যে কোনো টুর্নামেন্টের ড্র ও ফিকশ্চার তৈরি করে আমি প্রচুর আনন্দ পেয়ে থাকি। আগের দিনে ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনাল ড্র-এর আগে আমি আমার নিজস্ব ড্র করে ২৪ বা ৩২ টিমের গ্রুপিং তৈরি করতাম। ফাইনাল ড্র-এর সাথে মিল-অমিলের তালিকা বানিয়েও অনেক মজা পেতাম।
গোটা পাঁচেক ফুটবল, হকি ও ভলিবল টুর্নামেন্টের ড্র পরিচালনা ও খেলা আয়োজনের অভিজ্ঞতা আমার ঝুলিতে জমা রয়েছে, যেখানে ২২ থেকে ২৯টা দলকে ৬ থেকে ৮টা দলে ভাগ করে গ্রুপিং করা হয়েছে। এ নিয়ে আমি যেমন গর্ব করি, খানিকটা অহংকারও করি মাঝে মাঝে
ড্র-য়ের মূলসূত্র হলো- একই গ্রুপের দুটি দল লিগ পর্যায়ের পর ফাইনালের আগে আর মুখোমুখি হবে না। কিন্তু মনে করে দেখুন, ২০০২ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিল আর টার্কি একই গ্রুপে ছিল, আবার তারা সেমি-ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল। এটা কীভাবে সম্ভব? সেবার পুরো ৩২টা দলকে আগেই নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে দুইভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছিল। প্রতি ভাগের চ্যাম্পিয়ন ফাইনালে উত্তীর্ণ হয়েছিল। যে-ভাগে ব্রাজিল ও টার্কি ছিল, ভেবে দেখুন, ব্রাজিল ও টার্কি ঐ ভাগের ফাইনালের আগে কিন্তু আর মুখোমুখি হয় নি।
বর্তমান বিশ্বকাপের ড্র ৬ ডিসেম্বর ২০১৩-তে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ ড্র কীভাবে করা হয়েছিল, চলুন, সংক্ষেপে তা আলোচনা করা যাক।
অক্টোবর ২০১৩ মাসে ফিফা র্যাঙ্কিঙের শীর্ষ ৭ দল এবং স্বাগতিক ব্রাজিলসহ মোট ৮টি দলকে গ্রুপ শীর্ষদল বা ‘সিড’ (Seed) হিসাবে নির্বাচন করা হয়। ১ম ৭টি দল ছিল যথাক্রমে স্পেন, জার্মানি, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, বেলজিয়াম, উরুগুয়ে ও সুইজারল্যান্ড। ফিফা র্যাঙ্কিঙে ১১ নম্বরে থাকা ব্রাজিলকে নিয়মানুযায়ী ১ নম্বর ‘সিড’ হিসাবে ধরা হয় (স্বাগতিক হিসাবে)।
৩২টি দলকে সমান ৮ ভাগে ভাগ করে ৮টি পাত্র বা কাচের জার বা বৈয়ামে রাখা হয়।
১। সিডভুক্ত ৮টি দলকে রাখা হয় ১ম বৈয়ামে।
২। আফ্রিকা ও সাউথ আমেরিকার ৭টি দল, যথাক্রমে আলজেরিয়া, ক্যামেরুন, অইভরি কোস্ট, ঘানা, নাইজেরিয়া, চিলি ও ইকুয়েডরকে রাখা হয় ২য় পাত্র বা বৈয়ামে। ৪ নম্বর বৈয়ামে ছিল ইউরোপের ৯টি দল। সেখান থেকে এ্যাট র্যানডম তুলে আনা হয় একটি দলকে (ইটালি) এবং সেটিকে রাখা হয় ২ নম্বর বৈয়ামে। তাহলে ২ নম্বর বৈয়ামে মোট ৮টি দল হলো।
৩। ৩ নম্বর বৈয়ামে এশিয়া ও নর্থ আমেরিকার ৮টি দলকে ফেলা হয়। দলগুলো হলোঃ
Australia
Iran
Japan
South Korea
Costa Rica
Honduras
Mexico
United States
৪। ৪ নম্বর বৈয়ামে ইউরোপের ৮টি দল থাকে (১টি দলকে উঠিয়ে ২ নম্বর বৈয়ামে রাখা হয়েছে- ইটালি)। দলগুলো হলোঃ
Bosnia and Herzegovina
Croatia
England
France
Greece
Netherlands
Portugal
Russia
দলগুলো যাতে প্রতি মহাদেশের দলগুলোর সাথে যথাসম্ভব সমভাবে ভাগ হয়ে মিশ্রিত হয়, সেই চেষ্টা করা হয়, এবং একই গ্রুপে যাতে ইউরোপের ৩টি দেশ না পড়ে তার জন্যও বিশেষ কৌশল অবলম্বন করা হয়।
লক্ষ করে দেখুন, সিডভুক্ত ৮টি দলের মধ্যে ৪টি সাউথ আমেরিকা এবং বাকি ৪টি ইউরোপের দল।
৮টি সিড টিমের মধ্যে ব্রাজিলকে গ্রুপ ‘এ’-তে রাখা হয়। এরপর ১ নম্বর বৈয়াম থেকে একে একে বাকি ৭টি টিমকে তুলে যথাক্রমে বি, সি, ডি, ই, এফ, জি ও এইচ গ্রুপের শীর্ষ দল হিসাবে রাখা হয়।
এ- ব্রাজিল
বি- স্পেন
সি- কলম্বিয়া
ডি- উরুগুয়ে, ইটালি*
ই-সুইজারল্যান্ড
এফ- আর্জেন্টিনা
জি- জার্মানি
এইচ- বেলজিয়াম
(*সিডভুক্ত ৪টি সাউথ আমেরিকার দলকে আবার আরেকটি বৈয়ামে রাখা হয়। তা থেকে লটারি করে একটি দেশের নাম তোলা হয়। তাতে বের হয়ে আসে উরুগুয়ে। এই উরুগুয়ের সাথে ২ নম্বর বৈয়ামে রাখা ইউরোপিয়ান দল ইটালিকে রাখা হয়।)
এরপর ২ নম্বর বৈয়ামের ৭টি দলকে লটারি করে একে একে তোলা হয়। ১মটি তুলে এ গ্রুপে, ২য়টি বি গ্রুপে, এভাবে ৮ নম্বরটি এইচ গ্রুপে রাখা হয়। (ইটালিকে আগেই উরুগুয়ের গ্রুপে ফেলা হয়েছিল)।
একইভাবে ৩ ও ৪ নম্বর বৈয়াম থেকে ক্রমিকভাবে দলগুলো তুলে ‘এ’ থেক ‘এইচ’ গ্রুপে তোলা হয়।
গ্রুপের লটারি এভাবেই শেষ হলো।
কাজ আরেকটু বাকি ছিল।
প্রতি গ্রুপের সিডভুক্ত দলটি টিম-১ হবে। প্রতি গ্রুপের বাকি ৩টি টিমের মধ্যে ড্র করে অবস্থান নির্ণয় করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ, গ্রুপ এ-এর শীর্ষ দল ব্রাজিল, এ-১। এ গ্রুপে ড্র-র ১ম দলটি হবে এ-২, পরেরটি এ-৩ এবং শেষেরটি এ-৪।
এভাবে বাকিদলগুলোর মধ্যকার পজিশন নির্ণয় করা হয়।
ধাঁধা ও অংকে যারা মজা পান তারা এ সকল ড্র বা ফিকশ্চার করেও খুব মজা পাবেন বলে আমার ধারণা।
ফিকশ্চার তৈরি
এবার ফিকশ্চার কীভাবে তৈরি হয় তার উপর সংক্ষেপে আলোকপাত করছি। ড্র-এর আগেই ফিকশ্চার তৈরি করে নিতে হবে। ড্র-এর পর ক্রমিক নম্বর অনুযায়ী দলগুলোর নাম নির্দিষ্ট বক্সে বা বৈয়ামে ফেলে দিতে হবে।
৩২-দল টুর্নামেন্টের জন্য ৮টি গ্রুপ করাই উত্তম, অন্যথায় খেলার সংখ্যা বেড়ে যাবে। ১ম গ্রুপকে এ গ্রুপ, ২য় গ্রুপকে বি গ্রুপ, এভাবে বাকি গ্রুপগুলোকে যথাক্রমে সি থেকে এইচ পর্যন্ত চিহ্নিত করতে হবে। আবার একই গ্রুপের ভিতর শীর্ষ বাছাইকে ১ নম্বর (এ গ্রুপের হলে এ-১, বি গ্রুপের হলে বি-১, ইত্যাদি) এবং বাকিগুলোকে যথাক্রমে ২, ৩ ও ৪ নম্বর দল হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে (এ গ্রুপের ক্ষেত্রে এ-১, এ-২, এ-৩ ও এ-৪। বাকিগুলোও এভাবেই হবে)।
ফিকশ্চার তৈরির জন্য অনেক পদ্ধতি আছে। একটি পদ্ধতি আলোচনা করছি। এ পদ্ধতির মূলসূত্র হলো গ্রুপ লিগের পরে ফাইনাল খেলা ছাড়া একই গ্রুপের দলগুলোর মধ্যে মাঝপথে আর মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা থাকবে না। ব্যতিক্রম হিসাবে শুরুতেই আমি ২০০২ বিশ্বকাপের কথা উল্লেখ করেছি।
ধরে নিই প্রতি গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন ও রানার-আপ দল ২য় রাউন্ডে যাবে। এ প্রসঙ্গে আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিই আগের দিনের কথা যখন ২৪টি দল খেলতো। ঐ সময়ে ২৪টি দলকে ৬ গ্রুপে ভাগ করা হতো, ১৬টি দল ২য় রাউন্ডে উঠতো। প্রতি গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন ও রানার মিলে হতো ১২টি দল, আর ৬টি ৩য় স্থান লাভকারী দলের মধ্য থেকে সেরা ৪টি ২য় স্থান লাভকারী দল ২য় রাউন্ডে উঠবার সুযোগ পেতো। ঐ ফিকশ্চার তৈরি বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি জটিল ছিল। তবে গ্রুপ অব ডেথ তখন বর্তমানের মতো এত ভয়ংকর ছিল না, কেননা কোনো শক্তিশালী দল দুর্ভাগ্যক্রমে গ্রুপে ৩য় স্থান লাভ করলেও সেরা ৪টি ৩য় স্থান লাভকারী হবার আশায় শেষ পর্যন্ত খেলা ধরে রাখতো।
২য় রাউন্ডের জন্য এবার ফিকশ্চার নীচের মতো করে সাজানঃ
এ-১ বনাম বি-২
সি-১ বনাম ডি-২
ই-১ বনাম এফ-২
জি-১ বনাম এইচ-২
লক্ষ করুন, উপরে কোনো গ্রুপ থেকেই একটির বেশি দল উঠে আসে নি। এবার ১ম ম্যাচবিজয়ী বনাম ২য় ম্যাচবিজয়ী এবং ৩য় ম্যাচবিজয়ী বনাম ৪র্থ ম্যাচবিজয়ী ৩য় রাউন্ডে (কোয়ার্টার ফাইনাল) খেলবে। দুই কোয়ার্টার ফাইনাল বিজয়ী খেলবে সেমি-ফাইনাল। সেমি-ফাইনাল বিজয়ী খেলবে ফাইনালে। তাহলে দেখুন, এখানকার কোনো গ্রুপের অপর দলের সাথেই ফাইনালের আগে আর মুখোমুখি হবার সুযোগ থাকছে না।
চলুন দেখা যাক বাকি দলগুলোর ফিকশ্চার।
এ-২ বনাম বি-১
সি-২ বনাম ডি-১
ই-২ বনাম এফ-১
জি-২ বনাম এএইচ-১
এখান থেকেও উপরের নিয়মে কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমি ফাইনাল খেলার পর বিজয়ী দলটি ফাইনালে উত্তীর্ণ হবে।
এ তো গেলো ২য় রাউন্ডের ফিকশ্চার। ২য় রাউন্ডে উঠবার আগে একই গ্রুপের ফিকশ্চার কীভাবে করা হয় চলুন তা জেনে নিই। অনেক ভাবেই করা যেতে পারে, তবে সহজ পন্থাটি বলি। আগেই বলেই দলগুলোকে যথাক্রমে এ-১, এ-২, এ-৩ ও এ-৪, এভাবে সাজানো হয়।
এ-১ বনাম এ-২
এ-৩ বনাম এ-৪
এ-১ বনাম এ-৩
এ-২ বনাম এ-৪
এ-১ বনাম এ-৩
এভাবে বাকি গ্রুপের ফিকশ্চার সম্পন্ন করা হয়।
উপরোক্ত ফিকশ্চার হলো একটা সেট ফরম্যাট। প্রতিটা ম্যাচ কোন মাঠে কবে অনুষ্ঠিত হবে তা ড্র-এর আগেই ঠিক করে রাখা হয়; ড্র-এর সময় কেবল দলগুলো বসিয়ে দেয়া হয় জায়গামতো (শুরুতে যা বর্ণনা করা হয়েছে)। কখনো কখনো দর্শক চাহিদা, হোম গ্রাউন্ড ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে কোনো কোনো ম্যাচের মাঠ ও সময়সূচি পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। ক্রিকেট ওয়ার্ল্ডকাপে এ ফ্যাক্টরগুলো বেশি বিবেচনা করা হয়।
এ ছিল ড্র ও ফিকশ্চার সংক্রান্ত বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এ বিষয়গুলো বুঝবার জন্য যাদের আগ্রহ আছে কিন্তু আগে জানতেন না, তারা এটা পড়ে খুব মজা পাবেন। যাদের আগ্রহ আছে এবং এ ব্যাপারে বিশদ জ্ঞান রাখেন, তারা এর উপর আরও অপশন কী কী হতে পারে তা খতিয়ে দেখবেন।
তবে অনেকের কাছেই এ ব্যাপারটা জটিল মনে হতে পারে। সেটা মাথায় রেখেই যথাসম্ভব সহজ নিয়মে ড্র আর ফিকশ্চার তৈরি করার পদ্ধতি বর্ণনা করলাম। কারো যদি একটুখানি ভালো লাগে, আমি খুশি হবো।
বর্তমান বিশ্বকাপের ড্র যেভাবে হয়েছিল, তার সংক্ষিপ্ত ভিডিওটি দেখুন। ইউটিউবে সার্চ দিলে পূর্ণাঙ্গ ভিডিও পাওয়া যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ২:২৬