তমা ঃ কি সপ্ন দেখছিলে কতক্ষন ধরে ... এতক্ষন ঢাকলাম টের পেলে না। নাও পানিটা খেয়ে নাও। ইস সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। জামাটা খুলে মুছিয়ে দিচ্ছি। ভয় পেয়েছ খুব।
এক নিশ্বাসে পানিটা খেয়ে। জামাটা খুলে ফেলল সে। তমা শরীরটা মুছিয়ে দিল বেশ যত্মের সাথে। রাতুলের বুকটা এখনো কাপছে। রাতুল যেন কিছুই মনে করতে পারছে না। সে কিভাবে হাসপাতালের বেডে আসল। তমাই বা এখানে কিভাবে আসল। বুকের কাপুনি এর মধ্যেই অনেকটা কমে এসেছে।
ইউনিভার্সিটির শেষ বৎসরের ছাত্র রাতুল। বাবা মার একমাত্র সন্তান সে। বাবা রিটায়ার্ড পানি উন্নয়ন বোর্ড একাউন্টেন। মা মারা গেছে আজ দু বছর হ্ল। বাড়ির কোন কাজে ওকে না পাওয়া গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ নামডাক তার। একনামে তাকে সবাই চিনে। রেকর্ড মার্কস নিয়ে শেষ করতে যাচ্ছে সে। ভাল ছাত্র হবার কারনেই দ্বিতীয় আর তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের লাইন ছিল তার কাছে। হাত খরচের যোগান ঠিক রাখার জন্যই সে দু একজনকে পড়াত। আড্ডা দেবার একটা লোভ তার সবসময় ছিল। কোন জায়গায় বন্ধুরা সব এক জায়গায় আড্ডা দিচ্ছে শুনলেই সেও দৌড়ে চলে যেত আড্ডা দিতে।
মনে হয় দ্বিতীয় বর্ষের শেষ দিকের ঘটনা হবে। রাজীব হঠাৎ ফোন দিল, দোস্ত খুব বিপদে পড়েছি। মলি আমার সাথে দেখা করতে চায়। আজ বিকেলেই ধানমন্ডি লেকে আসতে চায়। আমার খুব ভয় ভয় লাগছে। একা যেতে পারব না। তুই সময় না দিলে মারা যাব।
রাতুল ঃ কিন্তু আমার যে টিউশনি আছে। আচ্ছা দেখি ম্যানেজ করতে পারি কিনা।
রাজীবঃ তোকে আসতেই হবে। আমি ৩২ নম্বরে থাকব। তুই আসলেই যাব, নইলে না।
অগত্যা রাতুল ধানমন্ডির দিকে রওয়ানা হল। মলির সাথে ওর এক বান্ধবী তমা ছিল। ওদের দুজন কিছুটা হাল্কা হবার পর। তমাই বলল তোরা একটু বস, আমি রাতুল ভাইকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি। কি রাতুল ভাই আমার সাথে একটু ওদিকটায় যেতে আপনার আপত্তি নেই তো। রাতুল মৃদু হেসে বলল, চলুন। মেয়েদের পাশাপাশি হাটার অভ্যেস নেই রাতুলের। চেষ্টা করছে তবুও একবার তমা এগিয়ে যাচ্ছে নয়তো সে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব দেখে তমা যেন হেসে উঠল। রাতুলকে বলল, চলুননা ওখানটায় একটু বসি। আমার সাথে বসতে আপত্তি নেই তো। মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ঝুলিয়ে রাতুল বলল, চলুন বসি।
সে দিনের প্রত্যেকটা কথা রাতুলের মনে আছে। না কোন বিশেষ কথা নয় .....শুধু মাত্র কথা চালাচালি। তার পরেও সে দিনটা রাতুলের বেশ মনে আছে। সময়ের প্রয়োজনে তারা বেশ কাছাকাছি চলে আসে। রাতুলের দিনের বেশ খানিকটা সময় নিয়ে নেয় তমা। নোট, হেল্প কিছু লাগলেই ক্যাম্পাসে চলে আসে সে। রাতুলো যেন ক্যাম্পাসে তখন একটু বেশী সময় দিত। হঠাৎ মাথাটা কেমন যেন চিন চিন করে উঠে। গুংগিয়ে উঠে সে। তমা যেন দৌড়ে ডাক্তার ডাকতে যায়। ডাক্তার এসে ঘুমের ওষুধ দিয়ে যায়। রাতুল ঘুমিয়ে পরে।
ঘুমিয়ে পড়া রাতুলের পাশে বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তমা। ভাবাবেগহীন একখানি মুখ। এই ছবি কি প্রত্যেকের মাঝে লুকিয়ে থাকা পবিত্রতার রুপ। শান্ত, সৌম্য একখানি মুখায়ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাতুলের সাথে এই চেহারা এখন অনেকটাই মিল নেই। গালটা অনেক ফুলে গেছে, গলার নিচে ভাজ পরে গেছে, দু একটা চুলও পেকে গেছে, মাথার সামনের দিক এখন অনেকটা ফাকা। ফেলে আসা দিনগুলো যেন ছায়াছবির মত ভেসে আসে তার চোখের মাঝে।
মলির সাথে ওদের প্রথম ডেটিংয়ে রাতুলকে দেখার পর থেকেই রাতুলের প্রতি অনেকটাই আকৃষ্ট হয়ে পরে সে। রাতুল মোবাইলে প্রয়োজনের বাইরে কথাই বলতে পারে না। মেয়ে হয়ে বার বার রাতুলকে ফোন দিতেও বাধত তার। তাই, রাতুলের সাথে সময় কাটানোর জন্য পড়াশুনায় বেশ মনোযোগ দিতে হয়েছে। রাতুলের জন্য নিত্যনতুন সমস্যা তৈরী করার জন্য বিভিন্ন লেখকের বইয়ের অনুশীলনী করতে হত তাকে। খুব সমস্যায় পড়ত সে সেমিষ্টার শেষ হয়ে গেলে। আর রাতুলো যেন কেমন ছিল ওকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না ও কিছু বুজতে পেরেছিল কিনা। এভাবেই চলছিল দেড় বছর। সমস্যা বেধে গেল যখন তমার বাবা মা ওর জন্য পাত্র ঠিক করে ফেলেছিল। হঠাৎ যেন দশ মন ওজনের কষ্টের বোঝা তমার বুকে চাপিয়ে দিয়েছিল তার বাবা মা। ওসব কথা মনে হলে এখন হাসি পায় তমার। কি সাহসই না সে দেখিয়েছিল সেই দিন। ভোর হতেই মলি ব্যাগ নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিল রাতুলের মেসে। কি জন্য সে উদভ্রান্তের মত সেই দিন বাড়ী থেকে ওভাবে বেড়িয়ে গিয়েছিল, ভাবলে আজো অবাক হয়।
হঠাৎ যেন রাতুল নড়ে উঠল। কি যেন সব বিড়বিড় করে বলছে। একবার ভাবল জাগিয়ে দিবে কিনা। পরে আবার ওর মুখচ্ছবি দেখে ওকে ঘুমুতে দিল সে। কতদিন পর এভাবে দেখতে পারছে ওকে কতদিন পর। স্মৃতি রোমন্থন ভালই পেয়েছে আজ তমাকে, বিয়ের দিনটার কথা আজ তার খুব মনে পড়ছে।
সে দিন রাতভর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে ভোরে ঘুমিয়েছিল। রাতুলের দেয়া ঠিকানা অনুসারে এসে থমকে যায় সে। একা একটা মেয়ে ছেলেদের মেসে সরাসরি চলে যাবে। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। অনেকক্ষন ধরে বাইরে দাড়িয়ে থাকায় দারোয়ান এসে জিজ্ঞাসা করল, কার কাছে যাবেন। ইতস্থত হয়ে হঠাৎ খুশি হয়ে বলল, রাতুল ভাইয়ের কাছে যাব, অনেকক্ষন ধরে মোবাইলে চেষ্টা করে পাচ্ছি না। আমার তো ভার্সিটি ছুটি তাই ভাইয়া আমাকে সিলেটে নিয়ে যাবে। কিন্তু ওতো ফোনই ধরছে না। আপনি একটু ডেকে দিবেন। রাতুলের উস্কোখুস্কো চুল নিয়ে কোন রকম একটা জামা জড়িয়ে নিচে নামতেই দেখে তমা ব্যাগ হাতে দাড়িয়ে। “কি ব্যাপার তমা তুমি এত ভোরে, কোন সমস্যা” এইটুক শুধু বলেছে রাতুল। ওকে কোন সুযোগ না দিয়ে ওর জামা ধরে টানতে টানতে টাক্সির কাছে নিয়ে গেল আর দারোয়ানকে শুনিয়ে বলেছিল, “রাতুল ভাইয়া, তারাতারি এস বাস ছেড়ে দিবে”। ট্যাক্সিতে বসে তমা যেন আড়ষ্ট হয়ে পরল তমা। অনেক কিছু বলতে চাইছে কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না। সে শুধু ভেবেই চলেছে কিভাবে বলবে। সরাসরি বলবে নাকি ঘুরিয়ে বলবে। রাতুল যদি তাকে ফিরিয়ে দেয়। এই সব ভাবতে ভাবতে তার চোখ ভিজে উঠল। রাতুল শুধু দুবার জিজ্ঞাসা করেছিল, তমা কি হয়েছে। উত্তর না পেয়ে সেও চুপ মেরে গেছে। তমাকে সময় দিতে চাইছে সে। হঠাৎ তমা বলে উঠল, “আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে” আরে কিছু বলতে পারল না সে। কেদেই মুখ লুকালো রাতুলের কাধে। হঠাৎ রাতুলের যেন খুব হাসি পেয়ে গেল। হো হো করে হেসে উঠল। মুখটা তুলে জানতে চাইল, “জনাবা, পাত্রখানা কে যে তার উপর গড়িয়ে পরবেন।” কিছু না বলে তমা দু হাতে রাতুলকে জড়িয়ে আবার ওর কাধে মুখ লুকালো। রাতুলের যেন বুকটা ভরে গেল। মগবাজার কাজী অফিসের সামনে দাড়ালো ওদের ক্যাব। রাতুল নেমেই দেখে রাজীব আর জাবির ওদের জন্য দাড়িয়ে আছে। হাসিমুখে রাতুল তমার দিকে ফিরেই বলল, “এই বান্দাদের খবর কখন দিলে, এত আয়োজন আর আমি জানলাম শেষে। ” বিয়ের ফিসের টাকা নেই আমার পকেটে। ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, মিষ্টি হেসে বলল তমা।
বিয়ের কথা তারপরেই চেপে যায় ওরা। ঠিক করে পড়াশুনা শেষ করার আগে একসাথে থাকবে না ওরা। আগের নিয়মেই তাদের সব কিছু হবে। তমার বাসায় খুব সমস্যা না হলে কাউকে কিছুই জানাবে না ওরা। এমনি করেই রাতুল অনার্স শেষ করে চাকুরীর চেষ্টা করতে থাকে আর তমা বেশ সিরিয়াস হয় একটা ভাল রেজাল্ট নিয়ে বের হবার জন্য। এখন আর ওদের যোগাযোগ চলত শুধুই মোবাইলে। এরই মাঝে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় রাতুলের মোবাইল। ক্যাম্পাসে তখন রাতুলের বন্ধুরা খুব একটা আসত না। কয়েকদিন ধরে রাতুলের কোন খোজ না পেয়ে, রাতুলের বাসায় চলে যায় সে। রাতুলের বাবা জলজ্যন্ত একটা মেয়ে তার ছেলের খোজে বাড়ি পর্যন্ত এসে পড়েছে দেখে ভীষন অবাক হলেন।
ভাংগা গলায় বলল ঃ রাতুল কোথায়?
রাতুলের বাবা ঃ তুমি কে
তমা ঃ আমি তমা।
রাতুলের বাবা ঃ তোমার সাথে রাতুলের সম্পর্ক?
তমা মুখে কিছু না বলে তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ওদের কাবিন নামাটা ওর বাবা হাতে দিল। আকস্মিক ঘটনায় রাতুলের বাবা এত বিস্মিত হলেন যে তিনি কিছু বলতে পারলেন না। তার খুব রাগ করা উচিৎ কিন্তু তিনি পারছেন না।
তমা ঃ রাতুল কোথায়?
রাতুলের বাবা ঃ রাতুল এক্সিডেন্ট করেছে, এখন ও হাসপাতালে।
তমা যেন দু চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। কোথায় কখন কিভাবে বলে ফুপিয়ে উঠল সে। বাবা, প্লিজ আমাকে নিয়ে চলুন, প্লিজ। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি যেন সব ভূলে গেলেন। শুধু বলতে পারলেন, “ভয় পেও না মা, এওর বিপদ কেটে গেছে।”
১৮ ঘন্টা পর ঘুম ভাংগল রাতুলের। বেশ স্বাভাবিক লাগছে তার। ঘুম ভেংগেই দেখে তমা ওর পাশেই চেয়ারে ঘুমিয়ে আছে। বেশ লাগছে ওকে দেখে। গাল ছুতে বেশ ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন কেবল সে হাতটাই ধরতে পারবে। পা টা দুপাশ থেকে টানানো আর কোমরেও একটা টানা দেয়া আছে। ঘুম ভেংগেই তমা দেখল তার হাত নিয়ে রাতুল খেলছে।
তমা ঃ কি ব্যাপার কখন উঠলে
রাতুল ঃ অনেকক্ষন
তমা ঃ ডাকলে না কেন
রাতুল ঃ তোমাকে ডাকলে এতক্ষন তোমার হাত নিয়ে খেলতে দিতে।
রাতুল দেখল ওর বাবা ঢুকতে গিয়ে ওদের দেখে চলে গেল। হঠাৎ সর্প দেখার মত লাফিয়ে উঠতে চাইল সে। তমাকে বলল, আমার আর রক্ষা নেই, বাবা আমাদের দেখে ফেলেছে।
তমাকে যেন খুব মজার একটা কথা বলা হল। সে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। উঠে দাড়িয়ে বলল, “আমার ক্লাস আছে, আমি যাই” । “কি ব্যাপার হাসছ কেন?” রাতুল উসখুস করতে লাগল। “তোমাকে বলা যাবে না, আমি চললাম, দু ঘন্টার মধ্যে আসছি।” কি হয়েছে বলে যাও চিৎকার করে উঠল সে। তার মেজাজটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সে কিছুই বুজতে পারছে না। চিৎকার করে ডাকল, “তমা, তমা এদিকে একবার শুনে যাও” তমা স্বাভাবিকভাবে এসে শান্ত অথচ দুষ্টুমি ভরা মুখ নিয়ে রাতুলের দিকে তাকালো। রাতুল কাতর ভাবে বলল, “প্লিজ, বল আমাকে, তা না হলে আমি টেনশনে মারা যাব” তমা রাতুলের বিছানায় ঝুকে গাঢ় স্বরে বলল, “ আমার উপর বিশ্বাস রাখ, আমি সব ঠিক করে দিয়েছি। তোমার আর ভয় নেই।” রাতুল তাকিয়ে দেখল অদ্ভূত এক মিষ্টি আলো তমার মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। তার বুকের অন্ধকারগুলো যেন সেই আলোয় হারিয়ে যেতে বসেছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১০ সকাল ৯:৫২