‘লাভা’ সিনেমার গল্পটা একদঙ্গল তরুণ-তরুণীকে নিয়ে। সিনেমার শুরুতেই দেখা যায় দূরে একটা সবুজ সুন্দর মাঠের এককোনায় মধ্যদুপুরে সূর্যের নীচে একটা গাছের ছায়ায় কিছু তরুণ-তরুণীর একটা ছোট জটলার মতো। ক্যামেরার ফোকাস ধীরে ধীরে কাছে যেতে থাকে। সেখানে সটান দাঁড়িয়ে একহাত কোমরে রেখে আরেক হাত দুলিয়ে কথা বলা একটা দুর্ধ্বর্ষ অপরূপা সুন্দরীর সামনে ৮-১০টা তরুণ বিক্ষিপ্তভাবে, কেউ পেছনে হাতের উপর ভর করে, কেউ মাটিতে হেলান দিয়ে, কেউ জোড়পায়ের হাঁটুতে থুতনি রেখে এখানে-সেখানে বসে আছে। অত্যন্ত চৌকস ও সপ্রতিভ মেয়েটি একটা বক্তৃতা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার মুখাবয়ব খুব দৃঢ় ও কঠিন। চোখ, চোয়াল ও ঠোঁটজোড়া শক্ত করে রাগ ঝাড়বার আগে ক্ষুব্ধ শিক্ষক কিংবা অভিভাবক, কিংবা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ অপরাধী অধস্তনদের উদ্দেশে যেভাবে উপর-নীচ মাথা দোলান, ওভাবে মেয়েটি দু-তিনবার মাথা ঝাঁকিয়ে শুরু করলো : ‘নাও লিসেন। দিস ইজ মাই গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস, সো প্লিজ বি অ্যাটেনটিভ, অ্যান্ড গেট রেডি টু কার্স ইয়োর লাইভস অ্যান্ড ইয়োরসেল্ভস।’ ছেলেগুলো নড়েচড়ে বসে। ওরা সবাই জানে আজকের বক্তব্যবিষয় কী হতে পারে, বা অবশ্যম্ভাবীভাবে কী হতে যাচ্ছে। ‘ইউ অল আর ইডিয়টস।’ প্রায় চিৎকার করে বললো মেয়েটা। ‘ইউ গট মি? ইউ অল আর ইডিয়টস অ্যান্ড স্টুপিডস অ্যান্ড হোয়াট নট।’ মেয়েটির গলার আওয়াজ আরো তীক্ষ্ণ, আরো বলিষ্ঠ শোনায়। ওর চোখ ঠিকরে আগুন বের হচ্ছে। ‘অ্যাকচুয়ালি ইউ পিপল অল আর লুইচ্চা। ইউ গট মি? ইউ আর মোর দ্যান লুইচ্চা।’ এরপর মেয়েটা সবগুলো যুবককে একে একে গালিবর্ষণে ধুলিস্মাৎ করে ফেলে।
মেয়েটা ওদের ক্লাসমেট, কিংবা ছেলেগুলো মেয়েটার ক্লাসমেট, একই ক্লাসে বিভিন্ন সেকশন ও ডিপার্টমেন্টে পড়ে ওরা। একটা সুন্দরী মেয়ের যেসব সমস্যা হয়ে থাকে, মেয়েটার তার সবগুলোই হয় এবং তার চাইতেও অধিক কিছু গঞ্জনা ও যন্ত্রণা তাকে সহ্য করতে হয়। কারণটা হলো, মেয়েটা আর দশটা সুন্দরী মেয়ের মতো ইন্ট্রুভার্ট বা কঞ্জারভেটিভ না। সে সব জায়গায় নির্দ্বিধায় চলতে পছন্দ করে, এবং অভ্যস্ত। নীরবে অন্যায় মেনে নেয় না, প্রতিবাদ করে, সম্ভব হলে চর-থাপ্পড় মারে, একদিন কারো গালে স্যান্ডেল দিয়ে পেটাবে, এই প্রতিজ্ঞা আছে তার।
এ ছবির স্ক্রিপ্ট খুব জটিল এবং শ্যুটিং খুব কঠিন ছিল। মেইন ফোকাস থাকে প্রথম দৃশ্যের উপর। সামনে উপবিষ্ট ক্লাসমেটদের ভর্ৎসনা করতে করতে তুলোধুনো করে, আর এরই ফাঁকে চলতে থাকে প্রতিটা গালিবর্ষণের জন্য একেকটা ফ্ল্যাশব্যাক।
মেয়েটা এবার যার দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করে উঠলো, তার নাম ডেলিম।
‘ইউ ইডিয়ট, তুই বার বার এমন ভাবে আমার গায়ের উপর পড়ছিলি যে, তুই আমাকে দেখতে পাস নি। বা পেছন থেকে তোকে কেউ ধাক্কা দিয়েছে। কিংবা, তুই হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে আমার উপর এসে পড়েছিস। অথচ, একবারও স্যরি বলিস নি। এবং একলাইনে দাঁড়িয়ে কম করে হলেও ১০বার এই কাজটা তুই করেছিস।’ একথাগুলো যখন সে বলতে থাকবে, তখন প্রতিটা ঘটনার জন্য দৃশ্যগুলো দেখানো হবে। এ মুহূর্তে শুধু বক্তব্যের পার্টটাই ভিডিও করা হচ্ছে। অন্য সিকোয়েন্সে বার বার হোঁচট খাওয়ার অংশ রেকর্ড করা হবে।
‘আচমকা ঝড়ের মতো উড়ে এসে পাশে বসেই গলার উপর দিয়ে হাত উঠিয়ে দিলি, যেন আমি তোর শতজনমের বন্ধু, অনেক অনেক ঘনিষ্ঠ। এতেও কোনো দোষ ছিল না। কিন্তু পরের মুহূর্তেই তুই কী করলি?’ যার দিকে ফিরে মেয়েটা এই কথাগুলো বললো, তার নাম শ্যাফেল। শ্যাফেল হাঁটুর ভিতরে মুখ লুকোতে গিয়ে সংকুচিত হতে হতে খুব ছোটো হয়ে গেল। মেয়েটা বলতে থাকলো, ‘তুই হাতটা আরেকটু নামিয়ে আমার বুবসে এত জোরে পেস্ট করলি যে আমি কুঁকিয়ে উঠলাম ব্যথায়। বহুদিন আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি নি। আমি ঝামটা দিয়ে তোর হাত সরিয়ে দিয়েছিলাম। তুই অবাক হয়েছিলি আমার এমন প্রম্পট রিএকশনে। তোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল। ছেলেরা এমন হয় কেন? মেয়ে দেখলেই তাদের শরীর পিষ্ট করে সুখ নেয়ার বাসনা জাগ্রত হয় কেন? এটা তো অমানবিকতা, পৈশাচিকতা। ইতর স্বভাবের কাজ।
ফ্ল্যাশব্যাকে এই শটটা নেয়া ছিল খুবই কঠিন একটা কাজ। একটা মেয়ের কাঁধে হাত রাখা অশোভনীয় নয়, গল্প ও চরিত্রের প্রয়োজনে তা করা যেতে পারে, কিন্তু হাতটা আরেকটু বাড়িয়ে নীচে নামানো, ও বুক দলন করা সম্ভব নয়। ওখানে মেয়েটার সংলাপ, দৃশ্যগুলো ডার্ক করে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয় শুরুতে। এরপর এটা নিয়ে পরিচালক আমাদের সবার সাথে আলাপ করেন, কীভাবে দৃশ্যটাকে রিয়েলিস্টিক্যালি বোঝানো যায়। অনেকগুলো সাজেশন পর্যালোচনা করে তিনটা সাজেশনের উপর তিনটা শট নেয়া হয়। চূড়ান্ত সাজেশনটা ছিল- শ্যাফেল তার হাতটা ধীরে ধীরে নীচে নামাবে এবং আলগোছে বুক বরাবর উপরে হাতটা রাখবে, ভুলেও যেন বুক স্পর্শ না করে; সহেলিকে এতখানিতে রাজি করাতে পরিচালককে তার পায়ে ধরে মিনতি করা বাকি ছিল।
ক্যাম্পাস এলাকা। রাস্তার পাশে বসেছিল সহেলি। পেছনে ক্যামেরা, লাইট সব প্রস্তুত। এমন সময়ে শ্যাফেল এসে সহেলির ডানপাশ ঘেঁষে বসবে। ‘কী রে দোস্ত, একা একা কী এত ভাবছিস? খুব গ্লুমি মনে হচ্ছে তোকে!’ এ কথা বলতে বলতে সে বাম হাতটা সহেলির কাঁধের উপর উঠিয়ে বাম বুক বরাবর নামাবে। আরেকটু সময় পরেই ঘটনাটা ঘটবে। সহেলি ‘উহ্’ বলে ব্যথায় চাপাস্বরে চিৎকার করে উঠবে। শ্যাফেল ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার ভান করবে।
এই সিকোয়েন্সটা যখন হয়, তখন অল্প সময়ের মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে যায়। শ্যাফেল বাম বুক বরাবর হাত নামানো মাত্র সামনের অন্ধকারে, যা পেছন থেকে দেখা যায় না, মুহূর্তের মধ্যে সহেলি ওর বাম হাতটা উঠিয়ে শ্যাফেলের হাত নিজেই তার বুকের উপর খুব গভীরভাবে চেপে ধরে। দুজনের শরীরেই যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। এবং তৎক্ষণাৎ এই বিদ্যুতায়ন থেকে সম্বিৎ ফিরিয়ে এনে দুজনেই অভিনয়ে ফিরে আসে। ক্ষিপ্র গতিতে সহেলি এক ঝটকায় শ্যাফেলের হাত সরিয়ে দেয়। দুজনের এক্সপ্রেশনে পেছনের সবাই মুগ্ধ হয়ে তুমুল হাততালি দিয়ে ওঠে।
এরপর কিছুক্ষণ, কিছুসময়, কিছুদিন আমার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে নি সহেলি। একান্তে আমরা একবার মুখোমুখি হলে সে প্রথম মুখ খুলে বলেছিল, ‘আপনি কিছু মনে করেন নি তো, ভাইয়া?’
এ প্রশ্নটা আসলে বাহুল্যে ভরপুর। মেয়েদের এমন আচরণে কোনো যুবক কোনোদিন কিছু মনে করতে পারে না। আমিও মনে করি নি। প্রতিটা যুবকের মতো আমিও যুবতীদের কামনা করে থাকি। না চাইতেই কেউ যদি এভাবে কিছু পেয়ে যায়, তার সুখ অন্যসব সুখের চাইতে অনেক বেশি।
‘আপনি কিছু মনে করেন নি তো, ভাইয়া?’ কথাটা বলার সময় সহেলির কণ্ঠ কাঁপছিল, সে খুব নার্ভাস ছিল। সংকোচিত চোখে আমার দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল সহেলি।
‘শ্যাফেল ক্যারেক্টারটা আমি খুব উপভোগ করছি সহেলি। খুব ছোট্ট, কিন্তু, এতে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে।’ আমরা পাশাপাশি হাঁটছিলাম আর কথা বলছিলাম।
ছবিতে সহেলির রোলটা যতখানি ডাকসাইটে, চঞ্চল ও ছটফটে স্বভাবের, বাস্তবে তাকে দেখে বোঝা খুব কষ্ট, কীভাবে এত শান্ত, ধীরস্থির মেয়েটা এই টগবগে রোলে অসাধারণ পারফর্ম করে যাচ্ছে।
চলবে-
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:১৯