ঘূর্ণি
দিনতরী গোবাক্ষ নদী
বনরুঁই, ঘুমের চিতাবাঘ
পবনপ্রবাহে জলে বাঁধি মন
তারায় তারায় সিঁড়িঘর
মানচিত্র তোমার মুখ
সবুজ পাথারে বৃষ্টি, দিনরাত্রির সুখ
সারসডানায় অয়োময় দিন
পদচিহ্নহীন
তারপর খসে পড়ে দিগন্তের তারা
আজও তুমি শূন্যতায়
অন্তর্প্রস্রবণধারা
দিনান্তের মেঘ অথবা পাখিদের বোধ : সূর্যহরিণ
চশমায় সময়ের চোখ আর আয়নায় চোখের আলস্য
জানালার পাড়ে তুমি, আকাশবারান্দায় আমি নেই
তুমুল হাসনাহেনা, ঘ্রাণের শরীর, তবু মন কৃষ্ণকায়া
ছড়িয়ে দিলাম বিন্দু বিন্দু সোনা, কুড়িয়ে নিও। নেবে না?
এলোমেলো স্রোতাঞ্জলি : শব্দকবিতার কেটে গেলে ঘোর
ফিরে এসো প্রেমাশনি, পদ্মপ্রণয়ী
লুকোচুরি, কবিতায় ছায়ারঙ মেয়ে
সবকিছু ছাই হয়, মহাকাল বেঁচে থাকে, তোমার প্রতিমা।।
***
যাঁরা এ লেখাটাকে বুঝবার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী লেখটা পড়তে গিয়ে অযথাই আপনাদের কষ্ট করতে হয়েছে বলে। এটি একটি কবিতা, যে কবিতার হয়তো কোনো অর্থই নেই। পড়তে পড়তে যদি কোনো অনুভূতির উদ্রেক হয়, সেটির কৃতিত্ব আপনার নিজস্ব, লেখকের নয়। এর একটা নাম আছে, শব্দকবিতা - শব্দেই দৃশ্যানুভূতি। এ ব্যাপারে সামান্য ধারনা পাওয়া যাবে নিচের অংশটুকু পড়লে।
***
শব্দকবিতা
গাঙচিল লালপাল কাশবন নদী
দুপুরের বালুচর বাঁশপাতা ঘুড়ি
কলাপাতা নিজ্ঝুম গরমের ঘুম
রাখালের বাঁশিমন উচাটন দিন
ঝড়খড় বাউলের একতারা ঝিম
সুনসান ইতিহাস সময় কলস।
শব্দকবিতা- শব্দেই দৃশ্যানুভূতি
২০০৮ বা ২০০৯-এর দিকে শব্দকবিতার উপর প্রথম লিখি কবিতা মুক্তমঞ্চে, যেটি সম্ভবত বাংলা কবিতার প্রথম ওয়েব সাইট, যাতে প্রথম দিকে ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লিখতে হতো (২০০১/২০০২ সালের দিকে)। শব্দকবিতার উদাহরণ স্বরূপ উপরের শব্দকবিতা লেখাটা পোস্ট করি, যাতে ঝর্নাদিদি, আশিক ভাই, অন্তরদিদি, সিদ্ধার্থদা, রাকা দা, অর্ঘ্য দা, প্রমুখ কবি বন্ধুরা এটির উপর আলোকপাত করেন এবং ‘শব্দকবিতা’ও যে এক ধরনের কবিতা হতে পারে, সে ব্যাপারে তাঁরা পজিটিভ মনোভাব ব্যক্ত করেন। এরপর উক্ত সাইটের বিভিন্ন আলোচনায় উত্তরাধুনিক কবিতার (নতুন ধারা বা নতুন কবিতা) পাশাপাশি আমি শব্দকবিতার ধারনা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। বেশিরভাগই সাধুবাদ জানিয়েছেন, তবে কেউ কেউ বলেছিলেন ‘শব্দকবিতা’ মূলত কোনো নতুন ধারনা নয়, ইংরেজিতে এ ধারার কবিতা অনেক আগে থেকেই লিখিত হয়ে আসছিল।
আধুনিক কবিতার অর্থ ও শব্দকবিতা
একটা কবিতা লিখে বহুবার রিভিশন দিয়ে ওটাকে রিফাইন করা হয়। ফলে একটা অপেক্ষাকৃত কাঁচা বা অপরিপক্ব কবিতা কিছুটা হলেও পরিপক্বতা বা বিশুদ্ধতা লাভ করে। কবিতা লিখার এটাই বোধ হয় চিরন্তন ও প্রায়-সর্বজনসিদ্ধ ও অনুসৃত পদ্ধতি।
সাম্প্রতিককালে মণীষী-কবিদের কবিতাবিষয়ক জ্ঞানগর্ব আলোচনা ও বিদগ্ধ পাঠকবর্গের সুনিপুণ কাব্য-সমালোচনা পড়ার পর এ বিষয়ে আমার জ্ঞানভাণ্ডার কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ হয়েছে। প্রথমেই যেটা বুঝতে পেরেছি তা হলো : একটা কবিতা লিখে ছেড়ে দিলেই কবি হিসেবে আমার দায়িত্ব প্রায় শেষ; ও-কবিতার গূঢ়ার্থ বা শাব্দিক কিংবা আক্ষরিক অর্থ উদ্ধারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পাঠকের। কবিতার অর্থ উদ্ধারে পাঠকের যতো কষ্ট ও ভোগান্তি হবে, কবি হিসেবে আমার কৃতিত্ব বা বড়ত্ব ততোই বেশি। ভুলক্রমে অথবা ছাপাখানার বিড়ম্বনায় কোনো শব্দ বা বাক্য উলটপালট হয়ে গেলে কবিতার যে অর্থ-বিভ্রাট ঘটে, পাঠক তাতে জটিল সৃজনীশক্তির কাছে পরাস্ত হয়ে আমাকে কুর্ণিশ করবেন বৈকি!
কবিতা যদি পানির মতো তরল ও স্বচ্ছ হয়, তা সত্যিকারেই কোনো কবিতা হয় না বোধ হয়; আমাদের কিছু কবি তাই মনে করেন। জসীম উদ্দীনের কবিতা সেই বিবেচনায় ‘কবিতা’ কিনা তা এখন বিচার্য্য বিষয় বটে!
অতএব, কবিতা লিখা বোধ হয় নজরুল-রবীন্দ্র যুগের চেয়ে আজকাল অনেক অনেক সহজ হয়ে গেছে। কিছু সাবলীল ও কিছু অপ্রচলিত শব্দগুচ্ছ ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে পঙ্ক্তিবদ্ধ করে ছেড়ে দিলেই হলো; তার যদি একটা গূঢ়ার্থ থাকে তো ভালো, না থাকে তো আরো ভালো- বুদ্ধিমান পাঠক জটিল ও দুরূহ গাঁথুনির ভেতর ঢুকে অমূল্য রত্নখনি তুলে এনে সগর্বে কবির সামনে উপস্থাপন করবেন। কবি অতিশয় চমত্কৃত হলেও হতে পারেন- এতো সৃষ্টিশীল ও শিল্পোত্তীর্ণ কবিতা- এতো বাঙ্ময়, এতো বহুব্রীহিময়- কবি নিজেও হয়তো কবিতা রচনার কালে ভেবে উঠতে পারেন নি। প্রকৃতপক্ষে, কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থোদ্ধারের দায়িত্ব পাঠকেরই, কবির নয়; পাঠকগণই গবেষণা করে বের করবেন রচিত কবিতার ‘মেসেজ’টা আসলে কী; সেই বাণী জ্ঞাত হয়ে কবি নিশ্চিত হতে পারেন- হ্যাঁ, আমি বোধ হয় কবিতায় এ কথাটাই বলতে চেয়েছিলাম।
কবিকে কেবল একগুচ্ছ শব্দ সুগ্রন্থিত করতে হবে। তার অর্থ অথবা অর্থহীনতা অনুসন্ধানের দায়িত্ব পাঠকের। অর্থের ভেতর যেমন নানান অর্থ লুকায়িত, ‘অর্থহীনতা’ও অশ্রুতপূর্ব অর্থদ্যোতনায় ভাস্বর হয়ে উঠতে পারে।
সম্ভবত কবির চেয়ে পাঠকগণই কবিতা বিষয়ে অধিক জ্ঞান রাখেন। কবিতার উপর কবিকে কোনো গবেষণা করবার প্রয়োজন পড়ে না (যিনি করেন তিনি এটি একটা বাড়তি কাজ করেন, যা তাঁর বাড়তি প্রতিভাও হতে পারে)। গবেষণা করতে হয় একজন ছাত্র বা শিক্ষার্থীকে, আর তাঁর শিক্ষককে। এর বাইরে যাঁরা করেন তাঁরা হলেন বিদগ্ধ আলোচক বা সমালোচক। যাঁরা কবিতার পাঠক, তাঁরা এর সবগুলো কাজই করেন ও পড়েন, শুধু কবিতা লেখা ছাড়া। পাঠকের জ্ঞান এভাবেই কবির চেয়ে বেশি হয়ে ওঠা সম্ভব।
বস্তুত কবিতার কোনো অর্থ হয় না। কবিতার সর্বজন-স্বীকৃত সারমর্মের অনুসন্ধানও যৌক্তিক নয়। কবিতার যদি কোনো অর্থ থেকেও থাকে, তা কেবল পাঠক-কল্পিত অর্থ, যা পাঠক ভেদে বহুবিধ। কবি অনেক সময় খামখেয়ালিভাবে কিছু একটা লিখে ছেড়ে দিতে পারেন; পাঠক সেটিকে রত্ন ভেবে এর বিরাট অর্থ তৈরি করে ফেলতে পারেন, যা পড়ে স্বয়ং কবিও হতবাক হয়ে যেতে পারেন। অনেক সময় কবিতা লিখবার কালে যে প্রেক্ষাপট ছিল, (হয়তো কবি নিজেও তার একটা মর্মার্থ স্থির করেছিলেন), কবিতাটি প্রকাশিত হবার পর ওটির একটি নতুন অর্থ তৈরি করবার প্রয়োজন পড়তে পারে।
আমার এ কথায় হয়তো কেউ একমত হবেন না। হয়তো বলবেন, প্রত্যেকটা কবিতারই একটা থিম থাকে। থিম ছাড়া কি কবিতা লেখা যায়? এ কথাটাই ঠিক যে, প্রত্যেকটা কবিতারই একটা থিম থাকে।..... এ ব্যাপারে আমি দুইশত ভাগ একমত। তবে কবিতার অর্থ, থিম, মূল বক্তব্য, ইত্যাদি নিয়ে কোনো এক সময় মুক্তমঞ্চে অনেক প্রাণবন্ত ও উপভোগ্য আলোচনা হতো। আমি অনেকের অনেক কবিতা পড়ে খুব ক্ষুব্ধ হতাম ও বিরক্তি প্রকাশ করতাম, ওসবে কোনো মূল বক্তব্য খুঁজে না পাওয়ায়। আমার মতামতকে সাপোর্ট করার জন্য যেমন কেউ কেউ ছিলেন, বিপক্ষে দাঁড়ি্যে অনেকে তলোয়ারেও শান দিয়েছিলেন - কবিতার আবার অর্থ কী? তুমি পড়ে যা বোঝো তা-ই কবিতার অর্থ। কেউ কেউ বলতেন, কবিতার কোনো অর্থ হয় না, কেবল পাঠকের কাছে কবির ভাবটা অনূদিত হয়ে পৌঁছে থাকে। টিএস ইলিয়টের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে- কবিতা হলো সেই বস্তু যা বুঝবার আগেই হৃদয়কে স্পর্শ করে। এ থেকে বোঝা যায় কবিতার অর্থ থাকাটা জরুরি নয়।
কবিতা অনেক সময় সংকেতের মতো কাজ করে। কবিতা শুধু ভাবকে ধারণ করতেই সৃষ্ট, মনে হয় তা আজকাল চলবে না; কবিতা হলো শব্দ ভাঙা-গড়া-সাজানোর খেলা, শব্দের সর্বোত্তম বিন্যাস। পড়তে বা কানে শুনতে অপূর্ব, অর্থ খুঁজতে গেলে হয়তো দেখা যেতে পারে নিরেট মূল্যহীন একগুচ্ছ শব্দমাত্র।
কবিতার সংজ্ঞা এবং গতি-প্রকৃতি সত্যিই বিচিত্র। তাই যে লেখাকে আমি ‘ডাস্ট’ বলে নাক সিটকাই, ওটাই দেখা যায় অনেক পাঠকের কাছে খুব উঁচু মাপের কবিতা হিসাবে গণ্য হচ্ছে, এবং ভাইস-ভার্সা। জীবনানন্দ জীবদ্দশায় কবি-খ্যাতি সেভাবে পান নি, কারণ, তাঁর লেখাকে অনেকেই কবিতা বা ভালো কবিতা হিসাবে গণ্য করেন নি; সেই জীবন কি এখন আমাদের আধুনিক কবিতার প্রধান পুরুষ হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে না?
কবিতার সংজ্ঞা একেক জনের কাছে একেক রকম; হয়তোবা কবিতার কোনো সংজ্ঞাই হয় না। কিন্তু একটা লেখাকে পড়েই কিন্তু আমরা বলে দিতে পারছি- এটা একটা কবিতা, বা নিছক গদ্য। এই যে বলে দেয়া গেলো- মনে হয় এর দ্বারাই বোঝা যায় কবিতা কীরূপ হওয়া উচিত। তবে যদি কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়, হয়তো দেখা যাবে কোনো সংজ্ঞাই মনের মতো নয়, অথবা সব সংজ্ঞাই আলাদা আলাদাভাবে কবিতাকে বুঝবার জন্য যথেষ্ট।
কবিতার আঙ্গিকে বৈচিত্র্য আনার মানসে কবিতাকে কিছুটা রসকষবিবর্জিত করার পক্ষপাতী আমি নই। কবিতা সবার জন্য নয়, তা ঠিক, কিন্তু কবিতার পাঠকের কাছেই যেন কোনো কবিতা কাঠের মতো শুকনো হয়ে না ওঠে, কবিতা রচনা-বিষয়ে সেটি খেয়াল রাখবার পক্ষে আমি। কবিতা শ্রুতি-মাধুর্যের প্রতীক, এজন্য একজন মূর্খ বা অশিক্ষিতও কোনো কোনো আবেগের মুহূর্তে দু কলি কবিতা গেয়ে উঠতে পারেন। কবিতা সুখপাঠ্য হবে, কবিতা উপভোগ্য হবে, কবিতা সহজবোধ্য ও প্রাঞ্জল হওয়া বাঞ্ছনীয়, কিংবা, কবিতা এমন হতে হবে যা বুঝবার আগেই হৃদয়কে স্পর্শ করে। একটি কবিতার পঙ্ক্তি গঠন, শব্দচয়ন এমন হতে হবে যে তা পড়ামাত্রই যেন পাঠকের বুকের উপর একটা তীব্র প্রভাব সৃষ্টি করে। আমাদের অনেকের এমন প্রবণতা আছে- তাঁরা কবিতায় গাম্ভীর্য সৃষ্টির লক্ষে অপ্রচলিত, কিংবা ডিকশনারি ঘেঁটে শব্দ বসিয়ে লেখেন, এটা করলে সহজেই ব্যাপারটা বোঝা যায়, কারণ, তখন কবিতা তার গতি ও সাবলীলতা হারায়, কবিতার দুর্বলতা প্রকটতর হয়। বাংলা ভাষায় বিখ্যাত কবিতাগুলো বিখ্যাত হয়েছে এর সহজবোধ্যতা ও হৃদয়াগ্রাহিতার জন্য। 'সহজ করে যায় না বলা সহজে।' রবীন্দ্রানথের উক্তি। কবিতার উপর যে-সব প্রবন্ধ নিবন্ধ লেখা হয়, সেগুলো পড়ার সময় অবাক হয়ে লক্ষ করে দেখবেন যে, রবীন্দ্রনাথের যে-সব কবিতার উদ্ধৃতি দেয়া হয় তা অন্য সব কবিতার ঔজ্জ্বল্যকে ম্লান করে দেয়। এটা এজন্য নয় যে তিনি সব কবিতায় গুরু-গম্ভীর শব্দালি ইউজ করতেন সেজন্য, এটা হলো, তিনি সঠিক জায়গায় সঠিক শব্দটা খুব সাফল্যের সাথে বসাতে পারতেন, এজন্যই তিনি অদ্বিতীয় আজও।
আমাদের কবিতার পাঠকের সংখ্যা বাড়াতে হবে; এ সংখ্যা বাড়লে তা কবিদের জন্যই মঙ্গল। বেশি পাঠক, বেশি পরিচিতি। পরিচিতি লাভের আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরয়াত ক্ষুধা। যাঁর এ ক্ষুধা নেই তাঁর কোনো কবিতা আমরা পড়তে পাই না, কেননা, তিনি তা পাঠকের জন্য কখনো উন্মোচন করেন না। পাঠক যেন কবিতার প্রতি ঝোঁকেন, সেই আবহ তৈরির দায়িত্ব কবিদেরই। আমি বলছি না যে ‘শব্দকবিতা’ এসব উদ্দেশ্য সাধনে সাফল্য পেতে পারে, আমি সার্বজনীন কবিতার কথাই বলছি।
আমি তাই বলি, একটা পুরো কবিতা লিখবারই বা কী দরকার? একটা একটা করে শব্দ একের পিঠে আরেক দাঁড় করিয়ে দিলে কেমন হয়? একটা ব্যাকরণগত সার্থক বাক্য না হোক, এরা পাশাপাশি বসে বা দাঁড়িয়ে কি কোনো ভাব বা আবহ সৃষ্টি করে? দৈবাৎ যদি একটা মাত্র শব্দও আপনাকে আমূল নাড়িয়ে দিয়ে যায়, যা একশ পঙক্তির একটা কবিতাও পারে নি, ওটিই আপনার সবচেয়ে শক্তিশালী কবিতা। এভাবে শব্দের পর শব্দ বসিয়ে দেখুন, আপনিও একটা অনবদ্য শব্দকবিতার স্রষ্টা- আমি এর নাম রেখেছি ‘শব্দকবিতা’ : শব্দেই দৃশ্যানুভূতি।
আপনি রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। একটা জারুলগাছ, একটা শুকনো নদী, মানুষ, কিছু বাড়ি.... প্রতিটা আলাদা আলাদা বস্তু বা এলিমেন্ট। এগুলোকে বাক্যবন্দি না করেও সুন্দর একটা ছবিবন্দি কি করা যায়... তা-ই শব্দকবিতা। কিছু শব্দ, এমনকি একটা শব্দও আপনার ভাবনাকে নাড়িয়ে দিতে পারে, এরূপ একগুচ্ছ শব্দ, সুচয়নকৃত, সুসজ্জিত... একটা সুগভীর ভাবাবহের সৃষ্টি যদি করে, তা-ই শব্দকবিতা। শব্দকবিতায় একটা বাক্য ব্যাকররণগত ভাবে শুদ্ধ হবার প্রয়োজন নেই (কবিরা যেভাবে লিখেন, সেটাই কবিতার ব্যাকরণ; আমি প্রচলিত কবিতার ব্যাকরণের কথা বলছি না)।
‘শব্দকবিতা’ শব্দটা এবং ‘শব্দেই দৃশ্যানুভূতি’ আমার ধারনাপ্রসূত, তবে এতে নূতনত্ব কিছু নেই, কবিতার চিরন্তন বৈশিষ্ট্য শব্দে শব্দে দৃশ্যকল্প সৃষ্টির প্রয়াসকে নতুন একটি শব্দবন্ধে আটকে ফেলা হয়েছে মাত্র। এটা কোনো সাড়াজাগানো আন্দোলন নয়। কাউকে লেখার জন্য অনুপ্রাণিতও করা হচ্ছে না। শুধু নিজের ভেতর একটা তাগিদ অনুভব করছি, নিজের গণ্ডি থেকেই বেরিয়ে পড়ার। ইতিহাসে কি একটিমাত্র শব্দে কোনো কবিতা লেখা হয়েছে? এক শব্দে যদি একটা কবিতা লিখা যেতো- এ নিয়ে অনেক ভেবেছি। এক শব্দের কবিতার শিরোনামটাও একটা বিপুল কবিতা- এমন একটা কবিতা মনে মনে অনেক খুঁজেছি। সে হিসাবে শব্দকবিতার আয়তন কতো বড়!
প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘শব্দকবিতা’র এই নতুন পথে চলা আমাদের কতোটুকু প্রয়োজন? কেউ হয়তো বলবেন, কবিতায় ভাবের অভিনবত্ব যদি তৈরি না করা যায় তাহলে ‘শব্দকবিতা’ শব্দ প্রতারণা হয়ে যেতে পারে। এইসব পথচলা কতোটুকু প্রয়োজন এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়- হয়তো খুব বেশি প্রয়োজন নেই, তবে কেউ কেউ প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, যার ফলে যুগে যুগে একেক ধারার কবিতার সাথে আমরা পরিচিত হতে পেরেছি। এ প্রয়োজন না থাকলে আমরা আদিকালের পয়ার বা পুথিতেই রয়ে যেতাম আজও। ভাবের অভিনবত্ব ব্যাপারটা হলো কবির নিজস্ব- তাঁর প্রতিটা কবিতা যেমন অন্যান্য কবিতার ভাবপ্রবাহ থেকে ভিন্নতর, তাঁর সামগ্রিক কবিতাসম্ভারও অপরাপর কবিদের ভাবজগৎ থেকে ভিন্নতাময়। যদি বলেন- না, তাহলে বলবো, কবিতার ভাব কোনোদিনই পরিবর্তিত হয় না, আদিতে যা ছিল আজও তাই আছে- প্রেম, বীরত্বগাথা, ধর্ম, সংস্কার, নিত্যতা, ইত্যাদি থেকে কি আমরা বের হতে পেরেছি? বা এরা বাইরে কি অন্য কোনো ভাবজগৎ আছে? অন্য দিকে, মাইকেল, নজরুল- এঁরা যেমন ভিন্ন ভিন্ন টার্নিং পয়েন্টের স্রষ্টা, তদ্রূপ, জসীম উদ্দীন, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাসও কি নয়?
যাই হোক, কবিতা তার নিজের গতিতেই চলবে। আমরা যতো অভিধায়ই কবিতাকে ভিন্ন ভিন্নরূপে চিহ্নিত করি না কেন, কবিতা তার নিজস্ব বিভায়ই সাহিত্যকে আলোকিত করতে থাকবে- আজকের শব্দকবিতা, হাইকু, সনেট- ৪০০০ সালের সরহপাদের হাতে নতুন শরীর ও সৌন্দর্যে লিখিত হবে, এতে কোনো ভুল হবার সম্ভাবনা নেই।
আমার কবিতাটির আপাত কোনো থিম নেই। তবে ‘শব্দকবিতার ধারনা’ অংশটুকু পড়লে হয়তো বুঝবেন এ কবিতার একেকটা শব্দ একেকটা দৃশ্য বা আবহের আভাস দিচ্ছে, সব মিলিয়ে হয়তো বৃহত্তর একটা ভাবের আবেশ তৈরি করে ফেলতে পারে। যদি তা না হয়, তাহলে এটা কোনোরূপ থিম বা বক্তব্যবিহীন কবিতা। এতোটা নীরস না ভেবেও যদি দেখি, শব্দগুলো শুনতে তো মন্দ নয়! হয়তো তখন এর কিছুটা সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
সার সংক্ষেপ
কবিতার একটা নির্দিষ্ট অর্থ থাকতেই যে হবে, তা নয়; শব্দাবলি বা শব্দগুচ্ছ একটা ব্যাকরণসিদ্ধ বাক্য গঠন করবেই, তা-ও নয়। একটা শব্দ আপনার ভেতর বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে; একটা শব্দ আপনাকে আমূল নাড়িয়ে দিতে পারে; একটা লেখা পড়তে পড়তে আপনি দারুণ উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন (এটা নতুন কিছু নয়), কিন্তু সঠিক ভাবটা আসছে না; তখন একটা কাজ করুন, প্রাণসঞ্জীবনী শব্দগুলো এলোপাথাড়ি লিখে ফেলুন, এবার আরেকটু গোছানোর চেষ্টা করুন। এর নামই হতে পারে ‘শব্দকবিতা’।
আগ্রহীরা পড়তে পারেন :
উত্তরাধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য : একটা মনোজ্ঞ বিতর্কালোচনা।
শব্দকবিতার উপর মতামত