হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে গড়া বর্তমান বাংলাদেশ। যদিও সধারণভাবে বলা হয়ে থাকে,বাংলাদেশে মানব বসতি খুব প্রাচিন নয়, কারণ এখানকার মাটি নবীন;পলি জমে এ ভূমি গঠিত হয়েছে নিকট অতীতে। কিন্তু বর্তমান লালমাই, মধুপুর ও বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূমি-গঠনের ঐতিহ্য হাজার - লক্ষ বছরের, কেননা বাংলাদেশের লালমাই, চট্টগ্রাম এবং চাকলাপুঞ্জি অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক হাতিয়ার পাওয়াগেছে। এছাড়া মহাস্থানগড় ও ওয়ারী-বটেশ্বর বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য কে প্রত্যক্ষভাবে ধারণ করে আছে। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের ইতিহাস অনেক প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। মৌর্য যুগ থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস অনেকটা আমাদের জানা। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ অংশ মৌর্য শাসনাধীনে ছিল, এমন আভাস পাওয়া যায় মহাস্থান ব্রাক্ষ্মী লিপির মাধ্যমে। শুঙ্গ ও শক-কুষাণ শাসণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে অনেক কিছু জানা না গেলেও গুপ্ত যুগ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের চিত্রটি অনেকটা স্পষ্ট। বাংলাদেশ কখনো ছিল উপমাহাদেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক পরমিন্ডলের অধীনে, কখনো এর বিকাশ ঘটেছে স্বাধীনভাবে। বর্তমান বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রাচীনকালে একাধিক জনপদে -বঙ্গ, পুন্ড্র, রাঢ়, গৌড়, সমতট, হরিকেল নামে পরিচিত ছিল। প্রচীন জনপদ গুলোর কালপর্ব সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া গেলেও ভৌগোলিক সীমারেখা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলার সুযোগ নেই। কারণ জনপদগুলোর সীমানা নানান সময়ে স¤প্রসারিত ও সঙ্কচিত হয়েছে। বাংলাদেশের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন উৎসের আলোকে হাবিবুর রহমান এবং মমিন চৌধুরীর একটি বিশ্লেষণ রয়েছে-বঙ্গ প্রচীন বাংলার একটি জনপদ। ঐতেরেয় আরণ্যক-এ সর্বপ্রথম মগধের সঙ্গে বঙ্গ নামক একটি জনগোষ্ঠীর কথা বর্ণিত হয়েছে। বৌধায়ন ধর্মসুত্রে বঙ্গের উল্লেখ মেলে একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে, যারা আর্য সভ্যতার বাইরে বসবাস করত। তাদের অবস্থান ছিল কলিঙ্গের পাশে। পুরাণে এদের উল্লেখ রয়েছে পূর্বাঞ্চালীয় অন্যান্য জনগোষ্ঠী- যেমন, অঙ্গ, মগধ,পুন্ড্র, বিদেহ , তাম্রলিপ্ত ও প্রাগজ্যোতিষের সঙ্গে। রামায়ণে অযোধ্যার সঙ্গে বঙ্গের মৈত্রীবন্ধনের উল্লেখ রয়েছে। মহাভারত থেকে জানা যায় যে, বঙ্গদের রাজ্য সমুদ্র পর্যšত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। ‘বঙ্গে’র সর্বপ্রাচীন উল্লেখ রয়েছে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে একটি ভৌগোলিক ইউনিট হিসেবে। এখানে বালা হয়েছে যে, এই অঞ্চলে উৎকৃষ্ট সাদা ও নরম সুতি বস্ত্র উৎপন্ন হতো (শ্বেতম্ স্নিগ্ধম্ দুকূলম্)।
কালিদাসের রঘুবংশে (খ্রিস্টীয় ৪র্থ ও ৫ম শতক) বঙ্গের অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। রঘুর বিজয়াভিযান বর্ণনার সময় উল্লেখ করা হয় যে, সুহ্মদের পরাজিত করার পর নৌ-বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী বঙ্গীয়দেরকেও তিনি পরাজিত করেন। তিনি গঙ্গার দুই মোহনার অšতর্বতী বদ্বীপে বিজয়¯তম্ভ নির্মাণ করেন। এই বর্ণনা সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে, গঙ্গার দুই প্রধান স্রোতোধারা ভাগীরথী ও পদ্মার মধ্যবর্তী ত্রিভুজাকৃতির ভূখন্ডটিই বঙ্গ। আর এমন জলমগ্ন প্লাবনভূমির অধিবাসীদের পক্ষে নৌ-বিদ্যায় দক্ষ হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রাচীন গ্রীক ও ল্যাটিন ক্ল্যাসিক্যাল লেখকগন এই অঞ্চলকেই গঙ্গারিডাই বলে আখ্যা দিয়েছেন ।
সেন যুগের লিপি সাক্ষ্যে বঙ্গের ‘বিক্রমপুরভাগ’ ও ‘নাব্যভাগে’র উল্লেখ রয়েছে, যা বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর ঢাকা, ফরিদপুর ও বরিশাল এলাকা নির্দেশ করে । চন্দ্র তা¤্রশাসনে ‘চন্দ্রদ্বীপ’ এর উল্লেখ রয়েছে, যা বাংলার দক্ষিণ অঞ্চল বরিশালকে নির্দেশ করে। এবং এটিও বঙ্গেরই একটি অংশ ছিল।
ইতিহাসের বিভিন্ন সময়পর্বে এর সীমানা কী ছিল তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা কঠিন, তবে মোটামুটিভাবে বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাংশের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বঙ্গের অস্তিত্ব ছিল, তা বোঝা যায়। প্রথমদিকে সম্ভবত পশ্চিম বাংলার দক্ষিণ অংশেও এর বিস্তৃতি ছিল। তবে গঙ্গার দুই প্রধান ধারার (ভাগীরথী থেকে পদ্মা-মেঘনা ) অন্তর্বতী এলাকা নিয়ে এই ভৌগোলিক ইউনিটের মূল কেন্দ্র গড়ে ওঠে এবং এখানেই স্বাধীন বঙ্গ রাজ্যের বিকাশ ঘটে। মুগল ঐতিহাসিক আবুল ফজল এর মতে সুবা-বাঙ্গালা চট্টগ্রাম থেকে তেলিয়াগড়ি পর্যন্ত চারশ ক্রোশ ও উত্তরে পাহাড়ি অঞ্চল থেকে হুগলির মান্দারণ পর্যন্ত দু’শ ক্রোশ বিস্তৃত ছিল।
বঙ্গ জনপদের বিকাশ বোঝার জন্য এই অঞ্চলের অন্যান্য প্রাচীন জনপদগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা থাকা দরকার । প্রাচীনকালে উত্তর বাংলায় ছিল পুন্ড্র জনপদ যার নগর ছিল পুন্ড্র নগর । এক সময় প্রায় সমগ্র বাংলাদেশ পুন্ড্রদেশ নামে পরিচিত ছিল। গঙ্গার উত্তরে এবং করতোয়ার দক্ষিণে ছিল বরেন্দ্রে, পালরাজাদের জনকভূ। ষষ্ঠ, সপ্তম, শতকে মালদহ ও মুর্শিদাবদের দক্ষিণাংশ গৌড় নামে পরিচিত ছিল। এক সময় বঙ্গ থেকে ভুবনেশ্বর পর্যšত সমগ্র অঞ্চল গৌড় নামে পরিচিত ছিল
চতুর্থ শতক থেকে সমতট জপদের উল্লেখ পাওয়া যায় । বর্তমান কুমিল্লা, ত্রিপুরা ও নোয়াখালির কিছু অংশ নিয়ে ছিল সেকালের সমতট । এক সময় সমতটেশ্বরের রাজনৈতিক প্রভাব এত বৃদ্ধি পায় যে সমতট ও বঙ্গ একই অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকে।
সপ্তম শতকে বর্তমান কুমিল্লা ও নোয়াখালির দক্ষিণ-পূর্বে ছিল হরিকেল রাজ্য । চট্টগ্রাম এই রাজ্যের অšর্তভূক্ত ছিল। দশম -একাদশ শতকে চন্দ্ররাজাদের উত্থানপর্বে হরিকেল বলতে সমগ্র বঙ্গকে বোঝাতো । প্রাচীন গ্রন্থে বঙ্গের সঠিক অবস্থান সম্পর্কিত কোন তথ্য বা ইঙ্গিত কোথাও পাওয়া না গেলেও প্রতœতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে দিলিপ কুমার চক্রবর্তী মনে করেন, ভাগীরথী এবং পদ্মার মধ্যবর্তী অংশে খ্রিস্টপূর্বাব্দের বঙ্গের প্রধান কেন্দ্র ছিল চন্দ্রকেতুগড়।