যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।
বইটি লেখার পর বহুদিন চলে যায়। হঠাৎ একদিন মনে পড়ে, হায়, যাকে নিয়ে একটা বই লেখা হয়ে গেল, জীবদ্দশায় সেই মেয়েটি জানতেই পারলো না সে একটা ‘জীবন্ত ইতিহাস’! আমার এমন একটা ইচ্ছে মনের ভেতর প্রবলতর হলো- মেয়েটার হাতে বইটা তুলে দিয়ে তাকে চমকে দেব; এতে সে না জানি কত খুশি ও চমৎকৃত হবে, আর তাতে আমিও যে প্রচণ্ড আনন্দ পাব, তা বলাই বাহুল্য।
‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসে মেয়েটির নাম ‘জুঁই’। ওটা একটা গল্প হওয়ায় স্বাভাবিক নিয়মেই বাস্তব নামটি পালটে দেয়া হয়েছিল। এ নিয়ে আলাপ হচ্ছিল একদিন আফরোজার সাথে। আফরোজা জোর দিয়ে বলে, বাস্তবেও মেয়েটির নাম ‘জুঁই’ ছিল এবং সে বেগম আয়েশা গার্লস পাইলট হাইস্কুলের ফার্স্ট গার্ল ছিল, ওদের বাড়ি পালামগঞ্জ। আমি ততোধিক জোর দিয়ে বলি যে, মেয়েটা ছিল নারিশা গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রী, ওদের বাড়ি মেঘুলা ছিল। আফরোজার সাথে আমার বিতর্ক শেষ পর্যন্ত বিতণ্ডায় পরিণত হয়- সে বলে, তোদের মধ্যে আগে থেকেই জমজমাট প্রেম ছিল। পরে মেয়েটা তোকে ‘রিজেক্ট’ করেছিল। সেই রিজেকশনের রিভেঞ্জ নেয়ার উদ্দেশ্যেই এতদিন পর এই বই লিখেছিস। এরপর ক্রূরচোখে আফরোজা আমার দিকে তাকায়। আমি ক্রোধে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই।
উপন্যাসটি লিখেছিলাম ঘটনা ঘটবার প্রায় বিশ বছর পর। যদিও এটাকে ‘ঘটনা’ বলছি, আদতে এটা কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা জাতীয় কোনোকিছু নয়। স্কুলজীবনের শেষ ধাপে গিয়ে, এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার সময় ‘অ’র সাথে আমার একটা ‘সম্পর্ক’র মতো সৃষ্টি হয়েছিল; এই ‘সম্পর্ক’ ব্যাপারটা নিয়েও আমার নিজের মনেই অনেক দ্বিধাগ্রস্ততা রয়েছে, অর্থাৎ আমি নিশ্চিত নই আমাদের মধ্যে সত্যিকারেই কোনো ‘সম্পর্ক’র মতো কিছু সৃষ্টি হয়েছিল কিনা। আমি শুধু জানতে পেরেছিলাম, শাহজাহানের কাছ থেকে আমার কবিতার খাতাটা ‘অ’র হাতে পৌঁছুবার পর আমার তারুণ্যমুখর কবিতার প্রতি ওর কিছু মুগ্ধতা জন্মেছিল।
আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাহজাহানের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় এই সম্পর্ক সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল। কিন্তু ‘অ’-কে এক কপি বই দেয়ার কথা শাহজাহানকে বলতে খুব সঙ্কোচ বোধ হলো। সে কী ভেবে বসে, সেটাই ছিল সঙ্কোচের বড়ো কারণ।
একটা মেয়ের সাথে আপনার পরিচয় হলো, দু-একদিন দেখাসাক্ষাৎ হলো, স্বল্প আলাপ হলো। আপনার সাথে ‘সম্পর্ক’ সৃষ্টি হওয়ার মতো কিছু একটা ঘটে গেলে এ থেকেই তার আভাস পেয়ে যাবেন। ‘অ’ আর আমার মধ্যকার মনের দূরত্ব বা ঘনত্ব বোধগম্যতার অতীত ছিল। ওর সাথে পরিচয় হবার পর পরীক্ষা চলাকালে আর মাত্র একদিন আমাদের সামনাসামনি দেখা হয়েছিল, কিন্তু কোনো কথা হয় নি; অথচ, এই অল্প সময়ের মাঝখানে সে আমার ব্যাপারে আমার বন্ধুদের সাথে অনেক আলাপ করেছে; সেই আলাপের পরিধি এত ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিল যে, এ কথা আমার বন্ধুরা, বিশেষত শাহজাহান যখন আমাকে শোনাতো, মনে হতো ‘অ’ আমার প্রতি অনেক অনেক ‘আগ্রহী’ হয়ে উঠেছে।
আমাদের দুজনের গ্রাম ছিল দু’দিকে; আমাদের পরীক্ষা হয়েছিল ভিন্ন এক গ্রামে - জয়পাড়া। পরীক্ষা শেষে আমরা যার যার গ্রামে চলে গেলাম। আমরা তখন বাঁধনহারা পাখি। দল বেঁধে কত জানা-অজানায় ছুটি। এবং কাকতালীয়ভাবে মাঝে মাঝেই বন্ধুদের সাথে আমি ওদের গ্রামে গিয়ে পৌঁছুই। আরো কাকতালীয় ব্যাপার ছিল এই যে- কেমন করে যেন ‘অ’র সাথে আমার দেখা হয়ে যেত। কিন্তু আমরা কখনো মুখোমুখী হতে পারি নি। হয়ত গ্রামে একটা মেলা হচ্ছে, স্কুলের অ্যানোয়াল স্পোর্টস, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কোথাও-বা জারিগানের আসর; আমার চোখ চারদিকে ‘অ’-কেই খুঁজতো, এবং হঠাৎ একসময় আবিষ্কার করতাম- জটলার কোনো এক কোনা থেকে অনেক বান্ধবীকে নিয়ে সে এবং তারা একসাথে আমি এবং আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই ওরা একযোগে উধাও হয়ে যেত। কালে আমার অবস্থা এমন হলো, আমি যদি কোনো ভিনগ্রহেও যেয়ে উঠতাম, আমার চোখ চারদিকে শুধু ‘অ’-কেই খুঁজতো।
‘অ’র সাথে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল শিমুলিয়া গ্রামে। আমার আরেক সহপাঠী ফরিদ আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা চইচই করে সারাটাদিন সারাগ্রাম ঘুরে বেড়ালাম। দুপুরে কফিলদের বাড়িতে গিয়ে ভাত খেলাম। বিকালে শুভ আর খায়েরও আমাদের সাথে এসে মিলিত হলো। ওরা সবাই আমার সহপাঠী; সবাই কলকল খলখল করতে করতে হাঁটছিল, কিন্তু আমার মন খুব উস্খুশ করছিল- হায়, ‘অ’-কে আজ দেখতে পেলাম না, বা ‘অ’র সাথে আজ দেখাই হলো না! ঠিক এমন সময় একদঙ্গল মেয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছিল। বাতাসে ওদের ওড়না উড়ছিল। বেণির মাথায় গোল করে পাকানো লালফিতার ফুল দুলছিল। আমি ওদের উড়ন্ত ওড়না আর ফুলবেণির এপাশ-ওপাশ দোলখাওয়া দেখছিলাম। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ যে-মেয়েটি মুখে হাসি ছড়িয়ে একঝলক পেছন-ফিরে তাকালো, সে ছিল ‘অ’ এবং আমার হৃদয় বিদীর্ণ করে মুহূর্তেই সে হাস্যচ্ছন্দে সখীদের সাথে বাড়ির আড়ালে হারিয়ে গেল। তারপর শিমুলিয়া গ্রামে আর যাওয়া হয় নি। ‘অ’র অনেক খোঁজ নিয়েছি। কেউ আমাকে জানায় নি ‘অ’ ভালো নেই, ‘অ’ আমাকে অনেক খুঁজেছে, ‘অ’ আমার জন্য কাঁদতে কাঁদতে চক্ষু লাল করেছে। অনেকদিন পার হয়ে গেলে, দীর্ঘ ১৭ বছর পর যেদিন শাহজাহানের সাথে দেখা হলো, ওকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ মনের উষ্ণতা আর নিগূঢ় ভালোবাসা বিনিময় করলাম, আর বারংবার ওর শরীরে আমার হৃদ্স্পন্দন ছড়িয়ে জানতে চাইলাম, শাহজাহান, তুই আমাকে শুধু এটুকু বল- স্বামীর ঘরে গিয়েও, সন্তানের জননী হওয়ার পরও, আমাকে ভেবে ভেবে আজও ‘অ’ চোখের জল ফেলে, যেমন আমি নিজেও স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে শুধু ‘অ’-কে খুঁজতে থাকি।
২
‘অ’-র কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম; কিন্তু শাহজাহানের সাথে আড্ডায় বসলে স্কুলের আম্রবাগানে টগবগে দুপুর নেমে আসে, যেখানে আমরা সহপাঠীরা আজও, অনন্তকাল ধরে আড্ডার আসর গেড়ে বসে আছি, অদূরে কাঁঠালবাগের ছায়ায় মেয়েরা আমাদের দিকে বার বার ফিরে ফিরে চায়, আর মুচকি হাসিতে আমাদের প্রাণ ছিঁড়ে ফালি ফালি করে। আমি কোনোকালেই কোনো আড্ডার মধ্যমণি হতে পারি নি। কফিলের মুখে কথার তুবড়ি ফোটে। খায়েরের গল্পে আড্ডা জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমি শুধু শুনি, মনের সাধ মিটিয়ে ওদের আড্ডা উপভোগ করি। ‘অ’র কথা অনেক আগেই ভুলে গিয়েছি। শাহজাহান জম্পেশ গল্প শুরু করে। ও সবার কথা বলে। শাহনাজ ওর মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে; পারুল বিয়ে করিয়েছে ছেলেকে; করিম নানা হয়েছে সবার আগে; নয়ন আর শায়লার বিয়েটা শেষ পর্যন্ত টিকলো না- আহা, কত না মধুর ছিল ওদের প্রেম। আমি অধীর উন্মুখ থাকি- এ বুঝি শাহজাহান ‘অ’র কথাটাও তুলবে। কিন্তু শাহজাহান শেষ পর্যন্ত ওর নিজের প্রেমকাহিনি বলতে শুরু করে। দীর্ঘক্ষণ আবেগ মিশিয়ে গল্প বলার পর সে সান্ত্বনার সুরে বলে, ‘প্রেমিকা হিসাবে মেয়েরা যত সেরা, বিয়ের পর ততখানিই নিরামিষ, রোমান্সের একফোঁটাও থাকে না, রসকষ সব শুকাইয়া যায়। এটা দাও, ওটা দাও, সেটা নাই কেন? খালি ডিমান্ড আর ডিমান্ড। সারাদিন চেঁচামেচি। শুকনা কাঠ। তক্তা। বুঝলি?’
আমি আর আগ্রহ চেপে রাখতে পারি না। বলি, ‘আচ্ছা, অযুতির কথা বল।’ কথাটা বলেই আমি চমকে উঠি- কী করে হঠাৎ ‘অযুতি’ নামটা মনে পড়ে গেল!
শাহজাহান মাথা উঁচু করে জিজ্ঞাসু চোখে আমার দিকে তাকায়।
আমি মুখ মলিন করে হাসি। ও জিজ্ঞাসা করে, ‘অযুতি যেন কোনটা?’
‘আরে ঐ যে, তোদের পাড়ার মেয়ে। সেই মেয়েটা। ঐ যে…’
শাহজাহানের চোখ আরো সরু হলে আমি বলি, ‘অযুতি কি জানে, ওরে নিয়া আমি একটা মস্ত উপন্যাস লিখে ফেলেছি? ‘অন্তরবাসিনী’ যার নাম?’
শাহজাহানের হুঁশ হয়। ও অট্টহাসি দিয়ে ওঠে। অনর্গল হাসতে হাসতে বলে, ‘আমারে আর হাসাইস নারে পাগল। হাসতে হাসতে আমি মইরা গেলাম। আমারে ধর ধর। আমি হাসতে হাসতে মইরা গেলাম।’ তারপর একটু দম নিয়ে বলে, ‘ব্যবসা বাণিজ্য, জমিজমা নিয়া ও এখন মহাব্যস্ত। ফুইল্যা ডোল হইয়া গেছে। হাঁটলে মনে হয় একটা হাতি হাঁইটা যাইতেছে। মুখ ভইরা খালি পান চিবায়। কথা বলতে গেলে পানের পিক ছুইটা আসে আমাদের শরীরে। বইটই পড়ার কি বেল আছে অযুতির? ও এখন সংসারের পাক্কা গিন্নী।’
আমি একটু বিমর্ষ ও উদাস হয়ে পড়ি। অযুতির উঠতি যৌবনের একটা সুন্দর ছবি এতদিন আমার চোখে ভাসতো। একটা হালকাপাতলা শ্যামলাবর্ণ মেয়ে, যে নেচে নেচে ছোটে, খিল খিল করে হাসে, যার হাসিতে পৃথিবীর বুক ভরে ওঠে, যার চুলের গন্ধে বাতাস মূর্ছা যায়, সে-মেয়ে আজীবন প্রেমিকা হয়েই থাকবে যে-কোনো প্রেমাকাঙ্ক্ষী যুবকের বুকে। তার বয়স বাড়তে পারে না, অগোছালো, ভারী শরীরে নিতম্ব দুলিয়ে যত্রতত্র পানের পিক ফেলা বেরসিকা হৃদয়হীনা হতে পারে না অযুতি।
‘ধূর, কী কস?’ আমি শাহজাহানের কথা অবিশ্বাসের সুরে উড়িয়ে দিতে চাই।
ও স্বর একটু নামিয়ে বলে, ‘কথা মিথ্যা না। একদম গ্যাছে অযুতি। মানুষের টাকাপয়সা মাইরাধইরা এখন একটা টপ ক্রিমিনাল হইয়া গেছে। কবে যে ক্রস ফায়ারে খতম কইরা দেয়, বলা যায় না।’
আমি চমকে উঠি। ‘হায় হায়! একী সর্বনাশ! এতখানি? আমার বিশ্বাস হয় না রে! অসম্ভব!’
শাহজাহান ‘হুহ্’ বলে একটুকরো শব্দ করে, যার অর্থ অত্যন্ত অস্পষ্ট।
অযুতির ব্যাপারে শাহজাহান হয়ত অনেকখানি বাড়িয়েই বলে থাকবে। ওর এই বাড়িয়ে বলার কারণ আমার কাছে গোপন কোনো রহস্য মনে হয় না। অযুতির প্রতি আমার একটা বাড়তি আগ্রহ বা আকর্ষণ সৃষ্টি হোক, যার ফলে একটা অশুভ পরিণতি নেমে আসুক আমার বা অযুতির সংসারে, শাহজাহান নিশ্চয়ই এটা চায় না। এ ছাড়া আর কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না। এমনও না যে, অযুতির সাথে স্বয়ং শাহজাহানেরই একটা অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, ও চায় না আমার আকস্মিক অভ্যুদয়ে তাতে ছেদ পড়ুক। ও কখনোই এ ধাঁচের কেউ নয়।
আমার ধারণা যে মিথ্যা নয় তা বুঝতে পেলাম আরেকদিন, যখন শাহজাহানকে বললাম, ‘চল, অযুতিকে একদিন দেখতে যাব। ওর হাতে ‘অন্তরবাসিনী’ না দিয়া আমি শান্তি পাচ্ছি না।’
শাহজাহান খুব শান্ত স্বরেই বললো, ‘তুই যেই অযুতিরে নিয়া উপন্যাস লিখেছিস, আজ তারে দেখলে খুব কষ্ট পাবি। মনে হবে বই লেখাটাই একটা বিরাট অপচয় হইয়া গেছে। ওরে দেখলে ওর দিকে ফিরাও তাকাবি না। মেয়েরা বুইড়া হইলে এমনই হইয়া যায়।’ তারপর আমারে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘আমি জানি তোর মনের মধ্যে সেই ১৬ বছরের একজন অযুতি বাস করে। খামাখা একটা সত্যকে কবর দিতে চাস কেন?’ শাহজাহানের শেষ কথাটা আমার কানের কুহরে অজস্রবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো- ‘খামাখা একটা সত্যকে কবর দিতে চাস কেন? খামাখা একটা সত্যকে কবর দিতে চাস কেন?’
আমি এরকম গল্প শুনেছি- প্রেমে ব্যর্থ একজন পুরুষ বয়সের শেষ প্রান্তে গিয়ে বহুকাল আগে হারানো প্রেমিকাকে একনজর দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েন। অনেক শ্রম বিসর্জনের পর প্রেমিকার সন্ধান পান। একদিন সেই প্রেমিকার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি। প্রেমিকাকে দেখার ইচ্ছে প্রবল হলেও চক্ষুলজ্জার কারণে মুখ ফুটে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারেন না। তিনি যৌবন কালের মতো প্রেমিকার বাসার চারপাশে বার কয়েক ঘুরলেন, তারপর সামনের মুদি দোকানের বেঞ্চিতে বসে সময় কাটালেন। মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে বউঝিরা বের হয়, বয়োবৃদ্ধ মহিলারাও কেউ কেউ এদিকে আসলেন-গেলেন, কিন্তু পুরোনো প্রেমিকার দেখা মেলে না কিছুতেই। বেলা শেষে বিষণ্ণ বদনে ফিরতি পথে রওনা হলেন পুরুষপ্রেমিক। তখন নাতির হাত ধরে কূঁজো হয়ে লাঠিতে ভর করে খুটখুট শব্দে ও-পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল তার হারিয়ে যাওয়া বিগতযৌবনা প্রেমিকা, যার সাথে তার চোখাচোখি হলো, কিন্তু ঘূণাক্ষরেও কেউ টের পেলেন না, একদিন তারা উন্মত্ত প্রেমিকপ্রেমিকা ছিলেন- পরস্পরকে না পেয়ে যাদের বুক ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছিল।
৩
অযুতির চেহারাটা ভারি মিষ্টি। মিষ্টি একটা পাখির মতো সে একডাল থেকে আরেকডালে ছুটে যায়। প্রজাপতির মতো রঙিন ও ঝলমলে ওড়না বাতাসে উড়িয়ে সে দৌড়ে চলে। আমি নেশাগ্রস্তের মতো অযুতির দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার চোখ নড়ে না। অযুতি আজও এমনি। আমি কেবলই ভাবতে থাকি।
শাহজাহানকে আর তোয়াক্কা করি না, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আমি নিজ হাতে অযুতিকে ‘অন্তরবাসিনী’ তুলে দেব। ওর বিস্ময়াভিভূত মুখ দেখে আমিও বিস্মিত হতে চাই- এর চেয়ে বড়ো আনন্দ আর কিছু নেই।
একদিন আফরোজাকে নিয়ে অযুতির উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হই। সাথে নিই সুন্দর মোড়কে বাঁধাই করা দুটি ‘অন্তরবাসিনী’। কীজন্য দু’কপি নিচ্ছি, সেটা আমি নিজেও জানি না। হতে পারে- এককপি অযুতির হাতে দেবার পর সে হয়ত দ্বিতীয় কপিটি চাইবে অন্য কাউকে গিফট করার জন্য। তাকে নিয়ে একটা বই লেখা হয়েছে, এ কথা খুব কাছের মানুষকে জানানোয় অনেক গর্ব হবে তার।
আমার ভেতরে উত্তেজনা। আমার কল্পনাবিলাসী চোখে অযুতি যদিও তার সেই আগের জায়গাটিতেই স্থির রয়েছে, তবু আমি মনকে প্রস্তুত রাখলাম গল্পের প্রেমিকার চাইতেও অপ্রত্যাশিত কিছু মোকাবেলা করার জন্য। আমি জানি না, কেন এই অন্তিম বেলায় আমার এ নেশা হলো অযুতিকে খুঁজে বের করার; অযুতির হাতে এ বইটা তুলে দিলে এর মূল্যই বা কতখানি বাড়বে, তা আমি জানি না; কিংবা অযুতির মুগ্ধতা দেখে আমার যে-তৃপ্তি ঘটবে, সেই তৃপ্তিরই বা কী মূল্য আছে, তাও আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। কিন্তু আমি প্রাণপণে চাইছি এ বইটি অযুতির হাতের একটু স্পর্শ পাক। বইটি হাতে নিয়ে অযুতি একবার আমার চোখে তাকিয়ে থাকুক, এক মুহূর্তের জন্য, দেখুক, একবার যে-ভালোবাসার জন্ম হয়, তা শত আগুনে জ্বলতে জ্বলতে অনিঃশেষে অফুরন্ত হয়; অনেক অনেক ভালোবাসার গভীরে তা ঢাকা পড়ে গেলেও কখনো নির্বাপিত হয় না।
আমরা অযুতির বাড়িমুখে যেতে থাকি। টুকিটাকি কথা বলি। চারদিকের প্রকৃতি দেখি। প্রকৃতি বদলে যায়। সবকিছু বদলে যায় প্রতিদিন। মানুষ বদলায়। বদলে যায় মানুষের মন। ২৭ বছর চলে গেছে। আজ কেন যেন মনে হচ্ছে, অযুতিকে দেখার প্রথম দিন থেকেই আমার মনের নিভৃত একটা কোণে সে গভীর একটা স্থান দখল করে নিয়েছিল। বয়স থমকে থাকে না; যৌবন এবং রূপও চিরস্থায়ী নয়। আমরা বদলে গেছি। অযুতিও আগের অযুতি নেই। আমি এই বর্তমানের অযুতির সামনে গিয়েই দাঁড়াবো। ওর ঝলসে যাওয়া রূপ ভেদ করে অন্তরের কুঠরিতে যে শাশ্বত সৌন্দর্য ফুটে আছে- আমার মন বাড়িয়ে সেই সৌন্দর্যকে ছোঁব।
৪
বাড়িতে যাওয়ার পর অবিকল অযুতির মতো দেখতে দুটো মেয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। আমাদের বুঝতে সময় লাগলো না যে এরা দুজন অযুতিরই গর্ভজাত কন্যা। ওদের মিষ্টি হাসিতে ঘর ছেয়ে গেল। কথাবার্তা চলতে চলতেই ওরা সবচাইতে কষ্টের সংবাদটি জানালো, ওদের মা আর বেঁচে নেই, বছর তিনেক হলো মারা গেছেন। সহসাই আমাদের মন বেদনায় ভারী হয়ে ওঠে। বেশ কিছুক্ষণ আমাদের মধ্যে কোনো কথা হয় না। মেয়ে দুটোর মুখও কালো হতে থাকে।
আরো কিছু সময় পরে আমরা উঠে পড়ি। ওরা দুজন রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেয় আমাদের। বিদায় নিয়ে পথে যেতে যেতে আমরা বার কয়েক ফিরে তাকাই। হঠাৎ আমি ঘুরে দাঁড়াই। ওরা তখনো আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি এগিয়ে আসি ওদের সামনে। আমার সাইড ব্যাগ খুলি। আসার সময় দুটো টবলারেন চকোলেট কিনেছিলাম অযুতির বাচ্চাদের জন্য, দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। ভুলে যাওয়াটা আমাকে মানসিকভাবে খুব আহত ও অপরাধী করলো। অপরাধমনস্কভাবেই চকোলেট দুটো বের করে ওদের দুজনের হাতে দিই। আমার ‘অন্তরবাসিনী’ অন্তরেই থেকে যায়। ওদের হাতে এ বই দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কেন ইচ্ছে হচ্ছিল না তার কোনো ব্যাখ্যাও নেই আপাতত।
আমি ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। আদরের একটা ভাষা আছে। ওদের চোখ ভিজে উঠলো সেই ভাষার স্পর্শে। হয়ত আমারও চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়বে এখনই, তার আগেই উলটো ঘুরে আমি হাঁটতে থাকি। একবার শুনলাম ওরা বলছে- ‘মামা, আবার আসবেন।’ আমি পেছনে না তাকিয়েই হাত নাড়িয়ে ওদের কথার জবাব দিই, তারপর আফরোজাকে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে থাকি।
৫
২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতার বেল ভিউ হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৮২ বছর বয়সে সুচিত্রা সেন মৃত্যুবরণ করেন। তার আগে ১৯৭৮ সালে সুদীর্ঘ ২৫ বছর অভিনয়ের পর তিনি চলচ্চিত্র থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। এর পর তিনি লোকচক্ষু থেকে আত্মগোপন করেন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় ব্রতী হন। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য সুচিত্রা সেন মনোনীত হয়েছিলেন, কিন্তু ভারতের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সশরীরে পুরস্কার নিতে তাঁকে দিল্লী যেতে হবে। তিনি ঘর থেকে মানুষের সামনে বের হন নি এবং দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারও গ্রহণ করেন নি। ইন্দ্রাণী, সাগরিকা, বিপাশা, শিল্পী, পথে হলো দেরী, সাড়ে চুয়াত্তর, দেবদাস, চাওয়া পাওয়াসহ অজস্র ছায়াছবিতে অভিনয় করে সুচিত্রা সেন আমাদের হৃদয়ে একটা চিরস্থায়ী রূপ ধারণ করে আছেন। ৮২ বছর বয়সে দেখতে কেমন হয়েছিলেন তিনি, আমরা জানি না। তিনি তাঁর অগণিত ভক্তহৃদয়ের রক্তক্ষরণের কথা ভেবেই হয়ত জনসাধারণ্যে বেরিয়ে নিজের ক্ষয়ে যাওয়া রূপ আর বুড়িয়ে পড়া যৌবন প্রকাশ করতে চান নি। সাগরিকা বা সাড়েচুয়াত্তরে যেমন দেখেছি সুচিত্রা সেনকে, তিনি আজও তেমনি হাস্যোজ্বল রোমান্টিকতাময়, চিরকাল তেমনি অটুট থাকবেন।
অযুতির সাথে আমার দেখা হলো না। অযুতির সাথে আর দেখা হবেও না কোনোদিন। অযুতি বুড়িয়ে গেছে, পান খেয়ে বিদ্ঘুটে করে রাখে মুখ- শাহজাহানের এ কথা আমি বিশ্বাস করতে চাই না। আমি চোখ বুজলেই আজও দেখতে পাই, কবিতার মতো স্নিগ্ধ লাবণ্যময়ী একটা মেয়ে গোধূলির রাঙা আঁধারীতে হাত নেড়ে নেড়ে আমাকে বলছে, আচ্ছা, কীভাবে এত ভালো কবিতা লেখেন, বলুন তো?
৬ এপ্রিল ২০১৯
উৎসর্গ :
আমার ক্ষ্যাপাটে এবং পাগলা বন্ধু আবদুল করিম, যার জীবনঘনিষ্ঠ স্টেটাস ও কবিতাগুলো আমাকে খুব ভাবায় (গল্পের শাহজাহান আসলে আবদুল করিম)। আর শাহজাহান নামটা আমার আরেক ঘনিষ্ঠ ও মেধাবী ক্লাসমেট, সুবিদিত ইংলিশ টিচার স্বয়ং শাহজাহানের। শাহজাহান আর করিম উভয়েই আমার অনেক গল্পের নায়ক বা প্রধান চরিত্র। ওদের প্রতি শুভেচ্ছা।
ফুটনোট :
আমার স্কুলজীবনের আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবুল কালাম শের খান, এসএসসি পরীক্ষার সময় যার সাথে আমি এক রুমে থাকতাম, যে জুঁই-সম্পর্কিত ঘটনাবলি পূর্বাপর জানতো, আজ ২২ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে আমার বাসায় এসেছিল। সম্ভবত ২০০৭ সালের পর এই প্রথম ওর সাথে দেখা। অন্তর থেকে অনেক কথা অগ্নিলাভার মতো টগবগিয়ে উঠে এলো, এতদিনের জমানো কথাগুলো খইয়ের মতো ফুটছিল দুজনের মুখে। কথায় কথায় হঠাৎ শের খান উচ্চারণ করলো ‘রানু’। আরো দু’বার – ‘রানু’। ‘রানু’। আমি জিজ্ঞাসা করি, রানু কে? শের খান অবাক হয়ে উলটো প্রশ্ন করে, ‘তুই ভুলে গেছিস?’ কয়েকটা সেকেন্ড, তারপর স্মৃতিতে তুমুল ভাস্বর হয়ে উঠলো নামটি। এ নামটি আমি কত খুঁজেছি, অর্থাৎ, এ নামটি আমি কত সহস্রভার, কতভাবে মনে করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু মনে করতে পারি নি। শেষ বার কবে এ ‘রানু’ নামটি আমার মনের কুঠরিতে স্থিত ছিল, তারপর কবে তা হারিয়ে গিয়েছিল, আমি বিলকুল টের পাই নি। ২০০৩/৪ সালে আমি ‘অন্তরবাসিনী’ লিখতে শুরু করি; ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের মূল চরিত্র বা নায়িকাটিই হলো রানু। কিন্তু ঐ সময়ে আমি এ নাম মনে করতে পারি নি। লজ্জার কারণে করিম বা আর কাউকে জিজ্ঞাসাও করি নি। অবশ্য, অন্য কারো মনে যে এ ঘটনা গেঁথে থাকতে পারে, তাও আমি ভাবি নি তখন। আর, দৈবাৎ যদি ‘রানু’ নামটি মনে পড়তোও, নিশ্চিতভাবেই উপন্যাসে এ প্রকৃত নামটি দেয়া হতো না।
রানুকে নিয়ে আমি উপন্যাস লিখেছি ঠিকই, যদিও রানুই গল্পের মূল চরিত্র, কিন্তু বাস্তবে রানুর প্রতি আমার কোনো প্রেম গড়ে ওঠে নি। ঐ ঘটনাটাকে একটা গল্পের প্লট হিসাবেই ব্যবহার করেছি মাত্র।
ওর প্রতি আমার কোনো মোহ বা টান জন্মায় নি বলেই ওর কোনো খোঁজখবরও নেয়া হয় নি কোনোদিন। পথে যেতে যেতে কত মানুষকে পাশ কাটিয়ে যাই, কতজন চলে যায় পাশ দিয়ে, দিন শেষে কারো কথাই মনে থাকে না। রানু হয়ত এমনই একজন পথচারিণী ছিল।
শের খান জানালো, রানু আর বেঁচে নেই। কয়েক বছর আগে মারা গেছে। ক্যান্সার হয়েছিল। আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারি নি, আমার এ গল্পটির মতোই রানু পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে।
ফুটনোট লেখার তারিখ : ২২ এপ্রিল ২০২৪
অন্তরবাসিনী, উপন্যাস, একুশে বইমেলা ২০০৪, ডাউনলোড লিংক
বইটই-এর লিংক - অন্তরবাসিনী
আমার জীবনের সবচাইতে রোমান্টিক ঘটনা
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৬