ঘুমোচ্ছি। হ্যাঁ, তোমার যখন
খুশি যেতে পারো। ওদের বললেই
তোমাকে খেতে দেবে।
দোকানে দোকানে সব সময়
খাওয়া ভালো না লাগারই কথা। সেই
তো বিরিয়ানি, নয়তো পরোটা-গোশত।
কত দিনের পুরোনো কে জানে। স্বাদ
বদলের জন্য এসো আমার
বাড়ি মাঝে মাঝে। যখন খুশি।
আমি বলে রাখব। জমির চাচা বললেও
আমি সঙ্গে সঙ্গে তার বাসায় যাইনি।
আমার মনে বেশ সন্দেহ জমেছিল।
আস্তে আস্তে লোকটার
চেহারা খুলে যাচ্ছিল আমার সামনে।
জমির চাচা নিজেই একদিন
নিয়ে গেলেন তার বাসায়। প্রায় জোর
করেই ড্রিংক করালেন
ড্রয়িংরুমে বসে। সেদিন বেশিই
খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, তারই চাপে।
ড্রিংকের পর পোলাও-
কোর্মা খাওয়া হলো। খুব
ফুর্তি লাগছিল। অমন
মজা করে খাইনি অনেক দিন।
তিনি যখন অনেক রাতে বললেন,
দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন
হোস্টেলে যাওয়া ঠিক হবে না।
থেকে যাও এখানে।
তাঁকে বেশি করে বলতে হলো না।
থেকে গেলাম প্রায় স্বেচ্ছায়। সেই
শুরু। তারপর বেশ কয়েক দিন
হয়েছে অমন, একসঙ্গে ড্রিংক করা,
খাওয়া আর ঘুমানো। দলের
ছেলেরা তো বোকা না, টের
পেয়ে গিয়েছে। ঠাট্টা করেছে,
মিসট্রেস বলে। গায়ে মাখিনি। এমন
ভাব করেছি, যেন শুনতেই পাইনি।
ওরা ঠাট্টা করা বন্ধ করেনি।
জমির চাচাকে কেন বলিনি ওদের
কথা? এই জন্য বলিনি যে জমির
চাচা ওদের কিছু বলবেন না। তাদের
নিয়ে কাজ করতে হয় তাকে।
তিনি রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন,
অনেক জায়গাজুড়ে মঞ্চ। রাস্তায়,
ফুটপাতে মানুষের ভিড়। অল্প বয়সের
ছেলেমেয়েই বেশি। স্লোগান
উঠছে থেকে থেকে, কোলাহল বাড়ছে।
তিনি সীমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
তুমি মঞ্চে যাবে না আজ? স্লোগান
দিতে?
না। ছাত্রনেতারা পলিটিকস
করছে আমার সঙ্গে। বলছে, তাদের
খাদ্য হতে হবে। শুধু জমির চাচার
একার খাদ্য হলে চলবে না। রাতের
বেলা মঞ্চের আশপাশে তাদের সঙ্গেও
শুতে হবে। তাহলেই হাতে মাইক্রোফোন
দেবে, নচেৎ নয়।
শুনে তিনি অবিশ্বাসের চোখে তার
দিকে তাকান। রাস্তার স্লোগান
ক্রমেই জোরালো হয়।
তিনি সীমা নামের মেয়েটিকে বলেন,
মাইক্রোফোন ওরা কন্ট্রোল করে? ওরাই
ঠিক করে কে কখন স্লোগান দেবে?
তা নয় তো কী? ওরাই তো মঞ্চের
নেতা। ওদের কথা যারা মানবে না,
তারা হাতে মাইক্রোফোন পাবে না।
গলা যত সুন্দরই হোক। আমার
মতো ভরাট গলা হলেও চান্স
পাবে না। মেয়েটি হঠাৎ তার
দিকে তাকিয়ে বলল, শুনবেন স্যার?
একটা স্লোগান দেব? আমার ভরাট
গলায়?
না, না। দরকার নেই। এমনিতেই
বুঝতে পারছি তোমার গলা বেশ ভরাট।
রেডিও, টিভি অ্যানাউন্সারদের মতো,
নিউজ রিডারের মতো।
মেয়েটি খুব খুশি হয় শুনে।
হাসিমুখে বলে, সত্যি বলছেন স্যার?
টিভি অ্যানাউন্সার, নিউজ রিডারের
মতো? বলতে বলতে মেয়েটির চোখ
ভিজে এল। ধরা গলায় বলল, আমার
মতো অধঃপতিত মেয়ের
ভাগ্যে কি তা হবে কখনো? হতে পারত
যদি খারাপ হয়ে না যেতাম।
ভালো পথে চলতাম। ভালো লোকের
সঙ্গে মিশতাম। কিন্তু
তা কী করে সম্ভব? আমার মতো অবস্থার
একটা মেয়ে ভালো পথে কী করে চলবে?
ভালো মানুষের সঙ্গ সে কোথায় পাবে?
হাজার চেষ্টা করলেও তা হবে না।
পাবনা থেকে ঢাকা অনেক দূরের পথ।
আমি তো জানি পথের বাধাগুলো কোথায়
কোথায় দাঁড়িয়ে। না, অত বড় কিছুর
কথা ভাবতে পারি না আমি এখন।
ছোটখাটো একটা চাকরি পেলেই
বর্তে যাব। যেকোনো কাজ,
যা ভদ্রভাবে চলতে দেবে,
সুন্দরভাবে থাকতে দেবে।
আচ্ছা স্যার, আপনার টেলিভিশন
চ্যানেলে লেখাটেখার কোনো কাজ
নেই? আমি খুব ভালো বাংলা লিখি।
কবি শামসুর রাহমানের ওপর
লেখা আমার কয়েকটা প্রবন্ধ আছে।
অনেকে প্রশংসা করেছিল। আরও
কয়েকটা লিখে একটা বই বের করব
ভেবেছিলাম। কিন্তু সময় হলো না।
ইচ্ছেটা এখনো আছে।
জমির চাচাকে বলব?
তিনি উড়িয়ে দেবেন কথাটা। বলবেন,
কবি-টবিদের ওপরে বই
লিখে কী হবে? তার চেয়ে আমাদের
দলের ওপর লেখো। দলের নেতাদের
ওপর লেখো। তারপর একটু
থেমে বলেছেন, তোমার
অসুবিধা কোথায়? এই সব কথা তোমার
মাথায় ঢোকে কেন? মাসে তিন হাজার
টাকা পাচ্ছ। সেই টাকায় কলেজের
ফি, হোস্টেলের খরচ দিচ্ছ। এই
বয়সে এর চেয়ে ভালো চাকরি আর
কী হতে পারে? তাও আবার
পার্টটাইম। পরীক্ষায় পাস করার পর
বেশি বেতনে চাকরি পেয়ে যাবে,
তখন তুমি শুধু শামসুর রাহমান কেন, সব
কবিদের নিয়ে লিখবে। এখন
তোমাকে আমার অফিসের কাজের জন্য
বেশি দরকার। ছাত্রনেতারা হাসি-
ঠাট্টা করে?
তা একসঙ্গে করলে বন্ধুরা অমন
করবেই, গায়ে না মাখালেই
হলো অথবা হেসে উড়িয়ে দেবে। আর
শোনো, আমাকে না বলে ছাত্রনেতাদের
সম্পর্কে কিছুই বলতে যাবে না।
ওরা রেগে গেলে সবকিছু করতে পারে।
দল ভেঙে অন্য কোথাও যাওয়ারও
চেষ্টা কোরো না। দলের
ছেলেরা সেটা সহ্য করবে না।
ওরা সাংঘাতিক কিছু করে ফেলবে।
দলের ছেলেমেয়েদের
দলে রাখা তাদের জন্য
একটা প্রেসটিজের ব্যাপার।
ইচ্ছে করলেই
কাউকে চলে যেতে দেওয়া যায় না।
ঢোকা সহজ, বেরোনো কঠিন। বুঝলে?
মাথা ঠিক রেখে কাজ করো।
সমস্যা হলেই আমার কাছে চলে আসবে,
খোলাখুলি সব বলবে।
জমির সাহেব মঞ্চের ছেলেদের বলছেন
না কেন তোমাকে মাইক্রোফোন দেওয়ার
জন্য?
তিনি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করেন।
বলছেন না এই জন্য যে তিনি তাদের
সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে চান না।
তা ছাড়া ব্যাপারটা নাটকের মতো।
পেছন থেকে প্রম্পটার যা বলছে, তাই
নিয়ে স্লোগান হচ্ছে,
সে অনুযায়ী সবকিছু চলছে।
বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না।
জমির চাচা মঞ্চের পেছন
থেকে সামনে আসতে যাবেন কেন?
তিনি এবং তার
বন্ধুরা টাকা দিয়ে যাচ্ছেন, খাওয়ার
প্যাকেট পাঠাচ্ছেন। মঞ্চ চালু
থাকছে, মিছিল বের হচ্ছে। ব্যস,
এতেই তারা সন্তুষ্ট। একটা মেয়ের
জন্য তিনি কিংবা তার
সহকর্মীরা ছাত্রনেতাদের
খেপাতে যাবেন কেন? নিজের
দুর্বলতা থাকলে এমনই হয়। না, জমির
চাচাকে বলে কিছু হবে না। সে আমার
জানা আছে। হাতে মাইক্রোফোন
পাওয়ার একটাই উপায়।
ছাত্রনেতাদের কথা শুনতে হবে।
সোজা কথায়, তাদের খাদ্য হতে হবে।
হ্যাঁ স্যার, আমার মতো মেয়েরা সবাই
খাদ্য। তারা মেনে নিয়েছে, ইচ্ছায়
এবং অনিচ্ছায়। কী করবে? বাবার এত
টাকা নেই যে তার খরচে ঢাকায়
থাকবে। চাচা নেই, মামা নেই
যে সাহায্য করতে পারেন। একমাত্র
জমির চাচারা আছেন। তারা আগ
বাড়িয়ে সাহায্য করতে আসেন। বড়
মিষ্টি তাদের ব্যবহার। প্রায়
অপত্যস্নেহে তাঁরা সঙ্গে নিয়ে
ঘোরেন।
মেয়েটি প্রসঙ্গ বদলায়। বলে,
আপনাকে টেলিভিশনে দেখেছি,
টকশোতে আপনার কথা শুনেছি।
আপনাকে অন্য রকম মনে হয়েছে।
মানে অন্য পুরুষদের মতো না। আমার
ভুলও হতে পারে। কিন্তু সত্যিই
আপনাকে দেখে আমার এমন
মনে হয়েছে। তা স্যার, পারবেন
আমার জন্য কিছু করতে? বড় কিছু না।
মঞ্চের আড়ালেই থাকব,
লেখালেখি কিছু থাকলে করে দেব।
টেলিভিশনেও লেখার কাজ নিশ্চয়ই
আছে?
এই বইটা থেকে পড়ব? কতটুকু? এক
প্যারা? বেশ পড়ছি।
বলে মেয়েটি পড়তে থাকে এক মনে।
পড়া শেষ হলে সে তাকে বলে, ক্যামন
হলো স্যার? স্লোগান
দিয়ে দিয়ে গলাটা ভেঙে গিয়েছে।
নরমাল হলে আর একটু ভালো হতো।
তা লেখালেখির কাজের জন্য তো গলার
স্বরের দরকার নেই। আমার
লেখা প্রবন্ধগুলো আপনাকে দেব।
কবি শামসুর রাহমানের ওপর
লেখা প্রবন্ধ। আমার খুব প্রিয়
কবি ছিলেন। ‘স্বাধীনতা তুমি’
কবিতাটি পড়লেই আমার গায়ের রোমকূপ
দাঁড়িয়ে যায়। আমি প্রবন্ধগুলো আপনার
অফিসে গিয়ে দিয়ে আসব। আপনার
কাছে পৌঁছাবে কি না কে জানে। কত
রকমের সিকিউরিটি আপনাদের
অফিসে। তবু আমি দিয়ে আসব।
তিনি পকেট থেকে মোবাইল বের
করে চোখের
সামনে নিয়ে একটা নম্বরে টিপ
দিলেন। তারপর ওপাশে কণ্ঠস্বর
শোনা যেতেই তিনি বললেন,
একটা মেয়ে যাবে অফিসে। নাম
সীমা। ওর একটা অডিশন নেবে। হ্যাঁ,
সে একটা কিছু পড়ে যাবে,
যা তোমরা তাকে দেবে। শোনার পর
নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে।
তারপর আমাকে তোমাদের মত দেবে।
হ্যাঁ, আমিও শুনব তার রেকর্ড
করা অডিশন।
স্যার, আমি টেলিভিশনে অডিশন দেব?
সত্যি বলছেন? না, না ঠাট্টা করবেন
না আমার সঙ্গে। আমি এর মধ্যেই
জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছি। আর
বাড়াতে চাই নে কষ্টের বোঝা।
স্যার, চাকরি না দেন, আমার
সঙ্গে ঠাট্টা করবেন না।
আমি মফস্বলের সামান্য একজন মেয়ে,
তার ওপর আবার অধঃপতিত।
পড়ে গেলে নাকি ওঠা কঠিন।
আমি একটু দেখতে চাই, পড়ে গেলেও
ওঠা যায় কি না, তার জন্য ছোট
একটা সুযোগ দেন শুধু।
তিনি মেয়েটির
দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি খুব
বেশি কথা বল।
শাহবাগ চত্বর লোকে লোকারণ্য। সব
বয়সের মানুষ নর-
নারীতে ভরে গিয়েছে সব রাস্তা,
ফুটপাত। সবাই ব্যগ্র
হয়ে তাকিয়ে আছে দক্ষিণের দিকে,
যেখানে জাতীয় জাদুঘর, পাবলিক
লাইব্রেরি আর তারপর আর্ট
ইনস্টিটিউট। হকাররা ভিড়ের
মধ্যে নানা ধরনের জিনিস
বিক্রি করছে। খেলনা, খাবার জিনিস
—সবই। লাল আর সাদা হাওয়াই
মিঠাইয়ের পেজা তুলার
মতো ফাঁপানো শরীর প্লাস্টিকের ভেতর
থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বাবার
কাঁধে চড়ে একটা শিশু হাওয়াই মিঠাই
খাচ্ছে, কাঁধে চড়েই কেউ
বাতাসে খেলনা নাড়ছে।
বাঁশি বাজাচ্ছে এক হকার, গলায়
ঝোলানো ঝোলায় বিক্রির বাঁশি।
শুকনো মিষ্টি বিক্রি করছে
ঠেলাওয়ালা। বাতাসে ভাজা-পোড়ার
গন্ধ। শিশুপার্কের সামনে এক
চিলতে জায়গায় ফকির আলমগীর তাঁর
দল নিয়ে লালনসংগীত গাইছেন ফিউশন
সুরে।
একটু পরে আর্ট ইনস্টিটিউট
থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হলো।
সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের মধ্যে ঢেউয়ের
মতো একটা চঞ্চলতা আছড়ে পড়ল।
পেপিয়ার-ম্যাশে তৈরি মস্ত বড় বাঘ,
প্যাঁচা, ময়ূর মাথার
ওপরে তুলে এগিয়ে আসছে শোভাযাত্রার
ছেলেমেয়েরা। উত্তেজনায়
ফেটে পড়ছে যেন, চঞ্চল
হয়ে উঠেছে ভিড়ের মানুষ।
গরমে ঘামছে সবাই, লাল
হয়ে এসেছে মুখ। ধুলো উড়ছে,
বাতাসে রোদের ঝাঁজ।
মেয়েটি ক্যামেরার
সামনে দাঁড়িয়ে হাতে মাইক্রোফোন
নিয়ে বলছে, ‘নতুন বর্ষকে স্বাগত
জানিয়ে এগিয়ে আসছে মঙ্গল
শোভাযাত্রা। এতক্ষণ যারা অধীর
প্রতীক্ষায় ছিল, হাজার হাজার সেই
সব নর-নারী শিশু-কিশোরের
প্রতীক্ষা শেষ হলো। গান
শোনা যাচ্ছে, এসো হে বৈশাখ,
এসো এসো।’ বলতে বলতে মেয়েটির স্বর
ক্রমেই উঁচু হলো। এত কোলাহল, গানের
চড়া সুর, তার ভেতরে মেয়েটির
কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
সে পরেছে লাল পেড়ে সাদা সুতির
একটা শাড়ি। তার এক হাতে ছোট
গাঁদা ফুলের মালা বালার
মতো জড়িয়ে।