যতদূর জানা যায়- মনুষ্য কূলে আদি হইতে অদ্যবধি মোটামুটি দুইটি প্রজাতির বসবাস রহিয়াছে!
যাহাদের মধ্যে একটি প্রজাতি - বাঁচিবার তরে খায়!
আর অপর প্রজাতিটি - খাইবার তরে বাঁচিয়া থাকিতে চায়!!
এই দ্বিতীয় প্রজাতির বিশেষ প্রাণীকূলের কিয়দ্বংশ যাহারা এখনও বঙ্গদেশে বহাল তবিয়তে টিকিয়া রহিয়াছে বলিয়া ধারনা করা হয় তাহাদের একটি বিশেষ অবস্থান পুরনো ঢাকায়। আসুন এখানকার একটি সুখী- সমৃদ্ধশালী (!) যৌথ পরিবারের পরিচয় আগে জানিয়া লই।
বছর দশেক আগের কথা- তাহাদের পরিবারে সবচেয়ে কমন অতিথি ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, কিডনি ডিজিজ সহ অন্যান্য সকল প্রকার সমস্যা লইয়া তখনও শয্যাশায়ী পিতা, সার্বক্ষণিক চলমান এক মাতা ও চিরকুমার ষাটোর্ধ্ব চাচা ছাড়াও তিন তিনটি অকাল কুষ্মাণ্ড ভাই ও আস্ত দুই দুইটি অতি আদরের বোন রহিয়াছে।
যাহাদের একমাত্র উপার্জন বলিতে পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত বাড়িঘর ও জায়গা জমি হইতে উত্তোলিত ভাড়া হইতে প্রাপ্ত লক্ষাধিক টাকা, যাহার দেখাশুনার পুরো দায়িত্ব তখনও সংসারের কেন্দ্রস্থল সকলের অতি প্রিয় চিরকুমার চাচার উপরে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ব্যতীত যাহার মূল কাজ হইল- চক্রাকারে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ভাড়া উত্তোলন, সকলের পছন্দ অনুযায়ী বাজার করিয়া সংসারের অন্ন সংস্থান ও সকলের বিভিন্ন দাবী দাওয়া মেটাইয়া নিজেকে সবার প্রিয়পাত্র করিয়া সংসারের কর্তৃত্ব নিজহস্তে কুক্ষিগত করিয়া রাখা।
বছর পাঁচেক হইল বড় ছেলে ও বড় মেয়ের বিবাহ এবং অল্প কিছুদিন আগে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে মেজ ছেলে ও ছোট মেয়ের বিবাহ সফল ভাবে সম্পন্ন করিয়া তিনি আগেই নিজেকে ধন্য করিয়াছেন। ছোট ছেলে সকাল বিকাল মাঞ্জা মারিয়া তখনও এদিক সেদিক ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।
পরিবারের একমাত্র চলমান মাতা যাহার মূল কাজ হইল বড় পুত্রবধু ও জনা তিনেক কাজের লোকের কিঞ্চিত সহায়তায় ফজরের আজান হইতে মধ্যরাত্রি অবধি সকলের পছন্দ অনুযায়ী খাবার রান্না করিয়া সবাইকে সন্তুষ্ট চিত্তে উদরপূর্তি করিয়া নিজেকে ধন্য করা।
বাড়ি সংলগ্ন মাদ্রাসা হইতে কামিল পাশ করিয়া উচ্চ শিক্ষার জন্য মিশরে গমন করিয়া পরিবারের একমাত্র কাজের ছেলে হিসেবে ইতিমধ্যেই যিনি সকলের আস্থা অর্জন করিতে সমর্থ হইয়াছেন তিনি হইলেন মেজ ছেলে। বাকিরা সবাই শুধুই খায়, ঘুমায় আর ঘুরিয়া বেড়ায় বলিয়া ব্যাপক দূর্নাম রহিয়াছে। তাই তাহাদের ব্যাপারে ঘাটাঘাটি না করিয়া চলুন কাজী বংশের একমাত্র ভবিষ্যৎ কাজের ছেলেটি মেজ কাজীর দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া আমরাও ধন্য হই।
মাত্র একদিনের ঘটনা- ঈদুল আজহার পরের দিন। শ্বশুর শাশুড়ির আব্দার রক্ষার্থে ঈদের দিন রাতেই দুই মেয়ে ও জামাই তাহাদের সহিত যোগ দিয়াছেন। পুরো বাড়িতেই যেন উৎসবের আমেজ দ্বিগুণ হইয়াছে। তাই সেদিন সকালেও নাস্তার টেবিলে মোটামুটি প্রত্যেকের পছন্দ অনুযায়ী আলাদা আলাদা কম করিয়া হইলেও ১০ হইতে ১৫ টি আইটেম রহিয়াছে বলিয়া অনুমান করা যায়। যাহার মধ্যে ছোট জামাইয়ের বিশেষ পছন্দের কারনে চিতই পিঠা ও নেহারী (গরুর পায়া, ঠ্যাং ও অন্যান্য হাড়সমৃদ্ধ মাংস সহযোগে তৈরি সূপ বিশেষ) স্থান পাইয়াছে।
যাহোক, মেজ কাজী সাহেব শুরু হইতে শেষ অবধি মিশরে তাহার খাবারের ব্যাপক কষ্টের গল্প সকলের সহিত পারিতে পারিতে অল্প বিস্তর সকল খাবার আইটেমের স্বাদ গ্রহনপূর্বক মাত্র ঘন্টা দেড়েক ডাইনিং টেবিলে কাটাইয়া কোনটাতেই স্বাদ পাইতেছেন না বলিয়া আফসোস করিতে করিতে শেষে গোটা দশেক চিতই পিঠা সহযোগে এক পেয়ালা সূপ ও গোটা তিনেক আস্ত গরুর ঠ্যাং চিবাইয়া ছেলেটা কিছুই খাইতে পারিল না বলিয়া আরেকটু নে বাবা, এমন অনুরোধ উপেক্ষা করিয়া বিষন্ন মা জননীর মুখপানে চাহিয়া আপাতত নাস্তা পর্বের সমাপ্তি টানিলেন।
অত:পর, রিকশা সহযোগে তিনি শ্বশুর বাড়িতে গমন করিলেন এবং সুর্যাস্তের কিঞ্চিত পূর্বেই গোটা দশেক বিরিয়ানির প্যাকেট সহিত ফিরিয়া আসিলেন। তাহার হস্তে এতগুলো বিরিয়ানির প্যাকেট দেখিয়া ছোট জামাইয়ের জানিবার বিশেষ আগ্রহ লক্ষ্য করিয়া তিনি যাহা বর্ণনা করিলেন তাহা শুনিয়া ছোট জামাই মাথা ঘুরিয়া পরিয়া যাইবার উপক্রম হইল। তবে ভাগ্যিস তিনি এ যাত্রায় রক্ষা পাইয়াছেন!
তাহার বর্ণনা অনুযায়ী- সকালের নাস্তাটা মন:পূত না হওয়ায় তিনি সরাসরি শ্বশুর বাড়িতে না গিয়া মতিঝিলের 'ঘরোয়া হোটেল'- এ গিয়া তাহার বিশেষ পছন্দের 'কাচ্চি বিরিয়ানি' মাত্র তিন প্লেট চাখিয়া দেখিয়া শ্বশুর বাড়ির সকলের জন্য বিরিয়ানির প্যাকেট লইয়া সেখানে উপস্থিত হইয়া দেখেন ততক্ষণে তাহার শ্বাশুড়ি আম্মা নতুন জামাইয়ের পছন্দ অনুযায়ী সকল খাবারের এন্তেজাম করিয়া বসিয়া আছেন।
দুপুরে মনের মত উদর পূর্তি করিয়া ছোট্ট একটা ঘুম হইতে জাগিয়া তাহার মনে হইল শ্বশুর বাড়িতে সকলের জন্য বিরিয়ানি লইয়া আসিয়াছেন এই গল্প হয়ত তাহার স্ত্রী অতি শীঘ্রই তাহার বোনদের কাছে হাসিয়া হাসিয়া করিবেন, তাই মান ইজ্জত রক্ষার জন্য কাল বিলম্ব না করিয়া তিনি আবার 'ঘরোয়ায়' যাইয়া বাড়িতে সকলের জন্য বিরিয়ানি লইলেন, তবে বিকেলের বিরিয়ানির স্বাদটা কেমন হইয়াছে তাহা পরখ করিতে মাত্র প্লেট তিনেক তৎক্ষনাৎ চাখিয়া দেখিলেন।
এদিকে, আম্মাজান দুপুরে পুরান ঢাকার 'নান্নার শরিষা তেলের বিরিয়ানি' রান্না করিয়াছিলেন বলিয়া বোনদ্বয় 'ঘরোয়ার বিরিয়ানি' খাইতে অসম্মতি প্রকাশ করিয়া সকলে মিলিয়া 'চাংপাই চাইনিজ'- এ যাইবার বায়না করিলেন। মেজ কাজী সাহেব তখন "এতগুলা বিরানি নষ্ট হইবার পারে" বলিয়া আশাহত হইয়া "আইচ্চা, তাইলে আমিই খাইয়া লই" বলিয়া মুহুর্তেই প্যাকেট চারেক বিরিয়ানি সাবার করিয়া "বাকিগুলা রাইতে খামুনে" এই আশাবাদ ব্যক্ত করিয়া সানন্দে বোনদের সহিত সকলকে লইয়া চাইনিজে চলিলেন.................!
ইহা মনুষ্য কূলের উল্লেখিত দ্বিতীয় প্রজাতি সম্বন্ধে প্রথম প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত ছোট জামাইয়ের অনেক অভিজ্ঞতার মাত্র একদিনের কিঞ্চিত বর্ণিত হইল!
তাই ইহাকে গল্প ভাবিয়া ভুল করিলে নিজ দায়িত্বে করিবেন, ইহাতে বর্ণনাকারীকে মোটেও দায়ী করা চলিবে না!!
ছবি- অন্তর্জাল।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:০৫