somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবনে একটি বুক রিভিউ লিখেছিলাম, সেই গল্প বলি আপনাদের...

১২ ই মে, ২০০৯ রাত ১১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করেছিলাম বেশ কিছুদিন। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার মৃদুভাষণ পত্রিকায়। নির্বাহী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকার যথারীতি সম্পাদকীয় পদের প্রতি সুবিচার করে দিনের অধিকাংশ সময় গম্ভীর থাকেন। কেবল বিশেষ কিছু বন্ধুবান্ধব আসলে তাকে কিছুটা তরল অবস্থায় পাওয়া যায়। সোভিয়েতস্কি কৌতুকভ থেকে সবার জানা কৌতুকগুলো তখন বের হয় তার মুখ থেকে। সেরকমই একটি তরল অবস্থায় তাকে মনের বাসনা জানাতেই তিনি আমাকে সাপ্তাহিকটিতে লেখালেখির সুযোগ করে দেন।

নির্বাহী সম্পাদক ভদ্রলোকটিকে আমি বিভিন্ন কারণেই পছন্দ করতাম। এর প্রধানতম কারণটি হচ্ছে, আমি ছাইপাশ যা-ই লিখতাম না কেন, তিনি কোনো কাটাকুটি করতেন না। বলতেন, ‘আপনি যা লিখেছেন, সেটাই আপনার স্টাইল। আমি সেখানে কলম ধরতে যাবো কেন?’ ফলে সুযোগ পেয়ে যখন যা ইচ্ছা সেটা লিখে গেছি দিনের পর দিন। কেবল পত্রিকাটি ছাপা হলে তিনি আমাকে ডেকে বলতেন, 'কী বিষয়ে লিখেছেন সেটা বুঝতে পারছি। দশ বাক্যের অনুচ্ছেদকে আপনি ২০০ বাক্যের রচনা বানিয়েছেন। আর ভিতরে তিনটা বানান ভুল আছে।'

এই নির্বাহী সম্পাদক ভদ্রলোকই একদিন আমাকে ডেকে বললেন একটা বই পর্যালোচনা করতে। আমি সাফ জানিয়ে দিলাম- 'আমি এই লাইনের পাবলিক না।' তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন- ‘আরে আগে বইটা পড়েন তো! ভালো লাগলে রিভিউ লিখেন, নাইলে লেখার দরকার নাই। আরেকজনকে দিয়ে লেখাবো’।

আমি অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বইটির দিকে তাকালাম। শুরুতেই বইয়ের নামটি আমার পছন্দ হলো না। কবি মাহবুব লীলেনের ভাষায় মনে হলো এটি আসলে পুতুপুতু প্রেমের গল্পের বই হবে। তার ওপর লেখক চেনাজানা কেউ নন; সময়টাই নষ্ট হবে। কিরা কেটে বলছি, সে সময় মাহবুব লীলেনের সাথে পরিচয় থাকলে পকেটের পয়সা খরচ করে হলেও তাঁকে দিয়েই রিভিউটি করাতাম। কারণ তিনি পুতুপুতু প্রেমের গল্প পড়তে পছন্দ করেন।

যা হোক, তখন থাকতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। রাতে খানাপিনার পর বইটা নিয়ে বসলাম। লেখক যতো খারাপই লিখুক, আমি রিভিউটা লিখলে অন্তত দুটা পয়সা পাওয়া যাবে; অবশ্য না পড়ে লিখে দিলেও কেউ বুঝবে না যে পড়িনি, কিন্তু হারাম-হালাল বলে যে দুটো শব্দ অভিধানে পাওয়া যায়, সেগুলোও পরকালে সাক্ষ্য দিতে পারে। তাই ভাবলাম, পড়ে একটা কিছু লিখে দিই।

বইটি উল্টিয়ে পড়া শুরু করলাম। উল্টিয়ে মানে একদম শেষ প্রচ্ছদটি আগে দেখে তারপর মূল প্রচ্ছদ থেকে চোখ বুলানো শুরু করলাম। বইয়ের নাম রোজনামচা ঃ ভালোবাসা, লেখক আফসানা কিশোয়ার লোচন।

প্রেম জিনিসটার ওপর আমি এমনিতেই বিরক্ত। তার ওপর প্রেমের বইগুলো আরো বিরক্তিকর। তবে চরিত্রদোষের কারণে প্রেমিক-প্রেমিকার কথোপকথন শুনতে বেশ ভালোই লাগে, গোপনে হলে তো আরো ভালো। দেখলাম আফসানা ওই কথোপকথনই লিখেছেন, ফলে পড়ার আগ্রহটা একটু বাড়লো।

সেই কবে পুর্নেন্দু পত্রীর কথোপকথন পড়ে শুভংকর হতে ইচ্ছে হয়েছিলো। শুভংকরের মতো চোখ দুটি চারপাশ খুঁজে বেরিয়েছিলো একজন নন্দিনীকে। কিন্তু ব্যস্ত সভ্যতায় চাইলেই কি নন্দিনীর দেখা মেলে? তাই কিশোর বয়সে একসময় পুর্নেন্দুর ওপর রাগ হয়েছিলো খুব। কিন্তু বড় হয়ে বুঝতে পারলাম, তিনি আমাদের মতো শুভংকর-তরুণদের কী উপকারটাই না করেছেন। এই যে নন্দিনীকে খুঁজে বেড়ানোর জন্য অনবরত স্বপ্ন দেখা, সেই স্বপ্নের মাঝে নিজেকে গড়ে তোলা এবং প্রতিষ্ঠিত শুভংকর হয়ে ক্রমাগত পরিবর্তিত নন্দিনীকে আবিষ্কার করা- এগুলো কি একজন তরুণের জন্য কম কিছু?

ফলে একসময় শুরু হলো কথোপকথন ধাঁচের বই খোঁজার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। চাইলেই যে সব পাওয়া যায় না, কথোপকথন ধাঁচের বই খুঁজতে গিয়ে সে সত্যটিই নতুন করে আবিষ্কার করলাম। কয়েক বছর আগে ফুটপাতে একটি বইয়ের সন্ধান মিললো- দু’জনে মিলে কথা ও কবিতা (দুঃখিত, লেখকের নামটি মনে করতে পারছি না, তবে সম্ভবত রোকনুজ্জামান)। বাংলা একাডেমীর তরুণ লেখক প্রকল্পের ফসল ওই বইটি। সেটি ঠিক কথোপকথনের মতো নয়, কথার চাইতে কবিতা বেশি, কিন্তু তা-ও তো কিছু কথা রয়েছে সেখানে। আবার কয়েক বছরের বিরতি দিয়ে কয়েকদিন আগে হাতে আফসানার এই বইটি।

মুখবন্ধ করে কলমের মাধ্যমে আফসানা কিশোয়ার লোচন মুখবন্ধে জানিয়েছেন, তিনি নিজেও নন্দিনী হতে চেয়েছিলেন, পারেননি। কিন্তু হরহামেশাই খুঁজেছেন শুভংকর-নন্দিনীকে; একসময় পেয়েও গেছেন তাদের- মৌন ও অভিককে। বাস্তব দুটি চরিত্রকে ভিত্তি করে আফসানা এই বইতে দেখিয়েছেন কীভাবে মানুষের অসাম্প্রদায়িক সম্পর্ক একসময় দূরে ঠেলে দেয় সাম্প্রদায়িক কারণে, যেখানে চরিত্রগুলোর নিজস্ব অনুভূতি আমাদের এই বর্তমান সমাজ ধারণ করতে পারে না। তাই মৌন যখন আমার যা কিছু ভিতর-বাহির সবই তো তুই নিবি বলে অভিকের স্বপ্নের কারখানায় নতুন আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত, সেই তাপেই বোধহয় তখন অভিকের জ্বর এসে যায়। অভিক আগে থেকে বুঝতে পারে না কিছু। মৌনও না। সমাজ তাদের বুঝতে দেয় না। পরস্পরের সুগন্ধী স্মৃতিতে ভরে থাকে তাদের হৃদয়-মন।

এই সুগন্ধী স্মৃতিতে কঠোর বাস্তবতা প্রবেশ করতে শুরু করে একসময়। কোনো বন্ধুরই মৌনদের বাসায় প্রবেশাধিকার নেই। অভিকের তো নেই-ই। কেনো নেই? সমাজের সাম্প্রদায়িক কাঁটাতারের যে বেড়ার অস্তিত্ব তাদের নিজেদের কাছে নেই, সেই বেড়াই তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে রেখেছে বেঁধে। এই বন্ধনের মধ্যে থেকে মৌন খুঁজে বেড়ায় কী দিয়ে চুকানো যায় ভিন্ন ধর্মী হবার দাম?

সমাজ, রাষ্ট্রের এই কাঁটাতারের বেড়ায় আস্তে আস্তে মৌন-অভিক বাস্তব জীবনকে হয়তো বুঝতে শিখতে চেষ্টা করে, কিন্তু উপলব্ধি করতে পারে না। অভিক যা হবার নয় তা আর চাইবার সাহস রাখে না। আর মৌন...। না, আর কিছু বলা যাবে না। হিন্দু-মুসলিম প্রেমের সম্পর্কের যা পরিণতি হওয়ার কথা, তাই হয়।

তবে আফসানা যদি মৌন-অভীকের সংলাপগুলো পাঠকের সামনে আরেকটু স্পষ্ট করে তুলতে পারতেন, তাহলে মৌন-অভিকের কষ্টগুলোর প্রকাশ হয়তো আরেকটু বেশি হতো। আমরাও আরো বেশি করে উপলব্ধি করতে পারতাম সাম্প্রদায়িক পরিণতির এই চরিত্রগুলোর দুঃখগাঁথা। অবশ্য এরকম চরিত্র তো আমাদের চারপাশে প্রচুর রয়েছে। কিন্তু তাদের আমরা বুঝতে চেষ্টা করি কতোজন, কতোজন চাই তাদের উপলব্ধি করতে? আফসানা পেরেছেন বলে হয়তো আমরা দুজন মৌন-অভিকের কথা জানতে পারলাম।

বুক রিভিউটি প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পর পত্রিকাটি ছেড়ে চলে আসি। বইটি মৃদুভাষণ অফিসেই রয়ে যায়। ফলে বইয়ের প্রচ্ছদটি দিতে পারলাম না এখানে। এর মধ্যে আফসানা আরো দুটি বই পাঠিয়েছিলেন। সেগুলোও পড়া হয়নি। মাঝখানে কিছুদিন সমকাল পত্রিকায় আফসানার লেখালেখি দেখেছিলাম। ইদানিং আর সেটিও দেখা হয় না। ফলে একদিন যে ভালোবাসার রোজনামচা তিনি লিখেছিলেন, এখন তিনি কীসের রোজনামচা লিখছেন তাও জানা হয় না।

তবে আফসানার ওই বুক রিভিউটি যে আমি লিখতে চাইনি, সে কথা তাকে জানানো হয়নি কখনো। তাকে এটাও জানানোও হয়নি যে, তার মতো করেই অন্য কোনো মৌন-অভিকদের কষ্টগুলো শেয়ার করতে হয়েছে আমাকে, প্রবলভাবে। বইয়ের অক্ষরগুলো লেখককে ছেড়ে রিভিউয়ারের জীবনে সওয়ারও হয়েছিলো একদিন- আফসানা হয়তো কখনো জানবে না সেই আরেক রোজনামচার কথা।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০০৯ রাত ১১:২৫
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ওয়াকফ: আল্লাহর আমানত নাকি রাজনীতির হাতিয়ার?

লিখেছেন শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু, ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৯:৫৯


"একদিকে আমানতের আলো, অন্যদিকে লোভের অন্ধকার—ওয়াকফ কি এখনও পবিত্র আছে?"

আমি ইকবাল হোসেন। ভোপালে বাস করি। আমার বয়স প্রায় পঁইত্রিশ। জন্ম থেকে এখানেই বড় হয়েছি, এখানেই আমাদের চার পুরুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড. ইউনুসের সরকার..........দীর্ঘ সময় দরকার!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:২৫



সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টির সারজিস আলম ড. ইউনুস সম্পর্কে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে। সে মোটাদাগে যা বলতে চেয়েছে তা হলো, ড. ইউনুসের আরো পাচ বছর ক্ষমতায় থাকা উচিত। অত্যন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেমন মুসলিম ??

লিখেছেন আরোগ্য, ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ২:০৫



বিলাসিতায় মগ্ন মুসলিম জাতি তার আরেক মুসলিম ভাইয়ের নির্মম হত্যার সংবাদ শুনে কেবল একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেদের রাজভোজ আর খোশগল্পে মনোনিবেশ করে। হায় আফসোস! কোথায় সেই মহামানব যিনি বলেছিলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবাবিল পাখি আরবদেরকে চর্বিত তৃণের ন্যয় করবে! ছবি ব্লগ

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৯


ফিলিস্তিনকে বোমা মেরে ছাতু বানিয়ে ফেললো ইসরাইল, অর্ধলক্ষ মানুষকে পাখি শিকারের মতো গুলি করে হত্যা করলো তারপরও মধ্যপ্রাচ্যের এতোগুলো আরব রাস্ট্র শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে আর ভাবছে আমার তো কিছুই... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা (বোনাস পর্ব)

লিখেছেন সামিয়া, ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৪:০৮



চারদিক হাততালিতে ভরে উঠলো।
বর্ষা আপু চিৎকার করে বলে উঠলো, "ইশান-অহনা!! অফিস কাপল অফ দ্য ইয়ার!!"
বুলবুল ভাই অহনাকে বললেন, “এখন বলো আসলেই সাগরে ঝাঁপ দিবা, না এই হ্যান্ডসাম যুবকটারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×