কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর কবিতা ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ অবলম্বনে
##
অন্ধকারের ভিন্ন ভিন্ন রঙ আছে । আলাদা ঘ্রাণও আছে । যা শুঁকে বলা যায়, এটা কি কেবল ব্যক্তিগত বিষাদের অন্ধকার নাকি কোনো দুর্যোগের পূর্বাভাসও । এ অন্ধকারে মৃত্যুর তীব্র গন্ধ । তারেক টের পাচ্ছে, ভালোমতোই টের পাচ্ছে । কয়েক সারি পিঁপড়ার দল তারেকের পা ঘেঁষে চলছে । এরাও কি মৃতের মাংস খায় ?
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ।
তারেককে একটা চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে ওরা, পাকিস্তানী হানাদাররা । হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা । দুর্বল লাগছে ওর, নিজেকে । মনে হচ্ছে যেন অনন্তকাল ধরে এই একই জায়গায় বসে আছে । শ্লথ সময়ের পাড়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুগুহায় বসে অশুভ ক্ষণের অপেক্ষায় । জনাকয়েক সৈন্যের বুটের থপ থপ শব্দ প্রতিধ্বনি তুলল লম্বা ঘরটাতে । কে যেন এসে চোখে কালো কাপড় বেঁধে দিয়ে গেল । অপেক্ষা শেষের প্রারম্ভিকার জন্য চলছে শেষ মুহূর্তের চেক-আপ । কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তারেকের মুখের উপর কেউ সজোরে লাথি হাঁকাল । চোয়ালের স্নায়ুতন্ত্রগুলো যেন কিছু মুহূর্তের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায় । তীব্র ব্যথাটা কেটে যেতেই অবশ্য অনুভূতিরা ফিরে আসতে শুরু করে । তারেক টের পায় উপরের মাড়ির দুটো ভাঙ্গা দাঁতের অস্তিত্ব । জিভ নাড়তেই সে দাঁতগুলো পড়ল কংক্রিটের শক্ত মেঝেতে । ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে একাকার হয়ে যায় মুখে । সে রক্তমাখা মুখে মাকে ডেকে আর্ত-চিৎকার করে উঠে নিজের অজান্তেই ।
তার চোখ বাঁধা হল ।
বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত করল তার মুখ ।
থ্যাতলানো ঠোঁটজোড়া লালা-রক্তে একাকার হল,
জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙ্গা দাঁত ঝরে পড়ল কংক্রিটে ।
“মা...মাগো” চেঁচিয়ে উঠল সে ।
চোখের উপর কালো কাপড়ের বাঁধনটাও অনেকক্ষণ হল, ওরা লাগিয়ে দিয়ে গেছে । তারেককে সেই একইরকম পিছমোড়া করে আটকে রাখা হয়েছে । চোখ খোলা আর বন্ধ করার মধ্যে তেমন পার্থক্য হবে না, এতোটাই ঘোর অন্ধকার,অমানিশা । চোয়ালের ব্যথাটা সইয়ে এসেছে, তবে মাথায় চিনচিনে ব্যথা করছে । খুব ছোট্ট একটা পোকা যেন মগজের ভেতরে কিলবিল করে হেঁটে বেড়াচ্ছে ।
পরিচিত বুটের শব্দ শুনতে পাচ্ছে তারেক, আবার । সাথে কখনো উঁচু, কখনো নিচু স্বরে কথোপকথন । তারেকের কাছে এসে ওদের উঁচু স্বরের কথাবার্তাই বেশী শোনা গেল । হয়তো খিস্তি-খেউর করে উঠছে ওরা, তারেকসহ সকল ‘গাদ্দার,কাফের’ বাঙালীদের প্রতি ।
তারেকের চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হল । আলোক-সংবেদনশীল অপটারী স্নায়ুতন্ত্রের সাথে এই ঘোর অন্ধকারের সহাবস্থানে পৌঁছার আগেই প্রচণ্ড শক্তিশালী বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে উঠলো ওর ঠিক মাথার উপরেই । তারেকের মনে হল যেন, আস্ত সূর্যটাই কেউ চোখের সামনে মেলে ধরেছে । চোখ মুদে ফেলে সে । ইন্টারোগেশনটা শুরু হতে যাচ্ছে এবার ।
ওরা তারেককে জিজ্ঞেস করে নাম-ধাম,ঠিকানা। তারেক উত্তর দেয় । ওদের ঠিক মনঃপুত হয়না কিনা কে জানে! আবারও সেই একই প্রশ্ন করতে থাকে । একসময় জিজ্ঞেস করে দু’দিন আগে ফার্মগেটের অপারেশনের সময় সে কোথায় ছিল । তারেক উত্তর দেয়, সে কিছু জানে না ।
পশ্চিমের নরপশুরা তাদের দেশে তামাকজাত দ্রব্যের মধ্যে ঠিক কি কি খায়,সে ব্যাপারে তারেকের কোনো ধারণা ছিল না । তবে এখন সে দেখল এই বাংলাতেই বানানো ৫৫৫ সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ইন্টারোগেশনের অফিসারটিকে, নিজের ঠোঁটে ধরে আগুণ জ্বালাতে । তারেকের নিকোটিনের তৃষ্ণা পেয়ে যায় । কিন্তু এরকম অবস্থায় যেখানে বেঁচে থাকা নিয়েই ঘোর সন্দেহ, সেখানে সিগারেটের আশা করাটা একেবারে শিশুসুলভ কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয় । তারেকের ভাবনার সত্যতার প্রমাণ পেতে খুব বেশী সময় লাগল না । ওর বুকের উপর চেপে ধরা হল আধ-খাওয়া সিগারেটটি । প্রথমে বিন্দু, তারপর বৃত্তাকারে । স্পর্শ করানো হল তারেকের দেহের নানা অংশে । ফোস্কা পড়তে তেমন সময় লাগল না । দাঁতে দাঁতে চেপে সে সহ্য করতে লাগল এই নরক-যন্ত্রণা । আরেকজন এসে বা-পায়ে সর্বশক্তি দিয়ে লাথি মারল তারেকের বুকে । ব্যথায় ধনুকের মত প্রশস্ত হয়ে বেঁকে যায় তার দেহ । দুর্বল তারেক, চিৎকার করার মত শক্তিটুকুও পায় না ।
পাঁচশো পঞ্চান্ন মার্কা আধ-খাওয়া একটি সিগারেট প্রথম স্পর্শ করলো তার বুক । পোড়া মাংসের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল ঘরের বাতাসে ।
জ্বলন্ত সিগারেটের স্পর্শ তার দেহে টসটসে আঙ্গুরের মত ফোস্কা তুলতে লাগল ।
দ্বিতীয় লাথিতে ধনুকের মত বাঁকা হয়ে গেল তার দেহ,
এবার সে চিৎকার করতে পারলো না ।
ক’টা বাজে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না । এখন কি দিন না রাত সেটাও ঠাওর করা যাচ্ছে না । বুকের পোড়া মাংসের উপরের চামড়ার অংশটুকু শুকিয়ে গেছে । তবে চিনচিনে ব্যথাটা এখনও আছে । সবকিছু ছাপিয়ে মাথাব্যথাটা অসহ্য হয়ে উঠছে । তারেকের কাছে মাথাটা এতো ভারী মনে হচ্ছে যেন, যেকোনো মুহূর্তে ছিঁড়ে পরে যাবে ।
পাকিস্তানী রক্তপিশাচগুলোর কোনো তাড়া নেই অবশ্য । তারা ধীরে ধীরে টর্চার করেই তারেকের কাছ থেকে তথ্য আদায় করে নিতে চাইবে ।
মাথার উপরের বাল্বটা জ্বলে উঠলো আবারও । তারেকের চিবুক লেগে থাকে বুকের সাথে । মাথা তোলে না সে । ইন্টেরেগেশনের অফিসারটি আজও আবার জিজ্ঞেস করে তারেকের নাম-ধাম,পরিচয়,ঠিকানা । টুকে নিতে চায় ফার্মগেট অপারেশনের সাথে তারেকের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী । তারেকের সামনে ঠেলে দেয় এক টুকরো কাগজ । ওকে বলা হয় কাগজে ‘স্টেটমেন্ট’ লিখে দিতে । ক্লান্ত তারেক দুর্বলস্বরে কথা বললেও স্বীকার করে না ফার্মগেট অপারেশনের কথা । স্বীকার করে না তার সাথে মুক্তিবাহিনীর অন্যান্য সদস্যদের কথা । সে কাঁপাকাঁপা হাতে কাগজটিতে লিখে, “আমি কিছু জানি না । আমি ফার্মগেট অপারেশনের সাথে জড়িত নই ।”
তারেককে মারার জন্য হাত নিশপিশ করতে থাকা ছাই রঙের সেমিজ পরা মিলিশিয়ারা এগিয়ে আসে । ঠেলে ফেলে দেয় তারেককে চেয়ার থেকে । তাকে চিত করে তার পেটের উপর চেপে ধরে নির্মম কর্কশ বুটজোড়া । যেন পিষে মেরে ফেলতে চায় তারেককে, আজন্ম ক্ষুধা মিটিয়ে দিতে চায় একেবারে ।
তারেকের দোষ কি ছিল ?
তারেকের দোষ হল, সে দাঁড়িয়েছিল অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে । সে দাঁড়িয়েছিল গণহত্যাকারী কিছু নরপিশাচের বিরুদ্ধে। সে আন্দোলন করেছিল দেশের কোটি কোটি জনগণের অনাহার ও ক্ষুধা মুক্তির দাবিতে ।
তারেকের পাপ ছিল, কারণ সে চেয়েছিল শান্তিতে দুবেলা দুমুঠো ভাত মুখে দিতে ।
তাকে চিৎ করা হল ।
পেটের উপর উঠে এলো দুজোড়া বুট,
কালো ও কর্কশ ।
কারণ সে তার পাকস্থলীর কষ্টের কথা বলেছিল,
বলেছিল অনাহার ও ক্ষুধার কথা ।
তারেকের মুখ দিয়ে দমকে দমকে কাশির সাথে রক্ত বেরুচ্ছে । এতোটা দুর্বল লাগছে যে, নিজের হাত-পা নাড়ানোর মত শক্তি আছে বলেও মনে হচ্ছে না তার । মিলিশিয়া সৈন্যরা আবার তাকে তুলে ধরে বসালো চেয়ারটাতে । তারেকের চোখ মেলে তাকাতেও কষ্ট হচ্ছে ।
তারেকের হাতে কলম গুজে দিয়ে এবার লিখতে বলা হল ওর নাম,পরিচয় । এই পাকিস্তানীগুলোর স্মৃতিশক্তি খারাপ নাকি বারবার একই কাজ করতে বলে তারেককে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে চাচ্ছে, সেটা ও ঠিক বুঝতে পারে না । সে লিখে , “নাম: তারেক হাসান, পিতা: মরহুম: আফজাল হাসান, মাতা:......”
শুধু এই একবারই না...বার বার । অনেক অনেক বার । দিনের পর দিন একই লেখা । এরকম করেই হঠাৎ আবার আরেকদিন এসে ওকে বসানো হয় একই রকম চেয়ারে, সামনে একটা টেবিল, মাথার উপর একশ ওয়াটের বাল্ব পেন্ডুলামের মত ঝুলতে থাকে, এপাশ-ওপাশ । টেবিলের ওপাশে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিতে থাকে কিছু মানুষরূপী সাক্ষাত শয়তান । আর টেবিলের পাশে, তারেকের পিছনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে হায়েনারুপী মিলিশিয়াগুলো, হুকুম তালিমের অপেক্ষায় । ওদের নিষ্ঠুর,নির্দয়,নোংরা হাসি অন্ধকারেও জ্বলে, শিকারি প্রাণীর চোখের মত ।
আজ আবার ফার্মগেটের অপারেশনের কথা জিজ্ঞেস করছে ওরা । ঘুরেফিরে একইরকম প্রশ্ন করছে বারবার। যেমন তারেক মুক্তিযোদ্ধাদের কি কি সাহায্য করেছে, মুক্তিযোদ্ধারা কয়জন ছিল, তাদের অস্ত্রের সরবরাহ কে দেয়,সেগুলো শহরে আসে কীভাবে । এই চারটা প্রশ্নই বারবার জিজ্ঞেস করে,নানাভাবে,নানা ভঙ্গিতে । একেক বার একেক স্বরে । ওরা চায় তারেকের ধৈর্যচ্যুতি হোক । ওরা চায় তারেক বেখেয়ালে বলে ফেলুক গোপন কোন তথ্য । যে প্রশ্নের উত্তর হাজার শারীরিক অত্যাচার করেও পাওয়া যায় না, সে প্রশ্নের জবাব তারা পেতে চাইছে মানসিক অত্যাচার করে । তারেক তবু মেজাজ ধরে রাখে । সে সেদিনের ব্যাখ্যা দেয় নিজের মত করে। স্টেটমেন্টে লিখে, “সেদিন ছিল শুক্রবার । সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আমি বেরিয়েছিলাম কাঁচা বাজারের উদ্দেশ্যে । সেসময় প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই । জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাই রাস্তায়...”
ইন্টারোগেশন অফিসারটির এরকম লেখা পছন্দ হয় না । সে ছিঁড়ে ফেলে কাগজটা । আবার লিখতে বলা হয় তারেককে । তারেক লিখে । আবার ছেঁড়া হয় কাগজ । তারেক আবার লিখে । এরকম চলতেই থাকে । তারেকের মনে ক্ষীণ একটা আশা, যদি বারবার একইরকম লেখা লিখে যায়, তবে হয়তো ওদের সন্দেহ কেটেও যেতে পারে।
বাইরে থেকে কেউ একজন এসে চিরকুটে লেখা একটা কাগজ দিয়ে যায় ইন্টারোগেশন অফিসারের হাতে । অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা চার জন মিলিশিয়া সদস্যের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় অফিসারটি । অন্ধকার ফুঁড়ে তারা বেরিয়ে এসে দাঁড়ায় তারেকের সামনে । আরেক দফা টর্চারের অপেক্ষায় তারেক চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে হায়েনাগুলোর দিকে ।
মোট জনসংখ্যার ৫৪ ভাগ এই বাংলার লোক হলেও পশ্চিম পাকিস্তানীরা দেয়নি এদেশের মানুষদের প্রাপ্য মর্যাদা বা অর্থনৈতিকভাবে তাদের কোনো সম্মানজনক স্থান। এই বাংলার মানুষদের চেয়ে শতকরা ৬১ ভাগ বেশী মাথাপিছু আয় নিয়ে ওরা দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল এদেশের মানুষদের । এই বাংলা থেকে উৎপন্ন পাট,চা রপ্তানি করে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীরা নিজেরা সমৃদ্ধ হয়েছে । বাংলার কৃষকদের কষ্টার্জিত উপার্জন দিয়ে ওরা কিনেছে অত্যাধুনিক অস্ত্র, কিনেছে দামী সামরিক পোশাক, কিনেছে এদেশের নিরীহ মানুষদের হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠার জন্য । আর এই বাংলার কোটি কোটি তারেকের, অনেকের কাছেই থাকত না ন্যূনতম সভ্য বস্ত্রটুকুও । তারেক তাদের কথা বলত । তারেক সেই অসম অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল । হয়তো সেকারণেই এবার মিলিশিয়ারা টেনে ছিঁড়ে ফেলল ওর বহু কষ্টে জমানো টাকায় কেনা শার্ট । অশ্রাব্য গালি দিতে দিতে ওরা খুলে ফেলল তারেকের প্যান্ট । সে এখন সম্পূর্ণ বিবস্ত্র । তারেককে সেই অবস্থায় উলটো করে ঝুলিয়ে রাখা হল ঘরটির এক পার্শ্বে। হয়তো অত্যাচারের নতুন কোনো পদ্ধতি খুঁজে পেয়েছে ঐ নরপশুরা...
সে তার বস্ত্রহীনতার কথা বলেছিল-
বুঝি সে কারণে
ফর ফর করে টেনে ছিঁড়ে নেয়া হল তার শার্ট ।
প্যান্ট খোলা হল । সে এখন বিবস্ত্র, বীভৎস ।
উলটো করে ঝুলিয়ে রাখলে নাকে-মুখে রক্ত চলে না আসার একটা ব্যায়াম আছে, ‘হেডস্ট্যাণ্ড’ নাম । মাথা নিচে করে পা উপরে দিয়ে রাখতে হয়,প্রতিদিন ঘন্টাখানেক । তারেক শখের বশে এরকম ব্যায়াম করেছিল কয়েকদিন । সেটা কাজে দিচ্ছে এখন, নাকে-মুখে রক্ত বের হচ্ছে না। তারেককে এখনো এ অবস্থায় টর্চার করা হয়নি,যেটা সচরাচর অন্যান্য বন্দীদের উপর করা হয় ।
তবে এ স্বস্তি টিকলো না বেশীক্ষণ । তারেককে নামিয়ে আনা হল কয়েক ঘণ্টা পড়েই । আবারও তারেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু হল । একই প্রশ্ন অনেকবার করে। স্বীকারোক্তিমূলক স্টেটমেন্ট লিখতে বলা হল । তারেক লিখে সেই আগের মত একই লেখা “সেদিন ছিল শুক্রবার । সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আমি...”
তারেকের চুল ধরে টেনে সজোরে মাথাটা নামিয়ে আনা হল টেবিলের উপরে । শক্তিশালী সে আঘাতে কপাল কেটে রক্ত বের হয় মুহূর্তেই ।
তারেকের মাথার পেছনের চুল টেনে ধরে পাক আর্মির অফিসারটি উর্দুতে যা বলল, তার বাংলা করলে কথাটা দাঁড়ায়, “যে হাত দিয়ে তোরা মুসলিম পাকিস্তানীদের মেরেছিস, সে হাতগুলোই তাহলে কুরবানি দে ।”
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তারেক, উনসত্তরের আন্দোলনে মিছিলের সামনে থেকে স্লোগান দিয়েছে দৃপ্তকণ্ঠে । রাতের পর রাত জেগে পোস্টার লাগিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ ঢাকার নানা প্রান্তে । অত্যাচারী পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহবানে লেখা বিপ্লবী লেখা সম্বলিত লিফলেট বিতরণ করেছে নিজ হাতে । পোড়-খাওয়া,বহু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সে হাত দুটো তারেকের ...
গায়ের যতটুকু জোর ছিল তা দিয়ে প্রচণ্ড আক্রোশে তারেকের হাতের উপর ভারী লোহার হাতুড়ি দিয়ে পেটাতে লাগল সে লম্বা-চওড়া মিলিশিয়ার হায়েনাগুলো । তারেকের মুখ দিয়ে ভেসে আসা প্রবল আর্ত-চিৎকার ভেঙ্গে দেয় মধ্যরাতের সুনসান নীরবতাকে । প্রকৃতিও আজ শোকে মুহ্যমান, স্থবির ।
তার দুটো হাত-
মুষ্টিবদ্ধ যে-হাত মিছিলে পতাকার মত উড়েছে সক্রোধে,
যে-হাতে সে পোস্টার সেঁটেছে, বিলিয়েছে লিফলেট,
লোহার হাতুড়ি দিয়ে সে হাত ভাঙা হল ।
সেই জীবন্ত হাত, জীবন্ত মানুষের হাত ।
মা’র কথা মনে পড়ছে খুব তারেকের । যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, মা’র সাথে দেখা করে এসেছিল গত সপ্তাহেই । মা’কে সে জানাতে পারেনি তার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার কথা । শুধু মা’র চোখ মুছে বলেছিল “বিজয় আসবেই মা, এই কষ্টের সুফল আসবেই ।” ছোট ভাইটিকে জড়িয়ে ধরে সেবারই শেষবারের মত আদর করা ।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে,টি এস সিতে, হলের বারান্দায় বসে তারেকরা শপথ নিত সাম্যের । স্বাধীন দেশ গড়ার অঙ্গীকার । দীক্ষা নিত অত্যাচারী শাসকদের হাত থেকে দেশ রক্ষার । হাতে হাত রেখে গাইত রক্তে শিহরণ তোলা নানা সংগ্রামী গান । তারা ছিল স্বপ্নবাজ তরুণের দল ।
রসায়ন বিভাগের শারমিন ছিল তারেকের ভালোবাসার মানবী । শারমিনের সাথেও শেষবার দেখা হয়েছিল চব্বিশে মার্চ, তারপর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি । হয়তো আর কখনোই দেখা হবে না ।
মাথা নাড়তেই আবারো এগিয়ে আসে সেই ভীমদর্শন ঘাতকটি । এবার মুখে ক্রূর হাসি, হাতে লোহার সাঁড়াশী । আজন্ম সাহসের সাথে লড়াই করে যাওয়া তারেকের সে হাতগুলোর প্রায় পিষে ফেলা আঙ্গুল থেকে উপড়ে নিতে থাকল নখগুলো । আরো একবার প্রচণ্ড চিৎকারে প্রকম্পিত হল পুরো ক্যাম্প । ফিনকি দিয়ে বের হতে লাগল গাঢ় লাল রক্ত । সে রক্তে ভেসে গেল টেবিলটা, জয়ের শরীরের উপরিভাগ, ঘাতকের হাত...আশপাশের সব । হয়তো ছিটেফোঁটা লেগেছিল খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাক আর্মি অফিসারটির শার্টের একটা কোণে । লাখো খুনে রাঙ্গা যাদের ইউনিফর্ম ।
তার দশটি আঙুল-
যে-আঙুলে ছুঁইয়েছে সে তার মা’র মুখ, ভাই এর শরীর, প্রেয়সীর চিবুকের তিল ।
যে- আঙুলে ছুঁয়েছে সে সাম্যমন্ত্রে দীক্ষিত সাথীর হাত,
স্বপ্নবান হাতিয়ার,
বাটখারা দিয়ে সে-আঙুল পেষা হল । সেই জীবন্ত আঙুল, মানুষের জীবন্ত উপমা ।
লোহার সাঁড়াশী দিয়ে একটা-একটা করে উপড়ে নেয়া হল তার নির্দোষ নখগুলো ।
কী চমৎকার লাল রঙের রক্ত !
তারেকের হাত থেকে বেরিয়ে আসা সে রক্তের ক্ষীণ স্রোত,ভেজা, চুপচুপে করে দেয় চারপাশ । তার পড়ে থাকা দেহ ঘিরে রয়েছে টকটকে তাজা লাল রক্ত । চারপাশে শুধু লাল আর লাল । একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকলে মাথায় কেমন যেন ঝিম ধরে যায় । রক্ত বুঝি এতোটা লাল হয় ?
তারেক কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায় । ফ্ল্যাশব্যাকের মত ওর মনে পড়তে থাকে নানা স্মৃতি । পঁচিশে মার্চের প্রচণ্ড গোলাগুলি শুনে হল ছেড়ে দূরে আত্মগোপন। পরদিন শহরজুড়ে লাশ আর ধ্বংসস্তূপের ছবি। ক্যান্টিনের সাত-আট বছর বয়েসী মালেকের লাশ দেখে তারেকের কেঁদে ফেলা; এই বাচ্চাটা ওদের সাথে মিছিলে যেত প্রতিদিন। তারপর বর্ডার পাড়ি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ। ক্যাম্পে সবাই একসাথে বসে রেডিওতে স্বাধীন বাংলার বেতারের গান শোনা। চরমপত্র শুনে হেসে ফেলা। ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে গাইতে সবাই মিলে কেঁদে ফেলা ।
“মা তোর বদনখানি মলিন হলে,
আমি নয়ন, ওমা আমি নয়ন জলে ভাসি,
সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।”
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলেই তারেক বরণ করে নেয় মৃত্যুকে । হাতের থ্যাতলানো সে মাংস পিণ্ড থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত, জমা হয় মেঝেতে । গাঢ় লাল রক্ত, একসময় হয়তো কালশিটে হয়ে যাবে সেখানটাতেই । তারপর মুছে যাবে মাটির আবরণে, যেমন করে মুছে যায় কিছু কিছু ইতিহাস সময়ের আস্তরণে ।
কিন্তু তারেকদের এ রক্তের ঋণ এদেশ কখনো ভুলবে না ।তারেকদের দেখিয়ে যাওয়া চেতনা এদেশ ধারণ করবে সবসময় । এই চেতনা কখনো মরবে না । ফিনিক্স পাখির মত ছাইয়ের স্তূপ থেকে এর জন্ম হবে বারেবারে ।
তারেকের থ্যাতলানো হাত থেকে ঝরে পড়া সে রক্ত, জমাট বাঁধছে এদেশের মানচিত্রের ওপর,এদেশের পতাকার ওপর, এদেশের অস্তিত্বের ওপর । স্বাধীন বাংলাদেশের উপর ।
সে এখন মৃত ।
তার শরীর ঘিরে থাকা কৃষ্ণচূড়ার মত ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত, তাজা লাল রক্ত ।
তার থ্যাতলানো একখানা হাত
পড়ে আছে এদেশের মানচিত্রের ওপর,
আর সে হাত থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের দুর্বিনীত লাভা ।
সমাপ্ত