প্রেম ও সৌন্দর্যের অনিন্দ্য সুন্দরী দেবী আফ্রোদিতির পুত্র ইরৌস হল প্রেম, কামনা ও যৌনতার দেবতা। অনেকের মতে তার না ছিলো জন্মদাতা, না ছিলো জন্মদাত্রী। একই সাথে দেবতা ও মানব ছিলো সুদর্শন ইরৌস; যার পিঠে ছিলো স্বর্গীয় কোমল দু'টি পাখা।
উড়ন্ত ইরৌসের হাতে থাকতো ধনুক আর পিঠে তীর, দুই রকমের অনেক তীর তার - সোনালী তীরে পায়রার ও অন্যটিতে পেঁচার পাখনা। তীর বিদ্ধ কেউ সর্ব প্রথম যা দেখবে সামনে তার প্রেমেই পড়ে যাবে।
অনেকে মনে করেন, ইরৌস হলো সে যে জন্ম হয়ে আলোর জন্ম দেয়। এ সম্পর্কে বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো বলেছেন: ইরৌস মানুষের হৃদয়ে থাকে কিন্তু সে শুধু নরম হৃদয় পছন্দ করে, কঠোর হৃদয় থেকে দূরে সরে থাকে। তার সবচেয়ে সম্মানজনক গুণটি হলো সে কারো সাথে খারাপ করে না, আর কাউকে খারাপ কাজের অনুমতিও দেয় না। সবাই স্বাধীন ও ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে সেবা করে এবং যে ইরৌসের ভালোবাসার স্বাদ অনুভব করতে পারে সে কখনোই অন্ধকারে থাকে না।
ইরৌস ছিলো দুষ্ট প্রকৃতির। তার অন্যতম খেলা ছিলো তীর ছুড়ে মানুষকে ভালোবাসা ও প্রচন্ড যৌন লিপ্সার ভেতর ফেলে দেওয়া। উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক সেদিক পাখার তীর ছুড়ে দিয়ে প্রেমাতুর করে তোলাই ছিলো তার প্রধান কাজ।
সে সময় একজন রাজার তিন মেয়ের ভেতর ছোট মেয়েটি ছিলো ভীষণ রুপবতী, নাম ছিলো সাইকি। তার যশ ও রুপের খবর দূর দুরান্তে ছড়িয়ে পড়লো এবং অনেক লোক তাকে পূজা করতে আসতে থাকলো। এদিকে দেবী আফ্রোদিতির ভক্ত ও অভ্যর্থনাকারীর সংখ্যা গেলো কমে। এতে আফ্রোদিতি হিংসায় পুড়তে থাকলো, সিদ্ধান্ত নিলো তার পুত্র ইরৌসের সাহায্য নিবেন সাইকিকে হেয় করতে। ইরৌসকে বললেন ঘুমন্ত সাইকিকে তীর মেরে তার সামনে সবচেয়ে ঘৃণীত ও বাজে পশু যেমন শুকরকে রাখতে, যাতে করে ঘুম থেকে উঠে সাইকি শুকরের প্রেমে পড়ে।
অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ইরৌস রাজি হলো, মায়ের কথা মতো চলে গেলো ঘুমন্ত সাইকির ঘরে। কিন্তু তীর নিক্ষেপের সময় সাইকির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। হতচকিত ইরৌসের বাহুতেই অসাবধানতায় বিঁধে গেলো তীর, পরিণতিতে সাইকির গভীর প্রেমে পড়লো ইরৌস। প্রেমের মাত্রা এত বেশি ছিলো যে তীরের আঘাতে এমন তীব্র প্রেমে পড়েনি কেউ আগে।
প্রেমে কাতর ইরৌস ফিরে এসে সব কিছু খুলে বললো আফ্রোদিতিকে। আফ্রোদিতি ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো এবং অভিশাপ দিলো - যদিও সবাই তার রূপে মুগ্ধ হবে কিন্তু কেউ তাকে স্ত্রী হিসেবে নেবে না। সেই সাথে ইরৌসকে সাইকির থেকে দূরে থাকতে বললো। ভগ্ন হৃদয়ে ইরৌস শপথ করলো যতক্ষণ না সাইকি অভিশাপ মুক্ত হবে ততক্ষণ সে কোন তীর ছুড়বে না।
ইরৌসের ভালোবাসার তীরের অভাবে পৃথিবী ক্রমেই ভালোবাসা ও কামহীন হয়ে পড়লো। কোন পশু বা মানুষ কেউ কারো প্রেমে পড়লো না, কেউ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধও হলো না। সাথে আফ্রোদিতির পূজাও থেমে গেলো, প্রেমহীন অপার সৌন্দর্যের কোন মূল্যই রইলো না। ইরৌস যেন আগের মত তীর ছুড়ে এই শর্তে আফ্রোদিতি বাধ্য হয়ে ইরৌসকে সাইকির কাছে যাওয়ার অনুমতি দিলো।
সবাই সাইকির রূপকে শ্রদ্ধা করতো, ভালোবাসতো; কিন্তু আফ্রোদিতির অভিশাপে কেউ তাকে স্ত্রী হিসেবে চাইতো না। এদিকে সাইকির জন্য ইরৌসের প্রেম ও তৃষ্ণা ক্রমশ বাড়তে থাকলো। ইরৌস এপোলোকে অনুরোধ করলো একটা দৈব্যবাণী দিতে যাতে বিষয়টার একটা সমাধান হয় এবং সে তাকে বিয়ে করতে পারে। এপোলো কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কাছে দৈব্যবাণী প্রেরণ করলো - নববধুর সাঁজে সাইকিকে পাহাড়ে রেখে আসতে হবে যেখানে তাকে পাখাওয়ালা ভয়ঙ্কর এক দৈত্য স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবে এবং সে দৈত্যের মুখ সাইকি কখনো দেখতে পারবে না। অশ্রুসজল সকলে বিদায় দিলো সাইকিকে।
নববধুর সাঁজে কান্নারত সাইকি নিজেকে পাহাড় চূড়ায় ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত সে, হঠাৎ তার ঘারের কাছ দিয়ে গরম বাতাস বয়ে গেলো। ঘুমিয়ে পড়লো সাইকি। ঘুম ভাঙ্গলে নিজেকে এক প্রাসাদে আবিষ্কার করলো সে, যেখানে অদৃশ্য কিছু কন্ঠ তাকে বললো - এ সব কিছুই তোমার, ক্লান্ত অঙ্গ ধুয়ে নিয়ে রাতের খাবারের জন্য প্রস্তুত হও। আমরা এখানে তোমার সেবায় আছি তোমার সকল ইচ্ছা পূর্ণ করতে।
সে রাতে অন্ধকার ঘরে ইরৌস আসলো কথা মোতাবেক সাইকিকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে, সাইকিও তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করলো। ইরৌস আসতো প্রতি রাতে; সাইকিকে অনুরোধ করতো কখনো আলো না জ্বালাতে, কারণ সঠিক সময়ের আগে সে চায়না সাইকি কিছু জানুক তার সম্পর্কে।
এভাবে গেলো কিছুদিন আঁধার প্রেমে; তবুও এক সুখময় প্রেমপূর্ণ জীবন। আরো কিছুদিন পর আঁধারের দৈত্যেকে অনুরোধ করলো তার বোনদের কিছুদিনের জন্য আনতে, কারণ সে একা থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলো। বোনেরা এসে সাইকির সুখ-শান্তি দেখে ঈর্ষান্বিত হলো, বিভিন্ন কথা বলে সাইকিকে রাজি করালো রাতে আলো জ্বালিয়ে দৈত্যের মুখ দেখতে। এক রাতে ইরৌস ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে সে ঘরে আলো জ্বালালো, আর দেখে ফেললো ইরৌসকে। দৈত্যের বদলে দেখতে পেলো স্নিগ্ধ সুন্দর দেবতার মুখ।
আলোতে চোখ খুলে অপ্রস্তুত ইরৌস উড়ে পালালো মায়ের নিষেধ ও দৈববাণী মানতে। যাওয়ার সময় বলে গেলো সে আর কোনদিন ফিরবে না, কারণ সাইকি দৈববাণী ও নিষেধ ভঙ্গ করেছে। দিন যায় মাস যায় - স্বামী বিরহে কাতর সাইকি, ইরৌসের কোন দেখা নেই।
হারানো ভালোবাসা ফিরে পেতে অসহায় রাজকন্যা অবশেষে আফ্রোদিতির কাছে সাহায্য চাইলো। আফ্রোদিতি বললো যে ইরৌসকে সে যদি সত্যিই ভালোবেসে থাকে তবে তাকে তিনটি কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারলেই কেবল পুনরায় দেখা পাওয়া যাবে ইরৌসের।
প্রথম পরীক্ষায় আফ্রোদিতি একটি ঝুড়িতে রাখা কয়েক প্রকারের ডালের মিশ্রণ রাত হওয়ার আগেই বেছে বেছে পৃথক করতে দিলো। এত কম সময়ে এমন কাজ শেষ করা অসম্ভব ছিলো; সাইকির এমন অবস্থা দেখে একটি পিঁপড়া তার প্রতি সদয় হলো। সমস্ত শস্য আলাদা করে দিলো পিঁপড়া। নির্ধারিত সময়ের ভেতরে প্রথম পরীক্ষায় সফল হলো সে।
দ্বিতীয় পরীক্ষা সম্পর্কে আফ্রোদিতি জানলো যে তাকে একটি চারণভূমিতে যেতে হবে, যেখানে সোনালী পশমের ভেরারা ঘাস খায়। ঐ ভেরাদের কাছ থেকে সোনালী পশম আনতে হবে সাইকিকে। পথমধ্যে একটি নদীর দেবতা সাইকিকে জানালো যে ঐ ভেরাগুলো ভীষণ বদ মেজাজি আর বলিষ্ঠ। কেউ তাদের পশম তুলতে গেলে নিশ্চিত প্রাণ হারাতে হবে। বুদ্ধি দিলো ঐ নদীর দেবতা - বিকেল হলে ভেরাগুলো নদীর অন্য তীরে বিশ্রাম নিতে নিতে ঘুমিয়ে যায়, তখন সে তার পশম সংগ্রহ করতে পারবে। বিকেলের অপেক্ষায় থাকলো সাইকি। কিন্তু এ সময় আফ্রোদিতি নদীর পানিকে বললো তুমুল বেগে প্রবাহিত হতে, যাতে কোন মানুষ নদী পার না হতে পারে। এই বিপদে একটি ঈগল পাখি সাইকির সাহায্যে এগিয়ে আসলো। ভেরাগুলো ঘুমিয়ে পড়লে ঈগল পাখি পশম সংগ্রহ করে দিলো তাকে। দ্বিতীয় পরীক্ষাতেও উৎরে গেলো সে।
সাইকির বেঁচে যাওয়ায় আরো ক্ষিপ্ত হলো আফ্রোদিতি। তৃতীয় পরীক্ষাতে আফ্রোদিতি বললো যে - ছেলের চিন্তায় তার রূপ কমে গেছে, তাই পাতালের দেবী পারসিফোনের কাছে কিছু রূপ ছোট বাক্সে ভরে আনতে হবে তার জন্যে। আর বললো বাক্সটি যেন কিছুতেই সে না খোলে। সাইকি ভাবলো পাতালে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো কোন উঁচু স্হান থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করা। তাই সে একটি মিনারে উঠে পড়লো, কিন্তু সে মিনার তাকে অবাক করে দিয়ে লাফ দিতে নিষেধ করলো। মিনারটি সাইকিকে জীবন্ত পাতালে যাওয়া ও আসার পথটি বিস্তারিত বলে দিলো, আসন্ন বিপদের কথাগুলোও বললো। সাথে এটাও বললো যে পাতালে নিম্ন মানের মোটা রুটি ছাড়া কোন কিছু না খেতে, অন্যকিছু খেলে সে আর কখনোই ফেরত আসতে পারবে না - ঐ মায়াজালে আটকে যাবে। যখন সে পাতাল দেবীর কাছে থেকে বাক্স বন্দী রূপ নিয়ে আফ্রোদিতির কাছে ফিরছিলো তখন সে তার কৌতুহল সামলাতে পারলো না। সে চাইলো কিছু রূপ নিজের জন্য নিতে।
মাটির উপরে এসে যাত্রা পথে খুললো ঐ রূপের বাক্স, কিন্তু কোন রূপ দেখতে পেলো না বাক্সের ভেতর। রূপের বিনিময়ে নারকীয় ঘুম এসে গ্রাস করলো তাকে।
ইরৌস যখন দেখলো তার প্রেয়সীর এরকম করুণ অবস্থা হয়েছে, তখন সে ছুটে গেলো অলিম্পাস পাহাড়ে। দেবতা এপোলোর কাছে সাইকিকে রক্ষা করার জন্য অনুনয় করলো।
দেবতা এপোলো অনুভব করলো সাইকির প্রতি তার ভালোবাসা, অমরত্ব দান করলো সাইকিকে - অনুমতি দিলো তাদের অমরত্বের মাঝে একসাথে থাকার। অবশেষে বিয়ে হলো তাদের, একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হলো পরিপূর্ণ ভালোবাসার মাঝখানে।
ভালোবাসায় বিভোর ভালোবাসার দেবদূত ইরৌস এখনো তার তীর ছুড়ে চলেছে যখন তখন, বলা যায় না কখন সে তীর কার বুকে এসে বিঁধবে!!!
আগের পর্ব - লুল গ্রিক দেবতা প্যান - পোস্টে অপ্রাপ্ত বয়ষ্কদের প্রবেশ নিষেধ।
এটি ঈদের আগে ও এই মাসের শেষ পোস্ট, ঈদে নেটের বাইরে থাকবো গ্রামে। তাই সবাইকে ঈদের অগ্রীম শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ভালোবাসার তীর বেশি করে বিদ্ধ করুক সবার হৃদয়, ধন্যবাদ সবাইকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ৯:০৯