
পৃথিবীর যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে আজকে সারাদিন একটা বিষয়ই ভাবছি, ওরা কীভাবে না কেঁদে পারে? উম, কাদের কথা বলছি বুঝেন নি? আচ্ছা দাঁড়ান, খোলাসা করেই বলি…
গিয়েছিলাম বিয়ে খেতে। বিয়ে খেতে গেলেই আমি সবার আগে দেখতে যাই নতুন বউকে। একটা মেয়ে কেমন লাল টুকটুকু শাড়ী পড়ে সবার মধ্য-মণি হয়ে লজ্জা লজ্জা করে বসে থাকে

পুতুল নিয়ে খেলার ব্যাপারে আব্বুম্মু ছোটবেলা থেকেই ভীষণ কড়া ছিলেন।


এর পরের বছর যখন ক্লাস ফাইভে আম্মু আমাকে স্কুল চেইঞ্জ করে মাদ্রাসায় নিয়ে যাচ্ছে, খুকুমনি ছিল আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড তখন, শেষের দিন দুই বান্ধবী গলা জড়াজড়ি করে কান্না করছি যখন, ও ব্যাগ খুলে ছোট একটা পুতুল বের করে দিলো। একটা বউ-পুতুল! লাল-টুকটুকে জড়ির কাজ করা শাড়ি পড়া, মাথায় ঘোমটা দেয়া! ব্যাগে লুকিয়ে বাসায় নিয়ে এলাম। আব্বুম্মু না দেখে মতো আমি আর ফারহানা দুপুরে সবাই ঘুমিয়ে গেলে পুতুলটা বের করে খেলি। আম্মুর সেলাই মেশিন থেকে সুঁই-সুতা আর কাপড়ের টুকরা চুরি করে ছোট ছোট বালিশ বানালাম, কাঁথা বানালাম। একদিন বিকেলে দিয়াশলাইয়ের খালি বক্স দিয়ে বিয়ের মঞ্চের মত ছোট একটা মঞ্চ বানিয়ে তার উপর পুতুলটাকে বসিয়ে দিয়ে কালার পেপার কেটে কেটে স্টেজের চারপাশে সাজানোর চেষ্টা করছি, কী নিয়ে যেন কাজের মেয়েটার সাথে ঝগড়া লেগে গেলো



সে যাই হোক, স্টেজে বউ দেখলেই আমার সেই বউ-পুতুলটার মত লাগে। ছোটবেলায় দেখতাম বউদের শাড়িতে জড়ির কাজ থাকতো। শাড়িগুলো হতো লালটুকটুকে ধরনের। একটু বড় হতে হতে দেখলাম বউ'র শাড়ি লালের চেয়ে গাঢ় মেরুন বা হালকা গোলাপী বেশী। বউ'র গায়ে টকটকে লাল শাড়ি না দেখলেই আমার মন খারাপ হয়ে যেতো। কারন তখন বউটাকে আর তেমন বউ বউ লাগতোনা। আরো বড় হতে হতে দেখলাম, বাপরে, মেরুন-গোলাপী তো দূরের কথা, বউরা বিয়ের দিন এখন হালকা নীল, হালকা সবুজ ইত্যাদি ইত্যাদি অন্যরকম সব রং'র শাড়ি পরে বসে থাকে। যে যাই বলুক, লাল না হলে আমার কাছে মোটেও বউ বউ লাগেনা। বউ হবে লাল টুকটুকে; নীল-টুকটুকে বা সবুজ-টুকটুকে বউ'র কথা কখনো কেউ শুনেছেন?!

আচ্ছা শাড়িতো গেলো, যে প্রসংগে কথা শুরু করেছিলাম; ছোটবেলায় দেখতাম বউ-টউ দেখে, স্টেজের দুই-চারটা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে, বিয়ে খাওয়া দাওয়ার পর যখন হালকা ঘুম ঘুম আসছে, আম্মুকে জ্বালাতন শুরু করেছি 'আম্মু, হইছে তো! চলো বাসায় যাই' আর আম্মু দাবড় মারছে 'যাচ্ছিতো!'; ঐ সময়টাতেই হঠাৎ করে দেখতাম খুব শোরগোল পড়ে যেতো! কী হয়েছে কী হয়েছে? বউ নেয়ার সময় হয়েছে, কিন্তু বউ স্টেজে হঠাৎ করে বেঁহুশ হয়ে গেছে!

বড়ভাইয়ার বিয়ের সময় হয়েছিলো ভাবীর মুখ কিছুতেই সোজা করা যায়না! আরে, একটা ছবিও তুলতে পারিনা। আমি আর ফারহানা কত অনুরোধ করলাম, ভাবী মুখটা একটু সোজা করো প্লীজজজ! কে শোনে কার কথা, ভাবীকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেনো যে কোনো মুহূর্তে ঢলে পড়ে যাবে বেঁহুশ হয়ে। শেষে ছবি তোলা বাদ, আগে বিয়ে শেষ হওয়া পর্যন্ত ভাবী তো টিকুক! বড়ভাইয়া মালা পরানোর পর দেখি মালার পিছনে ভাবীর চেহারাই আর দেখা যায়না!


নিজের বিয়েতে বান্ধবীরা সহ সবাই ঠিক করছিলাম, যে যাই বলুক, আমি বাবা এক ফোঁটাও কাঁদবোনা। জীবনে প্রথম বউ সেজেছি, নিজেকে পার্লারের আয়নায় দেখে নিজেই মুগ্ধ, কেঁদে-টেদে এত সুন্দর মেকাপ নষ্ট করে ফেলার কোনো মানে আছে?!



ঘোমটার ফাঁক দিয়ে আম্মুকে খুঁজি। আম্মু কই? এই মহিলা নিজের মেয়ের বিয়েতেও সংগঠনের কাজ করতেছে শিউর। মন খারাপ করে বসে আছি আম্মুকে না দেখে। এর একটু পর হঠাৎ দেখি আম্মু আর হবু শ্বাশুড়ি আমার সামনে। চিন্তা করতেছি ঘটনা কী? দুইজন একসাথে আমার সামনে ক্যান? এ্যাশের দিকে তাকাই, আরে ঐ শয়তান দেখি ভীড়ের ভিতর হারায়ে গেছে! ওম্মা, ফারহানাও নাই! এরা সব গেলো কই?! নিজেকে কোরবানীর গরুর মত মনে হচ্ছিলো হঠাৎ করে। যা বাবা, মেরিনা আন্টি দেখি আমার হাত ধরে আছেন শক্ত করে! কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখলাম আম্মু আমার হাত ধরে ঢুকড়ে ঢুকড়ে কাঁদছেন। আমার শ্বাশুড়ী আমার আর আম্মুর হাত ধরে আছেন। কোথা থেকে কী হলো জানিনা, আম্মুকে কাঁদতে দেখেই কিনা, ভ্যাএএ করে গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলাম। আম্মুর কান্নায় মনের ভিতরটা কেমন পুরা খালি খালি লাগছিলো, মনে হচ্ছিল, ধুর কীসের এইসব বিয়ে শাদী। করবোনা আমি বিয়ে! আম্মুকে কিছুতেই আর ছাড়িনা। যাবোনা আমি শ্বশুড় বাড়ি! কেমন যেন মনে হচ্ছিলো এখন যদি আম্মুকে ছাড়ি তাহলে আর কোনোদিন আম্মুকে ধরতে পারবোনা!!

বিয়ের এই তিনবছর পরেও যখন তখনের কথা ভাবি, চোখে পানি চলে আসে! কারা যেন তখন জোড় করে ধরে, টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো আমাকে। আমিতো আব্বুকে না দেখে কিছুতেই যাবোনা। নিজে কাঁদতেছি, এইবার দেখি আব্বুও কাঁদে



নিজের বিয়ের পর থেকে কোনো বিয়েতে গেলে আমি আরো বেশী মনযোগ দিয়ে বউ দেখি। কিন্তু আজকালকার বিয়ে গুলো দেখে কেমন যেন হতাশ লাগে। মনে হয় যেন বার্থডে পার্টি টাইপ কিছু। একেতো শাড়ীর রঙ লাল থাকেনা বেশীরভাগ; তারউপর বউ গুলো কেমন মডেলের মত পোজ দিয়ে বসে থাকে। ক্যামেরা নিয়ে যেই ছবি তুলতে যায় তার দিকেই তাকিয়ে মডেলের হাসি দেয়। বাঁকা বাঁকা চোখ করে তাকায়, যেনো ছবি ভালো আসে। নিজের বিয়ের খাবার নিজেই সবার সাথে বসে চামচ দিয়ে টুং টুং করে খায়। জামাই স্টেজে এলে নিজেই মালা পরিয়ে দেয়! সেই মালা পড়ানো নিয়ে জামাই-বউ দু'জন আবার সবার সামনে খুনসুটীও করে!

সবকিছু কেমন যেন হিন্দী সিরিয়ালে দেখানো সাজানো সাজানো বিয়ের নাটকের মত লাগে।


বাসায় ফিরতে ফিরতে কেনো যেনো এইসবকিছুই ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, আমরা যেভাবে 'মডার্ণ' হওয়ার নেশায় সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের সব কিছু ছেটে-ছুটে, কেমন সব কমার্শিয়াল হয়ে যাচ্ছি; কেউ কি টের পাচ্ছি? কেউ কি বুঝতে পারছি আমাদের ভিতর থেকে 'ইমোশান' ধুয়ে মুছে চলে যাচ্ছে, আমরা বড় বেশী নাটকীয় হয়ে যাচ্ছি জীবনে… আমার কাছে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য (সব না আবার! খারাপ দিকগুলো বাদ দিয়ে) অনেকটা পোষাকের মত। এসব ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলা মানে অনেকটা পোষাকবিহীন নেংটুপুটু হয়ে যাওয়ার মতো। কী জানি, আমি হয়তো একটু বেশী ভাবি। কিন্তু সত্যি বলছি, অনেকদিন সত্যিকারের বিয়ের মত বিয়ে খাইনা; এইসব নাটকের মতো বিয়ে আমার ভালো লাগেনা। কারো বিয়ে আছে সামনে যেখানে একটা লাল-টুকটুকে বউ থাকবে? দাওয়াত দিতে ভুইলেন না কিন্তু!

(এই লেখাটি উৎসর্গ করা হলো- এ্যাশ আর মায়মুনাকে; যে দু'জন আমার বিয়ের দিন সারাক্ষণ আমার সাথে ছিলো
