Qingzang railway
''এই রেলপথের সর্বোচ্চ স্টেশন প্রায় সাড়ে ষোলো হাজার ফুট উচ্চতায় থাকাটেংগুলা গিরিবর্ত্ম। এত উঁচুতে উঠলে শ্বাসকষ্ট হতেই পারে। তা যাতে না হয়,সে জন্য পুরো ট্রেনেই প্রেশারাইজড অক্সিজেন রয়েছে।''
Lahsa_station
চলেছি তিব্বতের পথে। ভোট প্রদেশের দিকে। না, অতীশ দীপঙ্কর বা শরৎচন্দ্র দাসের মতো নয়। অতি আধুনিক বিলাসবহুল বেজিং-লাসার ট্রেনে চড়ে। বেজিং-লাসা রেলপথে চলা ট্রেনের পোশাকি নাম প্ল্যাটো ট্রেন বা মালভূমি ট্রেন। হাল্কা ছাই রঙা ট্রেনটির দু’টি শ্রেণি বসার আর দু’টি শ্রেণি শোয়ার। শক্ত গদি হার্ডসিট, নরম গদি সফ্টসিট। শয়ন শ্রেণিতে কুপ রয়েছে। কুপের বাইরে সরু করিডর। করিডরে কাচের জানলা, জানলা বরাবর মুখোমুখি দুটো করে ফোল্ডিং সিট রয়েছে। লাংঝাউ থেকে ট্রেন আস্তে আস্তে উচ্চ ভূমিতে উঠতে শুরু করে। এত উঁচুতে যাতে শ্বাসকষ্ট না হয়, সে জন্য পুরো ট্রেনে প্রেশারাইজড অক্সিজেন রয়েছে। কুয়েনলুন পর্বতমালার বুক চিরে অবিশ্বাস্য এই রেলপথের সর্বোচ্চ স্টেশন ৫০৭০ মিটার বা প্রায় সাড়ে ষোলো হাজার ফুট উচ্চতায় থাকা টেংগুলা গিরিবর্ত্ম।
ট্রেন ছাড়ার বেশ কিছুক্ষণ পরে দূরে দূরে চোখে পড়ে ট্রান্স হিমালয়ের ভূগোল। ভূপ্রকৃতি মালভূমি সদৃশ; গুল্ম আর বৃক্ষশূন্য শুকনো পাহাড়। সে সব পাহাড়ের কত রকমই না রং হলুদ, নীলাভ, বাদামি বা ধূসর আর লাল আভাযুক্ত। সকালে উঠে দেখি মেঘলা আকাশ, তবুও মধ্যে মধ্যে মেঘের আস্তরণ ভেদ করে সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। তাপমাত্রা গড়ে ৩ থেকে ৬ ডিগ্রির মধ্যেই ওঠানামা করছে।
Tibetan Railway Bridge
ভোরের সূর্য কাচের জানলার গায়ে জমে থাকা কুয়াশা গলিয়ে জল করে দিল। ফলে স্পষ্ট দেখা যায় বরফে ঘেরা উঁচু পাহাড়চূড়া আর ঘন নীল আকাশ। বেশিটাই তিব্বতের মালভূমিকে ঘিরে থাকা কুয়েনলুন পর্বতমালার অংশ। রোদ বেশ চড়া হলে দেখলাম তিব্বতি গেজেলের একটা ছোট দল লাফিয়ে লাফিয়ে পালাচ্ছে।
তাদের শিং দু’টি ছোট আর পেটের নীচ ও পিছনের রং সাদা। খুব জোরে ছুটছে। আবার দেখলাম প্রচণ্ড গতিতে ছুটতে থাকা কিয়াং বা বন্য গাধা। ট্রেনে যেতে যেতে কিয়াংদের আরও ছুটে যেতে দেখেছি অনেক বার। যেমন, হাওড়া-ব্যান্ডেল ট্রেনের পাশে ছুটে যায় গরু-ছাগল। চিং-তিব্বত মালভূমিপথে চিং-হাই হ্রদের কাছে রয়েছে চাইনিজ অরিক্স। এ অঞ্চলে আছে মাত্র ৩০০। ফলে খুবই বিপন্ন প্রজাতি। গতিময় এই ছোট প্রজাতিটির গড় ওজন ১৫ কেজি।
পর্বতের গায়ে রোদের ফুলঝুরি। কোথাও কোথাও লাইনের দু’পাশে বরফ জমে আছে। দেখা যাচ্ছে পাথর দিয়ে সাজানো আয়তাকার জল সংরক্ষণ ক্ষেত্র। বৃষ্টি কম হওয়ায় এ ভাবে জল জমিয়ে রাখার ব্যবস্থা। চার দিকে সীমাহীন শীতল মরু প্রান্তর আর কী ভীষণ নির্জন, নিস্তব্ধ, কেউ কোথাও নেই। স্টেশনে ট্রেন থামলে কুয়াশা জমা কাচের জানলা পরিষ্কার করা হচ্ছে। দুপুর সাড়ে বারোটার পরে টুয়ো টুয়ো নদীর পাশ দিয়ে ট্রেন চলে গেল। হিমবাহ থেকেই টুয়ো টুয়োর জন্ম। এটাই আবার পীত নদী বা ইয়োলো রিভারের উৎস।
Qingzang railway map
টেংগুলা পর্বতশ্রেণিতে ঘেরা টেংগুলা পাসের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫০৭০ মিটার। পৃথিবীর সর্বোচ্চ রেল স্টেশন টেংগুলায় নেমে শীতের হিমেল হাওয়া সমস্ত শরীরকে কাঁপিয়ে দেয়। বেশি তাড়াতাড়ি হাঁটলেই শ্বাসকষ্ট হয়। কেবিন অ্যাটেনড্যান্ট মেয়েটির সঙ্গে পৃথিবীর উচ্চতম রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। হুইসেল বাজতেই আবার ট্রেনে উঠে পড়লাম।
বিকেলবেলা ট্রেন এক বিরাট সরোবরের পাশ দিয়ে চলতে থাকল। সরোবরের এ পার ও পার দেখা যায় না। পৃথিবীর সর্বোচ্চ মিষ্টি জলের হ্রদ সো-নার পাশ দিয়ে যাচ্ছি। উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে সতেরো হাজার ফুটেরও বেশি। টলটলে নীল ও পান্না সবুজ রঙের জল বিকেলের পড়ন্ত রোদে চিকচিক করছে। দূরে দেখা যায় বরফাবৃত পাহাড়চূড়া। যখন সরোবরের প্রায় গা ঘেঁষে ট্রেন চলল অনেক রাতে ট্রেন গতি কমিয়ে এই রেলপথের সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে আঠারো হাজার ফুটের গিরিবর্ত্ম ধরে লাসার দিকে এগিয়ে চলল। পর দিন ভোরে পৌঁছলাম তিব্বতের রাজধানী লাসায়। সত্যিই, চিন কী কাণ্ডটাই না করেছে!
ছবি - উইকিপিডিয়া
লিখছেন - অর্পিতা চক্রবর্তী
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১২ বিকাল ৩:২৪