'আই হেইট পলিটিক্স' ব্যাখ্যা করতে গেলে মধ্যবিত্তের বিকাশের উপলক্ষ গুলো বিস্তারিত আলোচনায় আনা দরকার। এখানে আসতে পারে অনেকগুলা বিষয়-
১। ঘুষের বিস্তার, সরকারি দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্র নির্ভর মধ্যবিত্ত বিকাশ,
২। চাঁদাবাজি ও অবৈধ ইনকাম জাত রাজনৈতিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ,
৩। ব্যবসায়িক জালিয়াতি ও দুর্নীতির জাত মধ্যবিত্ত বিকাশ,
৪। বেসরকারি খাতের বিকাশ ও ঋণ নির্ভর ব্যক্তি উদ্যোগের বিকাশ।
আমাদের নাগরিকদের অনেকেই দুর্বিত্ত প্রশাসনিক কিংবা দুর্বিত্ত রাজনৈতিক সংশ্রবে এসে দুধের বাটি হাতে পেয়ে গেছেন, কেউ সন্ধান পেয়েছেন তবে এখনও ভোগের ও ভাগের লাইনে অপেক্ষারত। বাকি একটি বড় অংশ এই সুযোগের অপেক্ষায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বদরুদ্দীন উমর স্কুল অফ থটে বলা যায়, অবৈধ সম্পদ অর্জনে ভাটা আসতে পারে এই ভয়ে মধ্যবিত্ত পরিবর্তনে ভয় পায় কিংবা রাজনীতি ঘৃণার ভান ধরে।
*******
৫। তবে গুরুত্বপুর্ণ বিষয়, সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের বিশেষ করে তরুণদের জীবনযাত্রাকে চেঞ্জ করে ফেলায়, আগে থেকেই থেকে যাওয়া ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক শহুরে ভোগবাদীতা মধ্যবিত্তের রূপান্তর প্রক্রিয়াকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়া।
৬। মধ্যবিত্ত ট্রান্সফর্মেশানের ষষ্ঠ ধাপ আমি মনে করে সাহিত্য ও শিল্পে বিরাজনীতি করণ। হুমায়ুন আহমেদের হাত ধরে বাংলাদেশের সাহিত্য পাঠক কলকাতা থেকে ঢাকায় অবতরণ করলেও তাঁর সাহিত্য ব্যাপকভাবে সমাজ ও রাজনীতি সচেতনতাকে এড়িয়ে গেছে। হ্যাঁ সমাজের দৈনন্দিন যাপিত জীবনকে অলংকৃত করেছে, কিন্তু তাতে তরুণদের দেশ গড়ার কোন উৎসাহ দেয়া হয়নি। (ফুটনোট দিয়ে রাখি যে, Faruk Wasif ভাইয়ের এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন অব্জার্ভেশান আছে)। সমাজ সচেতনতা এবং রাজনীতি বিরুদ্ধ এই ধারা এখন সাদাত হোসেনরা ফলো করছেন।
বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গন সরকারি টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। দুটা পয়সা আর একটা পদের পিছে ঘুরছে আমাদের সমূদয় ক্লাসিক্যাল শিল্পের সব অঙ্গন। হাজার হাজার বই প্রকাশিত হচ্ছে, সামান্য অংশ সরকারের নজর পেতে নেতা তোষণ কেন্দ্রিক, বাকি সব মধ্যবিত্তের ট্রান্সফর্মেশানের পঞ্চম ধাপ আমি মনে করে সাহিত্য ও শিল্পে বিরাজনীতি করণে ঠাসা। বিএনপি ক্ষমতা থেকে যাবার পরে তত্ত্বাবধায়কের আমলে রাজনীতি কিছু নাটক হয়েছে, পরের নাটক ও সিনেমায় সমাজ ও রাজনীতি অনুপস্থিত। আছে প্রেম, বিনোদন, বেহায়াপনা, অপসংস্কৃতি। পরিচালকরা ক্ষমতা চাটায় প্রতিযোগিতা করছে। সম্প্রতি মহানগরের মাধ্যমে আশফাক নিপুন আলো ছড়িয়েছেন।
৭। মধ্যবিত্তের ট্রান্সফর্মেশানের পরের ধাপ সরকার প্রযোজিত মোটিভেশনের গল্প বিক্রি ও শর্টকাটে বড়লোক হওয়ার ফাঁদ। ব্যবসার ও বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি না করে, দক্ষতা তৈরি না করে, বিদ্যুৎ পানি জমি বাসা ভাড়া পরিবেশ শোধন সহজ না করে- বলা হয়েছে সরকারের দিকে চেয়ে না থেকে, নিজে উদ্যোক্তা হও, চাকরি দেও।
উদ্যক্তা, ই-কমার্স, ব্যাংক ঋণ দেখিয়ে ধনী হওয়ার শর্টকাট দেখানো হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে সীমাহীন অর্থ অপচয় ও লুট করা, মানহীন কাজ করা, প্রশাসনিক জালিয়াতির মাধ্যমে অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো কিংবা উন্নয়ন প্রকল্পের সময়ক্ষেপণ করে টাকা মেরে রাজনৈতিক প্রভাবশালীর বলয়ে রেখে মধ্যবিত্তের ছোট একটা অংশের বিকাশ নিশ্চিত করা হয়েছে। জবাবদিহিহীন রাষ্ট্রে বেপরোয়া দুর্নীতি, লুটপাট ও জালিয়াতির মাধ্যমে একদল কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী রাতারাতি প্রথমে উচ্চ মধ্যবিত্ত পরে ধনী হন।
৯। দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি ১৪ দল ছাড়া বিরোধীদের একেবারেই রাজনীতি করতে না পারা, দাঁড়াতে না দেয়ার ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে দেশের ছাত্ররা সরকারি দলের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণে বাধ্য হয়ে ক্রিয়েটিভিটি এবং সমাজ সচেতনতা হারিয়েছে। ডিবেটিং ক্লাব, পলিসি ক্লাব, এনভায়রন্টাল ক্লাবের মত সমাজ ও পলিসি বেইজড কাজগুলো না থাকা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক মুর্খ বানিয়ে ফেলেছে, রাজনীতি নিয়ে তারা মিডিয়ার সামনে নির্বোধের মত কথা বলে। রাজনীতি বিষয়ে অনাগ্রহী প্রজন্ম নিজেদের চেয়ে শতগুণ নিকৃষ্ট লোকদের দিয়ে শাসিত হচ্ছে।
১০। মাদ্রাসা শিক্ষাকে বিরাজনীতি করণ। হেফাজতের মত অরাজনৈতিক সংঘঠন দেশের কওমি মাদ্রাসা ছাত্রদের রাজনৈতিক আধিকার বিষয়ক সচেতনতা থেকে দূরে রেখেছে।
****
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে স্কুলের বাচ্চারা যেভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিলো সেটা অকল্পনীয় ছিলো। তারা যতটা নিয়ম ঠিক করতে চেয়েছেন ততটা কিন্তু রাজনীতি নয়। কিংবা যখন তারা রাজনীতি মেরামতের চিন্তা শুরু করেছেন তখন তাদের হিংস্র শক্তি দিয়ে স্বৈরাচারী সরকার আন্দোলনকে শক্তিহীন ও ব্যর্থ করে দেয়।
****
সব কিছুর ফল হচ্ছে, 'আই হেইট পলিটিক্স'। রাজনীতি ঠিক করতে মধ্যবিত্তের কোন পার্টিসিপেশন নাই, কিন্তু সংকটে মধ্যবিত্ত রাজনীতিবিদদের গালি দিয়ে কাজ সারে, কিন্তু রাজনীতিবিদ যখন ম্যাসিভ পলিসি করে তখন আপনি তার প্রভাব নিয়ে মধ্যবিত্ত ভাবে না, নির্বিকার থাকে। অথচ এই পলিসি তার জীবনকে প্রভাবিত করে চলেছে। এই এক ভয়ংকর দ্বিচারিতার ভিতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি। কথা ছিল মধ্যবিত্ত নিজেই রাজনীতির রুল ওফ গেইম চেঞ্জ করে দিবে, কিন্তু মধ্যবিত্তই যে দেশের শুভ পরিবর্তনের মূল শক্তি যায়গা, এই উপলব্ধিটাই অনুপস্থিত। ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, পুলিশ ও প্রশাসন যে তাদের যেকোনো কাজের জন্য জনগণের কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য এই বোধটাই মানুষের মধ্যে নাই। আউটডোর খেলাধুলা না থাকায় হেলদি গ্রুপ এক্টিভিটি নাই। উপরন্তু আফিমের মত নানা ধরনের নেশায় আসক্ত। প্রেম, ভিডিও গেম, অনলাইন জুয়া ইত্যাদি এখন মহামারির মত ছড়িয়ে পড়েছে।
আমাদের উচ্চ মধ্যবিত্ত দুর্নীতি সহায়ক লুটেরা কাঠামোকে মেনে নিয়েছে, এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ বিত্ত আমাদের অনৈতিক এস্টাব্লিশ্মেন্ট এর ভিত্তি হয়ে গেছে, রাষ্ট্রচিন্তায় তার অংশগ্রহণ শুধুই ব্যক্তি সম্পদ সৃষ্টি কেন্দ্রিক, কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনে তার কোন কার্যকরিতা নেই।
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বয়সে ৩০ এর কম তরুণ যারা বুঝতে শিখেছে তাদের জীবনে গনতন্ত্রের কোন কালেকটিভ মেমোরি বা সম্মিলিত অভিজ্ঞতা না থাকা। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই বিষয়টা নিয়ে বিরোধীদের অসচেতনতা। বিরোধীরা আজকের তরুণদের দেশের সীমিত গণতান্ত্রিক যাত্রার ২০ বছরে সাফল্য মেসেজিং করতে পারেনি। এই দশকে বিরোধী রাজনীতির উল্লেখ্যযোগ্য বিষয় রাষ্ট্র সংস্কারে ঐক্যমত্য, বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চ যে রূপরেখা দিয়েছে সেটা পারফেক্ট না, তবে বড় ঘটনা। কিন্তু দেখুন রাষ্ট্র সংস্কার কেন দরকার, তরুণদের জন্য এই নিয়ে আলাদা মেসেজিং নেই। একদিকে তরুণরা সরকারি দলের হিংস্রতা দেখছে ঠিকই, পাশাপাশি তারা শুনছে কিছু উগ্র বিরোধী এক্টিভিস্টের গালিগালাজ, নোংরা প্রতিক্রিয়াশীল মেসেজিং। নতুন বিশ্বাসযোগ্য আশা দেখছে না বরং তারা প্রতিহিংসার ভয়ে আক্রান্ত। ফলে গণতন্ত্রের আকাংক্ষা তাদের আলোড়িত করছে না। তাদের অপেক্ষাকৃত ছোট জীবনে রাজনীতি তাদের সামনে কোন ভ্যালু তৈরি করেনি।
Tariq Sadat ভাইয়ের একটা হাইপো থিসিস দিয়ে শেষ করি, ''আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের রসদ ছিলো জিয়ার ক্যাপিটালিস্ট ইকনোমিক লিবারাইজেশন ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির রিসেন্ট মেমোরি। খালেদা জিয়া সফলভাবে এই মেমোরিকে ক্যাপিটালাইজ করে তরুনদের এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত করতে পেরেছিলেন।''
কিন্তু পরে দেখা গেল, গণতন্ত্র মানে একদিকে দুর্নীতি অন্যদিকে হরতাল, চট্রগ্রাম বন্দর অচল। হরতালে স্কুল কলেজ বন্ধ। গণতন্ত্র মানে হলো দলীয় লেজুড় বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি, এবং অবাধ সন্ত্রাস ও মারামারির অধিকার। শিক্ষকদের নিদারুণ হীনতা, রাজনীতির গোলাম বনে যাওয়া। রাজনৈতিক কারণে একের পর এক সরকারি চাকরির পোস্টিং বা বদলি, সরকারি সৎ কর্মচারীর দুঃখ কষ্ট। রাজনীতির সাথে জড়িতদের প্রশাসনে পদায়ন প্রমোশান, ঘুষের আস্ফালন, তদবিরের দৌরাত্ম্য এবং এমপিদের মাফিয়া দৈত্য হয়ে উঠা, চাঁদাবাজির মহামারি।
সবমিলে নতুন করে কালেক্টিভ মেমেরি যেহেতু নাই, হয় সেটা তৈরির সম্মিলিত চিন্তা ও চেষ্টা দরকার, নতুনবা দরকার বাস্তবায়ন যোগ্য আশা ও স্বপ্ন তৈরি ও মেসেজিং, সংস্কারের এর যৌক্তিক রোডম্যাপ ও পথ নির্দেশনা। বড় প্রশ্ন হচ্ছে, মধ্যবিত্ত রুপান্তরকে নিউ শেইপ দিতে থট লিডার/ইয়থ লিডাররা কি চিন্তার নতুন বিন্যাস নিয়ে হাজির হতে পারবেন কী!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ৩:১৭