
গুজব আছে, আঁন্দ্রে রুবেলভ তারকোভস্কি পরিচালিত এগারোটি ছবির মাঝে সবচেয়ে সহজবোধ্য চলচ্চিত্র ছিল The Mirror (১৯৭৫)। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই অসংখ্য আশাহত দর্শক স্বনামে-বেনামে চিঠি লিখে ছবিটি সম্পর্কে তাদের ক্ষোভের কথা তারকোভস্কিকে জানান। সবারই সমস্যা এক, কেউ তারা ছবিটি বুঝতে পারেননি। লেনিনগ্রাদের এক বাবুর্চি তারকোভস্কিকে পরামর্শ দেন, দয়া করে তিনি যেন কাট্, এডিট, জুম এসব প্রাথমিক ব্যাপার শিখে চলচ্চিত্র বানাতে আসেন। দমে যাননি আঁন্দ্রে তারকোভস্কি। ইতিহাস বলে, দ্বিগুণ উৎসাহে ফিল্মি নিরীক্ষা বাড়িয়ে তুলেছিলেন তিনি।
কাঠামোতে হাত দিলে বিপদ বিবিধ। শুধু রক্ত মাংস নিয়ে নাড়াচাড়া করার যত না বিপত্তি তার চেয়ে হাজার গুণ বিপত্তি ভিতরের কংকালটা ধরে টান দেবার। গ্রিফিথ [The Birth of a Nation, (১৯১৫)] পরবর্তীকালে চলচ্চিত্র প্রধানত দুটি ধারায় বিকাশ লাভ করেছিল। একটি আইজেনস্টাইন [Battleship Potymkin, (১৯২৫)] উদ্ভাবিত মন্তাজ সম্পাদনা পদ্ধতি, অপরটি স্ট্রহাইম [Greed, (১৯২৪)], ওয়ালেস [Citizen Kene, (১৯৪১)] ও রেঁনোয়া [The Grand Illusion , (১৯৩৭)] চালিত মিজঁসিয়েন (Mise-en-scene) বা অখণ্ড দৃশ্য পর্যায় পদ্ধতি। তারকোভস্কি কিন্তু মন্তাজ ও মিজঁসিয়েন এই দুই প্রচলিতের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। গল্পের প্লটকে তিনি বর্ণনা করেছেন বহুস্তরে, অনেক ক্ষেত্রে কালচেতনাকে অস্বীকার করে সাদৃশ্যহীন দৃশ্য পরম্পরার মাধ্যমে। তারকোভস্কি পরবর্তী ফিল্মের ইতিহাস অনেকটা কাঠামো নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষার ইতিহাস। এদের কেউ ‘স্পেস’ ভেঙেছেন, কেউ সম্পাদনা রীতি পাল্টেছেন, কেউ ক্যামেরাকে করে তুলেছেন বিভঙ্গময়। বর্তমান সময়ের যে কজন পরিচালক চলচ্চিত্র শিল্পের একেবারে আঁতুড় ঘরে বসে পরীক্ষা চালাচ্ছেন তাদের একজন লারস্ ভন ট্রিয়ার (Lars Von Trier)। তার কথা আজকাল চলচ্চিত্রপ্রেমী থেকে শুরু করে ছবি সমালোচনার রাঘব-বোয়ালেরা একটু আলাদা করে ভাবছেন। কারণ গত দেড় দশকে তার মত কেউই চলচ্চিত্রের মূল ভিত্তিগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ছবি তৈরির চেষ্টা করেননি। তার চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত Dogville ছবিটি বিশেষ আলোচনার যোগ্য।
ডগভিল (Dogville) ছবিতে, ঘটনার সূত্রপাত আমেরিকার একটি পরিত্যক্ত খনি শহর ডগভিল-কে কেন্দ্র করে। সময়কাল এই শতাব্দীর ত্রিশের দশকের মহামন্দার বছরগুলো। এক সময় শহরটি গড়ে উঠেছিল রূপার খনিকে কেন্দ্র করে। আরিজোনা, ভার্জিনিয়া ও ক্যালিফোর্নিয়ার মত জনবিরল ঊষর মরুভূমিগুলোতে কিছুদিন আগেও ছিল সোনা, রূপা এবং তেলের রমরমা ব্যবসা। খনি বাণিজ্যকে ভিত্তি করে অনুর্বর, পাথুরে জমিতে লোকালয় থেকে শতশত মাইল দূরে গজিয়ে উঠত এক একটি শহর। প্রথম মহাযুদ্ধের ধাক্কায় সমস্ত পৃথিবী জুড়ে যখন মন্দা ঘনিয়ে আসে তখন একের পর এক বন্ধ হতে থাকে খনিগুলো। ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৪০ সাল। আমেরিকার অর্থনীতি প্রবেশ করে এক তীব্র স্থবিরতায়। খনি ও খনিকেন্দ্রিক বাণিজ্যগুলো বন্ধ হয়ে আসে কিন্তু মরা খনির পাশে একদা মুখর, চঞ্চল শহরগুলো মুমূর্ষু অবস্থায় বেঁচে থাকে। এমনই একটি শহরের বাসিন্দা টম জুনিয়র (Paul Bettany)। তার পিতা সাবেক চিকিৎসক এবং পিতার সরকারি অবসরভাতায় বেশ ভালই চলে তাদের সংসার। অন্তত শহরে তারাই সবচেয়ে সচ্ছল পরিবার। টম একজন স্বঘোষিত চিন্তাবিদ। নিজেকে নিয়ে এক ধরনের মহান দিবাস্বপ্নে কাটে তার অহোরাত্রি। টমের নিশ্চিত অনুমান ভবিষ্যতে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে মহান লেখকের স্বীকৃতি। যদিও অদ্যাবধি কিছুই লেখেনি সে এবং এখনো তার লেখনীর বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিশ্চিত নয়—তবুও স্বপ্নবাজ সে। ডগভিলে টমের সময় কাটে এক ধরনের উদ্দাম কল্পনায় যেখানে সে নিজেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ক্লাসিক ও রোমান্টিক যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ লিখিয়েদের নাতিদীর্ঘ সারিতে। এই কল্পনা তার মনে পুলক জাগায়। খানিকটা দার্শনিকতাও রপ্ত করেছে টম বইপত্তর ঘেঁটে। তার এই আধা-দার্শনিক, আধা-রোমান্টিক মনটি প্রায়শই নিয়োজিত থাকে শহরের অন্যান্য মানুষগুলোর কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণে। দার্শনিকসুলভ দূরত্বে দাঁড়িয়ে টম শহরবাসীদের সাথে আন্তরিক হবার চেষ্টা করে। মনের এই কল্পনাবিলাস, কেতাবি ঢংয়ের বাক্যালাপ ও প্রবল দার্শনিকতাপূর্ণ পরামর্শ ডগভিলবাসীরা কতটা গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করে, সেটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ সমস্ত ডগভিল ও তার মানুষগুলোকে সে লেখনীর ও দর্শনচর্চার গিনিপিগ হিসেবে বেছে নিয়েছে। একজন চিন্তাশীল লেখক সে, প্রজ্ঞায় ও মননে মানবশ্রেষ্ঠদের অন্তর্গত এই ভাবনায় তাড়িত হয়ে নিজেকে সাধারণ মানুষের কাতারে ফেলতে নারাজ টম। টমের দৃঢ় ধারণা, মহামন্দার এই তীব্রতায় শহরবাসীরা অন্তত তাদের মনুষ্যত্ব হারায়নি। অভাব, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে নিজেদের ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে, প্রতি রবিবার চার্চের সমাবেশে এই থাকে তার কথা বলার বিষয়বস্তু। কিন্তু মনের পাতালে যুক্তি ও ধর্মবোধের অন্তহীন ঠোকাঠুকি, টমের দর্শনকে নিজের কাছেই পরিষ্কার হতে দেয় না। ফলে মনে মনে সে প্রার্থনা করে একটি সুযোগের। যে সুযোগের মাধ্যমে সে পরীক্ষা চালাবে ডগভিলবাসীদের ওপর এবং নিজস্ব দর্শনকে পরিষ্কার করে তুলবে নিজের কাছে। যখন চেতনার এই দোলাচলে দুলছে টম, ঠিক তখনি সুযোগরূপে শহরে পলাতকা গ্রেসের আগমন।