আমার বামহাতটা কব্জির নীচ থেকে উড়ে গিয়েছিলো
দু দুটো বুলেটের আঘাতে পায়ের উরুতে অঙ্কিত হয়েছিল দুটো গভীর ক্ষতচিহ্ন --
দীর্ঘদিন অনাহারে ছিলাম বলে খুব বেশি রক্ত ঝরতে পারেনি ,
অথবা ঝরলেও আমি তা বুঝতে পারিনি;
অর্ধমৃত অবস্হায় সঙ্গাহীন পড়ে ছিলাম তিনদিন ........
অত:পর তিনদিন পর যখন জ্ঞান ফিরে আসে --
তখন বামহাতের কব্জির নীচের অংশটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষন .......
আমার একবিন্দু আফসোস হয়নি , অনিরুদ্ধ বাষ্পে চোখের কোনাও ভিজে উঠেনি ............
বরং জানোয়ারের বাচ্চাগুলোর প্রতি এক দুর্নিবার ক্রোধে বুকের ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিলো ........
ক্যাম্পে পর্যাপ্ত খাবার থাকতোনা বলে প্রায়ই না খেয়ে থাকতাম,
কখনো কখনো ক্ষুধার জ্বালা অসহ্য হয়ে উঠতো ।
তখন একটুকরো মাংসের জন্য নির্মম আকাশে উড়তে থাকা শকুনগুলোর সাথে নিজের কোন পার্থক্য খুজেঁ পেতাম না ..........
তখনও আমার তেমন একটা কষ্ট হয়নি ,
চোখদুটোও বরাবরের মতোই শুকনো ছিলো ..........
যেমন শুকনো ছিলো আমাদের ভবিষ্যত ............ ।
সবকিছু প্রায় গুছিয়ে এনেছিলাম
বর্ডার ক্রস করে নতুন একটা দল আগামীকাল এসে পৌছুবে --
সাথে নিয়ে আসবে সারি সারি আগ্নেয়াস্ত্র, তাজা গোখরো সাপের মতো বিষাক্ত গ্রেনেড ......মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের মতো দুর্বার সিক্সটি মিলিমিটার মর্টার .............. ।
প্রতিশোধের স্পৃহায় সারারাত আমার ঘুম হয়নি ..........
পশ্চিমা বাহিনীর পরাজয়ের স্বপ্নে চোখদুটো আমার অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করে উঠেছিল ..........
কিন্তু ভোরে যখন খবর পেলাম কয়েকটা বিশ্বাসঘাতকের জন্য............
মাত্র কয়েকটা বিশ্বাসঘাতকের জন্য নতুন দলটা ধরা পড়ে গেছে তখনও খুব একটা অবাক হইনি ........
শুধু প্রচন্ড ক্রোধে আমার ডান হাতের একমাত্র মুষ্ঠিটা বজ্রের মতো শক্ত হয়ে উঠেছিলো .........
তারপর কয়েকটা দিন যেন দু:স্বপ্নের মতো পার হয়ে গেল'
দুদিন পর আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম হানাদার ক্যাম্পে
বেয়নেট দিয়ে খুচিঁয়ে ওরা আমার ডান চোখটা তুলে নিয়েছিলো
পায়ের আঙুলগুলো রাইফেলের বাঁটের আঘাতে থেঁতলে গিয়েছিলো বহু আগেই ........
ওরা আমাকে কষ্টের শেষ সীমানায় পৌছেঁ দিয়েছিলো যদিও ---
আমি তখনও কাদিঁনি ......... ............ ।
শুধু সামনে দাড়ানো শান্তিবাহিনীর লিডার শরাফত আলীকে দেখে ঘৃনায় আমার চোখের নীচটা দ্বিতীয়বারের মতো কুচকে উঠেছিলো ... ....
আমায় দেখে শরাফত দেতো হাসি দিয়ে শূকরের মতো চারপায়ে এগিয়ে আসে ---
''.............. খুব তো খেল দেখাইলা মুক্তির বাচ্চা !! বামহাতটা দেখি উড়াইয়া দিছে , চোখটাও তুইলা ফালাইছে ........ তোমার পরীবানু অবশ্য এতোটা কষ্ট পায় নাই , দুই রাইত স্যারের লগে কাটাইয়াই গলায় দড়ি দিছে ......... ........ ''
........... পরীবানু !! !!! .........তবে কী ওরা পরীকে ....... !!!!!! ????
আমি আর বাকিটুকু শুনতে পেলাম না ...... ....
----দীর্ঘ চারমাসের একটানা ক্লান্তিহীন যুদ্ধ ,
আহত সহযোদ্ধার আর্তনাদ !!
গ্রামকে গ্রাম উজাড় করা বধ্যভূমি,
বধ্যভূমিতে গলিত লাশের গন্ধ .......
বেয়নেটের আঘাতে থেতলে যাওয়া চোখ ------
এসব সবকিছু ছাপিয়ে আমার মুখের সামনে পরীর নিস্পাপ চেহারাটা ভেসে উঠে ........
তখন প্রথমবারের মতো ........ ......হ্যাঁ , প্রথমবারের মতো আমার একটিমাত্র চোখ বেয়ে টুপটাপ করে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে ......
আর আমি কব্জিহীন হাতটা দিয়ে সেই জল মোছার চেষ্টা করি , বারবার ---
বারবার ............. বারবার .....................
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০০৮ সকাল ৭:০৬