এক.
সন্তর্পণে দরজাটা ফাঁকা করে উঁকি দিলাম- শালা বোধহয় চলে গেছে! আস্তে শব্দ না করে বারান্দা পেরিয়ে উঠানে নামলাম- না, বোধহয় এ কারণে আসে নি। মনের ভেতরে স্বস্তি অনুভব করলাম, পরমুহূর্তে নিজের ওপরই অসম্ভব রাগে ফেটে পড়লাম- হালার আডানা হইসার লাইগ্যা এইরম লুকাইয়া থাকন লাগে!
দুই.
গত ডিসেম্বরে বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে আমরা দলবেঁধে স্কুলে আসি। বেশ কিছুক্ষণ আড্ডাবাজি করার পর শালা আনিস বলে- ল, আসার খাই।
আমি বললাম- না, আমার কাসে টিয়া নাই।
বস্তুত আনিসরে আমি এই কারণে অপছন্দ করতাম। খালি খাওয়া আর খাওয়া। আর এদিকে আমার কাছে একটা ফুটা পয়সাও থাকে না। যা হোক, সবাই মিলে আচারের দোকানে গিয়ে আচার কিনলাম। আটআনা করে প্যাকেট। সেটাও আমার কাছে নাই। আসার সময় মার কাছে চেয়েছিলাম, লাভ হয় নি। বাবার কাছে চাইলে তো আরো হবে না। তোশকের নিচে, মার গীতার পাতার মধ্যে- সবখানেই খুঁজেছি, কোনো লাভ হয় নি। বাধ্য হয়ে ফতুর পকেটে স্কুলে কুচকাওয়াজ দেখতে আসা।
আনিস বলে- ল, ল, আমার থন আসে। কাউল্যা দিয়া দিস।
আমি বললাম- কাউল্যা না, হরশুদিনের হরের দিন।
কারণ পরশুদিনের পরের দিন শুক্রবার, তাতে একটা দিন সময় বেশি পাওয়া যায়।
এর আগে আনিসের কাছ থেকে একবার দুই টাকা নিয়েছিলাম। সেটি ফেরত দেওয়া হয় নি। ব্যাটা ভুলে গেল কিনা কে জানে! ঠিক ওই মুহূর্তে ফজলু বলে উঠল- হেই, তুই না হের থেইক্যা দুই টিয়া নিসিলি, হেইডা দিসস্?
আমি চোখের দৃষ্টিতে ফজলুকে ভস্ম করে দিলাম।
তবে আনিস জানালো- হে দিব দুই টিয়া? হের বাপের জীবনে দুই টিয়া দেকসে? হেইল্লাইগ্যাই তো আমি হের খাতাডা হেইদিন লইয়্যা গেসি গা। দুই টিয়া ধার দিয়া তিন টিয়ার খাতা নিসি।
যেদিন খাতাটি হারিয়েছিলো সেদিন খাতা হারানোর দুঃখে আমি দুপুরে খাই নি। আনিস এই কাজ করেছে শুনে আমার চোখে পানি চলে আসলো। অসম্ভব রাগ হলো বাপ-মার ওপর- আনিইস্যার বাপের মতো টিয়া কামাই করতারে না, আবার বড় বড় কতা কয়! মানুষ অ, মানুষ অ। মানুষের গুস্টি কিলাই। মানুষ অইয়া বাল সিরমু?
তিন.
আচার খাওয়ার লোভটা প্রবল ছিলো। ফলে কিরা কেটে সেদিন আনিসের কাছ থেকে আট আনা পয়সা ধার নিয়ে এক প্যাকেট আচার কিনেছিলাম। কিরা কাটলেও সেটি আর শোধ দেওয়া হয় নি। বাবার কাছে চাইতে পারি নি। মার কাছ থেকেও পাই নি। অনেকে হয়তো ভাবছেন, আট আনা পয়সা পেতে আমার এতো কষ্ট? আমি বলি- হ্যাঁ, ঠিক তাই। ওই সময় আট আনা কেন, ঠিকমতো খেতে পাওয়াটাই যে ভাগ্যের ব্যাপার ছিলো। যে কারণে দুবাই যাওয়ার আগে আনিস যেদিন বাড়িতে দেখা করতে এসেছিলো, সেদিন দরজার আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম। আমি তখন জানতামও না যে আনিস দুবাই চলে যাচ্ছে। সে এসেছিলো বিদায় নিতে, ওই আট আনা পয়সা চাওয়ার জন্য আসে নি।
চার.
আনিসের সাথে আবার দেখা ষোল বছর পর, সেদিন, গুলশানে। দুবাই থেকে এসেছে, বেড়াতে। হঠাৎ পাওয়া জীবনের মতো আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। অনেক গল্প হলো, খাওয়া হলো, বেড়ানো হলো। জরুরি কাজে কোথায় যেন যাচ্ছিলো, আমিও কোথায় যেন কাজেই যাচ্ছিলাম- সব বাদ দিয়ে দুই বন্ধু একসাথে কাটালাম সারাটা দিন। এক পর্যায়ে হাসতে হাসতে সেই আট আনার কাহিনী মনে করিয়ে দিলাম। আনিস সহাস্যে বললো- তুই তাইলে আমার থন আডানা ঋণী। হে হে হে অহন তো তুই চাইলেও ঋণ দিতারতে না। আডানা হইসাই তো দ্যাশে নাই।
আমি হাসতে হাসতে বললাম- অতদিনে সুদ অইসে না। সুদ অইতে অইতে তো আডানা বাইড়া বাইড়া অনেক টিয়া হয়্যা গেসে।
আনিস বললো- হালার পো হালা, আমি কি তরে সুদ হিসাব কইরা টিয়া ধার দিসিলাম নি?
পাঁচ.
আমাদের ছোটবেলাকার ওই পার্থক্যটা অবশ্য রয়েই গেছে। দুজনের পোশাকেই তার প্রমাণ দেখা যাচ্ছে। সেটা আরও বুঝা গেলো আনিসের-আমার, আমাদের কথা, আচরণে। বন্ধুত্বে কোনো ছেদ পড়ে নি, কিন্তু ছোটবেলার বন্ধুত্বে যেমন একটা অর্থনৈতিক দূরত্ব সবসময়ই ছিলো, সেটা বোধহয় এখনো আছে। তিন-চার দিন পর চলে যাবে সে, আর দেখা হবে না, তাই জোর করে আনিসকে নিয়ে গেলাম ওয়েস্টকেস, একটা সুন্দর শার্ট কিনে দিলাম। যাওয়ার আগে আনিস আমাকে একটা মোবাইল সেট কিনে দিতে চেয়েছিলো, আমি নিই নি। বদলে বলেছিলাম- তুই আমারে চা খাওয়া, চায়ের লাহান জিনিস এই দুইন্যাত আর নাই। বালা কইরা একটা চা খাওয়াইলেই অইবো।
আনিস প্রত্যুত্তরে বলেছিলো- ল ব্যাডা, চা খাওয়ামুনে। তার আগে কিছু একটা কিন। ওইডা লইয়্যা আর খোডা দিমু না। কিরা কইলাম। পারলে আডানা দিয়া দিস। হে হে হে...
ছয়.
আমাদের মধ্যকার আট আনার পার্থক্যটা কি আসলেই রয়ে গেছে এখনও? হয়তো। মাঝে মাঝে এসব পার্থক্য ভেঙেচুরে দিতে ইচ্ছে করে; মাঝে মাঝে ভাবি- কী হবে! মানুষের ভেদাভেদ সব জায়গায়ই। ছোট্ট এইটুকু পার্থক্য আমাদের না হয় থাকলই। এই পৃথিবীই যেখানে পার্থক্যের পূজারী, সেখানে এই চাওয়াতে কার আর কী আসে যায়!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ১২:৩৭