আর কারো হয় কিনা জানি না, কিন্তু আমার প্রায়শ এ ব্যাপারটা ঘটে থাকে। যে থিম বা প্লট মাথায় ডিগবাজি খাচ্ছিল, লিখতে গিয়ে দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতেই দেখি ১৮০ ডিগ্রি সরে যাচ্ছি। শেষাব্দি নতুন কিছু রচিত হয়তো হলো, যা থেকে সৃষ্টির আনন্দ বেশ আস্বাদন করা যায়, কিন্তু ব্যক্ত-করতে-না-পারা ভাবনাটা ক্রমাগত মনের মধ্যে যন্ত্রণা দিতে থাকে। আবার এমনও হয়, বিষয়টা মনের ভিতরে যেভাবে ভাবছি ও অনুবাদ করছি, অবিকল সেভাবে ব্যক্ত করতে পারছি না। এখানেও একটা অতৃপ্তি ক্রমশ ঘনিয়ে উঠতে থাকে।
মজার ঘটনাও ঘটে থাকে। ১ লাইনের এক কবিতা এমনি-এমনি হঠাৎ করে বেরিয়ে গেলো। দিন যায়, মাস যায়, সেটি আর এগোয় না। কী যে লিখেছি, তার না হয় কোনো অর্থ, না আছে কোনো সমাপ্তি, ‘কোনোদিনই হইল না শেষ’ অবস্থার মধ্যে ওটাকে ‘ক্ষণজন্মা’ শিরোনামে আপগ্রেড করে দিই। মজার ঘটনা আরো আছে। ৫-৭ লাইনের কবিতাকে ব্লগে পোস্ট করা হলো। তার উপর পাঠকের একেকটা মন্তব্য জমা হয়, নতুন নতুন থিমের উন্মেষ ঘটে, আর কবিতার কলেবরও বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত ওটি প্রায় ৩-৪ পাতা খেয়ে ফেলে। সবচেয়ে হাস্যকর এবং ‘হৃদয়বিদারক’ ঘটনা ঘটে তখন, যখন এটিকে পূর্ণ কবিতা হিসাবে ব্লগে নতুন করে পোস্ট করি – হায়, কেউ এটাকে আর কবিতা বলে না, বলে ‘প্রবন্ধ’, ‘গবেষণা’!
‘রুপা’ চরিত্রটি আমার অনেক পছন্দের। রুপার স্বামী আছে, সন্তান আছে। রুপার সুখের সংসার। ভবঘুরে হিমালয়, কিংবা হঠাৎ হঠাৎ অন্য কোনো নায়ক-চরিত্র মানসিক অশান্তিগ্রস্থ হয়ে পড়লেই রুপার আশ্রয়ে চলে আসে। তারা প্রেমিক-প্রেমিকা। গভীর সম্পর্ক তাদের মধ্যে। কিন্তু কোনো পঙ্কিলতা নেই। আমি এমন একজন নারীকেই কল্পনা করি। সে নারী আমার সর্বস্ব, সে আমার হাতের পুতুল, চাইলেই মুহূর্তে সে তার স্বামী-সংসার-যাবতীয়-সুখ ত্যাগ করে আমার কাঁধে হাত রাখবে। চাইলেই সে যখন-তখন আগুনে পা দেবে। কিন্তু আমি তা চাই না। বুকের ভিতরে যে-নারী অনাঘ্রাত পুষ্পের মতো আজন্ম অক্ষত, মর্মের ভিতর দিয়েই আমি তার ঘ্রাণ নিতে থাকি। তাকে এবার কবিতায় নিয়ে আসি। আমি লিখলামঃ
চারদিক ছেয়ে আসে গাঢ় অন্ধকার,
আমি মুদিত-নয়ন কবি, ধ্যানমগ্ন, উতলা-অস্থির,
যত চাই ভুলে যেতে, ততই ভেসে ওঠে
জীর্ণ-শীর্ণ, অশ্রুভেজা, ম্লানমুখ চির দুঃখিনীর।
তুমি ভগ্নি, তুমি কন্যা, জননী বা তুমি প্রণয়িনী
সর্ব বর্ণে, সর্ব রূপে মনে হয় জন্মে জন্মে তোমাকে আমি চিনি।
আমাকে চেনো নি তুমি? তোমার জন্যে বুকে জাগে
তামাম পৃথিবীর ভালোবাসা, অন্তরে নিত্য প্রস্রবণ,
আপন বক্ষের মাঝে কান রেখে শোনো, রয়েছে
তোমার আত্মার সাথে আমার আত্মার নিগূঢ় বন্ধন।
আমার হৃৎপিণ্ডের আধেক আমাতে,
আধেক রয়ে গেছে তোমার বুকের ভিতর,
তুমি কি কখনো পাও নি টের কখন শান্ত নদী,
কখন সেখানে জাগে উত্তাল দেবে।
নাহ্, হয় নি। যা চাই, তা হয় না। কী ভেবেছিলাম, আর কীইবা লিখেছি, কোথাও কোনো মিল খুঁজে পাই না। পঙ্ক্তি ধরে ধরে কতো রকমে নিজেকে বোঝাতে চাই- যা ভেবেছি, এ তা-ই। কিন্তু এটা যে একটা ফাঁকি, নিজের সাথেই প্রতারণা, তা ভেবে মনোকষ্টে তাড়িত হতে থাকি। আবার ব্লগে লিখি – ‘অমর্ত্যবর্তিনী’-
তুইতো বউ হলি না, হলি না প্রেমিকাও
সম্পর্ক আর অসম্পর্কের মাঝগাঙে তোর নাও
বউকে দিব্যি প্রেম দিই, যার চেয়ে ঐশ্বর্য কিছু নেই
তোকে দিই মুহূর্তকবিতা, না চাইতেই
গৃহের ধ্যানে বড্ড গুটিয়ে গেছিস; আমিও তাই
আজও এক গৃহেই জ্বালি তোর রোশনাই
এখানে সামান্য তৃপ্তি মেলে। কিন্তু যতই দিন বাড়ে, ‘রুপা’র প্রতি আমার অনুরাগ যেমন অদম্য হয়ে ওঠে, তাকে ‘প্রকাশিত’ করতে না পারার ব্যর্থতা আমাকে ততই বিধ্বংসী এবং যুগপৎ বিদীর্ণ করতে থাকে। ভেঙেচুরে মিহিদানার মতো গুঁড়ো হয়ে যেতে থাকি। সেই কষ্টের ভেতরই ক্ষুদ্র একটা ‘প্রাপ্তি’ জুটে যায়-
সেই কবে
একটি বাহু ছুঁয়ে দিয়েছিলি
বিষম আলতোমিতে
তারপর এক শতাব্দী গত
আজও তোর স্পর্শের দাহে
জ্বলেপুড়ে ছারখার অঙ্গারিত ক্ষত
যৌবন বনস্পতি
বরিখে বরিখে নীরবে অশ্রু ফেলে
কী এমন হতো রে ক্ষতি
এক জনমে এ-প্রসাদটুকু না পেলে?
যন্ত্রণা আমাকে কুরে কুরে ক্ষয় করতে থাকে। যাঁরা লেখেন তাঁরা জানেন যা লিখতে চান তা ফুটিয়ে তুলতে না পারলে তার কী কষ্ট। অনেক আগে, বিটিভির এক সাহিত্য-অনুষ্ঠানে কবি ত্রিদিব দস্তিদার বলেছিলেন- একজন কবিকে একটা শব্দের জন্য কখনো কখনো পুরো একটা দিন- একটা সপ্তাহ, অনেকগুলো মাস- বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। আমি কবির কথা স্মরণ করে নিজেকে সান্ত্বনা দিই, আর ভাবি, সেই ‘অধরা’কে একদিন পাবই। এমন সময়েই আমি ‘ধ্রুব’ সৃষ্টি করি, যা আমাকে প্রভূত তৃপ্তি ও আনন্দ দান করে-
১
তোর জন্যই আঁধারে নহর কিংবা রোশনাই
তোর জন্য তুমুল বেঁচে থাকা
তোর জন্যই মুহূর্তে নিঃস্ব; নঞ্-ত্বে নস্যি, নষ্ট হয়ে যাই।
২
তুই কি চলে যাবি ঘুড়ি, আকাশে?
ঠিক আছে, যা।
তুই তোর আকাশেই থাক, আমি খুঁজে নেব আমার ঠিকানা।
৩
কে তবে আগুন-পাহাড়ে বরফের বীজ বোনে? আমি, নাকি তুই?
যাবার আগে, অয়ি ঈশ্বরিনী, বলে যা এটুকুই।
এটাও যখন হলো না, তখন এভাবে ‘অধরা’কে ধরার চেষ্টাকে আমি খুব পজিটিভলি নিতে শুরু করি। সৃষ্টির লক্ষ্যে সৃষ্টি; সৃষ্টির জন্য সৃষ্টি। নব নব সুখ ও তৃপ্তি। আমি রুপা’র উদ্দেশে ‘হিরণ্যকথা’ লিখলাম-
১
ল্যাবএইডের উত্তর গেইটের সিঁড়ি, ১ নম্বরের গোলচক্বর
ওভারব্রিজের গোড়ায়, সনি’র দক্ষিণে সংকীর্ণ গলির মুখে
বিগবাজারের নির্মল দরজার ভেতর অস্থির দাঁড়িয়ে
অমনি রিকশার হুড গলে বাতাসে শাড়ির ওড়াউড়ি
আমি এক প্রেমার্ত শিশু। আলাভোলা। পূর্বাপর ভাবি না কোনও কালে।
উড়ে তোর কোল জুড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। অসাবধানে। বেখেয়ালে।
২
দুইশ বত্রিশ কিলোমিটার বাসে চেপে বাড়ির স্টপেজে নামলি। দশ পা ফেললে ঘর। ‘এখনই চলে আয় বুড়ি।’
আকাশে তুমুল তুফান। আহা! ফালি ফালি জ্যোত্স্নারা। আহা! একজোড়া তীর্থের চোখ। আহা!
‘মোবাইলে কান পেতে আছি। ফিরতি টিকিট কাট্। এখনই।’
দুইশ বত্রিশ কিলোমিটার। আহা! নির্বিবাদ ফিরে আসা তোর। আহা!
‘কী করে চলে গেলি না বলে?’
‘বড্ড উন্মাদ তুই। ছেলেমানুষ।’
‘আজ খুব ধকল গেলো।’
‘ঘরে তুই আগুন দিবি?’
‘আমি কোনও ঘর চিনি না। কী শান্তি সংসারে?’
‘এ আমার কলজেটা নে। খেয়ে তবে নিষ্কৃতি দে।’
এটা লিখবার পর আমাকে একটা বিচিত্র ধরনের যন্ত্রণায় ধরলো- এর পাঠক হয়তো ঘটনাটা ধরতে পারবেন না- কারণ, লেখাটা খুব বেশি সাংকেতিক ও সংক্ষিপ্ত। আমাকে না জানিয়ে রুপা ওর নিজভূমে চলে গেছে! এটা তো হবার নয়! রুপার নিশ্বাসকে আমি নিয়ন্ত্রণ করি; আমার হুকুম বিহনে, আমার অনুমতি ব্যতিরেকে ঢাকা ছেড়ে বহুদূর সীমান্ত গাঁয়ে পাড়ি দেবে রুপা, ওর এতই দুঃসাহস! বাস থেকে নেমে দু পা ফেললেই ঘরের দাওয়া। উঠোনে পা ফেলতেই আমি রুপাকে কল দিই মোবাইলে – এক্ষুণি, এক্ষুণি- ফিরতি বাসে ঢাকা ফিরে আয়। রুপা অতিশয় নির্বিবাদে দুয়ারে পা না রেখেই ফিরে এসে বুকের উপর আছড়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ওঠে – ‘স্বামীর ঘরেও কি যেতে নেই?’ ‘না....’ আমার সুদীর্ঘ তীক্ষ্ণ চিৎকারে আকাশের চিকন বুক চৌচির হয়ে যায়। ... সরল অর্থ করলে এ-কবিতার অর্থ এ বই অন্য কিছু হয় না। কিন্তু আমি চাই রুপাকে। তখনই মনে পড়ে, অনেক আগে লিখেছিলাম ‘তুমি শুধু মন নিয়ে খেলা করো’ সিরিজ। তাতে কমপক্ষে দুটো সিকোয়েলে আমি রুপাকে ধরতে চেষ্টা করেছিলামঃ
১
আমার প্রেম পাওয়া হয়ে গেছে, এবার তবে
যেতে পারিস যথাতথা, মহোৎসবে।
সবই তুই দিস, শুধু যত্ন করে
আমার জন্যে মনটারে তোর রাখিস ধরে।
২
তুই যে বড় বলিস, কৈশোরের কাল হতে
আমায় বেঁধেছিস মনে
তাহলে প্রমীলা চল্ আমরা ফিরে যাই
বিশ বছর আগেকার প্রথম যৌবনে।
আমি তো ছিলাম অভাগা ‘যতিশংকর’,
এমন কেউ নয় তোর চোখে পড়বার মতো।
তুই কি জানিস, একটানা কতোদিন কাটিয়ে দিতিস
একবারও না তাকিয়ে আমার পানে?
আমার ছিল না কেউ দেখবার অন্তরের রক্তাক্ত ক্ষত।
কখনো সহজ চোখে, কখনো বিরক্তিতে,
কখনো তোরই প্রয়োজনে, কখনো অভ্যাসবশত,
কখনো ভুলে-ভাটে অতর্কিতে
তোর চোখের আলো এসে পড়তো আমার নয়নে।
অমনি রুদ্ধশ্বাস ভালোবাসা ছুটতো ফিনকি দিয়ে অন্তর্প্রস্রবণে, সঙ্গোপনে।
তা তুই জানতিস না কিছুই। প্রমীলা, আজ তবে চল্ আমরা ফিরে যাই
বিশ বছর আগেকার প্রথম যৌবনে প্রেমের বৃন্দাবনে।
প্রমীলা? হ্যাঁ, প্রমীলা। প্রমীলাকে কবে, কোথায় দেখেছি, জানি না। রুপার কোনো অস্তিত্ব যেমন নেই আমার জীবনে, কিংবা ত্রিভুবনে, প্রমীলা তেমনি। প্রমীলা অন্ধকারের ঝিনুক থেকে ছিনিয়ে আনা অহংকারী বেদনা। এমন সময়ে ‘হিরণ্যকথা’র কথা মনে পড়ে। ওটার আরেকটা অনুবাদ বা সংস্করণ তৈরি হয়ে যায় – ‘প্রমীলার সাথে আমার সম্পর্ক’-
প্রমীলার সাথে আমার কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না, কোনোরূপ যৌনসম্পর্কও নয়।
অথচ আমরা একে অপরকে সবচেয়ে বেশি বুঝতাম, বকতাম সবচেয়ে বেশি।
বললাম, ‘তোকে কল করলেই ‘ওয়েটিং’ পাই, কার সাথে এতো কথা?’ অমনি সে মোবাইল সেটটা মেঝেয় আছড়ে গুঁড়ো করলো। এটা অবশ্য ওর অভিমান ছিল; ছেলেমানুষি।
দীর্ঘ ১০ ঘণ্টা বাসভ্রমণ শেষে কাশিয়ানিতে পা রাখলো প্রমীলা। ‘না বলে চলে গেলি?’
বলতেই সে ফিরতি বাসের টিকিট কাটলো।
আমি তখন কাঁটাবনের রাস্তায় উদাস গড্ডলিকা। প্রমীলার ছায়া পাশে দাঁড়ালেই আমার
হাড়গুলো টের পায়। আমার কাঁধে ওর হাত, ‘চেয়ে দেখ, আমি কাঁদছি।’
ঘুমের ভেতর ‘বুবু’ চিৎকারে আড়িয়াল বিলের ধানক্ষেত মাড়িয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠলে যে ছায়ামূর্তি আমার সামনে এসে নির্মলহাস্যে মধুর হাত বাড়িয়ে দেয়,
সে প্রমীলা।
আমি প্রমীলার শাসন-হুকুম ভালোবাসি।
আমি হাসলেই প্রমীলার দুঃখ হয়, আমি হাসি না।
আমি যদি একবেলা প্রমীলাকে না দেখি, জীবনের সব অর্থই অনর্থ হয়ে যায়।
আমি যদি একবেলা প্রমীলার সামনে না দাঁড়াই, সে ভাবে
ওর কথা আজ একটুও ভাবি নি।
প্রমীলাকে বলেছিলাম, ‘ভ্রূ প্লাক করিস না পাখি। এই যে পারলারে যাস, ওখানে কি
ছেলেরাও থাকে না?’ প্রমীলা একটা ভয়ানক কাজ করেছিল- পুরোটা মাথা ন্যাড়া করে
পবিত্র ভিক্ষু’র মতো সামনে এসে দাঁড়ালো- ওর চোখ ছিল বিশ্বস্ত ও নির্লিপ্ত, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর; পুলিশের হাতে ধরা-খাওয়া খুনের আসামির মতো আমি কাঁপছিলাম।
প্রমীলা মাতৃস্থানীয়া নয়, সহোদরা নয়, প্রেমিকা অথবা বান্ধবী নয়। প্রমীলার সাথে কী
আমার সম্পর্ক জানি না। সকল অ-সম্পর্কের গভীরে তীব্র অস্তিত্বশীলা রমণীর নাম
প্রমীলা, যে আমাকে সকল সম্পর্কের মতো এখনো নির্মোহ ভালোবাসে।
বাহ্! বাহ্! এইতো! এইতো আমি এতদিন ধরে চেয়েছি! আমি উদ্বেলিত হই। ফল্গুস্রোতে আমার নদী বয়ে যায়। আমি উড়তে থাকি। কিন্তু, সহসাই সব আলো ম্লান হয়ে গেলো। উচ্ছ্বাস নিভে গেলো মুহূর্তে, হায়, আমি যে রমণির আরাধনা করি, সে তাকিয়ে আছে অন্য আলোর দিকে, অধীর উন্মুখ হয়ে। কে সে? সে কে? ‘তোমার প্রেমিকের নাম বলো, প্রমীলা’-
তোমার প্রেমিকের নাম বলো, প্রমীলা, যার সাথে
প্রতিদিন গোপনে দেখা করো, অবলীলায় যে তোমার হাত ধরে
মনুষ্যভিড়ে; অথবা চিলের মতো ছো মেরে কেড়ে নেয় তোমার হৃৎপিণ্ড,
যার ধ্যানে একদিনও চোখ খুলে দেখলে না
তোমার পাদপদ্মে আত্মাহুতি দিয়ে গেলো ঘোরের সন্ন্যাসী
আমাকে তার নাম বলো, প্রমীলা, সেই মহান পুরুষের বিরাট ছায়ায়
একবার নিজেকে দেখি।
সব বেদনা ভুলে যেতে চাই, পাগলা ষাঁড়ের মতো বেদনারা তীব্র তেড়ে আসে। যাকে চাই নি, তাকে পাই নি; যাকে পাই নি, তাকে কেবল জীবন দিয়েই ভুলে যাওয়া যায়। সে থাকে আকাশ জুড়ে; আকাশ ছোঁয়া যায় না। আকাশ ফুঁড়ে তার হৃৎপিণ্ডে ঢুকে যাওয়া যায়। আকাশের অণু-পরমাণুতে সে মিশে আছে। আমি তার ঘ্রাণ পাই। তখনই লিখি ‘একটা ঘ্রাণ’-
হঠাৎ হঠাৎ একটা অরিহ গন্ধ ভেসে আসে বাতাসের স্বননে; প্রথম তারুণ্যে আফরোজার কেশফুলে এমন পেলব একটা ঘ্রাণ ছিল; কলমিলতা আর দুধুল্লার শরীরেও ছিল এমন অদ্ভুত কিছু ঘ্রাণ; এখনো কোনো কোনো নিঝুম দুপুরে বড্ড আচানক নাকের পর্দা ভেদ করে একগুচ্ছ সৌভিকঘ্রাণ মগজে ঢুকে পড়ে; অন্ধের মতো ঘ্রাণের উৎস খুঁজতে খুঁজতে কেবলই দিশেহারা হই;
সে-রাতে ভৈরবের রেল-স্টেশনে নামতেই বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া একজন মানুষ একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন করলো; ‘ভালো আছিস, সোনাপাখি?’ বলতেই কেঁদে উঠলো অহনা, ‘তোর ঘ্রাণ এখনো ভুলতে পারি না সোনা; ঘরের চারপাশ, বারান্দায় এখনো তোর ঘ্রাণ। আমাকে জ্বালায়, পোড়ায় তোর ঘ্রাণ। আর পারি না, আমাকে একটু বাঁচতে দে না, পাখি!’
অরিহ গন্ধ। ‘অরিহ গন্ধটা’ খুব নিরীহ, সাদামাটা গন্ধ নয়, এমন একটা অনির্বচনীয় গন্ধ, যা অন্যসব গন্ধকে ছাপিয়ে ‘অস্তিত্বশীল’ হয়ে ওঠে। গন্ধের কোনো ‘অস্তিত্ব’ নেই, কিন্তু এ গন্ধটার এমনই প্রভাব, মনে হয় নিরীহ বাতাশের মৃদুতম শব্দতরঙ্গের সাথে একাত্ম হয়ে অতিশয় মোলায়েমভাবে নাসারন্ধ্রের ভেতর ঢুকে পড়ে। কোথা থেকে আসে এ গন্ধ? কোন্ অমরাবতীর পুষ্পোদ্যানে কোনোদিন-না-দেখা ফুলের থেকে উঠে আসছে এ ঘ্রাণ? প্রথম যৌবনে আফরোজা নাম্নী এক কিশোরীর চুলগুচ্ছে এমন ঘ্রাণ ছিল। আড়িয়াল বিলে ডগাতোলা কলমিলতার শরীরে এমন মাদকতাময় কিছু ঘ্রাণ ছিল। ধুধুল্লা-লতা মুঠো ভরে হাতে তুলে নেবার সময় এমন কিছু ঘ্রাণে আমি মাতোয়ারা হতাম। সেইদিন কবে চলে গেছে, অথচ আজও সেই ঘ্রাণ আমাকে পাগল করে। কোথা থেকে এ ঘ্রাণ আসে? ঘ্রাণের উৎস খুঁজে খুঁজে বিষাদগ্রস্থ হয়ে উঠি, উৎস মেলে না।
এমনটা কি শুধু আমারই ঘটে থাকে? কেন ঘটে থাকে?
ঝঞ্ঝা-ক্ষুব্ধ যৌবনে যে যুবতীর কোমল গন্ধে জীবনে স্থৈর্য্য এসেছিল, সে হারিয়ে গেলো। কিন্তু রেখে গেলো তার অফুরন্ত ঘ্রাণ। অহনার খবর জানা নেই, তার ঠিকানা হারিয়ে গেছে। এক ভবঘুরে, ছন্নছাড়াকে মনে রাখবে অহনা, এতোখানি আশা করাই অন্যায়। কিন্তু যেদিন মাঝরাতে, একটা অচেনা নাম্বার থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, অতি পরিচিত সেই কণ্ঠস্বর- অহনা- অনেক কাল আগে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটি। সে তো সুখেই আছে, এমন ভেবে ভেবে কতো কেঁদেছি। ....এই ভাবনাটাই ভুল ছিল। কেউ ভুলতে পারে না। আমিও যেমন অহনার কথা মন থেকে মুছে ফেলতে পারি নি, পারে নি অহনাও। আমার যেমন মনে হয়, একটা অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণ আমায় পাগল করে দিল, অহনার দশাও এমনই। ভুলতে না পারা কী যে বেদনাময়, বুকের ভেতর যার তুষের আগুন সেই শুধু তা জানে। অহনাও ভুলে যেতে চায়, ভুলে গিয়ে বেঁচে থাকতে চায়।
একটা ঘ্রাণ, শুধু একটা ঘ্রাণ নয়, একটা অদৃশ্য বন্ধনের প্রতীক।
তারপর অহনাকেও আর খুঁজে পাই না। জানি না কী তার গাত্রবর্ণরূপ। জানি না তার নদীর লাবণ্য ছিল কী না-ছিল। বড্ড মনে পড়ে নি এসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ বাহ্যিকতা। আমি তার বলয়বন্দি প্রেমাসক্ত পুরুষ, যুগযুগান্তকাল। আমি তার বাহির দেখি নি; খুঁজেছি অন্তরের হেমখণ্ডখনি। কী হবে তার গাত্রবর্ণরূপে, যদি গো তার প্রেম নাহি মেলে!
অহনার কথা আরো বলি। অহনা স্বপ্ন দেখে দিনভর অহনাকেই ভাবি। অহনা বললো : আমায় নিয়ে কবিতা লিখো না আর কোনোদিনও। আমি অহনার কথা মেনে নিয়ে অহনাকে নিয়ে আর লিখি না।
তারপর দেখো, অহনাকে কেমন অনায়াসে অতীত পাথারে ডুবে যেতে দেখি। অহনা মানবী ছিল : প্রেমিকা হতে হতে তারপর মহীয়সী। পবিত্র প্রত্যূষে অহনার উদ্ভাসিত হাসি আমাকে করেছিল মৃত্যুঞ্জয়ী পাখি। অহনা বলেছিল : আমায় নিয়ে কবিতা লিখো না আর কোনোদিনও। আমি অহনার কথা মেনে নিয়ে আর লিখি না।
এভাবেই অহনার কথা বিলকুল ভুলে যেতে থাকি।
অহনা একটা ভোরের পাখি, কিংবা ভোরের রং অথবা রাগ। কিংবা একটা স্বপ্নঘোর ঊষা। ভোর। অহনা আলেয়া কিংবা মরীচিকা। অহনা কে, তা সত্যিই জানি না।
প্রমীলা! সে এখন যে-কোনো নারী! তার বুকে অচেনা গন্ধ। কে তার সত্যিকারের প্রেমিক, জানি না।
প্রমীলা- সব আলো ম্লান করে দেয়।
প্রমীলা- জমাট আঁধারে তীব্র একখণ্ড আলো।
প্রমীলা- আলেয়া, এবং মরীচিকা।
মাঝে মাঝে মনে হয় প্রমীলাকে চিনি, এ গ্রহেই তার নিবিড় আনাগোনা। প্রমীলাকে এরপর দেখি না, তাকে ছোঁয়া যায় না, তার ফেলে যাওয়া পথে কখনো সোনাবীজ, কখনোবা বা দুঃখ রয়েছে বোনা।
পৃথিবীতে প্রেম ছিল। অমোঘ রত্নের মতো আলোডানাপ্রেম আমার চোখের ভেতর মেখে দিয়ে ভোরের কুয়াশায় মিলিয়ে গিয়েছিল যে নারী- রাতের পাখিরা তার নাম রেখেছিল ‘অহনা’। অহনা, কিংবা প্রমীলা, প্রমীলা অথবা অহনা- হতে পারে অন্য কোনো নারী কিংবা অপ্সরা- অথবা কোনোদিনই কেউ ছিল না- যা ছিল, তার একখণ্ড-সুখ, অন্যখণ্ড-দুঃখ। আমার কোনো দুঃখ নাই। দুঃখের সাথে সখ্য আছে, সে হয় আমার আপন ভাই।
এমন একজন নারীকে খুঁজি, যে হবে রুপার মতো প্রেমময়ী, প্রমীলার মতো সকল সম্পর্কের উর্ধ্বে হবে তার বাস। সে অহনা, অথবা আফরোজা, অথবা এমন একজন নারী, যে মানবী কোনো ‘ভাবে‘ই ব্যক্ত হতে শেখে নি, সে ‘এমন একজন নারী’-
একটা অদৃশ্য সিঁড়ি বেয়ে ছায়ার মতো ধীর পায়ে নেমে আসে কবিতার নারী
তার নরম নিশ্বাসে স্নিগ্ধ সৌরভ
সহসা চঞ্চল হয়ে ওঠে – নৃত্যের ভঙ্গিমায় সর্বাঙ্গে ফুটিয়ে তোলে রাশি রাশি ফুল আর কলা
আবার আলগোছে কাছে বসে শরীর এলিয়ে রাখে আমার শরীরে।
আমি তার হাত নাড়ি, আঙুলগুচ্ছ, ও রঙিন কঙ্কন।
আমি তার রক্তের ভেতর নাচি
আমি তার বুকের উপর নির্বিঘ্ন খেলা করি
আমি তাকে ফালি ফালি করে রাতদিন কেটে খাই
আমি তার সমগ্র সত্তা ও ইচ্ছেকে হাতের মুঠোয় পুরে রাখি তার বাধাহীন বিসর্জনে
অথচ আমরা কোনো সম্ভোগে বসি না- কীভাবে কামনাকে ভুলে গিয়ে অনায়াসে ডুবে যাই গভীর গঙ্গায়
এমন একটা প্রেমের জন্য আজন্ম ক্ষুধার্ত ছিলাম
এমন একজন নারীর জন্য বটবীথিকার নির্জনতায় নিয়েছি সন্ন্যাস
এখনো ঘোরের ভেতর অলৌকিক মাধুর্যে হাসে আমাতে জড়িয়ে থাকা অদ্ভুত প্ল্যাটনিক নারী
আমি তাকে দেখি, কিন্তু দেখি না
আমি তাকে ছুঁই, কিন্তু ছুঁই না
১১ জুলাই ২০১৩
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৩:৩৬