আগের পর্ব Click This Link
বাবাকে ছেড়ে আসাও অনেক কষ্টের ছিল। বাবার বয়স হয়ে গেছে, বাবার দিকে ঠিকমত তাকালে খুব কষ্ট হয়।আমার সবসময়ের নায়ক বাবার চেহারায় বয়সের ছাপ দেখতে ভাল লাগে না।আহা বাবা কেন তোমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে? ছোটবেলায় বাবা যেমন আমার সব কাজ নিজেই করে দিতেন, বাবা ঢাকায় আসলে আমিও চেষ্টা করতাম বাবার যেন কিছু করতে না হয়।বাবাকে কষ্ট করতে দেখলে আমার খুব কষ্ট হত।
আমার স্কুলের বেতন দেয়া থেকে শুরু করে স্কুলের খাতা বইও বাবাই কিনে আনতেন।কখনই বাজার এ যেতে বলেন নি, এমনকি চা কিংবা সকালের নাস্তা আনার জন্যও কখনই বলেন নি দোকানে যেতে। সব একাই করতেন। ইউনিভার্সিটির হল এ উঠার আগ পর্জন্ত সব কাজেই আমাকে বাবাই নিয়ে আসতেন।ফর্ম কেনা থেকে শুরু করে পরীক্ষা দেয়া, মেডিক্যাল দেয়া, ভর্তি হওয়া, হল এর সিট এ উঠা পর্যন্ত কোন কাজেই বাবা আমাকে একা যেতে দেন নি, সব কাজেই ছায়ার মত লেগে থাকতেন।
এখন এই বয়সে আবার সব দায়িত্ব উনার কাধে তুলে দিয়ে চলে আসতে ভয়াবহ কষ্ট হচ্ছিল।বাবার কি বেশি কষ্ট হয়ে যাবে না, এই বিষয়টা আমাকে বারবার খোচাচ্ছিল।বাবা কিন্তু মায়ের মত এত কান্নাকাটি করেন নি।কিন্তু বাবার মনের তীব্র হাহাকার আমি ঠিকই বুঝতে পারতাম।
বাবা যখন আমাকে ঢাকাগামী বাস এ তুলে দিতে আসলেন, বাবার মলিন মুখটা আমার বুকে ভয়াবহ হাহাকারের জন্ম দিল।আমি বাস এর জানালা দিয়ে অনেক্ষন তাকিয়ে থাকলাম বাবার দিকে।যখন আর কান্না লুকিয়ে রাখতে পারলাম না, তখন চোখ সরিয়ে নিলাম। আমার বাস চলে যাচ্ছে, বাবা বাস এ আমার জানাল বরাবর আমার দিকে তাকিয়েই আছেন, এই ভয়াবহ হতাশামাখা দৃশ্যের কথা যতবার মনে করি ততবারই চোখ ভিজে উঠে।লেখার সময়ও বারবার দেখছি কেউ আমার কান্না দেখে ফেলছে কিনা।
কষ্ট চেপেও বাবা আমাকে আরও পড়াশুনা করতে উতসাহই দিতেন।যখন খুব ইনডিসিশন এ ভুগতাম বাবার উতসাহ পেলে মন ভাল হয়ে যেত। আমি বলতাম,'একা তুমি সব দিক সামলাতে পারবে তো?'। বাবা তখন অমুক ভাই , তমুক ভাই এর কথা বলে বলত, ' ওরা ত আছেই সাহায্য করার জন্য।' এখন এই ব্যাপারটা ভাবলে আরও বেশি খারাপ লাগে, কোথাকার কোন ভাইরা বাবাকে সাহায্য করবে, আর আমি নিজের ছেলে হয়েও দূরে বসে থেকে শুধু উনাদের সাহায্যের কথা শুনেই যাব।
আমার ফ্লাইট এর আগের দিন বাবা, আমি আর আমার বউ ছাদে বসে ছিলাম। বাবা তখন ৭১ এ উনার ভারতে থাকার অভিজ্ঞতার কথা শুনালেন। বললেন,' দেশের অনেক তুচ্ছ জিনিস যেগুলার দিকে কখনই নজর দেই নাই, সেগুলার কথা মনে করেও খারাপ লাগত। বাড়ির সামনের তালগাছ, ময়লা পুকুর এগুলার কথা মনে পড়েও খারাপ লাগত। তখন ভাবতাম একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি। কিছুটা ভালো লাগত। তুমিও এরকম ভাববা। সবসময় চিন্তা করবা দেশের কাজে লাগবে এমন বিদ্দ্যা অর্জনের জন্যই তুমি বাইরে যাচ্ছ।দেশকে ভুলে যেও না'। আমাদের দুই জনকেই বললেন, 'সবসময় একজন আরেকজনের বিশ্বাসের মর্যাদা দিবা'। বাসায় কারেন্ট ছিল না, অন্ধকার ছাদে আমি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে ছিলাম। মনে হচ্ছিল কেন আমি আরও বেশি সময় ধরে বাবার পাশে বসি নাই আগে? (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:০৬