মজবুত হলো ভাতৃত্বের বন্ধন, মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র গঠন
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
পূর্ব প্রকাশের পর:
মজবুত হলো ভাতৃত্বের বন্ধন
মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করতে সক্ষম এমন সকল মুসলমান যখন মদীনায় এসে পৌঁছলেন এবং মসজিদে নববী নির্মাণ কাজ সমপ্ত হয়ে তাতে নিয়মিত সালাত আদায়ের সকল কার্যক্রমও সুসম্পন্ন হয়ে গেল, তখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় হিজরত করে আসা মুহাজির ও মদীনার স্থায়ী বাসিন্দা আনসারদেরকে সুসংগঠিত করা ও তাদের পরস্পরের মাঝে সম্প্রীতি ও মজবুত ভাতৃত্ব বন্ধন প্রতিষ্ঠার প্রতি মনোনিবেশ করলেন।
অবশ্য যদিও ইতিপূর্বে মক্কা থেকে আসা মুহাজির ও মদীনার আনসার সাহাবীদের মাঝে কোন ধরনের মনোমালিন্য বা সমস্যার সৃষ্টি হয়নি; বরং মদীনার আনসারগণ হিজরত করে আসা মুহাজিরদেরকে সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন এবং তাদের জন্য যে কোন ধরণের ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু তদুপরি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার দ্বারা একটি বিষয় লক্ষ্য করলেন যে, আনসার ও মুহাজির এতদুভয়ের মধ্যে মিল-মুহাবব্বতের দিক থেকে কোন ধরনের সামান্যতম খুঁত না থাকলেও কেন যেন তারা একে অপরের সাথে পুরোপরি সহজ হতে পারছে না। তাদের মাঝে কেমন একটা ফাঁক বা শুন্যতা থেকেই যাচ্ছে। আনসারদের মাঝে ছিল একটা অতি সৌজন্যভাব। না জানি আতিথেয়তায় কোন ত্র“টি হয়ে যায়! আর মুহাজিরদের মধ্যে ছিলো একটা অতিথি সূলভ সংকোচ ও কুণ্ঠাবোধ।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবীদের মধ্যকার পারস্পারিক সাম্প্রীতির ক্ষেত্রে এতোটুকু শুন্যতাও রাখতে চাইলেন না। তিনি তাঁর অচিন্তনীয় বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সাহাবীদের মধ্যকার এ অনাকাঙ্খিত অম্বাভাবিকতা দূর করতে প্রয়াসী হলেন। এ লক্ষ্যে তিনি একদিন তাঁর সকল সাহাবীদেরকে তলব করলেন।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সকলে হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. -এর ঘরে এসে জমায়েত হলেন। সকলে উপস্থিত হলে প্রিয়নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমবেতদেরকে লক্ষ্য করে বললেন,
“শোনো মদীনাবাসী আনসারগণ! শোনো মক্কা থেকে আগত মহাজিরগণ! এক মুসলমান অপর মূসলমানের ভাই। সুতরাং আমি চাই যে তোমরা পরস্পরে জোড়ায় জোড়ায় একে অপরের ভাই হয়ে যাও। প্রত্যেকে অপর পক্ষের একজনকে নিজের ভাই ও বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে নাও।”
ব্যাস! এতটুকুই। শুরু হয়ে গেলো প্রতিযোগিতা। রাসূলের একটি কথা বাস্তবায়নের প্রতিযোগিতা। নবী প্রেমের যথার্থতা প্রমাণের প্রতিযোগিতা। কোন বাধ্য-বাধকতা নয়, জোড় করে চাপনো কোন আদেশ বা হুকুমও নয়; বরং রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জবানে উচ্চারিত একটি কথাই যেন আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে এক নব জাগরণের বাণ ডেকে আনল। ইতিপূর্বে মুহজির ও আনসার মুসলমানদের মধ্যে যে ভাতৃত্বের উন্মেষ ঘটেছিল, আজ যেন তা বস্তব রূপ পরিগ্রহ করলো।
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা শেষ হওয়ার পর পরই আনসার ও মুহজিরদের প্রত্যেকে অপর পক্ষের একজনকে নিজের ভাই বলে বরণ করে নিলেন। আর একে অপরকে ভাই হিসেবে বরণ করে নেয়ার এই বিষয়টি শুধু মুখে বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল না। বরং সাহাবায়ে কিরাম রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষিত এই ভাতৃত্বকে সিদিন বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন।
এই ভাতৃত্বের বিষয়টিকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য মদীনার আনসারগণ সেদিন ত্যাগ ও কুরবানীর এমন এক নিদর্শন কায়েম করেন, যা বর্তমান সময়ের লোকদের জন্য ধারণাতীত ও অকল্পনীয় মনে হবে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, সেদিন মদীনার আনসার সাহাবায়ে কিরাম রা. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি কথার উপর ভিত্তি করে নিজেদের ঘর-বাড়ী, জমাজমি, ধন-দৌলত সব কিছুরই অর্ধস্বত্ব হিজরত করে আসা মুহাজির ভাইদেরকে বন্টন করে দিয়েছিলেন। এমনকি আনসারদের মধ্যে যাদের একাধিক স্ত্রী ছিলো, তাদের কেউ কেউ নিজের এক স্ত্রীকে তালাক দিয়ে নতুন ভাইয়ের সাথে তাঁর বিবাহ দিতেও প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ হযরত সা’দ আবনে রাবী‘আর কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি তার মুহাজির ভাই আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. কে ডেকে নিয়ে বললেন,
“ভ্রাতা! আমার দুই স্ত্রী। তুমি এই দু’জনের কাকে পছন্দ করো বলো, আমি তাকে তালাক দিয়ে তোমার সাথে বিবাহ করিয়ে দেবো।”
মুহাজির ভাইদের জন্য আনসারদের সহযোগিতা-সহমর্মিতার এধরনের আরো শত-সহস্র ঘটনা ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। সাহাবায়ে কিরাম রা. এর এক অপরের জন্য এধরনের নিখাঁদ আন্তরিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তসমূহ আমাদের কাছে অতি সৌজন্য মূলক মনে হলেও আসলে এটাই ছিলো নবী প্রেমের প্রকৃত নমুনা এবং ইসলামকে বোঝার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
মদীনার আনসারগণ মক্কা থেকে আগত মুহাজির ভাইদেরকে নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে তাঁদেরকে আপন করে নিয়েছিলেন এবং তাঁদের যে কোন প্রয়োজনকে নিজের প্রয়োজনের উপর প্রাধান্য দিয়ে তা পূরণ করার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতেও প্রস্তুত হয়েছিলেন।
কিন্তু তাই বলে মুহাজির সাহবায়ে কিরামগণ তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা ও আত্মসম্মানবোধ বিলীন করে দেননি। মদীনার আনসারদের উপর ভরসা করে কাজ-কাম সব বাদ দিয়ে আলস্য গ্রহণ করে তাদের বোঝা হয়ে থাকেন নি। বরং তাঁরা আনসার ভাইদের সাহায্য-সহায়তা ও সহমর্মিতার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সুকৌশলে তার থেকে এড়িয়ে যেতেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিভিন্ন কাজ-কারবারের মাধ্যমে নিজেদের ব্যয়ভার নিজেরাই বহন করতেন। যার ফলে দেখা যায় যে, অল্প সময়ের মধ্যেই নি:স্ব মুহাজির সাহাবীগণও আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন করেন। স্বনির্ভর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এমন কি খাইবার বিজয়ের পর মুসলমানগণ যখন বিপুল অর্থ-সম্পদের অধিকারী হলেন, তখন মুহাজির সাহাবীগণ মদীনায় আনসারদের দেয়া সকল সহায়-সম্পত্তি ফেরতও দিয়ে দিয়েছিলন।
কিন্তু এই দেয়া নেয়ার মধ্য দিয়ে আনসার ও মুহাজির সাহাবীরা পরস্পরে একে অপরের প্রতি ভাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির যে দৃষ্টান্ত পেশ করেন, তা কিয়ামত পর্যন্ত তাদের অমর কীর্তি হিসাবে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।
মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র গঠন
আনসার ও মুহাজির মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে যখন সুদুঢ় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল, প্রত্যেক মুসলমানের মধ্যে নিজের উপর অপরকে প্রাধান্য দেয়া এবং অপর মুসলমান ভাইকে নিজের চাইতেও বেশী মুহাব্বত করার কাঙ্খিত মনোভাব যখন সৃষ্টি হয়ে গেল, তখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় বসবসকরী সকল ধর্মের ও সকল জাতি গোষ্ঠীর লোকদেরকে নিয়ে সম্মিলিতভাবে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে মনোনিবেশ করলেন।
আর এ লক্ষ্যে সফল হওয়ার জন্য প্রথমেই তিনি মদীনায় বসবাসকারী শতধাবিভক্ত ও পরস্পরে দ্বন্দ-সংঘর্ষ লিপ্ত আউস, খাযরাজ, মদীনার আদিম পৌত্তলিক, ইহুদী সম্প্রদায়, হিজরত করে আসা মুহাজির সাহাবায়ে কিরাম ও অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর লোকদের মধ্যকার দ্বন্দ-সংঘাত বন্ধ করে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করা ও একটি নিদিষ্ট নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন খুব জোড়ালোভাবে।
আর তাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করার প্রতি মনোনিবেশ করলেন। এ লক্ষ্যে তিনি মদীনায় বসবাসকারী সকল সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে আহবান করে একটি বৈঠকের আয়োজন করলেন। এতে তিনি সম্মিলিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা এবং এজন্য প্রথমে একটি ‘সনদপত্র’ বা চুক্তিনামা’ লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরলেন।
পরিশেষে সর্ব সম্মতিক্রমে সকল গোত্র ও সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের সর্বাত্মক স্বীকৃতি ও গণস্বাক্ষরের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সার্বিক ক্ষমতা প্রদান করে ও যে কোন উদ্ভুত সমস্যার সমাধানে ফয়সালা করার কর্তৃত্ত প্রদান করে, ৫৩ টি ধারা সম্বলিত একটি ঐতিহাসিক ‘চুক্তিনামা’ তৈরী করা হয়, যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত রাষ্ট্রীয় সনদের মর্যাদা লাভ করে ইতিহসের পাতায় ‘মদীনা সনদ’ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে।
চুক্তিনামা বা মদীনা সনদটি ছিলো নিম্মরূপ:
বিসমিল্লহির রাহমানির রাহীম
আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক জারীকৃত একটি লিখিত সনদনামা বা চুক্তিপত্র। যা মক্কা থেকে হিজরত করে আসা কুরাইশ, মদীনার মুমিন-মুসলমান আর যারা তাদের অনুসরণ করে তাদের পর্যায়ভুক্ত হবে এবং তাদের সঙ্গে জিহাদে অংশ গ্রহণ করবে -তাদের সকলের জন্য প্রযোজ্য হবে।
১। আজ থেকে মদীনায় বসবাসকারী ইহুদী, পৌওলিক ও মুসলিম সকলে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ইউনিট বলে বিবেচিত হবে।
২। এই মিল্লাতের সকলেই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউ কারো ধর্মে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
৩। এ চুক্তিনামায় সাক্ষরকারী এবং এতে উল্লেখিত বিষয়ে ঐক্যমত্য পোষণকারীদের মধ্যে থেকে কোন গোত্র বা সম্প্রদায় শত্র“ দ্বারা আক্রান্ত হলে পরে, সকলকেই সমবেত শক্তি দ¦ারা তা প্রতিহত করতে হবে।
৪। কখনও মদীনা বহিঃশত্র“ কর্তৃক আক্রান্ত হলে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সকলকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এবং প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজেদের যুদ্ধের ব্যয়ভার নিজেরাই বহন করবে।
৫। এই সনদের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ জনগোষ্ঠীর কোন পক্ষই অপর পক্ষের বিরূদ্ধে বহিঃশত্রদের সাথে কোন রূপ আঁতাত করতে পারবে না। কোন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারবে না।
৬। যদি কেউ নিজেদের কোন পক্ষের বিরূদ্ধে শত্র“দের সাথে কোন রূপ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় বা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাহলে তার সমুচিত শাস্তি দেয়া হবে।
৭। নিজেদের মধ্যে কোন বিরোধ দেখা দিলে তার মিমাংসা ও সমাধানের জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের শরণাপন্ন হতে হবে এবং তাদের সিদ্ধান্ত, মিমাংসা মেনে নিতে হবে।
৮। চুক্তিবদ্ধ সকল পক্ষকেই মদীনার বিশেষ মর্যাদার প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করে চলতে হবে।
৯। এই সনদের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ কোন পক্ষই কুরাইশ বা তাদের সাহায্যকারীদের আশ্রয় দিতে পারবে না।
১০। ইহুদীদের মধ্যে যারা এই সনদের প্রতি অনুগত থাকবে তাঁরা সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার ভোগ করবে, তাদের উপর জুলুম করা হবে না এমন কি তাদের শত্র“দেরও সাহায্য-সহযোগিতা করা হবে না।
১১। মুসলমানগণ যদি কোন বহি:শক্তির সাথে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হয় তাহলে সেই সন্ধির শর্তাবলী ইহুদী ও পৌওলিকদেরও মেনে চলতে হবে। অনুরূপভাবে ইহুদী বা পৌওলিকগনও যদি (মক্কার কুরাইশদের বাদ দিয়ে) অন্য কারো সাথে সন্ধিচুক্তি করে, তাহলে মুসলমানগণও সেই চুক্তি মেনে চলবে। তবে ধর্মীয় বিরোধ ও সংঘাতের কথা ভিন্ন ।
১২। মজলুম ও নিপীড়ীত লোকদেরকে আশ্রয় ও সাহায্য দেয়া হবে।
১৩। বিনা কারণে বা অন্যায়ভাবে নরহত্যা আজ থেকে হারাম বলে গণ্য হবে।
১৪। কোন মুমিনই অন্য মুমিনকে কোন কাফিরের জন্য হত্যা করবে না, আর কোন মুমিনের বিরুদ্ধে কাফিরকে সাহায্যও করবে না।
১৫। এই সহীফায় সন্নিবেশিত বিষয়ে ঐক্যমত্য পোষণকারী এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী কোন মুমিনের জন্য কোন অন্যায়কারীকে সাহায্য করা বা আশ্রয় দেয়া বৈধ হবে না। কেউ এমন লোককে আশ্রয় বা সাহায্য প্রদান করলে তার উপর আল্লাহর লানত এবং গজব আপতিত হবে এবং তার কাছে থেকে কোন বিনিময় বা বদলা গ্রহণ করা হবে না।
১৬। মুমিনদের মাত্র একটি চুক্তি। কোন মুমিন অন্য মুমিন ব্যতীত আল্লাহর রাহে জিহাদ করার লক্ষে চুক্তি করবে না। যতক্ষণ না ঐ চুক্তি সমতা এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সম্পাদিত হবে।
১৭। কুরাইশের মুহাজিরগণ পূর্ব প্রথা অনুযায়ী তাদের পরস্পরের মধ্যকার রক্তপণ প্রদান করবে আর মুমিনরা মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত নিয়ম এবং ন্যায়-নীতির নিরীখে মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের বন্দীদের মুক্ত করবে।
১৮। বনু আউফ পূর্ব প্রথা অনুযায়ী তাদের সদস্যদের জন্য তাদের প্রদত্ত পূর্বহারে রক্তপন আদায় করবে আর প্রতিটি গোত্র মুমিনের মধ্যে প্রচলিত নিয়ম-নীতি এবং ন্যায়-বিচার ও আদল-ইনসাফের ভিত্তিতে মুক্তিপণের সাহায্যে বন্দীদের মুক্তি করবে।
১৯। বনু সা‘ইদা পূর্ব প্রথা অনুযায়ী সদস্যদের জন্য তাদের পূর্বহারে রক্তপণ প্রদান করবে, আর প্রতিটি গোত্র মুমিনের মধ্যে উত্তম পন্থা এবং ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে মুক্তিপণের সাহায্যে বন্দিদের মুক্ত করবে।
২০। বনু হারিস পূর্ব প্রথা অনুযায়ী সদস্যদের জন্য তাদের প্রদত্ত পূর্বহারে রক্তপণ প্রদান করবে আর প্রতিটি গোত্র মুমিনদের মধ্যে উত্তম পন্থায় ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে বন্দীদের মুক্ত করবে মুক্তিপণ প্রদানের মাধ্যমে।
২১। বনু জুশাম পূর্ব প্রথা অনুযায়ী সদস্যদের জন্য তাদের প্রদত্ত পূর্বহারে রক্তের মূল্য দেবে আর প্রতিটি গোত্র মুমিনদের মধ্যে প্রচলিত কল্যাণকর এবং ন্যায়-বিচারের ভিত্তিতে মুক্তিপণ প্রদানের মাধ্যমে বন্দীদের মুক্ত করবে।
২২। বনু নাজ্জার পূর্ব প্রথা অনুযায়ী সদস্যদের জন্য তাদের প্রদত্ত পূর্বহারে রক্তের মূল্য দেবে আর প্রতিটি গোত্র মুমিনদের মধ্যে প্রচলিত কল্যাণকর এবং ন্যায়-বিচারের ভিত্তিতে মুক্তিপণ প্রদানের মাধ্যমে বন্দীদের মুক্ত করবে।
২৩। বনু আমর ইবনে আওফ পূর্ব প্রথা অনুযায়ী সদস্যদের জন্য তাদের প্রদত্ত পূর্বহাবে রক্তের মূল্য দেবে আর প্রতিটি গোত্র মুমিনদের মধ্যে প্রচলিত মল্যাণকর এবং ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে মুক্তিপণ প্রদানের মাধ্যমে বন্দীদের মুক্ত করবে।
২৪। বনু নবীত (আননাবীত) পূর্ব প্রথা অনুযায়ী সদস্যদের জন্য তাদের প্রদত্ত পূর্বহারে রক্তপণ আদায় করবে আর তাদের প্রতিটি দল মুমিনদের মধ্যে প্রচলিত নিয়ম-নীতি এবং ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে মূল্য দিয়ে বন্দীদের মুক্ত করবে।
২৫। বনু আউস (আল আউস) পূর্ব প্রথা অনুযায়ী সদস্যদের জন্য তাদের প্রদত্ত পুর্বহারে রক্তপণ আদায় করবে আর তাদের প্রতিটি দল মুমিনদের মধ্যে প্রচলিত নিয়ম-নীতি এবং ন্যায়-বিচারের ভিত্তিতে রক্তপনের মাধ্যমে বন্দীদের মুক্ত করবে।
২৬। মুমিনরা নিজেদের ঋণগ্রস্থ/অভাবগ্রস্থ কাউকেই পরিত্যাগ করবে না এবং মুক্তিপণ ও রক্তপণ আদায়ের জন্য তাঁর সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে।
২৭। কোন মুমিনই অন্য মুমিনের আশ্রিত ব্যক্তির (মওলা) সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করবে না তাকে (আশ্রয়দাতা) বাদ দিয়ে।
২৮। খোদাভীরু (মুত্তাকী) মুমিনগনের মধ্য থেকে কেউ বিদ্রোহী হলে তাঁর বিপক্ষে থাকবে অথবা কেউ মুমিনদের মধ্য থেকে অত্যাচার, পাপাচার, শত্র“তা বা ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করতে চাইলে সে তাদের থেকে কারও সন্তান হলেও তাঁরা সম্মিলিতভাবেই তাঁর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
২৯। বনু আউফের ইহুদীরা মুুমিনদের সঙ্গে একই উম্মাহ। ইহুদীদের জন্য তাদের ধর্ম আর মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম। তাদের মাওয়ালী বা আশ্রিত এবং তাঁরা নিজেরাও। অবশ্য যে-ই অন্যায় বা অপরাধ করবে, সে নিজের এবং তাঁর পরিবার পরিজনদেরই ক্ষতি করবে।
৩০। বনু নাজ্জারের ইহুদীরাও বনু আউফের ইহুদীদের মতোই।
৩১। বনু হারিসের ইহুদীরাও বনু আউফের ইহুদীদের মতোই।
৩২। বনু সাইদার ইহুদীরাও বনু আউফের ইহুদীদের মতোই।
৩৩। বনু জুমমের ইহুদীরাও বনু আউফের ইহুদীদের মতোই।
৩৪। বনু সালাবার ইহুদীরাও বনু আউফের ইহুদীদের মতোই।
৩৫। বনু সালাবার ইহুদীরাও বনু আউফের ইহুদীদের মতোই।
অবশ্য, যে অত্যাচার করবে আর বিশ্বাসঘাতকতা করবে, সে নিজের এবং পরিবার-পরিজনের ক্ষতিসাধন করবে।
৩৬। সালাবর শাখা গোত্র জাফনার ইহুদীরাও সালাবারই অনুরূপ।
৩৭। বনু শুতাইবার ইহুদীরাও বনু আউফের ইয়াহুদীর মতোই।
৩৮। পাপাচার নয়, পূণ্যই কাম্য।
৩৯। সালাবার মাওয়ালী বা আশ্রিত ব্যক্তিবর্গ তাদেরই মতো ।
৪০। ইহুদীদের বন্ধুরাও (চুক্তিবদ্ধ) তাদের মতোই।
৪১। আমদের সাথী হয়ে যুদ্ধে করবে এমন প্রতিটি সেনাদল পরস্পরানুসারে একে অন্যের পেছনে থাকবে।
৪২। আল্লাহর রাহে দেওয়া রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার অদম্য স্পৃহায় মুমিনগণ পরস্পর একে অপরকে সাহায্য করবে।
৪৩। মুত্তাকী বা খোদাভীরু মুমিনগণই সর্বোত্তম এবং সঠিক হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত।
৪৪। কোন মুশরিকই কুরাইশদের জান অথবা মালের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে না। মুুমিনকে কেউ অন্যায়ভাবে হত্যা করলে এবং তা প্রমাণিত হলে প্রতিদানে তাকেও হত্যা করা হবে। তবে হ্যাঁ, নিহত ব্যাক্তির গুলী বা উত্তরাধিকারী যদি রক্তপণ গ্রহণে সন্তুষ্ট হয় তবে সেটা ভিন্ন কথা।
৪৫। কারও ক্ষতির প্রতিশোধ নেয়ার জন্য কাউকেই বাঁধা দেয়া হবে না। কেউ হঠকারীতা প্রদর্শন করলে তার জন্য সে নিজে এবং তার পরিবারই দায়ী থাকবে। তবে হ্যা কেউ অত্যাচারিত হলে তার কথা ভিন্ন।
৪৬। অমুসলমানদের মধ্যে কেউ কোন অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য হবে। সে জন্য তাঁর জাতীর অধিকার খর্ব করা হবে না।
৪৭। কোন নারীকে তার গোত্র বা পরিবারের অনুমতি ছাড়া আশ্রয় দেয়া যাবে না।
৪৮। এই চুক্তি গ্রহণকারীগণ শত্র“র মোকাবেলায় পরস্পরে একে অপরকে সদুপদেশ দ্বারা কল্যাণকর কাজে সাহায্য করবে। পাপ কাজে নয়।
৪৯। আশ্রিতরা আশ্রয়দানকারীদের নিজেদের মতোই। যে পর্যন্ত না তাঁরা কোন অন্যায় বা বিশ্বাসঘাতকতা করবে।
৫০। প্রতিটি মানুষই স্বপক্ষের কাছ থেকে তার প্রাপ্য অংশ পাবে।
৫১। বনু আওসের ইহুদী, মাওয়ালী এবং তারা নিজেদের এই চুক্তির মধ্যে শরীকদের মতোই হবে। তারা অন্যদের সাথে সম্মানজনক আচরণ করবে এবং তাদের সাথেও সম্মানজনক আচরণ করা হবে।
৫২। যে ব্যক্তি এই চুক্তির প্রতিটি ধারার প্রতি নিষ্ঠাবান ও বিশ্বস্ত থাকবে তাঁর প্রতি আল্লাহ তা’আলা এবং তাঁর বান্দা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও দায়িত্তশীল ও পৃষ্ঠপোষক থাকবেন।
৫৩। আল্লাহর নামে এটা চিরস্থায়ী প্রতিজ্ঞা। যে বা যারা এটা ভঙ্গ করবে, তাদের উপর আল্লাহ তা’আলার গযব নেমে আসবে।
এটিই ছিল রাসূলের তৈরী ‘মদীনা সনদ’। পৃথিবীর ইতিহসে এটাই প্রথম লিখিত চুক্তি। এর মাধ্যমে মদীনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিলো। এই চুক্তিনামা তৈরীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেই বিচক্ষণতা ও দূরদর্শীতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন, কিয়ামত পর্যন্ত তার স্বীকৃতি অব্যাহত থাকবে।
চলবে... পরবর্তী পর্ব: বিশ্বমানবের জন্য অতুলনীয়, অদ্বিতীয় ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা
পূর্বের লেখা:
রাসূল সা. এলেন মদীনায়
রহস্যে ঘেরা মদীনা:
মদীনায় অবস্থানকারী জাতি-গোত্রসমূহ
ঈমানের আলোয় আলোকিত হৃদয়
নির্মিত হলো কুবা মসজিদ
সৌভাগ্যের রহস্য
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!
অপেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন
কাছে থেকে আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....
আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....
২০০১ সালের কথা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে আমার কোম্পানি টেকনিক্যাল অফারে উত্তীর্ণ হয়ে কমার্শিয়াল অফারেও লোয়েস্ট হয়েছে। সেকেন্ড লোয়েস্টের সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ
বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন
=নারী বুকের খাতায় লিখে রাখে তার জয়ী হওয়ার গল্প (জীবন গদ্য)=
বুকে উচ্ছাস নিয়ে বাঁচতে গিয়ে দেখি! চারদিকে কাঁটায় ঘেরা পথ, হাঁটতে গেলেই বাঁধা, চলতে গেলেই হোঁচট, নারীদের ইচ্ছেগুলো ডিমের ভিতর কুসুম যেমন! কেউ ভেঙ্গে দিয়ে স্বপ্ন, মন ঢেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি
আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।
সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন