প্লেটো তার রিপাবলিকগ্রন্থে সক্রেটিসের শিক্ষাদানের পদ্ধতি গুলো সংলাপ আকারে তুলে ধরেন। তিনি একে বলেন The method of dialectic বা সক্রেটিয় পদ্ধতি । এ লেখায় পাঠকদের জন্য কিছু সংলাপ সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
সক্রেটিস ও তার বন্ধুর কথোপকথন :
সক্রেটিস একবার তার এক ব্যবসায়ী বন্ধু সেফালস কে জিজ্ঞাস করলেন : ন্যায়পরায়ণতা কী ?
সেফালস উত্তর করলেন : ন্যায়পরায়ণতা হল সত্য কথা বলা এবং কারো কাছে ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করা।
সক্রেটিস বললেন : কখনো কখনো ঋণ পরিশোধ করাও অনুচিত।
সেফালস বললেন : কিভাবে?
সক্রেটিস বললেন : ধরুন আপনি আপনার এক বন্ধু থেকে একটা অস্ত্র ধার নিলেন। কিছুদিন পর সে বন্ধু পাগল হয়ে গেল। এখন কি তাকে সে অস্ত্র ফেরত দেয়া ঠিক হবে ?
.... সেফালস পড়লেন বিপাকে। তখন সে সক্রেটিসের সাথে একমত পোষণ করলেন । আর এতে করে তার পূর্বের দেয়া সংজ্ঞাটা নস্যাৎ হয়ে যায়।
সক্রেটিস এভাবেই মানুষের দেয়া সংজ্ঞা গুলোকে যুক্তি, তর্ক বা প্রতিদৃষ্টান্ত দিয়ে সেগুলোর সংকীর্ণতা আর সীমাবদ্ধতা বের করে নিয়ে আসতেন। ফলে নতুন করে সংজ্ঞা নির্মাণ করা প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়াতো।
সক্রেটিস মানুষকে প্রশ্ন করতে পছন্দ করতেন। তিনি মানুষকে প্রশ্ন করতেন এবং মানুষ যেখানে গিয়ে আর পেরে উঠতো না সেখান থেকে তার নিজের জ্ঞান বিতরণ আরম্ভ করতেন। তিনি মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ের সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করতেন । তারা উত্তর দিলে তিনি সেখান থেকে টেনে ভুল বের করতেন। এভাবেই চলতো সক্রেটিসের জ্ঞান দান প্রক্রিয়া । কিন্তু সবসময় যে সক্রেটিস নতুন সংজ্ঞা দাঁড় করাতেন এমন না। কখনো কখনো সক্রেটিস নিজেও আগের সংজ্ঞা বাতিল করে দেয়ার পরে নতুন কোন সংজ্ঞা দিতে পারতেন না।
সক্রেটিস ও পলেমার্কাসের:
সেফালসের পুত্র পলেমার্কাস। তিনিও বাবার মতো একজন সুনাম-ধন্য ব্যবসায়ী; এবং সক্রেটিসের একজন গুণগ্রাহী ভক্ত ও শিষ্য। তিনি সক্রেটিসের আশেপাশেই থাকতেন বেশিরভাগ সময়।
"ন্যায়পরায়ণতা কী?"
এমন প্রশ্নের উত্তরে পলেমার্কাস বলেন যে: " বন্ধুদের বন্ধু এবং শত্রুদের শত্রু হিসাবে প্রত্যেকে তার পাওনা বুঝিয়ে দেয়াই হলো ন্যায়পরায়ণতা।"
(প্লেটোও এই মতের সাথে একমত ছিলেন। তার মতে, যার যা প্রাপ্য তাকে তা বুঝিয়ে দেয়াই হলো ন্যায়পরায়ণতা।)
সক্রেটিস বলেন: "একজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির বন্ধুর প্রতি অনুকূলতা বা পক্ষপাত করা কিংবা শত্রুর প্রতি শুধুমাত্র শত্রু বলেই হিংসা, বৈরিতা বা শত্রুতা প্রদর্শন করা অনুচিত" ।
পলেমার্কাসের নিকট এর প্রতিউত্তর নেই।তাই তিনি চুপ হয়ে যান।
এভাবে সক্রেটিস পলেমার্কাসের দেয়া সংজ্ঞা খণ্ডন করেন।
সক্রেটিস ও থ্রাসিমেকাস:
সক্রেটিস সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে যান থ্রাসিমেকাসের সাথে তর্ক করতে গিয়ে। থ্রাসিমেকাস ছিলেন সোফিস্ট মতানুসারী । সোফিস্টরা ছিল নীতি-আপেক্ষিকতাবাদী। তাদের মতে নৈতিকতাবোধ, ন্যায়পরায়ণতা, সম্মানজনক অবস্থা ইত্যাদির কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। অর্থাৎ এগুলি সার্বজনীন নয়। নৈতিকতাবোধ বা ন্যায়পরায়ণতা ইতিহাস, সংস্কৃতি ভেদে ভিন্ন হতে পারে।
এ সুরেই থ্রাসিমেকাস বলেন যে: "রাষ্ট্রের আইন এবং ব্যক্তির নীতিবোধের সাথে ন্যায়পরায়ণতার কোন সম্পর্ক নেই। আইন হলো শক্তিমানের ইচ্ছা। আর সমাজ বা রাষ্ট্রের আইন হলো শাসকের স্বার্থে, ক্ষমতাধর শক্তিমানের স্বার্থে। আইন মান্য করা হলো দুর্বলের নৈতিকতা এবং এ আইন শুধু শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করে।"
তৎকালীন শাসকশ্রেণীর উপর থ্রাসিমেকাস কতটুকু অসন্তুষ্ট ছিল তার কথাবার্তা থেকেই আন্দাজ করা যায়।
থ্রাসিমেকাস বলতে থাকেন: "সাধারণ মানুষের নৈতিক দায়িত্ব হলো আইন মান্য করে চলা। আর এর মানে হলো বিনাপ্রশ্নে, বিনাবাক্যে, অন্ধভাবে শাসকশ্রেণী বা শক্তিমানের স্বার্থরক্ষা করা"।
সক্রেটিস এ প্রসঙ্গে সুশাসনের কথা তুলে আনেন।
তিনি বলেন: "শাসক যদি শাসনব্যবস্থার সু-কারিগর হন তাহলে সে শাসিতের কল্যাণে নিবেদিত থাকবেন"। তিনি আরো বলেন: "শাসক হলো ডাক্তারের মতো। তার প্রাথমিক ইচ্ছা হলো রুগীকে ভালো করা। এরপর রুগী ভালো হলে তার কাছে তার মজুরি চাইবে। শাসক শ্রেণিও জনগনের কল্যাণে কাজ করার পর তাদের কাছে তার বিনিময় চাইবে। তবে সুশাসক সবসময় শাসিতের কথা আগে ভাববে"।
ন্যায়পরায়ণতার প্রশ্নে সক্রেটিস বলেন: "ন্যায়পরায়ণতা আপেক্ষিক নয়। সেটা সবকালে, সবসমাজে একই রূপে থাকে। স্পার্টাদের জন্য যেটি ন্যায় এথেনীয়দের জন্য সেটি অন্যায় নয়"।
(সক্রেটিসের এ কথাকে সমর্থন করে পরবর্তিতে প্লেটো তার পক্ষে যুক্তি দেন এবং সোফিস্টদের আপেক্ষিকতাবাদী নীতি ভুল প্রমাণ করেন।)
কিন্তু থ্রাসিমেকাস সক্রেটিসের কথায় সন্তুষ্ট হন না। তিনি মনে করেন সক্রেটিস তার যুক্তি খণ্ডন করতে সক্ষম হননি।
[তথ্যসূত্র: দার্শনিক অন্বেষা; টি জেড লেভিন]
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২১ ভোর ৫:৫৩