জি হ্যা আমি আজ কোন রম্য গল্প বলতে আসিনি আজ আমি আপ্নাদের একটি সত্যিকারের বীর গাথা শোনাতে এসেছি। আমার গ্রামের বীর যোদ্ধার ঘটনা কোন পেপারে হয়তো ছাপা হয় নাই কখনো, কিন্তু এটা আমার দায়ীত্ব সবাইকে ঘটনাটা জানানোর।
গতবছর ডিসেম্বর এর ঘটনা বলছি , খুব সকালে প্রচন্ড শীতের মধ্যে দ্রুত হাটছি , বুকাবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষধের পাশের বাজারে পৌছাতে হবে।দুর থেকেই আমি দেখলাম চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চে গায়ে চাদর জড়ানো অবস্থায় বসে আছে ৯নং সেক্টরের সাব সেক্টর গেড়িলা মজিবর শিখদারকে। বয়স ৭০ + গালে খোচা খোচা দাড়ি, পান খাওয়া মুখ , ঠোটে একটা কম দামি সিগারেট, ওনার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্য হলো তার কাছ থেকে একটা খুব রোমাঞ্চকর যুদ্ধের ইতিহাস শোনা।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর শিকদারের কোন ছবি আমার কছে নাই তাই আকার চেষ্টা করলাম
এবার আসল গল্প শুরু : (আমি সংক্ষিপ্ত আকারে ঠিক ওনার মতো করে বলছি)
আমাদের সেক্টর এর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন মেহেদি স্যার , আর্মির লোক, এই মুহুর্তে ৯ নং সেক্টরের দায়ীত্বে আছেন তিনি, যুদ্ধের প্রয়োজনে মাঝে মাঝে বুকাবুনিয়া সাব সেক্টরে এসে অবস্থান নেন। ক্যাপ্টেন মেহেদি বয়সে তরুন প্রায় ৬ফিট এর কাছা কাছি লম্বা , সুদর্শন , চোখে সবসময় সানগ্লাস থাকে, সর্বদা সিগারেট খান।ক্যাপ্টেন মেহেদি কে কখনো কোন পরিস্থিতিতে চিন্তিত দেখা যায় না, শত্রুরা অনেক বার তার দল সহ তাকে ঘিরে ফেলেছে, তার চেহারায় কোন চিন্তার ছাপ দেখা যায় নাই, নিজের ট্রেনিং আর রনকৌশল এর উপ্রে তার অনেক আস্থা। খুব স্বাভাবিক ভাবে সে নির্দেশ দিতো তার সহোমুক্তিযোদ্ধাদের এবং সে সফলও হতো প্রতিটা যুদ্ধে। আর বিভিন্ন অপারেশন এ জ্বয়লাভের পরে খুব স্বাভাবিক ভাবে সহো যোদ্ধাদের সাথে হ্যান্ডশেক করতো আর বলতো, "well done guys ,it was a very good job !" প্রথম যখন সে সাবসেক্টরে আসে তখন তার গায়ে ছিলো আর্মির শার্ট আর মাথায় একটা ক্যাপ। এখন তার সেই শার্ট নেই, কোন এক গুলিবিদ্ধ সহোযোদ্ধাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে গিয়ে শার্টখানা হারিয়েছেন এখন তার গায়ে আছে একটা সেন্ডো গেঞ্জি। তার মাথার ক্যাপটাই সবসময় চিনিয়ে দেয় এই সেই বীর যোদ্ধা ক্যাপ্টেন মেহেদি।
ক্যাপ্টেন মেহেদিকে আমি দেখি নাই আমার কল্পনায় ক্যপ্টেন মেহেদি
এবার গল্পের মুল নায়ক "সর্দার হাকিম", সদ্য বিবাহীত, কোন সন্তানাদি নাই, তার স্ত্রী লতিফা বানুকে নিয়ে তার সুখের সংসার। এই লোকটা সেই সময়ে একজন জীবন্ত কিংবদন্তি ছিলো যা আজও আমার গ্রামের মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়, পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা তাকে যমের মতো ভয় পেতো, সে ছিলো একটা সুপার হিরো টাইপের, মাথায় কচুরি পানা বেধে নি:শব্দে মাইলের পর মাইল দ্রুত সাতার কেটে চলে যেতো, গাছের উপর থেকে উল্টো হয়ে মাথা নিচের দিকে রেখে এক হাতে মেশিন গানের গুলি করতে করতে গাছ থেকে নেমে যাওয়া,রাতের অন্ধকারে একা নি:শব্দে সদ্য ঘাটি গারা হানাদার ক্যাম্পে ঢুকে শুধু একটা ছুড়ি ব্যাবহার করে ক্যাম্পের দখল নেয়ার গৌড়ব এই বীর যোদ্ধার। একবার নাকি জংগলে ক্রুলিং পজিশন নেয়া অবস্থায় তার পিঠের উপ্রে একটা সাপ এসে বসে পরে, কিন্তু দায়ীত্বে সমস্যা হতে পারে ভেবে সাপের দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করে সে সিংগেল শুট করে যাচ্ছিলো আর তার অব্যার্থ নিশানায় একের পর এক শত্রু ঘায়েল হচ্ছিলো। ক্যাপ্টেন মেহেদি অন্য এলাকায় তার কিছু দক্ষ গেরিলা পাঠানোর সময় "সর্দার" এর প্রশংসা করে মেজর জলিল কে বলেছিলো, "sir i am sending you my best one, you will win if he is alive,"
আমার কল্পনায় সেই সময়ের কিংবদন্তি, বীর যোদ্ধা, আমার গৌড়ব, গেরিলা "সর্দার হাকিম"
সর্দার হাকিমের স্ত্রী লতিফা বানু সবসময় সর্দার কে বকাঝকা করতো, যখনই সে লুকিয়ে বউ এর সাথে দেখা করতে যেতো সাথে থাকতো তার প্রিয় বন্ধু , ছোট বেলার দুস্টুমির সাথি সহোযোদ্ধা মজিবর শিখদার, তার বউ নাকি তাকে বলতো, "তুমি গোসল করো না কেন ?" সে বলতো, "যেদিন আবার পানির মইধ্যে যুদ্ধ করুম সেই দিন গোসল হয়া যাইবো।" তার বউ বলতো, "তুমি মাথায় তেল দাও না কেন ? সে বলতো তুমি আছো তেলের চিন্তায় !আমি আরও ভাবতাছি মাথা নাইড়া কইরা ফালামু !" লতিফা বানু , মাঝে মাঝে খাবার রান্না করে রাতের আধারে সর্দার ও তার সহো যোদ্ধাদের জন্য জংগলের গোপন আস্তানায় নিয়া যেতো। একবার ক্যাপ্টেন মেহেদি গোপন বেইজে অবস্থান কালীন সময়ে লতিফা খাবার নিয়ে হাজির হয়, ক্যাপ্টেন মেহেদি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায় এবং সিক্রেট বেইজের একমাত্র ভাংগা চেয়ারটিতে বসতে অনুরোদ করে লতিফা বানুকে , সবার সামনে লতিফা লজ্জা পেয়ে বসে না, সর্দার তখন রসিকতা করে বলে, "লতি বইসা পরো স্যারের এই চেয়ার ভাংগা দেকলে হইবো কি! এই চেয়ারে বইসা স্যারের মাথায় অনেক বুদ্দি আহে যেইডা কাজে লাগাইয়া অনেক পাইকা মিলিটারিরে পাইকারি মাইর দিছি আমরা।" লতিফা উত্তর দেয়, "আরেহ নাহ! স্যার শিক্ষিত মানুষ হেনি খারায়া থাকবো আর আমি বসুম এই টা হয় নাকি ?"
লতিফা বানুকে আমি দেখেছি, তবে সেই তরুনি গৃহিনী লতিফাকে দেখি নাই সেই সময়ের লতিফাকে আকার চেষ্টা করলাম, যদিও তার মতো মহান নাড়িকে আকার যোগ্যতা আমার নাই।
আমার কল্পনায় যুদ্ধাক্রান্ত একটি পরিবার
১৬ নভেম্বর ১৯৭১ ঠিক একমাস পরে দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে, অথচ এটা তখন সকলের অজানা ছিলো তবে স্বাধীন হবার সম্ভবনাটা খুব বেশি এটা বোঝা যাচ্ছিলো। পার্শবর্তী গ্রাম "কালমাঘা" একটা স্কুলের মধ্যে হানাদার বাহিনী ক্যাম্প করেছে ছত্র ভংগ রাজাকারেরা আবারও ক্যাম্পে এসে ভীর করছে, ক্যাপ্টেন মেহেদিও এই মুহুর্তে সাব সেক্টরে অবস্থান করছে, আজ রাতে অপারেশন হবে, ৯নং সেক্টর এর কয়েকজন দক্ষ যোদ্ধাও সাব সেক্টরের যোদ্ধাদের সাথে যোগ দিয়েছে, এমবুশ প্লান বুঝিয়ে দিয়ে ক্যাপ্টেন মেহেদি দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো, যেতে যেতে সর্দার তার বন্ধু মজিবরকে বললো আজকে ভোর রাতে লতিফা খাবার নিয়ে আসবে, যদি এর মদ্যে ফিরতে পারি তাইলে লতিফার হাতের খাবার খাওয়া যাবে, সিক্রেট বেইজের খাবার খেয়ে তার পেটের অবস্থা খারাপ, শুনে মজিবর কপট রাগ দেখালো, কারন মজিবরই সিক্রেট বেইজের পাচক।
এমবুশ শুরু হয়ে গেছে, রাতের আধারে ৩০৩ রাইফেল আর হালকা মেশিন গানের গুলি গুলো, ছুটে যাওয়া উল্কার মতো মনে হচ্ছিলো ! হানাদারদের অবস্থনটা ছিলো ভুমি থেকে একটু উচুতে , আমাদের যোদ্ধাদের ধীরে ধীরে শুটিং চালু রেখে ক্যাম্পের কাছে যেতে হবে, এধরনের পরিস্থিতিতে সর্দার অনেক এক্সপার্ট সে একই সাথে ক্রুলিং ও ফায়ারিং করতে পারে। রাতের আধার ও গুলির শব্দের মধ্যেও ক্যপ্টেন মেহেদির সংকেত ডাহুক পাখির ডাক ঠিকই সর্দারের কানে পৌছে গেছে, সুদক্ষ যোদ্ধার মতো ক্রলিং করে ফায়ারিং চালু রাখলো সর্দার, এখানে একটা কথা বলে রাখি সর্দারের পছন্দের আর্মস ছিলো হালকা মেশিন গান, কিন্তু ক্যপ্টেন মেহেদি তাকে বলেছিলো যেহেতু তোমার নিশানা ভালো তুমি সিংগেল স্যুট ৩০৩ ইউজ করবে। আর শত্রু কাছাকাছি চলে আসলে সংখ্যা বেশি হলে মেশিন গান চালাবা। কিন্তু আজকে সর্দার অনেক উত্তেজিত আর অনেক নার্ভাস কারন এই এলাকায় সর্দারের শ্বশুর বাড়ি, লতিফার বাবা মা এই এলাকায় থাকে, আসবার সময় প্রিয় স্ত্রীকে কথা দিয়েছে তোমার বাবা মায়ের কোন সমস্যা হবে না, হানাদারদের পাইকারি মাইর দিয়া খেদামু।
গেরিলা মজিবর ঠিক এই ভাবে বর্ননা করছিলো, "ক্যাম্পের কাছাকাছি গেলে সিংগেল শ্যুট ইউজ করা উচিত ছিলো কারন রাতের আধারে মেশিন গানের গুলির আলো একটানা গুলিবর্ষনে সর্দারের অবস্থান নির্দিস্ট করে দেওয়ার চান্স থাকে।" কিন্তু সর্দার যেখানে পজিশন নিয়েছে সেখানে লম্বায় বড় ৩০৩ রাইফেল নিয়ে শ্যুট করা ছিলো কষ্টকর আবার এখান থেকে ক্যাপ্টেন মেহেদিকে কভার না করলে ক্যাপ্টেন ক্যাম্পের কাছে পৌছাতে পারবে না। গেরিলা মজিবর এর বর্ননায় শুনলাম যতোক্ষন মেশিনগানের গুলির আওয়াজ পাচ্ছিলাম ততক্ষন নিশ্চিত ছিলাম সর্দার অক্ষত আছে,
আমার কল্পনায় রনক্ষেত্রে মজিবর ও সর্দার, শত্রুর সাথে লড়াই অবিরাম চলছে
তখন ভোর রাত, এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন মেহেদি তার টিম নিয়ে ক্যাম্প দখলে নিলো, যোদ্ধারা সবাই একে অপরের সাথে কোলাকুলি দিচ্ছে কারন এটাই ছিলো হানাদারদের শেষ ক্যাম্প আশে পাশের দুই চারটা থানার ক্যাম্পও তখন মুক্তি যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রনে চলে গেছে। ক্যাপ্টেন মেহেদি তার স্বভাব সুলভ আচরন মতো হ্যান্ডশেক আর মুখে সেই বিখ্যাত বানী, "well done guys ,it was a very good job !" কিন্তু সর্দার কে দেখা যাচ্ছে না ! সর্দার সর্দার বলে কয়েকবার চিৎকার করলো গেরিলা মজিবর, নাহ সর্দার দেখি ঠিক আছে তার পজিশন থেকে সে ধিরে ধিরে উঠে দারালো !
আমার কল্পনায় সর্দার হাকিম, বীর যোদ্ধা ৯নং সেক্টরের সাব সেক্টর গেরিলা
দুর থেকে সবসময়ের অভ্যাস মতো একটা স্যালুট দিলো ক্যাপ্টেনকে, মজিবর হাসছে সর্দারকে অক্ষত দেখে । সুদক্ষ যোদ্ধা ক্যাপ্টেন মেহেদির চোখ এরালো না সমস্যাটা ! ছুটে গিয়ে ধরে ফেললো সর্দার কে, সর্দার ঢলে পড়লো ক্যাপ্টেনের কোলে, গুলিটা পেটের এক পাশ ছিরে বেরিয়ে গেছে, ক্যাপ্টেন মেহেদি বললো সর্দার তুমি কেন এতো ঝুকি নিলা ?! সর্দার এর তখন কথা বলতে কস্ট হচ্ছে তবুও বললো স্যার নাইলে আপ্নে ক্যাম্প দখল করতে পারতেন না, ভাবলাম ঝুকি নিয়া নেই, ঝুকির ফলাফল আমি জানি, আমি এতে ভয় পাই না। শেষ সময়ে সর্দারের মুখে হাসি ছিলো,বিজয়ীর হাসি, কিন্তু চোখ থেকে পানি পরছিলো মনে হচ্ছিলো হয়তো সেটা লতিফার সাথে তার এই বিচ্ছেদেরে বেদনার কারনে। এই প্রথম ক্যাপ্টেন মেহেদির চেহারায় একটা ব্যাথার ছাপ দেখতে পেলো সহো যোদ্ধারা, বরাবরের মতো ভাবলেশহীন মেহেদিকে আবেগময় করে দিলো সর্দার।
সবাই সিক্রেট বেইজে আসলো না " বীর শহীদ সর্দার " কে নিয়ে আলো ফুটলে রওনা দিবে আর ক্যাম্পে ৯নং সেক্টর থেকে আসা যোদ্ধারা দায়ীত্ব নিবে। সহো যোদ্ধাদের নিয়ে মজিবর যখন খুব সকালে সিক্রেট বেইজে এসে পৌছালো তখন লতিফা তাদের খাবারের প্লেট পুনরায় ধুয়ে তৈরি করছিলো, সে বাড়ি ফিরে যায় নাই, সে জানে তার সর্দার আজকে বিজয়ী হবেই। তাই সে তার বিজয়ী সর্দার কে নিজের হাতের রান্না করা খাবার খাওয়াতে বসে আছে ক্যাম্পে । লতিফা সবসময়ের মতো খাবার প্লেটে সাজিয়ে রাখছিলো , তার আচরন স্বাভাবিক ছিলো কারন সে জানে না তার "বীর সর্দার হাকিম" এখন "বীর শহীদ সর্দার হাকিম"।
এই পর্যন্ত বলার পর গেরিলা মজিবরের চোখ থেকে পানি টপ টপ করে ঝরে পরছিলো আজ থেকে সেই ৪০ বছর আগের ঘটনা তাকে আজও আবেগময় করে তুলে। এরপর সে আর কিছু বলতে পারে নাই, নি:শব্দে উঠে চলে যায় তার বাড়ির পথে, আমি পেছন থেকে তাকিয়ে এক সময়ের তুখোর এবং রনক্ষেত্র কাপানো গেরিলা যোদ্ধা মজিবর শিকদার এর চলে যাওয়া দেখলাম। হঠাৎ মনে হলো বৃষ্টি হচ্ছে আমার দুই গালে পানির অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম, নাহ এখন শীতের দিন বৃষ্টি আসবে কোথ্থেকে ? হয়তো শীতের কুয়াশার কারনে আমার দুই গাল দুই চোখ ভিজে গেছে , কিন্তু খেয়াল করলাম আমার নিশ্বাষ ঘন হয়ে আসছে আর গলা থেকে জোর করে শব্দ বের হচ্ছে, আশে পাশে এখন কেউ নেই, এখন অনেক সকাল, এই সময় কেউ এখানে আসে না চিৎকার করে কাদলেও সমস্যা নেই !
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্র ধরি, মোরা একটি ফুলকে বাচাবো বলে যুদ্ধ করি।
(সকল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি একটা টেলিগ্রাম)
আমি ঘুড্ডির পাইলট ।
নির্ঘুম প্রহরি ৯নং সেক্টরের সাবসেক্টর থেকে বলছি, আমার প্রহরা চলছে অবিরাম, বিরতিহীন।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:২২