সেই ঘটনার পর হাসান সাব্বাহ মিশর চলে যায় । মিশর ছিল তদকালীন শিয়া মুসলমানদের জ্ঞান কেন্দ্র যা গড়ে উঠেছিল তাদের প্রতিষ্টিত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে । আর হাসান সাব্বাহ ছিল শিয়া মুসলমান । তখন মধ্যপ্রাচ্যে শিয়াদের অবস্থা ছিল করূন । একদিকে সুন্নী ও অপর দিকে খ্রিষ্টান শাসকদের মাঝখানে পিষ্ট এই সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ নিয়ে হাসান সাব্বাহ ইরান আসে। ইরানের আলামুত এ একটি দুর্গ দখল করে নেয় । দূর্গের ভেতর একটি প্রশিক্ষন শিবির স্থাপন করা হয় । এখানে গুপ্তহত্যাকারি এক ক্ষিপ্র দল তৈরির লক্ষে প্রশিক্ষন দেওয়া হয় । প্রশিক্ষন এর জন্য নির্বাচন করা হয় একদল শক্তিশালী , বুদ্ধিমান ও ক্ষিপ্র যুবক । তাদের দেওয়া হয় একই সাথে সমর শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা ও নিজ ধর্মের জন্য অকাতরে জীবন বিসর্জন দেয়ার দীক্ষা । এই কাজে তার সহায়তা করে অপিয়াম বা হাসিস জাতীয় মাদক যা গ্রহনের পর তাদের নিয়ে যাওয়া হত এক শীষ মহলে । সেখানে ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত বেহেশতের সকল উপকরন থাকত যা হাসিলের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হত শাহাদাতের বিনিময়ে । এই হাসিস থেকে দলের নাম হাসাসিন হয় । হাসাসিন শব্দটি থেকে বর্তমান অ্যাসাসিন শব্দের উতপত্তি । এভাবে দুর্ধর্ষ এই দলটি অভিযানের জন্য তৈরি হত ।
তাদের মিশনগুলো ছিল বেশ ইউনিক । শংখ্যায় কম হওয়ায় সম্মুখ যুদ্ধে না গিয়ে তারা বরং শত্রু শিবিরে মিশে যেতো । এক সময় সুযোগ বুঝে শত্রুকে হত্যা করে দ্রুত ঝড়ের মতো পালিয়ে আসতো । কিন্তু প্রথম সুযোগে তারা হত্যা করতোনা । বরং শত্রুদের সেনাপতি বা সুলতানকে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সুযোগ দিত রাজি না হলে শুধু তাকে হত্যা করা হতো । যেমন সুলতান আয়ুবী একদিন তার তাবুতে ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার বিছানার পাশে রক্তমাখা ছুরি পাশে একটি চিঠি যাতে লেখা এই ছূরিটা তোমার নরম বুকের মধ্যেও বিঁধতে পারতো ।অনেক ঐতিহাসিকদের মতে আয়ুবী ঐ ঘটনার পর হাসাসিনদের সাথে গোপন সন্ধি করে ও ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবহার করে । একই ঘটনা হয় সেলজুক সুলতান সানজার এর ক্ষেত্রে । সানজার এর কাছে শান্তি প্রস্তাব নিয়ে যায় হাসান সাব্বাহর দূত । কিন্তু সানজা তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয় । কিছুদিন পর একই ভাবে সানজার তার বিছানায় বিষ মাখানো ছুরি আবিষ্কার করে যার বিষয়বস্তু শান্তির বিকল্প শুধু হত্যা । কিন্তু একবার শতর্ক করার পরও তাদের কথায় রাজি না হলে হত্যা করা হতো পূর্বপ্রতিশ্রুত পদ্ধতিতে ।
ঘাতক দল গঠনের পর হাসান সাব্বাহ তার লক্ষ বাস্তবায়নের দিকে মনোনিবেশ করে । শিয়াদের প্রধান প্রতিদ্বন্দী ছিল তদকালীন সেলজুক সাম্রাজ্য যার সুলতান ছিল মালিক শাহ । মালিক শাহ এর প্রধানসহচর নিজাম উল মূলক ছিল সেলজুকদের প্রধান শক্তি আর পূর্বেই বলেছি নিজাম উল মূলক হাসান ছিল সাব্বাহর প্রাক্তন বন্ধু । হাসান সাব্বাহ বন্ধুকে হত্যার জন্য আততায়ি পাঠায় ।নিজাম উল মূলক তখন বাইরে । আততায়ী দরবেশ পরিচয়ে তার কাছে যায় । এক পর্যায়ে ছুরি দিয়ে মূলকের পিঠে আঘাত করে । ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয় ।আততায়ী নিরাপত্তা বেস্টনী ভেদ করে পালিয়ে আসতে সমর্থ হয় । অনেক এর মতে আততায়ীকে তার প্রহরীরা হত্যা করে । এভাবে হাসান সাব্বাহ তার প্রথম মিশনে সফল হয় । তার দ্বিতীয় টার্গেট ছিল সেলজুক সুলতান মালিক শাহ স্বয়ং । মালিক শাহ এর অন্দরমহলে হাসান সাব্বাহর লোক চাকরি নেয় ও তাকে বিষ পান করিয়ে হত্যা করে । এভাবে হাসান সাব্বাহ একটি সুচতুর , শক্তিশালি ও ক্ষিপ্র গুপ্তঘাতক দল প্রতিষ্ঠা করে । এই ঘাতক দল চারদিকে তাদের অভিযান পরিচালনা করলে ও হাসান সাব্বাহ কখনো তার দুর্গ থেকে বের হয়নি । এমনকি সে কখনও দুর্গের ছাদে ও দেখা দিতনা এবং দুর্গের ভেতরে সে মৃত্যুবরন করে । তার আগে সে দলের জন্য নীতিমালা করে যায় যে নীতিমালা অনুসারে এইদলটি পরিচালিত হত।নীতিমালার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল যুদ্ধ এরিয়ে চলা ও এমন অভিযান পরিচালনা করা যেখানে সাধারন মানুষ যুদ্ধের শিকার না হয় । তার মতে সাধারন মানুষ কখনও রাজনীতির অংশ হয়না কিন্তু যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার হয় সাধারন মানুষ । যুদ্ধের পরিবর্তে বিপক্ষ দলের প্রভাবশালি নেতা ও সেনাপতিদের গোপনে হত্যা করাকে বেশি মানবিক ও কার্যকারী মনে করতেন ।
হাসান সাব্বাহর মৃত্যুর পর ঘাতক দলটি আরবে আরও বেশি মারাত্নক হয়ে উঠে । তারা সিরিয়ার নুসারিগা পাহাড়ের বেশ কয়টি দুর্গ দখল করে নেয় । সেখান থেকে রাশিদিন সিনান অনেকটা স্বাধীনভাবে মূল দুর্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কর্মকান্ড পরিচালনা করে । মার্কো পলো সিনান কে অভিহিত করেন পাহাড়ের রাজা ।১১৭৫ সালে তারা দুইবার সুলতান সালাউদ্দিন আয়ুবীর উপর হামলা করে । অনেকের মতে এই হামলা ছিল তাকে হত্যা নয় বরং সতর্ক করার উদ্দেশ্যে । যদিও অধিকাংশ সুন্নী পন্ডিত এই হামলাকে সুন্নি মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্রের অংশ মনে করেন । কিন্তু শিয়া ও পশ্চিমারা মনে করেন তাই যদি হয় তাহলে পরবর্তীতে এই হাসাসিনকে ব্যবহার করে সুলতান কিভাবে খ্রিষ্টানদের উপর অতর্কিত হামলা করে । ১১৯৬ সালে তারা আলেপ্পোর সুলতান পরুসুকিকে হত্যা করে । এর মধ্যে তারা হত্যা করে খ্রিস্টান রাজা দ্বিতীয় কনরাডকে ত্যা করা হয সুলতান রিদওয়ান ও আল কাসাবকে । উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের পত্তনকারি মুহাম্মদ ঘুরীও হাসাসিনদের হাতে প্রাণ দেয় । ১২৫৬ সালে মোঙ্গলরা আলমূত আক্রমন করে তা দখল করে নিলে পারস্যে তাদের আধিপত্য কমে আসে । মোঙ্গলরা হাসান সাব্বাহর সকল নিদর্শন পুড়িয়ে দেয় । তাদের ভয় ছিল হাসান সাব্বাহ একজন যাদুকর ছিল ও তার যাদুকরী প্রভাব এখন ও মহলে রয়ে গিয়েছে । তাছাড়া পুরো আরবে ঝটিকা আক্রমনকারিদের ভীতি ছিল । আর হাসান সাব্বাহ ছিল এক বিভীষিকাময় কিংবদন্তী । আগুনে হাসান সাব্বাহ সম্পর্কিত সকল নিদর্শন পুড়ে যায় যার মধ্যে ছিল তার অটোবায়োগ্রাফি । এরপর মামলুক সুলতান বায়বারের হাতে পতন হয় তাদের সিরিয়া দুর্গের ।এভাবে মহলচ্যুত হয় গুপ্তঘাতকদের কিংবদন্তী দলটি । কিন্তু মহলচ্যুত হলেও তাদের প্রভাব কমে যায়নি বটে কিন্তু শিয়া স্বর্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ নিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠা সেই লক্ষ থেকে প্রকৃত অর্থে তারা সরে আসে ও গ্রহন করে নতুন কর্মপদ্ধতি । মূলত সুলতান বায়বার তাদের নিয়োগ দেয় চুক্তিভিত্তিক হত্যা মিশনে । বিনিময়ে তাদের মৃত্যু থেকে রেহাই দেয়া হয় ।এর পর হাসাসিনদের সংগঠিত দল হিসাবে আর ইতিহাসের পাতায় আমরা দেখতে পাইনা । তার পরিবর্তে তারা পরিণত হয় অর্থের বিনিময়ে গোপন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের গুটি অন্ধকারের গোপন আততায়ী হিসাবে । তেরো ও চৌদ্দ শতাকে তাদের আক্রমণের শিকার হয় বেশ কয়েকজন আরব সেনাপতি , মন্ত্রী ও আমীর । ঐ সময় তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় ফ্রিম্যাসনারিরা যার তাদের লক্ষ ছিল হাঙ্গেরীর তদকালীন রাজা ও তার প্রভাবশালী সেনাপতি ও সভাসদদের হত্যা করা । কিন্তু তাদের কঠোর হাতে দমন করা হাঙ্গেরিতে । পনেরো শতকের মধ্যে হাসাসিম দলটি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয় বলে ধারনা করা হয় ।
মিথ বিতর্ক : হাসান সাব্বাহকে নিয়ে অনেক মিথ প্রচলিত আছে । কারন বাস্তবের চেয়ে বেশি আরব্য গল্পগাথার অংশ হয়ে গিযেছিলেন তিনি । কোথাও প্রভাবশালী যাদুকর যে মাথাকেটে নিয়ে তার পায়ের তলায় রেখে তার ঐশী শক্তির সাক্ষ নেয় । আবার দিনে দুপুরে হাসাসিন সদস্য যারা হত্যা করে সবার সামনে অদৃশ্য হয়ে যায় । এছাড়াও চলচ্চিত্র , নাটক , উপন্যাস , ছোটগল্প , মহাকাব্য সহ আরব্য সংস্কৃতিতো বটেই পশ্চিমা সাহিত্য ও বিনোদন জগতে রহস্যজনক গুপ্ত ঘাতকের দল বড় জায়গা দখল করে আছে । কিন্তু তাদের যতোটা অনৈতিক ও দুরাচারী রুপে উপস্থাপন করা হয় তার সত্যতা নিয়ে ও বিংশ শতকের ঐতিহাসিকরা প্রশ্ন তুলেন । কারন হাসান সাব্বাহ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি আলোচনাকারী মার্কো পলো পারস্যে গিয়েছেন তার মৃত্যুর ৫০ বছরের ও বেশি সময় পর । তাই তিনি যতোটা বলেছেন তা মানুষের মুখে শুনে । যদিও তখন হাসাসিনদের উপস্থিতি ছিল । কিন্তু হাসন সাব্বাহ ছিলেননা । অপরদিকে ভ্লাদিমির ইভানভ , জোসেফ ভন হ্যামারদের মতে যে মাদক দ্রব্য গ্রহন করে হাসাসিনরা বেহেশত দেখতো তার প্রচলন আজও আছে । এসব মাদক গ্রহনের পর সবার একই দৃশ্য দেখা সম্ভব নয় । আর হাসান সাব্বাহর বেহেশত সম্পর্কে যে কথা হয় তা মোঙ্গলরা আলমূত দুর্গ দখলের পর খুজে পায়নি । নিটশে এ সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা প্রদান করেন । তার মতে ক্রুসেড ফেরত খ্রিষ্টানদের চাপা মারার প্রধান উপকরন ছিল আরব শয়তান যারা ঝড়ের মতো যে কোন স্থানে আক্রমণ করে যে কাউকে হত্যা করে পালিয়ে যোতে পারে ।এই পরাক্রমশালী ঘাতকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করা সাধারন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় । আবার অন্যদিকে তদকালীন সুন্নী অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা হাসান সাব্বাহকে শয়তান জাদুকর আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে উস্কে দিত যারা ছিল মূলত শিয়া সম্প্রদায়ের । এভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে সংখ্যালঘু এক দলের অধিকার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম পরিণত হয় পৌরাণিক কাহিনীতে ।তাছাড়া তখন আরবে যেকোন হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচিত না হলে তার দায়ভার চাপানো হত হাসাসিনদের উপর । যেসব হত্যান্ডের দায়ভার হাসাসিনদের উপর চাপানো হয় তার মধ্যে অন্যতম নিজামউল মূলকের হত্যাকরী হিসাবে মালিক শাহকে ও দায়ী করা হয় ও কারন দেখানো হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব । আর মালিক শাহ এর হত্যাকারী হিসাবে সন্দেহের তালিকায় ছিল নিজামউল মূলকের বিশ্বস্ত সৈন্য । সঠিক ইতিহাস যাই হোকনা কেন হাসাসিনদের সেই দল এর কথা যখনই বইয়ের পাতায় বা সেলুলয়েড পর্দায় বা বাচ্চাদের ভিডিও গেমসে উঠে আসে তা হয়ে উঠে রোমাঞ্চকর উপাখ্যান ।
তথ্যসূত্র :
১।উইকিপিডিয়া
২।উর্দুম্যানিয়া
৩।হিস্ট্রি অফ ইসলাম
৪।Alamut sinan
৫/the waste land and the flower of devil
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:১৮