। দূর্গাভ্যন্তর থেকে শত্রুর প্রতি গোলা নিক্ষেপের জন্য প্রাচীরের মধ্যে অসংখ্য চতুষ্কোনাকার ফোঁকর রয়েছে। একমাত্র খিলানাকার দরজাটির অবস্থান উত্তর দিকে। মূল প্রাচীরের পূর্ব দেয়ালের মাঝামাঝি অংশে ৩৩ মিটার ব্যাসের একটি গোলাকার উঁচু মঞ্চ রয়েছে। দুর থেকে শত্রুর চলাচল পর্যবেক্ষনের জন্য প্রায় প্রতি দূর্গে এই ব্যবস্থা ছিল। এই মঞ্চকে ঘিরে আর একটি অতিরিক্ত প্রাচীর মূল দেয়ালের সাথে মিলিত হয়েছে। দূর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সূদৃঢ় করার জন্য এটি নির্মিত হয়েছিল। মোঘল স্থাপত্যের একটি অনন্য কীর্তি হিসেবে ইদ্রাকপুর দূর্গটি ১৯০৯ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষিত হয়।
হাজীগঞ্জ দুর্গঃ
বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে একসময় বাংলার শাসকেরা এই ভূ-ভাগের বিভিন্ন অংশে যেসব দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন তারই একটি হলো ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জে অবস্থিত হাজীগঞ্জ জল দুর্গ। মূলত নদীপথে যাতায়াত করা শত্রুর ওপর নজর রাখতে এবং এই পথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নদীর কোল ঘেঁষে স্থাপন করা হতো বলেই এ ধরনের দুর্গকে জল দুর্গ নামে পরিচয় দেওয়া হতো। ঢাকাকে রক্ষা করতে সপ্তদশ শতকের আগে পরে যে তিনটি জল দুর্গকে ত্রিভূজ জল দুর্গ বা ট্রায়াঙ্গল অব ওয়াটার ফোর্ট গড়ে তোলা হয়েছিল তারই একটি হলো এই হাজীগঞ্জ দুর্গ; অধিকাংশ মানুষের মতে যেটি ১৬৫০ সালে নির্মিত হয়েছিল বলেই জানা যায়। তবে এটি কে নির্মাণ করেছেন তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। মুন্সি রহমান আলী তাঁর এক গ্রন্থে লিখেছেন, মীর জুমলা দুর্গটি নির্মাণ করেন। অন্যদিকে আহম্মাদ হাসান দানি তার 'মুসলিম আর্কিটেকশ্চার ইন বেঙ্গল' গ্রন্থে বলেছেন, ইসলাম খান ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করার পর এটি নির্মাণ করেন। পাঁচ কোণাকারে নির্মিত এ দুর্গের বাহুগুলো এক মাপের নয় এবং পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা দুর্গটির আয়তন আনুমানিক ২৫০ বাই ২০০ ফুট। দুর্গের কোণগুলোতে কামান বসানোর জন্য যে বুরুজ নির্মাণ করা হয়েছিল সেগুলো এখনও টিকে আছে। অন্যদিকে দুর্গের দেয়ালগুলো বেশ উঁচু এবং প্রায় ২০ ফুট পুরু। দুর্গের উত্তর দেয়ালেই এর একমাত্র প্রবেশ পথ বা দুর্গ তোরণটি অবস্থিত। কিছুটা উঁচু এই দুর্গে ঢুকতে হলে আপনাকে প্রবেশ তোরণের প্রায় ২০টি সিঁড়ি ডিঙাতে হবে। আবার তোরণ থেকে দুর্গ চত্বরের নামতে হবে ৮টি ধাপ। প্রাচীরের ভেতরে চারদিকে চলাচলের পথ রয়েছে প্রাচীর ঘেঁঁষেই। দুর্গের পূর্ব-দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় দুটি বুরুজ জায়গা আছে। আরও একটি বুরুজ রয়েছে দক্ষিণ পাশে। তা ছাড়া উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম কোণায় ছোট দুটি বুরুজ অংশ আছে, যেখানে এক সাথে কয়েকজন বন্দুক বসিয়ে গুলি চালাতে পারত। দুর্গের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে রয়েছে চৌকো একটি ওয়াচ টাওয়ার। এখন এটি ধ্বংসপ্রায় হলেও টাওয়ারে ঢোকার জন্য একসময় এতে ছিল ছোট্ট একটি পূর্বমুখী দরজা আর ভেতরে ঠিক মাঝখানে একটি মোটা গোল পিলার লাগোয়া ঘোরানো সিঁড়ি। শত্রুদের ওপর নজর রাখার জন্য এই ওয়াচ টাওয়ারটি ছাড়া দুর্গের ভেতর আর কোনো স্থাপনার অস্তিত্ব চোখে পড়ে না এবং সম্ভবত এখানে তেমন কোনো স্থাপনা কখনো ছিলও না। এর ফলে সৈন্যরা এখানে তাঁবু ফেলে অবস্থান করত বলেই ধারণা করেন ইতিহাসবিদরা। হাজিগঞ্জের এই দুর্গটি দেখার জন্য দেশের যেকোনো স্থান থেকে ঢাকায় এসে সেখান থেকে বাস বা ট্রেনে করে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় এসে নামতে হবে। তারপর চাষাড়া থেকে রিকশা, টেম্পু বা সিএনজি অটো রিক্সায় করে আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যাবে হাজীগঞ্জ জল দুর্গে।
সোনাকান্দা দুর্গঃ
সোনাকান্দা দুর্গ নিয়ে প্রচলিত রয়েছে মর্মস্পর্শী একটি কাহিনী। প্রথমে সোনাকান্দা ছিল ঈশা খাঁর কেল্লা, রাজা কেদার রায়ের মেয়ে স্বর্ণময়ী এসেছিলেন লাঙ্গলবন্দে পুণ্যস্নান করতে। একদল ডাকাত স্বর্ণময়ীর বজরায় হানা দেয়। প্রচুর স্বর্ণালংকারসহ স্বর্ণময়ীকে অপহরণ করে। পরে ঈশা খাঁ তাঁকে উদ্ধার করে কেদার রায়ের কাছে ফেরত পাঠাতে চান। কিন্তু মুসলমানের তাঁবুতে রাত কাটানোয় জাত গেছে_এ অভিযোগে কেদার রায় স্বর্ণময়ীকে আর ফেরত নেননি। এ খবর শুনে স্বর্ণময়ী কেল্লার তাঁবুতে দিনের পর দিন কেঁদে কেঁদে কাটিয়েছেন। আর তাই এর নাম হয় সোনার কান্দা বা সোনাকান্দা। এর নির্মাণশৈলী দেখলে বোঝা যায় এটি মোগল আমলের। আর ঈশা খাঁর শাসনকাল ছিল এটি নির্মাণের বেশ আগে। নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দরে অবস্থিত দুর্গটি প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিদপ্তরের অধীনে বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে। এর প্রতিরক্ষা দেয়াল এবং শক্তিশালী কামান স্থাপনার জন্য উত্তোলিত মঞ্চটি এখনো আগের মতো আছে। এ উঁচু মঞ্চে প্রবেশের জন্য পাঁচ খাঁজবিশিষ্ট খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে।
বাস থেকে নারায়ণগঞ্জ টার্মিনালে নেমে নৌকায় শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে রিকশাচালককে বললেই নিয়ে যাবে সোনাকান্দা দুর্গে। রিকশা ভাড়া ১৫ টাকা।
[বি.দ্র.ঃ এই লেখা তৈরির সময় কিছু তথ্য খুঁজতে গিয়ে দেখি এই বিষয় নিয়ে শ্রদ্ধেয় মুস্তাফিজ মামুন ভাইয়ের একটি চমৎকার লেখা রয়েছে এই বিষয় নিয়ে। পাঠকদের জন্য লিঙ্কটি দিয়ে দেয়া হলঃ দুর্গ ভ্রমণ]
তথ্যসূত্র, লেখা ও ছবিঃ
http://www.bn.wikipedia.org/wiki/
http://www.dailyjanakantha.com/
http://www.ittefaq.com.bd/
নিজ