নবীন কবিদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ‘শব্দরোগ’। তাঁরা হন্যে হয়ে ‘কঠিন’ শব্দ খোঁজেন। সমস্যা এখানেই শেষ নয়- যখন কবিতা লিখতে বসেন, স্মৃতিতে যতগুলো ‘কঠিন’ শব্দ জমা পড়েছে তার সবগুলোই এক কবিতায় ঢেলে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কবিতা লেখা শেষ হলে তৃপ্তির হাসি হেসে মনে মনে বলেন- এইতো, একটা ‘কঠিন’ কবিতা লিখে ফেললাম, এর অর্থ বের করতে পাঠকের দাঁত ভেঙে যাবে।
কিছু পাঠক এরূপ ‘কঠিন’ কবিতা পড়ে চমৎকৃত হোন। তাঁরা আদতে কবিতা কম বোঝেন, তাঁদের পরিচিত শব্দসংখ্যা খুব সীমিত; এমনও হতে পারে তাঁরা কবিতা বোঝেন না, শব্দও চেনেন না। ফলে এই কবির ‘সুবিশাল’ শব্দভাণ্ডার দেখে তাঁকে শব্দসম্রাট, শব্দের জাদুকর, শব্দের কারিগর, ইত্যাকার মহৎ অভিধায় ভূষিত করে মাথায় তুলে নাচতে থাকেন। কবিও তীব্র সুখে এই গর্ব রাষ্ট্র করে বেড়ান।
একটা কবিতা ভালো কবিতা হিসাবে দাঁড়িয়ে যায় কিছু ‘কঠিন’ শব্দের উপস্থিতিতে নয়, বরং ঐ শব্দগুলোর সঠিক প্রয়োগে। সঠিক প্রয়োগের ফলে কিছু মামুলি শব্দের সমাহারেও একটা কবিতা অনন্য হয়ে উঠতে পারে। বস্তুত, শব্দ কখনো ‘কঠিন’ হতে পারে না, শব্দের প্রয়োগই তাকে কঠিন করে তোলে। সব ‘কঠিন’ শব্দেরই ‘অভিধানে’ স্থান রয়েছে, যা থেকে তার অর্থ পাওয়া সম্ভব। অর্থ নেই, এমন শব্দ কোনো কবি তাঁর কবিতায় বসাবেন বলে মনে করি না; যদি কেউ বসান, তাতে কবিতার কোনো অর্থ সৃষ্টি হয় বলে মনে করি না। কবিতার ভিতরে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন, সেই মূল মর্মটি ‘কঠিন’ হতে পারে- কারণ, সকল দর্শন সকলের কাছেই যে বোধগম্য হবে, ব্যাপারটা এরকম নয়। কবিতার সারমর্ম কোনো শব্দকোষ বা কাব্যকোষে নেই। কবিতার ‘কঠিন’ কিছু থেকে থাকলে সেটি তার শব্দ নয়, অন্তর্নিহিত ভাবার্থ।
একটা কবিতাকে শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করার মধ্যেই প্রকৃত সার্থকতা নিহিত। মনের ভিতরে জমা হওয়া সব শব্দকে কবিতায় না বসিয়ে কেবল কবিতার প্রয়োজনে সঠিক অবস্থানে সঠিক শব্দটাকে বসাতে পারলেই একটা কবিতা সাবলীল ও সার্থক হয়ে উঠবে।
অনেকে নতুন নতুন শব্দ তৈরি করেন। এটা খুবই ভালো কথা, এবং সৃজনশীল কাজ। অনেকে এমন শব্দ আবিষ্কার করেন যে আবিষ্কৃত শব্দের কোনো অর্থ নেই। এরূপ ‘অর্থহীন’ শব্দেও কবিতা লিখে প্রতিষ্ঠিত কবিদের কাছ থেকে বাহবা পাওয়া যায় বলে তাঁরা দাবি করেন। যিনি সম্পূর্ণ নতুন একটা শব্দ তৈরি করে কবিতায় ব্যবহার করেন, আমার বিশ্বাস, তিনি নিশ্চয়ই এটার একটা অর্থ কল্পনা করেই এ কাজটি করে থাকেন। তা না করে থাকলে এটা ‘আগডুম, বাগডুম, ঘোড়াডুম’ ধরনের শব্দের মতো হবে, যেগুলো গানের মধ্যে ‘লা লালা লালা লা’, ‘হো হো হো’ ইত্যাদি রূপে ফিলার হিসাবে কাজ করে। প্রকৃতপক্ষে, নতুন শব্দ সৃষ্টি করা কোনো বাহাদুরি নয়। এই দেখুন, কত বিচিত্র ও নতুন নতুন শব্দ বানানো যায়- যোগনূর, যোগতাল, যোগীনূর, যোগামৃত, যোগবল, যোগাসুখ, যোগসুখ, যোগাতুর, যোগার্ত, যোগমৃত, যোগময়, যোগমায়া, যুগঞ্জয়, যোগসিৎ, যোগসিক্ত, যোগালয়, যোগনৃত্য। এগুলো কি কিছু হয়েছে? হ্যাঁ, এর প্রতিটা শব্দেরই অর্থ বের করা সম্ভব। শব্দকে কীভাবে ভাঙতে হয়, জুড়তে হয়, একজন দক্ষ কবি সেটা জানেন। যদি কোনো কবি শব্দ ভাঙাজোড়ার বদলে নতুন শব্দ বানিয়ে ফেলেন, সেটা বেশ হাস্যকর হয়ে যেতে পারে। শব্দ ঠিক এভাবেই বানানো যায় বলে মনে হয় না; প্রতিটা শব্দের প্রকৃতি বা মূল থাকতে হয়। সতুন, প্রতুন, যতুন, মথুন, অতুন, মর্তুন, মানুশি, প্রনিভা, সুরুনিমা, আলুশিনা, প্রনিতি, বিরূশা, চাপিশা, যশোথী, কপালো, কাপিতা, কপিতা, নপিতা, রানিলা- শব্দগুলো কি নতুন নয়? কিন্তু এই নতুন শব্দগুলোর কোনো মূল নেই, তাই এগুলো অর্থহীন শব্দ। তবে আপনি নতুন শব্দ বানিয়ে যদি তার একটা অর্থ জুড়ে দিতে পারেন, সেটা একটা কাজের কাজ হতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর কোনো ভাষায় কোনো ভাষাবিদ এভাবে নতুন শব্দ সৃষ্টি করেছেন কিনা আমার জানা নেই। শব্দ বা ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস এরকম কিনা তাও আমি জানি না। তবে বর্তমান যুগে কেউ যদি এভাবে নতুন শব্দ বানাতে বসে যান তাহলে ভূরি ভূরি নতুন শব্দ বানানো সম্ভব। সেক্ষেত্রে নতুন শব্দের আলাদা একটা অভিধান রচনা করার প্রয়োজন পড়বে বৈকি। এতে অবশ্য বিপত্তি যে কম কিছু হবে না তা নয়- একেক ব্যক্তি যদি নিজ নিজ সৃজনীশক্তি প্রমাণের উদ্দেশ্যে শত শত ‘ব্যক্তিগত নতুন শব্দের অভিধান’ রচনা করে বসেন, অবস্থাটা ভয়াবহ হবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু তা দ্বারা ভাষার কী উপকার সাধিত হবে? এজন্য, একটা নতুন শব্দ বানিয়ে ফেলেছি- এতে বিরাট কোনো কিছু ঘটে গেছে বলে আমি মনে করি না। সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতায় শব্দকে ভাঙার ব্যাপারটা অনেক আলোচিত ও সৃজনশীল বিষয়। একটা শব্দকে ভাঙার উদ্দেশ্য কোনো অর্থহীন শব্দ সৃষ্টি করা নয়। কল্পনা করুন, অর্থহীন অনেকগুলো বানানো শব্দ দিয়ে একটা বাক্য লিখলেন; যে-শব্দের কোনো অর্থ নেই, সেই শব্দ দ্বারা গঠিত বাক্যের কি কোনো অর্থ থাকতে পারে? সে ভাষা পাখি বা পশুর ভাষার মতোই অবোধ্য হবে।
মোটের উপর বাঙালিদের প্রকাশ ক্ষমতা, বিশেষ করে মৌখিক প্রকাশ ক্ষমতা খুব দুর্বল। যিনি যত সুন্দর করে ভাবতে পারেন, তিনি তত প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন। আমার ভাবনা যখন জট পাকানো থাকবে, আমার প্রকাশও তখন জটিল হবে। কেউ বুঝবে না। কিন্তু ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, আমরা যখন একটা কবিতা বুঝতে বা হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হই, মনে করি ওটা খুব গুরুগম্ভীর ও উচ্চমার্গীয় রচনা হয়েছে। এখানে লেখকেরও যে ভাবপ্রকাশে দুর্বলতা থাকতে পারে, আমরা মনে হয় তা ভেবে দেখি না।
একজন কবি সবচেয়ে বেশি তৃপ্ত হোন এবং আনন্দ পান বোধ হয় এই কমেন্টে- ‘আপনার কবিতা মাথার উপর দিয়ে গেলো। এটা একটা জটিল কবিতা। আপনি অনেক কঠিন শব্দ লিখেন! এত কঠিন শব্দ আপনি পান কোথায়? কট্ঠিন!’ কবির জন্য এসব বাচ্য বহুমূল্য পুরস্কারের মতো। কবির সুখ তখন বহুগুণ বেড়ে যায়। তিনি মাটিতে পা ফেলেন না; হাওয়ার উপর ভর করে হাঁটেন।
কবিতায় কোন্ শব্দগুলো আরোপিত, বা জোড় করে টেনে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে, কবিতাটা পড়লেই তা বোঝা যায়। এরূপ কবিতা পাঠে প্রায়শ মনে কোনো ভাব জাগে না, কল্পনায় কোনো ছবি ভেসে ওঠে না; কখনোবা পাঠকের মনে বিরক্তি সৃষ্টি করতে পারে। সহজাত লেখনিতে শব্দরা অনায়াস ভঙ্গিতে এসে পঙ্ক্তিতে নিজ জায়গায় বসে পড়ে। কবিতা পড়লে মনে হয় কবি খুব সহজভাবে কথাগুলো বলে গেছেন। শব্দ আরোপিত হলে পড়তে কষ্ট হবে, অর্থ উদ্ধার করতে যেয়ে দেখবেন এর কোনো অর্থ নেই। অনেকে পঙ্ক্তির ভিতরে অপ্রযোজ্য কিংবা অপ্রজোনীয় শব্দ বসিয়ে দিয়ে থাকেন, কবিতাকে ‘জটিল’ কিংবা ‘দুর্বোধ্য’ করার উদ্দেশ্যে। কেউ কেউ আরও ইন্টারেস্টিং পন্থা অবলম্বন করেন- হুটহাট কিছু ভুল শব্দ বসিয়ে দিন চরণের মধ্যিখানে। এ কবিতার কী মর্ম, পাঠক এবার হাড়ে হাড়ে টের পান, যখন দেখেন এ থেকে কিছুই উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। বুঝতে-না-পারা বা এরূপ ‘অর্থহীনতা’কে অনেকে কবিতার মাধুর্য বা বহুমাত্রিকতা বলে মনে করেন। তাঁদের ধারণা, কবিতাটার অর্থ না থাকায় একেক পাঠক একেকরকম অর্থ তৈরি করে নিবেন। এতেই নাকি কবিতার প্রকৃত স্বাদ বা মাধুর্য। এরূপ ব্যাখ্যা আমার কাছে খুব হাস্যকর মনে হয়। একটা ভালো কবিতা এমন- এর একটা পঙ্ক্তি পড়া মাত্রই একটা ছবি বা ভাব আপনার মনের মধ্যে জেগে উঠবে। পুরো কবিতাটা পাঠ করার পর একটা আনন্দস্রোত আপনার মনেপ্রাণে প্রবাহিত হতে থাকবে।
সামহোয়্যারইনব্লগে এমন অসংখ্য কবি রয়েছেন, সৃজনশীলতায় যাঁদের কবিতা খুব উচ্চমার্গীয়। এঁদের কবিতা পাঠে আমি চমৎকৃত হই এই দেখে যে- পরিচিত শব্দ, কিন্তু তাঁরা শব্দকে এমনভাবে ভাঙেন আর গড়েন যে, প্রতিটি প্রয়োগই আমার কাছে অভিনব। প্রতিটিই নতুন শব্দ। নতুন ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত। এটা হলো কবির সৃজনীশক্তি।
তবে কবিতাকে শব্দকোষও বানানো যায়। কবি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে এটি করেন, তাহলে শব্দের বাহুল্যে কবিতার মূল বক্তব্য ডুবে যেতে পারে। কবিতা তখন ব্যর্থ। কবির অনন্য সৃজনশীলতাই এটাকে একটা কবিতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেবে। আর যে কবি ‘অনন্য সৃজনশীলতা’র আধার, তিনি কবিতাকে শব্দকোষ না বানিয়ে ‘ভাবকোষ’ বানিয়ে থাকেন। কবির সার্থকতা এখানে।
নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের রেকর্ড ভাঙার জন্য হাইস্কুল লাইফে দিনে ৮-১০টা করে কবিতা লিখতে চেষ্টা করতাম। কবিতায় একটা ট্রাঙ্ক ভরে গিয়েছিল। এসএসসি’র পর ট্রাঙ্কের সব কবিতা ছোটো ভাইকে দিয়ে দিলাম, সের দরে বিক্রি করে চানাচুর খাওয়ার জন্য। ঐগুলো সত্যিই কোনো কবিতা হতে পারে নি (আজও কিছু যে হয়ে ওঠে, তা বলছি না)। তো, আমার সেই হাইস্কুল লাইফে আমাকে কেউ এসব লেকচার শোনালে তাঁকে উলটো দৌড়ের উপর রাখতে সাধ হতো বৈকি। পরিণতিতে কী হতো? সবগুলো (অ)কবিতা ভস্মীভূত করা ছাড়া গতি হতো না। এ কথা বলছি নবীন কবিদের অন্য আরেকটি অসুখের কারণে- সমালোচনা সহ্য করতে না পারা। ভুলভাট কিছু লিখে ফেললেও তার উপর প্রশংসা ছাড়া কোনো সমালোচনা তাঁরা সহ্য করতে পারেন না। ‘নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো’- এ কথাটা তাঁদের জন্য মিথ্যা।
একজন নবীন কবিকে সবচেয়ে বড় উপকার করেন তিনি, যিনি তাঁদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেন। যিনি এটাকে সাদরে গ্রহণ করেন, পরিণামে তাঁর উপকার সাধিত হয়। যিনি ভুলকে ভুল হিসাবে গ্রহণ না করে ‘সঠিক’ হিসাবে প্রমাণের জন্য প্রচুর যুক্তিতর্কের অবতারণা করেন, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা কামনা করেন, এবং প্রশংসাকারীকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা হারিয়ে ফেলেন- তাঁর জন্য প্রার্থনা- আমার মতো তাঁকে যেন কবিতার খাতা সের দরে বিক্রি করতে না হয়।
এবার সামহোয়্যারইনব্লগের কয়েকটি কবিতা পাঠকদের জন্য নিচে তুলে দিলাম। ইচ্ছে করেই কবিব্লগারের নাম উহ্য রাখলাম। উৎসাহী পাঠকগণ খুব সহজেই এঁদের চিনে নেবেন। এরকম আরও অনেক কবি রয়েছেন- পোস্টের আকার সীমিত রাখার জন্যই কেবল গুঁটিকতক কবিতা এখানে তুলে ধরলাম। এসব কবিতায় আপনি ‘কঠিন’ শব্দের সমাহার দেখবেন না, কবিতার হৃদয়ে যে সুগভীর ভাবরস রয়েছে, এসব কবিতা পাঠে আপনি সেই অনুপম মাধুর্যের আস্বাদ পাবেন। (যদি কোনো ব্লগবন্ধু তাঁদের কবিতা এখানে উল্লেখ করা হয় নি বলে মন খারাপ করেন, তাহলে সেটা আমারও মন খারাপের কারণ হবে। এখানে স্রেফ উদাহরণ স্বরূপ মাত্র কয়েকজনের কবিতা তুলে দেয়া হয়েছে।)
চোখগুলো যখন আর আমার সাথে থাকে না
ফড়িঙের পাখাবদলদৃশ্য দেখার সময় হয়ে ওঠে না আমার। চলে যায় বসন্ত,
বাসন্তী রঙের আভা রেখে বিদায় নেয় চৈত্র। খরার কথা মনে রেখে সাজিয়ে
রেখেছিলাম যে ছাতা, সে-ও ছায়া প্রদান থেকে বিরত থাকবে বলে ডাকে
ধর্মঘট। আর নগরে যারা ধার্মিক ছিল- তারা আমার পাপের বোঝা দেখে
ঘৃণায় ফিরিয়ে নেয় মুখ। পাপীদের প্রকৃত কোনো পথ থাকে না। তাই অন্ধ
হরিণের মতো উঁকি দিতে গিয়ে দেখি, চোখগুলো আমার সাথে নেই। ভাবি,
এই চোখ দুটি কি আমার ছিল কোনোকালে! যদি আমারই হতো- তাহলে
এত সত্য আমি কেন দেখতে পেলাম না! কেন আঁকতে পারলাম না কালিক
প্রস্থানপ্রবাহ রেখা!
বিষণ্ণতার প্রহর
তারপর ছিঁড়ে, করি কুঁচিকুঁচি
এইসব দিনক্ষণমান। আলো ও অন্ধকারের
সারিসারি ঘর।
যাকিছু হৃদয়ে ছিল, দিয়েছি নিলামে;
শূন্যতা ছাড়া এখন আর কিছুই নেই।
ঝড় কি গড়ে বালিঘর? শান্ত চোখের নীড়!
প্রতিদিন খাতা খুলে, মুছে ফেলি অবাধ
অতীত, নাম-ধাম। মুছে মুছে; ভুলে যাই
কথার বিভাজন।
যত বেশি যোগ করি, ঢের করি বিয়োগ।
অগাধ দিয়েছ তুমি; বেদনা মোড়ানো জীবন।
শুধু স্মৃতিপটে জমে থাকে নরম ক্ষীরের মতো
বিষণ্ণতার প্রহর।
ঘঘুদহ
জীবনের খানা-খন্দ ভরে গেছে
মাংসের ভেতর গেঁথে রাখছি শীতভরতি শিরিঞ্জ
সহসাই কেঁপে উঠছে
দেহখানা
কয়লার তলে জ্বলে ওঠা অগ্নিনায়িকার বাজুবন্ধে
মিলিয়ে যাচ্ছে মৃদু রোদের গতি
একটা পাতার মত
উড়ে উড়ে ফিরে আসছে হলুদ বাটা হাতের কাঁপন
মনে পড়তেছে ঘুঘুদহ
তার পানির নিচে নথ হারানো রমণীর একটা চুলের সাথে
তলিয়ে গেছে কার অন্তর?
আমার ক্ষমতা শুধু তোমাকে বপিত করে দেহে উঠা
আমাকে সব ছেড়ে দাগকাটা পাজামাটা পরতে দাও
সামনে বোতাম থাক আর না থাক
আমি ক্ষরিত বেদনায় আমার যৌবন লুকাতে চাই, পরিধানে;
যেখানে বিপরীত কাম খুব বেশি খোলামেলা হয়, সেখানে
আমার শক্ত পৌরুষ ঢলঢলে ছত্রাক হতে হতে বায়ু হয়ে যাবে
নিমিষেই-
খুব ভোরে, যখন শুধু শালিক জাগে
রতিক্লান্ত রাঙ্গাবউ চুপচাপ টুক করে ডুব দেয় দেওয়ান বাড়ির পুকুরে
তখন আমি ঢাকতে চাই আমার নিঙড়ে ফেলা নগ্নতা কাপড়ের বেভুল ভাঁজে
গোপনে যে খেলা চলে তোমার আমার
অবিরাম যে সুখে পাথর আকাশ
আমার ক্ষমতা শুধু তোমাকে বপিত করে দেহে ওঠা, কেমন যেন
প্রাণী প্রাণী ভাব আর শীত শীত কাঁপন
তাই ঢাকতে দাও আমার উরত আচ্ছাদনে, শালিক চোখের বৈরি চাহনি থেকে
নিজস্ব মেরুতে-
এখুনি পেশল রাখাল বেরুবে দঙ্গালে
সকালের কাঁচা মরিচ ভেঙে ভাত খাবে চাষি
আমি কেমনে বলো মগ্ন থাকি এ নগ্নতায়
আমাকে আচ্ছাদিত কর, আমাকে দাও উত্তাপ
সস্তা প্রেমের নাম কি কাম!
সস্তা চুমু কি গ্রাম্য নাবালকের অচেনা বিহার আর জুলফির তিরতিরে ঘাম
সস্তা দেহে কি শামুক গন্ধ এতটা বেহুঁশ করে
সস্তা সুখ মানে কি শরীর খুলে লোমকূপে দাহনের দুঃসাহস!
পিত চামড়া নখে তুলে আনে বিবশ লালা
তাই তো দাগকাটা পাজামাটা চাইছি
ঘুমের শুরুতে যে ছায়াছবি দেখে ঘুমায় মানুষ
সেই সব চরিত্রের কথিত সম্মেলনে তুমি আমি ঢাকবো পরাণপ্রেম!
স্তূপ থেকে আরো কিছু
আমাকে চিনে নি নীল, আমাকে চিনে নি সরল পথ।
চিনে নি নক্ষত্র, পথের শোভায় অহংকারী ঘাসফুল।
রাখে নি মনে প্রজাপতি, পাখায় লিখেছিলাম শপথ।
আমাকে চিনে নি ভেজা পথে শুয়ে থাকা শীত সকাল।
আমাকে চিনে অন্ধকার, শ্মশানের সে গোর খোদক
দেহ ছুঁয়ে যে গুনে ফেলে যাপিত জীবনের যোগফল।
ও গোর খোদক, তুমি কি শেষের হুইসেল জানো
মৃতের স্বজনকে বাঁচিয়ে রাখা দূরভিসন্ধি মানো?
কেন যে কে নিছক খেলে মিছিমিছি বাঁচিয়ে দেহ
দেহের ভেতর মৃত আত্মায় অভিশপ্ত পৃথিবী স্নেহ।
তুমি বরং নিশ্চিম অন্ধকারের বার্তা বাহক বনো।
ব্যাধ
১.
এখন মাঝরাতে জানালার পাশে
বসে দূর হতে দ্যাখা যায় দেয়ালে লেপ্টানো ছায়া
অথবা, আট তলা থেকে পড়ে যাওয়া মানুষটির থ্যাতলানো মাথা
এও হতে পারে, দেয়ালের সাথে কোন গোপন আলাপ
আছে তার- আমি জানি না; রাত গভীর হলে হয়তো বা
জড় রা জীবন্ত হয়, আর কেউ কেউ মরে যায়
ঘুমের ঘোরে, তবে ভৌতিক কোন কিছু নয়-
একথা স্বভাবতই পুরনো যে, অন্ধকারে-
মাঝে মাঝে এলোমেলো ভাবে জোনাকিরা ওড়ে-অনেক শখ নিয়ে
য্যামন শখ= সবুজ টাংস্টেন মিশ্রিত আলো; কিন্তু লাল কালো
অনেক অধিবৃত্তও দ্যাখা যায়, ওরা ছোট থেকে বড় হতে হতে
_________________আবার অদৃশ্য।
আমি তোমাকে বলি-
যেভাবে আমি অনুভব করি, তা নিতান্তই একটা অসুখ-
মহাজাগতিক,
ছিলো জন্মেরও অনেক আগে, তবে পৃথিবীতে এসে আরও
_______________________ বহু, বহু শখ জাগে
_____________________________মোহগ্রস্ত হবার;
________________________________তবে পৃথিবীর নয়-
আমি তাই শব্দের ভেতরে ভাসি
প্রকাণ্ড উল্লাসকরন শেষে, তারপরে খাপছাড়া- কেউ কেউ বলে, এগুলো কবিতা
কিন্তু আমি কবি নই; কারন আমি যা লিখি
___________________তা লিখি রক্ত দিয়ে;
মুলত রক্তেরও আছে অনেক গোপন অহংকার
__________________এবং অনেক অস্থিরতা-
অতপর একটা ঘূর্ণিপাক
_______এবং আরও, (আরও)১
________________পাক খাওয়া-
আমাকে টেনে নেয় একটা বিশাল চোখের ভেতর;
শূন্যতাঃ তাকে কি ই বা বলা যায়?
আমি অনেক সত্যের উপরে গাঢ় প্রলেপ দিয়ে
_____________________একটা অবয়ব সাজাই;
পথিমধ্যে ঘূর্ণি- ধাবমান
এবং আমি গুনি
_______এক
__________দুই
_____________তিন
চোখঃ বিনিদ্র ও নশ্বর;
অথবা, একটা জানালা-
একদিন বন্ধ হবে, তবে তার আগে, যা দ্যাখার সাধ আছে- সবকিছু দেখে নিতে হবে
যদিও মাঠে ঘাটে ইদুর-বেড়ালেরা এমনিই মারা যায়,
ওদের চোখ খুলে, তবে সব মানুষেরা নয়-
কদাচিৎ,
কি বিচিত্র!
আমার প্রয়োজন ছিলো শুধু একটা শব্দই,মনমতো
______তাইতো আমি জেগে থাকি- একটা নোম্যান্সল্যান্ড এর স্বপ্নে।
২.
অনেক শব্দ নিয়ে ভাসি
বহুকাল, আমার ভেতরের আমি কে চিনি না আমি
_________অহেতুক স্বপ্ন-গনিতায়
আত্মকামী ইথারের মাঝে বাসা বেঁধে
________সকল বাহু ডুবিয়ে রাখার স্বাদ আছে।
মা,
সেদিন স্বপ্নে দেখলাম, একটা খোলা মাঠ
আর একটা সবুজ প্রাচীন বারান্দা;
তারপর, কি মনে করে আমি একবার আকাশের দিকে তাকালাম
এবং, দ্যাখা গেলো- একটা কালো ঘুড়ি, শতছিন্ন কাপড়ের মতো
থেমে আছে
________মধ্য আকাশে
নাটাইহীন; একটা ছেঁড়া সুতো নেমে এসেছে নিচে
তারপর- সুতো ধরতেই ও আমাকে টানলো
অনেকবার
______ভাসার জন্য,
ও কি জানে, আমি এমনিতেই ভাসমান
হয়ে হেটে বেড়াই পৃথিবীতে;
তারপর একছুটে পাড়ি দেই অনন্তকাল।
৩.
শব্দ; মাত্র একটিই, আমার জন্য-আমি জানি না সেটা কি;
__________আকাশের পিঠে এখন একটা ঘর বানাচ্ছি।
-------------------------------------------
নাই..।
রঙনদীর মাঝি
এরূপ সান্ধ্য নৌকাভ্রমণের জলকোলাহলের ভিতর
দিয়ে অনির্ধারিত পৃথিবীর সবচেয়ে বিষণ্ণ চোখের মেয়েটি
পাখি হয়ে উড়ে গেলো এবং ধরতে পারা গেলো না !
আহ, এ বড় ব্যর্থতা । ঘুড়ির ডানার মত নেমে আসে
অসংখ্য প্রত্নভাষা, ব্যাখাতীত। কে সে ঘুঙুরবিভ্রমের
আড়াল থেকে ডাক দেয় নাম ধরে , সংখ্যাহীন বেদনার দিকে ।
এইসব বেদনা টেদনা ফাও, পৃথিবীর মন হু হু করে উঠলে
সকল নীরবতা মুছে আমি প্রজাপতি ডানার রঙনদীর মাঝি হয়ে গেলাম !
মহীন
এ-ই তবে 'নীরবতা' - সময়ের গাঢ় ইতিহাস !
চিরকাল শরতের আকাশের চেনা পরিসরে
নিয়ত চলচ্ছবি পিছে ফেলে গেলে বুনোহাঁস,
তারপর ঘোড়াগুলো নেমে আসে পৃথিবীর 'পরে।
সময়ের নিঃশ্বাসে লন্ঠনে অবাধ কাঁপন;
মহীনের ঘোড়াগুলো দেখে হাই তোলে বুড়ি চাঁদ;
কত যুগ কেটে গেল - তাও বুঝি ঘোড়াদের মন
আজও খুঁজে পায়নি যা দেখেছিল একদা অগাধ?
আস্তাবলের পথে কুয়াশা'র আস্তর বাড়ে
ঘোড়াদের স্তব্ধতা প্রাণ পায়। আর নিরাকারে -
লৌকিক সব আলো নিভে গেলে ওরাও তাকায়;
তাকিয়ে তো থাকে জানি, তবে ওরা দেখতে কি পায়?
জীবনানন্দে মেতে এক কবি আজও হেঁটে চলে:
নক্ষত্রের নীচে পৃথিবীর প্রগাঢ় মায়ায়...
সময়ঘড়ি
কেন জানে না, কেন শোনে না
কেন বোঝে না, কেন সময়ের ঘড়ি
দম দেয়া ছাড়াও চলে বিস্তীর্ণ পথ
ধরে, কেন বৈশাখের উৎসবে ঘুমের
গ্রহণ লাগে না; কেন বারবার ভুল
করেও ভুলের সালতামামীতে লালদাগের
পরিবর্তে কুমারী আলোর হাসি
কেন সময় বোঝে না, প্রাণের অর্গল
নিভে গেলে তার আপন বলতে কেউ
থাকে না, কেন বুঝে না সময়।
রাত বাড়ার সাথে সাথে পুরনো রোগেরা
ফিরে আসে, কাশির দমকে, নাভিঃশ্বাস
উঠে প্রাণে; কেন বোঝে না, না বুঝেও সে
চলে চলতে থাকে, আমার আমাদের
কাঙালপনা দেখেও মুচকী হেসে বলে--
'সময়ের ঘড়িতে দম দেয়া লাগে না'
স্রোত হারা নদী মরে গেলেও সময়ের
ঘড়িতে কখনো মরণের নাম নেই।
সে মরে না, ঘুণপোকার দাঁতে সেই ধার নেই
যে ধারে কেটে নিতে পারে সময়ের কাঁটা।
কেন, কী কারণে সময়ের এই ছুটে চলা
মৃত নগরীর পাঁচিল ধরে, আমাদের তৈরি
সুখপ্রাসাদের দেয়ালে! তবে কি সময় দেয়ালে
ঝুলে থাকা সেই তৈলচিত্র যার বয়সের
সাথে সাথে দামের হিসেব নিকেষে অমূল্য
হয়ে ওঠে। তবুও সময়ের ঘড়িতে দমের
ঠিকুজি আমাদের নানাবিধ রচনায়!
হঠাৎ করেই এটা ঘটবে
আমি জানি এটা ঘটবে খুব হঠাৎ,
আমার সব কিছু সাজানো হুট করে নাই হবে যাবে,
আজকে যাকে আমি বিশ্বাস করে মসৃণতা খুঁজে চলছি, সে শুধু সময় নিচ্ছে
যে কোন ভোরে আমি চোখ মেলতেই দেখবো কিচ্ছু নেই।
খুব আচমকা ঘটবে, বুঝে ওঠার আগেই
ছবিটা তছনছ হয়ে আমাকে বোকা বানাবে,
আজকে যে ছায়া দিয়ে অভ্যস্ত করে ফেলছে, আমি ধরেই নিচ্ছে সে আছে
আর আমিও ধীরে ধীরে আমার যাবতীয় স্থাবর সম্পত্তি তার কাছে লিখে দিচ্ছি
সে এক স্বাক্ষরে আমাকে ভিখিরি করে দেবে,
সে একবার পিছনে ফিরে হাসারও সময় দেবে না
যেমন আজন্ম যার স্নেহ মাতৃদুগ্ধের মত আশ্রয় সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে
মরে যাবে যে কোন সকাল বা বিকালে
আমি বোঝার আগেই আমাকে নিঃস্ব করে চলে যাবে
আমার আজকে যতটুকু স্বাচ্ছন্দ্য আর আনন্দ এসব ঘটছে কেননা
কিছুটা সময় লাগছে ষড়যন্ত্রের পরিণত হতে,
আমার যখন কিছু রইবে না, আমি অনেকবার ভাববো কেন আগে
জেনেও ব্যবস্থা নেই নি,
আলস্যে ভ্রমরের চাবি ঝুলিয়ে রেখেছিলাম প্রকাশ্য স্থানেই,
খুব মনে হয়েছিল মানুষ বড় মহান, তাই সবচেয়ে ভঙ্গুর মানুষের কাছে
আপাদমস্তক জানিয়ে দিয়েছি।
কবিতার আকুতি
এখানে পলেস্তারা খসে যাওয়া ভবনের প্রতিটি ইটের গাঁথুনি
পুরাতন চুন সুরকি, ছয়া সবুজে ঘেরা পিতামহ বৃদ্ধ দালান ঘর
স্মৃতির খুপড়ি ঘর থেকে নিত্য সঙ্গীরা এসে জড়ো
ছত্রাক ছত্রাক গন্ধ নাকে লেগে চিত্তে জ্বলে ওঠে কোমল আলোর পিদিম
আমার গায়েতে জমেছে শ্যামল শ্যাওলা-
আজ সকলের মন খারাপ
তাই দেয়াল ঘরে বিষণ্ন বাতাসের আনাগোনা
তোমাদের কেউ একজন ভালো করে ভেবে নাও
গলাটাও একটু সেধে নিতে পারো
ছেঁড়া আর মলিন কবিতার পৃষ্ঠাগুলো সযতনে মেলে
ডায়াসে দাঁড়াও
ভারী চশমার উপর একনজর চেয়ে দেখে
আমাদের কেউ একজন একটি কবিতা শোনাও।