ডাক্তার না হলেও যেহেতু অনেকদিন ধরে ডাক্তারদের পাশাপাশি চিকিৎসা পেশার সাথে জড়িত তাই অনেক সময় একটু জটিল কিংবা জরুরী রোগী হলে ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের ডাক্তার সাহেবরা অভিজ্ঞতার কারনে আমার সাথে পরামর্শ করেন। অনেকটা মিনি মেডিকেল বোর্ড এর মত। গতকাল এক বয়স্ক মহিলা এসেছেন একটা বাচ্চা রোগী নিয়ে, বয়স ৭/৮ বছর হবে। কয়েকদিন ধরে প্রচন্ড জ্বর, সাথে আরো কিছু সমস্যা ও আছে। ডাক্তার সাহেব ভালভাবে দেখে পরামর্শের জন্য আমার কাছে আসলেন। আমি ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে গিয়ে বাচ্চাটাকে আবার ভালভাবে দেখলাম এবং তার ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী অন্যান্য ওষুধের পাশাপাশি তাৎক্ষনিক জ্বর কমানোর জন্য সাপোজিটরী দেয়ার পরামর্শ দিলাম। দয়াকরে কেউ ভুল বুঝবেন না, চিকিৎসা পেশায় আমার ভাল অভিজ্ঞতা আছে এটা প্রচার করা আমার মোটেও কোন উদ্দেশ্য নয়।
এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল, কিন্তু আমার কাছে সমস্যাটা ধরা পড়ল এর পরেই। স্বাভাবিকভাবেই রোগীর তথ্য জানাটা চিকিৎসকের ধর্ম, যদিও বর্তমানে আমাদের সম্মানিত ডাক্তার সাহেবদের সেই সময় নেই। তারা রোগীর কাছ থেকে ফি এবং টেস্ট করানোর নামে টাকা বের করার জন্য যে সময়টুকু দিতে পারেন সেটা খুবই সামান্য, তবে সবার ক্ষেত্রে হয়ত এটা প্রযোজ্য নাও হতে পারে। যাহোক ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে কাজ নেই।
বাচ্চাটা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইতেই বয়স্ক মহিলা খুব আবেগআপ্লুত হয়ে পড়লেন। তিনি যা বললেন তার সারমর্ম এরকম- খুব ছোট বেলায় বাচ্চাটার বাবা অকালে মারা গেছে। মা ওকে ফেলে আরেকটা বিয়ে করে চলে গেছে। ওর কোন খোজখবর নেয় না। বাবার পক্ষের কেউ ওর দায়িত্ব নেয়নি। সেই থেকেই ও নানীর কাছে। বয়স্ক নানী ওকে নিয়ে কষ্টে আছে তাই একটা এতিমখানা কাম আবাসিক মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিয়েছে। কয়েকদিন ধরেই অসুস্থ তাই আজ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাকে খবর দিয়েছে। সে খবর পেয়ে কষ্ট করে ছুটে এসেছে এবং ওকে এখানে চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসেছে।
বাচ্চাটার মুখের দিকে বারবার তাকালাম, একটু আগেই আমি ওর কপালে-গায়ে বারবার হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করেছি। খুব মায়াবী চেহারা, ভীষণ চটপটে, ঝটপট সব প্রশ্নের জবাব দেয়, দেখলেই যেকোন মানুষের ভাল না লেগে উপায় নেই। বাচ্চাটাকে দেখে, সব শুনে খুব খারাপ লাগল, কিছুটা ইমোশনাল হয়ে গেলাম। দুর্বলতা আড়াল করতে দ্রুত নিজের রুমে ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকলাম, তারপর থেকে মনের মধ্যে কতগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে-
১। বাবার অবর্তমানে একটা বাচ্চার অভিভাবক কে বা কারা?
২। ছোট বেলায় বাবা মারা গেছে, এতে বাচ্চাটির অপরাধ কি?
৩। তার মায়ের নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া অবশ্যই আছে, কিন্তু এই নিষ্পাপ বাচ্চাটির প্রতি কি তার কোন দায়িত্ব নেই?
৪। মা কেন তাকে সকল স্নেহ-ভালবাসা থেকে বঞ্চিত করল?
৫। মা চাইলেই কি তাকে বাবার আদর ও মায়ের ভালবাসা দুটোই দিতে পারত না? ইত্যাদি....ইত্যাদি.........
কিছুদিন আগেই আমরা খুব ঘটা করে মা দিবস পালন করলাম, এটাই তাহলে আদর্শ মায়ের আরেক রুপ? দরিদ্র- মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, মেনে নিচ্ছি, কিন্তু এমনটা কখনও কাম্য নয়, মেনে নেয়ার মত তো নয়ই। সেদিন ফেসবুকে তামান্না সেতুর একটা পোষ্ট দেখলাম, তার ছেলেদের আবদার পূরণের জন্য তিনি বয়সে অনেক ছোট একজনকে বিয়ে করে ছেলেদের বাবার চাহিদা পূরণ করেছেন। বাবা-ছেলের ছবি পোষ্ট করার পরে "কে বাবা, কে ছেলে চেনাই যায়না" অনেকের এমন বিরুপ মন্তব্যের জবাবে তিনি বলেছেন- তিনি গর্বিত যে, ছেলেদের আবদার পূরণ করতে পেরেছেন। সত্যিই গর্ব করার মত।
আমিও একজন বাবা, আমার দুটি সন্তান। সকল সীমাবদ্ধতা, দুঃখ-কষ্ট, হতাশার মাঝেও ওরাই আলোক বর্তিকা। দিনশেষে ঘরে ফিরলে সকল দুঃখ-কষ্ট মুহুর্তের মধ্যে ভুলিয়ে মনটাকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেয়ার জন্য ওরাই একমাত্র ম্যাজিক।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৬ বিকাল ৪:৩৪