সময় বা কালের ভেতর লুকিয়ে আছে অপার রহস্য, সৃষ্টির আদিকাল ও পরকাল জুড়ে যার অবস্থান। চলমান এই বিষয়টির না আছে শুরু, না আছে শেষ। কালের উপরেই ভর করে চলছে অন্য সবকিছু। আমরা শুধু সে কালের কিছু হিসেব শিখেছি মাত্র। পৃথিবী ও সূর্যের আবর্তন থেকে হিসেব কষেছি দিন-রাতের, মাসের, বছরের; আবার দিন-রাতের হিসেবে এনেছি প্রহর, ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ড, মিলি সেকেন্ডের। বিভিন্ন জাতি হিসেব কষেছে চন্দ্র মাস, সৌর মাস ইত্যাদির। পঞ্জিকার পাতায় এঁকেছি মাসগুলো, আবার কাঠামো নিমার্ণ করে হিসেব করতে চেয়েছি সময়ের - সূর্যের আলোয়। পরকাল জুড়েই রয়েছে অফুরন্ত এই সময়। এর কি কোন শেষ আছে কিংবা কোন শুরু কি ছিল? চরম স্থিরতা বলতে কি কিছুই ছিল না? শুরু এবং শেষ না থাকা সময়ের ক্ষুদ্রতম অংশে আমাদের অবস্থান সত্যিই অবাক হওয়ার মত। কৌতুহলী মন কখনো চেয়েছে সময়কে বেঁধে রাখতে, কখনো চেয়েছে অতীতে ফিরে যেতে, আবার কখনো চেয়েছে ভবিষ্যতে ঘুরে আসতে। সে চাওয়াকে কেন্দ্র করে তৈরী করতে চেয়েছে টাইম মেশিন। এক রহস্যময় ও অস্পৃশ্য বস্তুকে বশ করে তার পিঠে চড়তে চায় মানুষ। কখনো হয়তো সফল হয়েও যেতে পারে, ততদিনে কালের অতলে হারিয়ে যাবো আমরা সবাই এটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।
উইকিপিডিয়ায় রয়েছে -
সময়: সময় সম্বন্ধে একাধিক স্বতন্ত্র মতবাদ রয়েছে। একটি মতানুসারে সময় মহাবিশ্বের মৌলিক কাঠামোর একটি অংশ যেটি একটি বিশেষ মাত্রা এবং যেখানে ভৌত ঘটনাসমূহ একটি ক্রমধারায় ঘটে। এটি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি যা আইজ্যাক নিউটনের তত্ত্বসম্মত। এই মতানুসারে সময় একটি ভৌত রাশি, যা পরিমাপযোগ্য।
সময় হচ্ছে ঈশ্বর: হিন্দুদের সময় সংস্কৃতে কাল বলা হয়। এটা ঈশ্বরের একটা অংশ। এটা শুরু হয় যখন ঈশ্বর সকল কিছুকে চালু করে এবং শেষ হয় যখন তিনি এটা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। এবং এটাই হচ্ছে অচল হবার সময়। ঈশ্বর সময়ের বাইরে। সময় চিরন্তর এবং সকল সময় চলছে, কিন্তু তিনি এটার মধ্যে থাকেন না। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত তার ভিতরেই আছে।
বৃত্তকার সময়: এই নিয়মিত সময় আমাদের বর্তমান দিনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু হিন্দুরা এটাকে অন্যভাবে দেখে। অন্য এক বিশ্বব্রহ্মান্ডের সময় হিসেবে। হিন্দুরা বিশ্বাস করে চারটি যুগে। এগুলো অনেক অনেক সময় ধরে থাকে। এই চার যুগের নাম- সত্য যুগ, ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ এবং কলি যুগ। এবং এই বিশ্বের জন্য এই বৃত্ত কোনোদিনও শেষ হয় না এবং শুরুও হয়নি। এটা জন্ম নেয়নি শেষ হবার জন্য আবার শেষ হবে না জন্ম নেবার জন্য।
কালচক্র: ভগবান তৈরি করেছেন সময়ে চক্র অথবা কালচক্র। এটা দিয়ে তিনি ভাগ করেছেন এবং সময়কে একটা গণনার মধ্যে রেখেছেন। ভগবান এই সময় ব্যবহার করে জন্ম এবং মৃত্য দেখিয়েছেন। সেখানে বয়স্ক থেকে মৃত্যু আছে তার সৃষ্টিতে। যখন আমরা সময়ের বাইরে আসব, তখন আমরা মারা যেতে পারবো না। মৃত্যু দিয়ে কিন্তু শেষ হয়না এই চক্রের কারণ তারপর আসে পরের জন্ম এবং এটা চলতেই থাকে। এটা আবার সত্যি যে এই বিশ্বব্রহ্মান্ড নিজে একটা রিদমে চলে। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, সকল মৃত্যুপ্রাপ্ত ব্যক্তি ৪টি সময়ের মধ্যে দিয়ে যায়। এই চক্র পুর্ণ হয় যখন এক কল্প শেষ হয়। এক কল্প ১০,০০০ ঐশ্বরিক বৎসর অথবা ১০,০০০,০০০ বছর। এটাকে চার ভাগ করে তৈরি হয়েছে চারটি যুগ। এই চার যুগের নাম, সত্য যুগ, ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ এবং কলি যুগ। সত্য যুগ চলেছে ৪০০০ ঐশ্বরিক বছর ধরে। তারপরে ত্রেতা ৩০০০ ঐশ্বরিক বৎসর। দ্বাপর চলে ২০০০ ঐশ্বরিক বৎসর এবং কলি চলবে ১০০০ ঐশ্বরিক বৎসর ধরে। প্রথম তিনটি চলে গিয়েছে। এই চারটি ভাগ কিসের জন্য করা হয়েছে তা ঠিক বলা যায় না। কারণ বৈজ্ঞানিক মতে এটা সত্যি হিসেবে প্রমাণ হয়নি। এই চার ভাগে দেখা গিয়েছে কিভাবে মানুষের পরিবর্তন হয়েছে। তাদের নিজেদেরকে ভুলে গিয়ে তারা পাপের দিকে ধাবিত হয়েছে। হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস যে পৃথিবীতে ৫ প্রকারের মানুষের শরীর। এগুলো হচ্ছে- অন্নমায়াস্ক, প্রাণমায়াস্ক, মনমায়াস্ক, ভিগনামায়াস্ক এবং আনন্দমায়াস্ক (annamayakosa, pranamayakosa, manomayakosa vignanamayakosa, anandamayakosa) যেগুলোর মানে-
অন্নমায়াস্ক- অমার্জিত শরীর
প্রাণমায়াস্ক- নিশ্বাসের শরীর
মনমায়াস্ক- মানসিক শরীর
ভিগনামায়াস্ক- বুদ্ধিমান শরীর
আনন্দমায়াস্ক- সুখি শরীর
আরেক মতে জানতে পারা যায় যে সত্য যুগে পুর্ণ সত্য ছিলো। ত্রেতাতে ১/৪ হারিয়েছে। তারপর দ্বাপরে ১/২ হারিয়েছে এবং কলিতে ১/৪ বাকি আছে। পাপ দিয়ে পুর্ণ করা হবে এই যুগে।
আমরা মিনিট, ঘন্টা ও বর্ষপঞ্জি দিয়ে সময়ের যে হিসেব করি তার সূচনা হয় প্রাচীন মিশরে।
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম লিখেছিলেন -
পৃথিবীর প্রায় ২৫ কোটি বাংলা ভাষীর বাংলা সন নামে নিজস্ব সন ছাড়াও রয়েছে একটি বিশাল সন ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশে এ যাবত আবিষ্কৃত ও ব্যবহৃত সনগুলো হলো : (১) বাংলা সন, (২) হিজরি সন, (৩) খ্রিস্টাব্দ বা ঈসায়ি সন (ইংরেজি), (৪) বৌদ্ধাব্দ, (৫) শকাব্দ বা শাক সন, (৬) সম্বত্, (৭) মঘীসন, (৮) লক্ষণাব্দ, (৯) ত্রিপুরাব্দ, (১০) নেপাল সংবত্, (১১) গুপ্তকলা, (১২) শ্রী হর্ষাব্দ, (১৩) বলবাব্দ বা বলভ কলা, (১৪) মলাব্দ বা বিষ্ণুপুরী সন, (১৫) চৈতন্যাব্দ, (১৬) পরগনাতি সন, (১৭) সরাইল সন, (১৮) নসরত্শাহী সন, (১৯) দানিশাব্দ, (২০) রাজরা সন, (২১) বিশ্ব সিংহ শক, (২২) রত্ন পিঠস্য নৃপতে শক, (২৩) অমলি সন, (২৪) যবন নৃপতে শকাব্দ, (২৫) সদর সন, (২৬) মন্দারন সন, (২৭) মিলিক সন (বাঘা), ২৮) জমিদারি সন, (২৯) সর্বসিদ্ধ সন বা শ্রীরামসিদ্ধি সন, (৩০) পালাব্দ ইত্যাদি।
এসব সনের ব্যাপক ব্যবহার ও জনপ্রিয়তার মুখে উপরি উল্লিখিত ৩০টি সনের প্রায় ২৭টিই এখন প্রায় লুপ্ত।
১. ঈসাব্দ বা ঈসায়ি সন: হজরত ঈসা আলাইহিসসালামের জন্ম থেকে এ সন গণনা শুরু হয়। খ্রিস্টানরা হজরত ঈসাকে (আ.) যিশু খ্রিস্ট বলে ডেকে থাকেন এবং এ সুবাদে তাঁর জন্ম তারিখ থেকে গণনা শুরু হওয়ায় এ সনকে তারা খ্রিস্টাব্দ বলে ডাকে। মুসলমানরা যিশুকে হজরত ঈসা (আ.) নামে ডাকার কারণে বিশ্বের নানা ভাষা ও মুসলিম দেশগুলোয় সনটিকে ঈসবি বা ঈসায়ি সন বলে ডেকে থাকে। বাংলা সনের সঙ্গে ঈসায়ি সনের পার্থক্য ৫৯৩ বছর। বাংলা সন প্রবর্তনের সময় ৯৬৩ হিজরি সনকে স্থির রেখে পরবর্তী অংশ সৌর সনে রূপান্তরকালে এ পার্থক্য গড়ে ওঠে। ৯৬৩ পরবর্তী বাংলা সনের সঙ্গে (১ বৈশাখকে ১৪ এপ্রিল ধরে) ৫৯৩ যোগ করলে মোটামুটি ঈসায়ি সন পাওয়া যাবে। অন্যদিকে যে কোনো ঈসায়ি (ইংরেজি) সন থেকে ৫৯৩ বাদ দিলে বাংলা সন মিলবে।
২. হিজরি সন: ৬২২ ঈসাব্দে হজরত মুহাম্মদের (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের স্মারক হিসেবে এ সন চালু হয়। ওই সনের জুলাই মাসের ১৬ তারিখ থেকে হিজরি সন গণনা শুরু হয়। এটি চান্দ্রমাস ভিত্তিক একটি সন। স্বয়ং আল্লাহপাক চাঁদকে সময় গণনা এবং হজের নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পবিত্র কোরআন শরীফে আয়াত নাজিল করেছেন। এটি মুসলমানদের কাছে পবিত্র সন। এ সনে বছর গণনা করা হয় ৩৫৪ দিন ৯ ঘণ্টায়। সৌর সনের সঙ্গে তাই ১০-১১ দিন করে পার্থক্য গড়ে ওঠে, যার ব্যবধান প্রতি ৩৩ বছরে ১ বছরের সমান হয়।
৩. বাংলা সন: সম্রাট আকবরের সময় এ সন চালু হয়। সম্রাটের আদেশক্রমে তার সভার পণ্ডিত ও অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা আমির ফতেহউল্লাহ শিরাজী বাংলা সন প্রবর্তন করেন। সন প্রবর্তনের সময় হিজরি সন থেকে এ সন চালু করা হয়। ৯৬৩ হিজরিকে স্থির সংখ্যা ধরে এর পরবর্তী অংশ সৌর সন হিসেবে ধরার ফলে এর পরবর্তী অংশ সৌর সনে রূপান্তরের মাধ্যমে একে বাংলা সনে রূপ দেয়া হয়। হিজরি সনকে উৎস সন হিসেবে ধরার ফলে এ সনের গণনাও শুরু হয় ৬২২ ঈসাব্দের ১৬ জুলাই ১ হিজরি ১ বাংলা হিসেবে।
৪. বৌদ্ধাব্দ: বুদ্ধের (শাক্যমুনি) নির্বাণ লাভের কাল থেকে বৌদ্ধাব্দ গণনা শুরু হয়। বৌদ্ধদের গ্রন্থে এবং শিলালিপিগুলোতে এ সনের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। গৌতম বুদ্ধের নির্বাণ লাভের কাল সম্পর্কে উপমহাদেশের বৌদ্ধ পণ্ডিতদের সঙ্গে চীনা বৌদ্ধ পণ্ডিতদের বিতর্ক রয়েছে। উপমহাদেশের পণ্ডিতরা ঈসা-পূর্ব (খ্রিস্টপূর্ব) ৪৮৭ সনে বৌদ্ধ নির্বাণ লাভ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। অপরদিকে চীনা পণ্ডিতরা নির্বাণ লাভ ৬৩৮ ঈসা পূর্বাব্দে সংঘটিত হয়েছিল বলে মানে। বাংলাদেশের বৌদ্ধরা বৌদ্ধপূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমাসহ অন্যান্য উপাসনার তারিখ এ সনের হিসাবেই করে থাকে। ঢাকার রামপুরা বৌদ্ধ বিহারসহ দেশের অন্যান্য বৌদ্ধ বিহারে এ সনের ব্যবহার দৃষ্ট হয়।
৫. শকাব্দ: শক নামক নৃপতি প্রবর্তিত বছর। হজরত ঈসার (আ.) জন্মের ৭৮ বছর পর এবং বাংলা সনের ৫১৫ বছর আগে এর শুরু। উপমহাদেশে বাংলা সন চালুর আগে রাজকীয় সন হিসেবে হিজরি সন চালু থাকলেও পাশাপাশি এ শকাব্দের ব্যবহারও ছিল। ভারত সরকার ডক্টর মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে গঠিত সংস্কার কমিটির সুপারিশক্রমে শকাব্দকে যুগোপযোগী সংস্কার করে সর্বভারতীয় সনরূপে গ্রহণ করেছে।
৬. সম্বৎ: হজরত ঈসার (আ.)র জন্মের ৫৭ বছর আগে উজ্জয়িনীরাজ বিক্রমাদিত্য প্রবর্তিত অব্দ। বাংলা সনের সঙ্গে ৬৫০ যোগ করলে সম্বৎ পাওয়া যায়।
৭. মঘী সন: প্রাচীন আরাকানের বৌদ্ধ ধর্মীয় রাজাদের মঘ বলা হয়। মঘদের প্রবর্তিত সনকেই মঘী সন বলে। ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে এ সন শুরু ধরে গণনা করা হয়। বাংলা সন থেকে ৪৫ বাদ দিলে মঘী সন পাওয়া যায়। মধ্যযুগে আরাকানে বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক চর্চা হলেও সেখানে বাংলা সন প্রবেশ লাভ করেনি। কবিরা তাঁদের কাব্যে মঘী সনের ব্যবহার করেছেন। এতে বোঝা যায়, এটি সরকারি সন হিসেবে চালু ছিল। আমাদের বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলেও এ সনের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। গত শতাব্দীতে জন্মগ্রহণকারী চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের জন্মকুষ্টি লেখা হয় মঘী সনের হিসাবে।
৮. নেপাল সংবৎ: নেপাল সংবৎ ৮৮০ ঈসাব্দে শুরু হয়েছে বলে জানা যায়। বাংলা পুঁথিতে এ সনের স্বল্প ব্যবহার দৃষ্ট হয়।
৯. ত্রিপুরাব্দ: পার্বত্য ত্রিপুরায় প্রচলিত এ সন ৬২১ ঈসাব্দে আরম্ভ হয় বলে ধারণা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে বাংলা সনের নতুন যাত্রার শুরুর (৯৬৩ হি.) বাংলা ৩ বছর পর শুরু হয় বলে পুঁথিতে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়। ঈসায়ি সন থেকে ৫৯০ বাদ দিলে ত্রিপুরাব্দ পাওয়া যায়। এটিও একটি সৌর সন।
১০. লক্ষ্মণাব্দ: সেন রাজবংশের সর্বশেষ রাজা লক্ষ্মণ সেন এ সন প্রবর্তন করেন । সংক্ষেপে এটিকে লং সং বলা হয়। এটি ১১১৮ ঈসায়ি থেকে শুরু হয় বলে ধরা হয়। আইনে আকবরির মতে, সম্রাট আকবরের নবতর সন প্রতিষ্ঠাকালে ৪৬৫ লক্ষ্মণাব্দ ছিল। বাংলাদেশে এ সনের ব্যবহার খুবই কম।
১১. পরগণাতি সন বা সরাইল সন: বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ জয়ের স্মারকে শুরু হওয়া এ সনটি পরগণাতি সন নামে বিভিন্ন স্থানে পরিচিত। সনটি সরাইল এলাকার সরাইল সন নামেও পরিচিতি লাভ করেছে। ১৮৯৩ সনে সরাইল এলাকায় জরিপ কাজ চালানোর সময় সেটেলমেন্ট অফিসার বাবু কালিশংকর সেন এ সনটির ব্যবহার লক্ষ্য করেন। ১৮৯২ সনে সনটির ৬৯৩ বছর চলছে বলে তিনি উলেখ করেন। ফলে সনটি ১৮৯২-৬৯৩=১১৯৯ ঈসায়ী সন থেকে শুরু হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, বখতিয়ার খিলজি বাংলা জয়ের আগে ১১৯৯ সনে বিহার জয় করেন। তবে সনটি যে মুসলমানদের দ্বারা সৃষ্ট, এতে কোনো সন্দেহ নেই। পরগণাতি সন নামে দেশের অন্যান্য স্থানেও এর ব্যবহার পুঁথিতে লক্ষ্য করা যায়।
১২ শাহুর সন: ‘সুর সন’ এবং ‘আরবি সন’ নামেও এটি পরিচিত। এটি হিজরি সনের সৌররূপ সন । ৭৪৫ হিজরি সনের ১ মহররম (১৩৪৪ ঈসায়ি সনের ১৫ মে) এ সন গণনা শুরু হয়। দিল্লির সুলতান মুহম্মদ তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১) দিল্লি থেকে রাজধানী (দেবগিরিতে) দৌলতাবাদে স্থানান্তরকালে ফসলের মাধ্যমে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে এটি চালু করেন। ‘আবজাদ’ শব্দের দ্বারা এর বর্ষ লেখা হতো। মারাঠি পঞ্জিকায় এ সনের ব্যবহার দৃষ্ট হয়।
১৩. নসরৎশাহী সন: রাজার ক্ষমতারোহণের কালজ্ঞাপক ‘রাজসক’ নামে পরিচিত এ ধারার সনগুলো অনেক ক্ষেত্রে রাজার মৃত্যু বা পতনের পর বন্ধ হয়ে গেছে। কতকগুলো বেশ কিছুদিন চলার পর আরেকটি সন চালু হওয়ায় তা এমনিতেই আস্তে আস্তে লয় পেয়েছে। অনেক সময় কোনো জনপ্রিয় রাজার মৃত্যুর পর তাঁর স্মারকে এ ধরনের সন চালুরও উদাহরণ রয়েছে। বাংলার স্বাধীন সুলতানী আমলের হোসেনশাহী যুগের সুলতান নাসির উদ্দিন নসরৎশাহের (১৫১৯-১৫৩২) নামে ‘নসরত্শাহী সন’ নামে একটি সন চালুর উদাহরণ পাওয়া যায়। বাংলা সনের সঙ্গে দুই যোগ করলেই নসরৎশাহী সন হয়।
১৪. আমলি সন: বাংলা ভাষার বিভিন্ন প্রাচীন বইয়ে এ সনের ব্যবহার দেখা যায়। ১১৮৫ আমলি সনে শকাব্দ ১৭০০ সাল লেখা হয়। ফলে ১৭০০-১১৮৫=৬২৫ আমলি হয় যা বাংলা সনের সঙ্গে মাত্র ৩ বছরের ব্যবধান। প্রকৃতপক্ষে এটি বাংলা সনেরই সমসাময়িক এবং কেবল নামের ক্ষেত্রেই এর ব্যবধান।
১৫. দানিশাব্দ: ‘আইন-সার-সংগ্রহ’ এবং ‘মনিহরণ’ নামক বইয়ে এ সনের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সনের উত্পত্তি সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে তবে উভয় বইতেই এ সনটির গণনায় বাংলা সনের সঙ্গে পার্থক্য সুস্পষ্ট। ১২৪৭ বাংলা সনে দানিশাব্দ ৯১ হয়। কাজেই ১২৪৭-৯১=১১৫৬ বাংলা সন। ১৭৪৯ ঈসায়ি থেকে এ সনের শুরু। গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকাতে চলতি শতাব্দীর প্রথম দশকগুলোতেও এ সনের প্রচলন লক্ষ্য করা যায়।
১৬. সর্বসিদ্ধ বা শ্রীরামসিদ্ধ সন: বগুড়া জেলার প্রাচীন নাথ সম্প্রদায়ের তীর্থস্থানরূপে পরিচিত যোগীর ভবনের কয়েকটি বাংলা শিলালেখে এ সনের উল্লেখ পাওয়া গেছে। ‘সর্বসিদ্ধ সন ১১৭৩ শ্রী সুফল’ (ধর্মডুব্দী মন্দির গাত্রে) এবং ‘শ্রীরামসিদ্ধ সন ১১৭৩ সাল আমলে শ্রীনাথ নারায়ণ’ (সর্বমঙ্গলার মন্দির দ্বারে) এর উল্লেখ রয়েছে। তবে এ জন্মসাল সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
১৭. মিলিক সন: রাজশাহীর বিখ্যাত বাঘা শরীফের পীর হজরত শাহ দৌলা ও শাহ আবদুল হামিদ দানিশমন্দের উত্তরাধিকারী হজরত মুহাম্মদ রফিক প্রতিষ্ঠিত ‘রফিকি ওয়াকফ এস্টেটে’ এ সনের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ১০৩৭ হিজরি মোতাবেক ১৬২৭ ঈসাব্দের ১ সেপ্টেম্বর এ এস্টেট প্রতিষ্ঠিত হয়। মিলিক সনের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট তারিখ পাওয়া যায়নি। তবে এ সনটি অগ্রহায়ণ মাস থেকে শুরু হয়। দানিশাব্দের সঙ্গেও এর আংশিক মিল লক্ষ্য করা যায়।
এছাড়াও আর যেসব অপ্রধান সন বাংলাদেশে চালু ছিল সেগুলোর মধ্যে গুপ্তকলা, শ্রী ঈসাব্দ (৪৫৮ ঈসাব্দ), পল্লভাব্দ বা বল্লভ কলা (৩১৮), মল্লাব্দ বা বিষ্ণুপুরী সন (৬৯৬), চৈতনাব্দ (১৫৩৩ ঈসাব্দ), রাজরা সন, জমিদারি সন (বাংলা সন-১০১ = জমিদারি সন), বিশ্বসিংহ শক, মন্দারণ সন, যবন নৃপতে শকাব্দ, রত্ন পীঠস্য নৃপতে শক, পালাব্দ, বিষ্ণুপুরী সন ইত্যাদি। এসব সনের বেশিরভাগই এখন অব্যবহৃত। কিন্তু আমাদের সমাজ বিবর্তনের ইতিহাসের প্রতি বাঁকে বাঁকে অবস্থান করে এগুলো জ্ঞানের এবং কালের সাক্ষী হিসেবে বিরাজ করবে আবহমান কাল। পুঁথি সাহিত্যের বিরাট ভাণ্ডারে এবং পাণ্ডুলিপি পাঠ বিষয়ে গবেষণা চালাতে গেলে এসব লুপ্ত সন সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ জরুরি। এসব সন সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে প্রাচীন সাহিত্যের পাঠ থেকে আমাদের জাতীয় ইতিহাস রচনা ও এর পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে না।
আবারো চলে যাই উইকিপিডিয়ায় -
বঙ্গাব্দের বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্রমন্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে । এই নাম সমূহ গৃহীত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ "সূর্যসিদ্ধান্ত" থেকে। বাংলা মাসের এই নামগুলি হচ্ছে -
বৈশাখ - বিশাখা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
জ্যৈষ্ঠ - জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
আষাঢ় - উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া নক্ষত্রের নাম অনুসারে
শ্রাবণ - শ্রবণা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
ভাদ্র -উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ নক্ষত্রের নাম অনুসারে
আশ্বিন - অশ্বিনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে
কার্তিক - কৃত্তিকা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
অগ্রহায়ণ(মার্গশীর্ষ) - মৃগশিরা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
পৌষ - পুষ্যা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
মাঘ - মঘা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
ফাল্গুন - উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে
চৈত্র - চিত্রা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহী-র মাসের নামগুলি প্রচলিত ছিল পারসি ভাষায়, যথা: ফারওয়াদিন, আর্দি, ভিহিসু, খোরদাদ, তির, আমারদাদ, শাহরিযার, আবান, আযুর, দাই, বহম এবং ইসক্নদার মিজ।
বাংলা সন অন্যান্য সনের মতোই সাত দিনকে গ্রহণ করেছে এবং এ দিনের নামগুলো অন্যান্য সনের মতোই তারকামন্ডলীর উপর ভিত্তি করেই করা হয়েছে।
সোমবার হচ্ছে সোম বা শিব দেবতার নাম অনুসারে
মঙ্গলবার হচ্ছে মঙ্গল গ্রহের নাম অনুসারে
বুধবার হচ্ছে বুধ গ্রহের নাম অনুসারে
বৃহস্পতিবার হচ্ছে বৃহস্পতি গ্রহের নাম অনুসারে
শুক্রবার হচ্ছে শুক্র গ্রহের নাম অনুসারে
শনিবার হচ্ছে শনি গ্রহের নাম অনুসারে
রবিবার হচ্ছে রবি বা সূর্য দেবতার নাম অনুসারে
বাংলা সনে দিনের শুরু ও শেষ হয় সূর্যোদয়ে। ইংরেজি বা গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির শুরু হয় যেমন মধ্যরাত হতে।
বঙ্গাব্দের সংস্কারকৃত ও পূর্বতন সংস্করণ: পহেলা বৈশাখ, বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন। বাংলাদেশে বাংলা একাডেমী কর্তৃক সংশোধিত বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে এদিন উদযাপন করা হয় প্রতি বছরের এপ্রিল ১৪ তারিখে। যদিও পশ্চিম বঙ্গে তা উদযাপন করা হয় পূর্বতন বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে। এটা পাশ্চ্যাতের বর্ষপঞ্জির মতো নির্দিষ্ট নয়। ভারতের বাঙালিরা নতুন বছর উদযাপন করে এপ্রিল ১৪/১৫ তারিখে। ভারতের পশ্চিম বঙ্গে বাঙালিরা সাইডেরিয়েল (পৃথিবীর কক্ষপথ ভ্রমণের সময়ের পরিমাপ; জ্যোর্তিমণ্ডলে তারার অবস্থান অর্থাৎ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর যে সময় লাগে সেটাই সাইডেরিয়েল সৌরপঞ্জি। এক্ষেত্রে সাইডেরিয়েল অর্থ হচ্ছে ৩৬৫.২৫৬৩৬০২ সৌর দিবস যা ক্রান্তীয় বর্ষপঞ্জি হতে ২০ মিনিট ২৪ সেকেন্ড দীর্ঘ।) সৌরপঞ্জি নির্ভর বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করে থাকে। এই বর্ষপঞ্জি ক্রান্তীয় সৌরবঞ্জি যেমন সংস্কারকৃত বাংলা সন এবং গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি হতে আলাদা। এই উভয় ধরণের বর্ষপঞ্জির মধ্যে সময়ের যে গাণিতিক পার্থক্য রয়েছে তার কারণেই বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের নতুন বর্ষ শুরুতে দিনের পার্থক্য হয়।
রাজধানীর বলধা গার্ডেনে সূর্যের আলো ব্যবহার করে সময় নির্ণয়ের বড় অবকাঠামো দেখেছিলাম অনেক আগে। উপরেরটাও ছোট তেমনি একটা।
বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় ব্লগের দিনপঞ্জিকার হিসেব ইংরেজীতে। অতীতে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করেও কোন লাভ হয়নি। বৈশাখের শুরুতে ব্যানার উঠে - আজ ১লা বৈশাখ। আজ বাংলা কোন মাসের কত তারিখ - কয়জন বলতে পারবেন? শুধু আমি না, নিশ্চিত আপনিও বলতে পারবেন না। অনলাইনে যে বাংলা সংবাদপত্রগুলো দেয়া থাকে সেখানে ইংরেজীর সাথে বাংলা মাস-দিন-তারিখও দেয়া থাকে। ব্লগের ক্ষেত্রে এটা হয়তো প্রযোজ্য না, তবে ব্যাপারটা দুঃখজনক।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:৫৬