ঘটনা-১
দুবাই। ৪ ফেব্রুয়ারী ২০১২। রাত ১১টা ৫৫।
ইতিসালাত মেট্রো ষ্টেশন।
দুবাই মল/বুর্জ খলিফা মেট্রো ষ্টেশন থেকে দিনের শেষ মেট্রো রেলে উঠে ইতিসালাত মেট্রো ষ্টেশনে নামলাম। এর পর আর মেট্রো ষ্টেশন নাই। ইতিসালাত মুলত দুবাই আর শারজাহ এর মাঝামাঝি জায়গা। আমি উঠেছি শারজায় এক পরিচিত জনের বাসায়। ইতিসালাত থেকে বাসা আরো প্রায় ১২ কিমি দূরে।
দুবাই এসেছি ২ ফেব্রুয়ারী। ৫ দিন থাকব। প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে দুবাই মেট্রো রেলের ১ দিনের আনলিমিটেড এন্ট্রি পাস কিনি ১৪ দিরহাম দিয়ে। তারপর মেট্রো রেলে চড়ে চষে ফেলি পুরো দুবাইয়ের এ মাথা থেকে ও মাথা। সাথে চলে অবিরত ক্যামেরার শাটার টেপা, ব্যাটারি শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
যাহোক, দুবাইয়ের জন্য রাত ১২টা কোন রাত না হলেও এসময়ে ইতিসালাত এলাকাটা শান্ত আর মোটামুটি জনমানবহীন। ট্যাক্সির জন্য দাঁড়ালাম। ১৫ মিনিট দাঁড়ানোর পরও যখন কোন ট্যাক্সি পেলাম না তখন হাঁটা শুরু করলাম। শাঁ শাঁ করে পাশ দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে। কোনটারই স্পিড ১২০ কিমির কম হবে না। প্রায় ২ কিমি হাঁটার পরও যখন কোন খালি ট্যাক্সি পেলাম না তখন একটু শংকিত হলাম। এমিরেটস রোডের (দুবাই-শারজাহ সংযুক্তকারী) এই হাইওয়েতে আমি ছাড়া কোন পথচারী নেই। আর বাসা এখনও প্রায় ১০ কিমি দূরে। সকালে বেরিয়েছি, সারাদিনের ভ্রমণে ক্লান্ত, পকেটে পাসপোর্ট সহ প্রায় ২ হাজার ডলার নিয়ে আকাশ পাথাল ভাবতে ভাবতে হাঁটছি। এমন সময় পাশে এসে থামল একটা ট্যাক্সি। ঝটপট কথা না বলে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে পড়লাম। দুবাইতে প্রত্যেক ট্যাক্সিতে চালকের পাশের ছোট্ট মনিটরে চালকের নাম, আইডি, মিটার সহ যাবতীয় তথ্য থাকে। তাকিয়ে দেখলাম, মিটার বন্ধ। তাই ড্রাইভারের নাম জানতে পারলাম না, তবে মনে হয় ভারতীয়। জিজ্ঞেস করল, "কাঁহা যাওগে?"
বললাম। গাড়ি চলতে শুরু করল। চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে প্রায় মিনিট পাঁচেক পর হঠাৎ রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করাল ড্রাইভার। বিদেশের মাটি, অচেনা ড্রাইভার, ক্লান্ত শরীর, গভীর রাত, রাস্তার পাশে হঠাৎ গাড়ি দাঁড় করানো--আমার কাছে লক্ষণ ভাল ঠেকল না।
ড্রাইভার উর্দু/হিন্দিতে বলল, "রাত ১২টা পার হয়ে গেছে তাই মিটার বন্ধ করে দিয়েছি। সাড়ে ১২টার মধ্যে আমাকে গাড়ি জমা দিতে হবে। আমার গ্যারেজ সামনে ডানে। আমি আর সামনে যেতে পারব না, পুলিশ ধরে ফেলবে। তোমাকে এখানেই নামতে হবে।"
আমি নামার আগে ভাড়া দিতে গেলাম। সে বলল, "মিটার বন্ধ করেছি, ভাড়া নিতে পারব না। তুমি রাস্তায় একা হাঁটছ, এ রাস্তায় কোন ট্যাক্সি পাবে না বলে তোমাকে ফ্রি (মুফত মে) লিফট দিলাম।"
আমি আমার বাসা চিনি তারপরও সে দিক নির্দেশনা দিয়ে বলল, "পায়দাল চালোগে তো পাঁচ মিনিট লাগেগা।"
ধন্যবাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনার দেশ?"
"পাকিস্তান", বলে গাড়ি নিয়ে শাঁ করে চলে গেল।
কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সারাজীবন পাকিস্তানীদের ঘৃণা করেছি। বিদেশ-বিভুঁইতে একজন বাঙালি হয়ে পকেটে টাকা থাকতেও কোন পাকিস্তানীর কাছ থেকে "ফ্রি" তে (তার ভাষায় "মুফ্ত মে") সাহায্য নেব--এমন কল্পনাও করিনি।...হাঁটা ধরলাম বাসার দিকে।
ঘটনা-২
১৬ই ডিসেম্বর ২০১১। বিজয় দিবস। আফ্রিকার একটি নিপীড়িত দেশ। আমার হাসপাতালের চেম্বারে বসে আছি। দেশে আজ বিজয় দিবসের উৎসব চলছে, সাথে সরকারী ছুটি। আর আমি ৭ হাজার কিমি দূরে হাসপাতলে বসে অফিস করছি। রোগী তেমন নাই। বাংলাদেশী কেউ অসুস্থ হলে সাধারনত আমাকে ফোন করেন। আমার বেশিরভাগ রোগীই স্থানীয় এবং অন্যান্য দেশের। এর মধ্যে রাশান রোগী বেশি। এরপর আছে কিছু সাউথ আফ্রিকান, আমেরিকান, জর্ডানিজ, মরোক্কান, পাকিস্তানী, নেপালী, ফিলিপিনো ইত্যাদি।
বসে আছি আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্ট এসে জানাল এক পাকিস্তানী রোগী এসেছে বুকে ব্যাথা নিয়ে। নিয়ে আসতে বললাম। ট্রিটমেন্ট ফরমে তার নাম, পরিচয়, বয়স দেখলাম। ৪১ বছর বয়সী এই পাকিস্তানীর কমপ্লেইন বুকের বামপাশে চিনচিনে ব্যথা, সারা শরীরে ঘাম আর উচ্চরক্তচাপ। টিপিক্যাল সিম্পটোম। কোন দেরী না করে হাসপাতালে ভর্তি করে ই.সি.জি করতে করতেই মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন এর ট্রিটমেন্ট শুরু করে দিলাম। যদিও এ পেশেন্ট আমার হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য অনুমোদিত (এনটাইটেলড) নয়। তবুও রোগীর স্বার্থে কিছু কমন ইনভেশটিগেশন করতে দিলাম যেগুলো আমাদের হাসপাতালে করা সম্ভব। ই.সি.জি দেখে বুঝলাম--আনস্ট্যাবল এ্যানজাইনা। রোগীকে ১ দিন ভর্তি রাখার ব্যবস্থা করলাম। ...বিকেলে আবার হাসপাতালে তাকে দেখতে গেলাম। তিনি বারবার ধন্যবাদ আমাকে জানালেন। কথাপ্রসংগে তাকে জানালাম আজ বাংলাদেশের বিজয় দিবস এবং বিজয় দিবসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাকে আমাদের কন্টিন্জেন্টে আমন্ত্রণ জানালাম । হেসে ধন্যবাদ জানাল এবং বলল "কংগ্র্যাচুলেশন্স অন ইয়োর ভিক্টরি ডে! ইউ ডিজার্ভ ইট!" তাকে কিছুটা লজ্জিত এবং অপ্রস্তুত মনে হল। বিজয় দিবসের কথা বলায় নাকি বাংলাদেশী হাসপাতালে আসার কারনে বুঝতে পারলাম না।
আমি শুধু হাসলাম।