বিএনপি বর্তমান স্ট্যাটাস্কোকে কাজ লাগাতে সমর্থ হবে কিনা সেটা ভবিষ্যৎ বলে দিবে, কিন্তু বর্তমানের সব রুট সরকারের পতনের পথেই মিলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান পরিষ্কার, তারা স্বচ্ছ নির্বাচন চায় এবং তারা এটাও জানে তত্ত্ববধায়ক বা নির্বাচন কালীন নির্দলীয় সরকার ছাড়া বাংলাদেশে স্বচ্ছ নির্বাচন হয়নি।
সম্ভাব্য মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞায় আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব, সচিবালয় এবং পুলিশের ঘরে ঘরে আতংকের বিস্তার ঘটেছে। গতকাল ফোরাম ফর বাংলাদেশের স্ট্যাডিজের ওয়েবিনারে দেশের বিশিষ্টজনেরা স্পষ্ট বলেছেন, এর প্রভাব সর্বব্যাপী। আমি আমার প্রথম আলো লেখায় বলেছি, দেশের নাগরিক সমাজের বয়ান পরিবর্তন হয়ে যাবে এতে। গতকাল জেষ্ঠ আইনজীবী আমিরুল ইসলামও বলেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার কথা। অর্থাৎ ঘটনাটি ঘটতে শুরু করেছে।
ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে ইউরোপের বাজারে জিএসপি প্লাস সুবিধা নিশ্চিত হতে পারে। তবে এর জন্য মানতে হবে বেশকিছু শর্ত। হোয়াইটলি বলেন, যদি নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয় তবে তা দারুণ ইতিবাচক সিগন্যাল দেবে যে বাংলাদেশ জিএসপি প্লাসের জন্য প্রস্তুত। বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারের জন্য জিএসপি প্লাস অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
নির্বাচনী গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রশ্নে ইউরোপ-আমেরিকার সাথে আওয়ামীলীগের সংকট আপাতত কাটছে না। ফলে দেড় দশকের মধ্যে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির সবচেয়ে বড় সম্ভাবনাটি তৈরি হয়েছে।
এর বাইরেও কিছু ঘটনা ঘটছে, মার্কিন সিনেট থেকে শুরু করে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সবখানেই সরকারের মানবাধিকার রেকর্ড এবং নির্বচনী অপরাধের ফিরিস্তি দিয়ে চিঠি যাচ্ছে, এমন চিঠি ফেইসবুক ও হোয়াটসএপে ঘুরছে। সুতরাং রাতের ভোটের কারিগরদের যাত্রা ভংগ হচ্ছে, এটা মনে করার যথেষ্ট কারন তৈরি হয়েছে ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি কি এর সুফল নিতে পারবে? অবিশ্বস্ত সুত্রমতে বিএনপির সাথে গতবার সরকারের যোগাযোগ হয়েছে এবং সরকারের ভিতরের ৩টি পক্ষ বিএনপির দুটি পক্ষকে কাঁচা কলা খাইয়েছে। ফলে আজকের সম্ভাবনাকে বিএনপি কাজে লাগাতে পারবে কিনা সেটা তাদের 'আপোষকামী, বিক্রয়যোগ্য এবং কৌশলহীন' নেতৃত্বের উপরই নির্ভর করে। বিএনপি শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলন চালিয়ে গেলে এবং কোন ধরনের আপোষে না গেলে তাদের ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা বেশি। অন্যথায় শেখ হাসিনার প্রস্থানের পরে সিভিল সোসাইটি সরকার আসবে।
বরাবরের মত সবাই বলেছেন, ভারতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমি মনে করি ইউক্রেন আগ্রাসনের বিরোধীতা এবং রাশিয়ার সাথে মাখামাখির জোরে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েন জনিত কারনে ভারত এবার আওয়ামীলীগকে রাখতে মরিয়া ভাব দেখাবে না। অর্থাৎ ভারতের অবস্থান হয়ে উঠবে এমন- ভারত বিএনপির ঢাকা ও লন্ডনের নেতৃত্বকে গোয়েন্দাদের দিয়ে বিভ্রান্ত করে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টার বাইরে আগ বাড়িয়ে মাঠে উপস্থিত হয়ে বেশিকিছু করবে না। তবে আওয়ামীলীগ যদি কোনভাবে টিকে যায় তাইলে পেছন থেকে জোর সমর্থন দিবে।
বিজেপিপন্থী গুরুত্বপূর্ন বুদ্ধিজীবী শ্রীরাধা দত্ত বিবিসি বাংলাকে বলেছেন ‘আওয়ামী লীগের হয়ে দেন-দরবার করবে না ভারত সরকার’।
শ্রীরাধা দত্তের বক্তব্যের বাইরেও আমাদের কাছে আরেকটি ক্লু আছে। কয়েকমাস আগে নেদারল্যান্ডের হেগে বিজেপির একজন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেত্রীকে আওয়ামীলীগ ও শেখ হাসিনা সরকারের বৈধতার সংকট, গুম-খুন ও বিরোধী নির্যাতন বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। সেখানে বিজেপি নেত্রী স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, বিষয়টি নিয়ে তারা বেশ উদ্বিগ্ন।
এই উদ্বিগ্নতা বাংলাদেশে একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করুন, এটা আমাদের একটা স্পষ্ট অবস্থান। শেখ হাসিনাকে যেতে হবে কেননা উনি অনির্বাচিত।
পরে যেই আসুক তাদেরকে সংবিধান সংস্কার করতে হবে, ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে হবে যাতে বারে বারে দেশে সাংবিধানিক স্বৈরশাসক উৎপাদন না হয়। অর্থাৎ ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকর ও ভারসাম্য করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গুলোকে শতভাগ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে এবং পাশাপাশি ভোটচুরির সরকার প্রতিহত করতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের স্থায়ী কাঠামো নিশ্চিত করতে হবে।
সবমিলে, শেখ হাসিনার পতন এবং পতন পরবর্তি রাষ্ট্র সংস্কারই মূখ্য। বাকি গুলো গৌণ। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি নিজেকে পরবর্তী ক্ষমতার কেন্দ্রে ফেরাতে পারবে কিনা, সেটা তার 'আন্দোলন কিংবা আপোষকামীতার' চরিত্রের উপর নির্ভর করবে। বিএনপিকে বর্তমান স্ট্যাটাস্কো এবং আগামীর পরিবর্তনে মূখ্য হতে চাইলে তাকে আপোষকামীতা বাদ দিয়ে মাঠের গণআন্দোলনে মনোযোগ দিতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০২৩ বিকাল ৪:৫৮