তোর কি ফুয়াদের কথা মনে আছে রু?
দেখতে দেখতে আটটা বছর কেটে গেলো। তুই নিউয়র্ক চলে গেলি, আর আমি অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু ফুয়াদ এখনো দেশেই আছে। ওর কখনোই দেশের বাইরে যাওয়া হবেনা আমাদের মত……
সেদিন তুই ফোন করে ভড়কে গিয়েছিলি,‘কীরে কাঁদছিস ক্যান?’
আমি ঢুকড়ে কাঁদতে কাঁদতে শুধু কোনোমতে বলেছিলাম, ‘ফুয়াদ হসপিটালে’।'
‘ক্যান??! কী হইছে?’
‘ঐ যে দুইদিন ধরে জ্বর ছিলো। বিকেলে হঠাৎ খিঁচুনী উঠছিলো। আম্মুকে ফোন করে আসতে বলতে বলতেই আমার কোলে অজ্ঞান হয়ে গেছে। আম্মু সিঁড়ি থেকেই ওকে নিয়ে হসপিটালে চলে গেছে!’
‘তুই বাসায় বসে বসে কাঁদছিস ক্যান গাধা! তুইও হসপিটালে যা। তুই ওখানে থাকলে ফুয়াদের ভাল লাগবে’।'
...... আব্বু গাড়ি পাঠালো। হসপিটালে গেলাম। কিন্তু ওর যে আর জ্ঞান ফিরলোনারে! …… তোর মনে আছে রু? সে-রাত ছিলো বছরের শেষ রাত। চারিদিকে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর কী ভীষন আয়োজন! একজন আরেকজনকে শুভেচ্ছা জানানোর হিড়িক। আর তারমধ্যে আমাদের পরিবারটা যেনো ডুবে যাচ্ছিলো… আমি, আব্বুম্মু, ভাইয়া আর সবাই… আমরা যেনো নিশ্বাস নিতে পারছিলামনারে! বিশাল ধবধবে সাদা বেডে ওর ছোট্ট নিথর শরীরটা আমাদেরকেও কেমন মৃত করে রেখেছিলো। তুই ফোন করে ফুয়াদ তখনো সেন্সলেস শুনে বললি ‘ভড়কে যাসনে। কিছুই হবেনা দেখিস। ডাক্তার চব্বিশ ঘন্টা টাইম দিয়েছে তো? দেখবি, তার আগেই জ্ঞান ফিরে আসবে। শক্ত থাক। তুই ভেংগে পড়লে আংকল আন্টিও ভেংগে পড়বে’।'
আমি শক্তই ছিলাম রু। আম্মু ক্লান্ত শ্রান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে ফুয়াদের পাশের বেডে শুয়ে মাত্র ঘুমিয়ে পড়লো। আমি হাঁটছিলাম। শুধুই হাঁটছিলাম। ফুয়াদ যেনো জ্ঞান ফিরলেই দেখে ওর বড় বোন আছে ওর পাশে; ও যেনো ভয় না পায়; ও যেনো হাত পা ছুঁড়ে স্যালাইনের লাইন ছিঁড়ে না ফেলে। একটু পর পর ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত, তারচেও ছোট্ট গুট্টূশ গুট্টূশ হাতের আংগুলগুলো ধরে যেনো ওকে জাগাতে চাইছিলাম; যেনো তখনি চোখ খুলে হাসবে ও! যেনো এই হসপিটাল, এই সাদা বেড আর স্যাকার মেশিনের ঘড় ঘড় আওয়াজ হঠাৎ মিলিয়ে গিয়ে আমি একটা দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখবো- ফুয়াদ কোল বালিশ জড়িয়ে আমার পাশে বেঘোরে ঘুম।… কিন্তু তা যে হয়নি!
পুরো একটা নির্ঘুম রাত মনে হয় সেই প্রথম কাটানো। একটু পর পর ওকে ছুঁই। ওর চোখ আর খুলেনা। ওর নাক থেকে বেরিয়ে আসা স্যাকার মেশিনের আওয়াজে আমার আতংক আর ভয় আমাকেই দিশেহারা করে ফেলতে থাকে। একরাতেই আমার চোখে কালির পোজ পড়ে যায়। চামড়া শুকিয়ে টান টান হয়ে যায়। ক্লান্ত ঘুমহীন চোখে ওর নিথর দেহের পাশে আমার নববর্ষের ভোর হয়। জানালা দিয়ে চুরি করে ঢুকে পড়া নরম সোনালী সূর্যোদয়ের আলোয় আমি ওর বাম হাতের ছোট্ট বুড়ো আঙ্গুল ধরে বসে থাকি।
ঘুম ভেংগে আম্মু ধমক দিয়ে বাসায় পাঠায়, ‘বাসা থেকে হাত মুখ ধুয়ে আমার জন্যে নাস্তা নিয়ে আয়, যা। পারলে একটু ঘুমিয়ে নিস। নাহলে ফুয়াদের সাথে তোকেও হসপিটালে ভর্তি করাতে হবে!’ …… বাসায় ফিরি। বুয়া আম্মুর জন্যে খাবার রেডী করতে থাকে। গায়ের কাপড় গায়েই নিয়ে আমি কেনো যেনো ফ্লোরে পাটি বিছিয়ে একটু শুই। বুয়াকে বলি খাবার রেডী হলেই যেনো আমাকে ডাক দেয়।
রু, এতদিন পর আর মনে নেই কীভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মাটিতেই; কীভাবে ঘুম ভেংগেছিলো কানের কাছে কারো ‘ফারজানা! ফুয়াদকে নিয়ে আসছে, উঠো!’ চিৎকারে; কীভাবে ঘুম ভেংগে ধড়মড় করে উঠতে উঠতে শুনেছি যে বড়ভাইয়া জীবনেও কাঁদেনা তার ঢুকরে কান্নার আওয়াজ! আমি ঐ অবস্থাতেই সোজা সিঁড়ির দিকে দৌঁড় দিয়েছিলাম রু। আমি তখনি জেনে গিয়েছিলাম ফুয়াদ আর নেই। কিন্তু এও কী বিশ্বাস করা যায় রে? ও যে আমার কোল থেকেই গেলো! ও যে যাওয়ার একটু আগে আমাকে ঈদ-বিচিত্রা-সংখ্যা পড়তে দিচ্ছিলো না বলে আমার ওয়াকম্যানটা ওর কানে লাগিয়ে দিয়েছিলাম! ওর জ্বর বাড়ছিলো-কমছিলো বলে কোলেই ঘুম পাড়িয়ে কাঁধে নিয়েই বিচিত্রার উপন্যাস পড়ছিলাম যে! রাতে যে ও ঘুম ভেংগে আম্মুর কাছ থেকে উঠে এসে আমার বুকে ঢুকে ঘুমালো! একটু আগে যে তবে ডক্টরের কাছে শুনে এসেছিলাম ‘রিস্ক একটু কমেছে’!
রু, আম্মু ওকে জন্ম দিয়েছিলো, কিন্তু এখনো আমার মনে হয় ও যেনো আমারই সন্তান ছিলো। সেই যে প্রথম স্যারিলাক খেতে শিখলো, ওকে স্যারিলাক খাওয়াতাম আর ও শুয়ে শুয়ে দুই হাত দিয়ে নাদুশ নুদুশ দুই পায়ের বুড়ো আংগুল ধরে বুকের উপর টেনে এনে খেলতে খেলতে আরাম করে খেতে খেতে উঁ আঁ করতো। এদিক ওদিন মাথা নেড়ে গালের পাশ দিয়ে স্যারিলাক ফেলে দিতো! কিছুদিন পর হাত ধরে ধরে ‘তা তা তা তা’ করে হাঁটতে শিখলো, ধুম ধাম পড়ে যেতো খালি! আর আব্বুকে দেখলেই তখন নতুন বায়না ‘তিপ!’- চিপস! ও পুরোপুরি হাঁটতে শেখার আগেই দৌঁড়ুতে চাইতো, রাস্তা দিয়ে মিছিল গেলেই দু’হাত উপরে তুলে ছোট্ট শরীরটা ঝাঁকিয়ে প্রানপনে চিৎকার ‘মিতিল মিতিল!’ আব্বুম্মু দু’জনেই ব্যাস্ত, বড়ভাইয়া ওর বন্ধু আর পড়ালেখায় হাওয়া, ওর কাছে ছিলাম আমিই শুধু। আমার তখন সামনে মেট্রিক পরীক্কা, কিন্তু ও পড়তে দিলেতো! আমি পড়ি আর ও বুকের উপর ঘুমায়। ওর ঘুমের সুবিধার জন্যে আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে পড়ি। আমার নোট খাতায় ও আঁকিবুঁকি করে দেয় কলম হাতে পেলেই! রাগে বকা দেই, আবার ওর অভিমানী মুখ দেখে নিজেই হাসি।
রু, আমার নোটসগুলো এখনো আছে এর-ওর কাছে। অবাক ব্যাপার কী জানিস? গতবছর এক অচেনা স্টূডেন্ট’র কাছ থেকে মেইল পেয়েছিলাম, ‘আপু, আপনার নোটস হাত ঘুরে ঘুরে এখন আমার কাছে। একটা জিনিষ খুব অবাক লেগেছে- এত সুন্দর করে গুছিয়ে রেডী করা নোটস, কিন্তু প্রায় পৃষ্ঠাতেই নোটস’র উপর এমন কলমের আঁকিবুঁকি কেনো?’ …… রু, ঐ মেইল পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। এখনো আমার টেবিলে কত বই খাতা, কিন্তু আঁকাবুঁকি করার যে কেউ নেইরে!
জানিস রু, আম্মু বলেছিলো ফুয়াদের শেষ জ্ঞান ফিরেছিলো আমি কেবিন থেকে বের হওয়ার পর পরই। আর জ্ঞান ফিরে পেয়ে ও চারিদিকে একবার তাকিয়ে কেবিনের দরজার দিকে তাকিয়ে শুধু দুইটা শব্দ বলেছিলো, ‘ফাদ্দানা! ফাদ্দানা!’ -ও আমাকে খুঁজছিলো! আম্মু ওকে বলেছিলো, ‘ফারজানা আছে আব্বু, এইতো এখনি আসবে।’ কিন্তু ও আমাকে আসার আর সময় দেয়নি। আর একটা শব্দও না করে আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো, এবং সেই সাথে প্রবল খিঁচুনী! হতভম্ব আম্মু ডাক্তার ডেকে আনতে আনতেই সব শেষ!
রু, কত সহজে একটা জীবন শেষ হয়ে যায়! কত সহজে!!
আমি ওর লাশের পাশে বসে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ওকে কেমন লম্বা দেখাচ্ছিলো। যে শীতল-পাটিতে আমি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ওটাতেই ওকে শুইয়ে দিলেন আব্বু। আমি বললাম- ‘আব্বু, ও ব্যাথা পাবে, মাথার নীচে বালিশ দিন’।' আব্বু হু হু করে কেঁদে ফেললেন। কে যেনো আমাকে বালিশ দিতে দিলোনা। শেষে আমার ওড়নাকেই গোল করে পেঁচিয়ে দিলাম ওর মাথার নীচে। … আত্না চলে গেলেই মানুষ এমন নির্জীব হয়ে যায় কী করে? এতত মানুষ ওর চারপাশে, তবু যে ও কথা বলছিলো না? তবু যে ও ভয় পেয়ে আমার কোলে উঠে পড়ছিলো না? … রু, আমি ওর শরীর ছুঁয়ে ওর আত্নাকে খুঁজেছিলাম। কোথায় চলে গেলো ওটা? একবার ফিরে আসুক, ও ‘ফাদ্দানা’ বলে ডাকুক, আমি ওকে বুকে ঢুকিয়ে ফেলবো, কিছুতেই ছাড়বোনা!
রু, ওকে আব্বু কোলে করে নিয়ে গেলো। বড়ভাইয়া গেলো পাশে পাশে। আম্মু বেহুঁশ। যাওয়ার আগে ওর কপালে শেষবার চুমু খেয়েছিলাম। আমার চোখের পানি পড়েছিলো ওর কপালে। বড়ভাইয়া সে পানি যত্ন করে মুছে দিতে গিয়ে উলটো ওর চোখের পানিতে ভরিয়ে দিয়েছিলো। …… রু, সেই শেষবার ও যখন ডাকলো, তখন কেনো ওর পাশে থাকতে পারলাম না? দশটা মিনিট পরেও যদি বের হতাম, তাও তো ওর সাথে দেখা হতোরে!
আট বছর চলে গেলো। আটটি বছর।…… আরো কত বছর যাবে। দিনগুলো ফিকে হয়ে আসে। জীবন ধীরে ধীরে আরো বেশী অর্থহীন লাগে।… ওর মৃত্যুর পর ওর কবরে গিয়ে বসে থাকতাম। চুপি চুপি কথা বলতাম ওর সাথে। আমি জানি রু, ওর কবরের পাশে বসে যখন আমি কথা বলি, ও শুনতে পায়। ও হাসে। আমি ওর হাসির আওয়াজ শুনতে পাই। …… বাসায় ভাইয়া-ভাবীর কোল জুড়ে ছোট্ট মামনি উমাইমা এসেছে। ফুয়াদের অভাব ভুলতে সবাই ওকে ডাবল আদর করে। ও নাকি এখন আব্বুম্মুকে শাসন করে শুনেছি! আব্বুকে নাকি খাবার সামনে নিয়ে পেপার পড়তে দেখলে ধমক দিয়ে বলে ‘কান্’!-খান্!... বাসায় কেউ ফুয়াদের কথা বলেনা। আব্বুম্মুকে মনে করিয়ে দেইনা কেউই। কিন্তু এবার অস্ট্রেলিয়া চলে আসার আগে আম্মু সহ যখন শেষবার ফুয়াদের কবরে গেলাম, আম্মু হঠাৎ ঢুকরে কেঁদে বললো, ‘ফারজানারে! উমাইমা কাঁদলেই আমার মনে হয় ফুয়াদ কাঁদছে!’ ……… আম্মু অনেক্ষন হুঁ হুঁ করে কেঁদেছিলো। ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ওড়না ভিজে গিয়েছিলো। তখনি বুঝেছিলাম- পৃথিবীতে কেউ কাউকে রিপ্লেস করতে পারেনারে! যে যায় সে তার সব নিয়েই যায়…… আমি ফুয়াদের কবরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে আম্মুর কাঁধ ধরে দাঁড়িয়েছিলাম।
…… এখন, আট বছর পর, এই গভীর রাতে একলা রুমে ওর কথা লিখতে লিখতে কাঁদছি।
শুভ জন্মদিন ফুয়াদ!