কবিতা পাঠের সুখ বা তৃপ্তি
কখনো কখনো একটা কবিতাকে আরেকটা থেকে আলাদা করা যায় না, কিংবা অনেকগুলো কবিতাকে একত্র করলে সবগুলো কবিতা মাত্র একটা কবিতা হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। আবার একটা কবিতার একেকটা স্তবককে ভেঙে আলাদা আলাদা শিরোনামে ছেড়ে দিলে ওগুলোও একেকটা স্বতন্ত্র, উজ্জ্বল ও সার্থক কবিতা হয়ে উঠতে পারে। কাজটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন এভাবে- আপনার লেখা গোটা কয়েক কবিতা থেকে বেশ কিছু পঙ্ক্তি নিন; এগুলো যথেচ্ছভাবে সাজিয়ে নতুন আঙ্গিকে দাঁড় করান নতুন আরেকটা কবিতা, পঙ্ক্তিগুলো অরিজিনাল কবিতা থেকে একটুও না পাল্টে। এবার ওটা পড়তে দিন বন্ধুদের; ব্লগেও ছেড়ে দেখুন। আর কবিতাটির উপর মন্তব্যগুলো রেখে দিন আপনার সন্তুষ্টি ও অবাক হবার জন্য। কবিতার মজা ওখানেই, বিশেষত আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে।
কবিতার রূপ বা গঠন যদি এই হয়ে থাকে তবে কবিতা পাঠের মূল তৃপ্তি বা সুখ কোথায়?
আমরা যখন একটা গল্প বা উপন্যাস পড়ি, তার প্রভাব খুব সরাসরি আমাদের মন ও মননে আঘাত হানে; তাই একটা কাহিনী থেকে খুব সহজেই আরেকটা কাহিনীকে আলাদা করা যায়। তদ্রূপ প্রবন্ধ বা নিবন্ধ খুব সরলভাবে শিরোনামে বক্ষ্যমাণ বিষয়ের ইঙ্গিত দিয়ে থাকে বলে মূল বক্তব্যে খুব তাড়াতাড়িই আমরা পৌঁছে যেতে পারি, যা অনুধাবনে আমাদের তৃপ্তি বা তৃষ্ণা মেটে; আর সহজেই একটা প্রবন্ধ থেকে আরেকটাকে আলাদা করা যায়।
নির্মাণ ও প্রকাশে কবিতা বর্তমানে যে অবয়ব ধারণ করেছে, তার নির্যাসের স্বাদ সবাই খুব সহজেই লাভ করতে পারেন বলে আমার বোধ হয় না। কবিতা খুব গভীর উপলব্ধির বিষয়। বেশিরভাগ বোদ্ধারাই কবিতায় চিত্রকল্পের নান্দনিক গ্রন্থনার কথা বলেন। কিন্তু আমার মনে হয় অধুনা কবিতায় চিত্রকল্প সৃষ্টির চেয়ে এবস্ট্রাক্ট বিষয়ের বুননই অধিক মাত্রায় হয়ে আসছে। মূলত আমিও মনে করি, কবিতা কোনো চিত্রকল্পের বিষয় নয়, ভাববোধ বা ভাব সৃষ্টির বিষয় হলো কবিতা।
তাহলে কবিতার রসাস্বাদন কিভাবে সম্ভব?
খুব নিগূঢ়ভাবে কবিতা পড়তে হয়; কবিতার ভেতর ডুবে যেতে হয়। একেকটা শব্দ পাঠককে একেকটা দিগন্তে নিয়ে যাবে, একেকটা দিগন্তে পাঠক একেকটা ভুবন দেখতে পাবেন; তখন একটা কবিতা থেকে আরেকটা কবিতা আলাদা, নাকি পুরো বই জুড়ে একটা মাত্র কবিতা, পাঠকমনে এই প্রশ্নের উদ্রেক হবে না মোটেও, কেননা প্রশ্নটাই তখন বেজায় অবান্তর। কবিতা মূলত শব্দে ভাবাবহ সৃষ্টির খেলা। শব্দেই পাঠক ঘায়েল কিংবা কুপোকাত।
আধুনিক কবিতা এমনই।
আধুনিক কবিতার অর্থ ও শব্দকবিতা
একটা কবিতা লিখে বহুবার রিভিশন দিয়ে ওটাকে রিফাইন করা হয়। ফলে একটা অপেক্ষাকৃত অপরিপক্ব কবিতা কিছুটা হলেও পরিণতি লাভ করে। কবিতা লিখার এটাই বোধ হয় চিরন্তন ও প্রায়-সর্বজনসিদ্ধ ও অনুসৃত পদ্ধতি।
সাম্প্রতিককালে মণীষী-কবিদের কবিতাবিষয়ক জ্ঞানগর্ব আলোচনা ও বিদগ্ধ পাঠকবর্গের সুনিপুণ কাব্য-সমালোচনা পড়ার পর এ বিষয়ে আমার জ্ঞানভাণ্ডার প্রভূত সমৃদ্ধি অর্জন করেছে! প্রথমেই যেটা বুঝতে পেরেছি তা হলো : একটা কবিতা লিখে ছেড়ে দিলেই কবি হিসেবে আমার দায়িত্ব প্রায় শেষ; ও-কবিতার গূঢ়ার্থ বা শাব্দিক কিংবা আক্ষরিক অর্থ উদ্ধারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পাঠকের। কবিতার অর্থ উদ্ধারে পাঠকের যতো কষ্ট ও ভোগান্তি হবে, কবি হিসেবে আমার কৃতিত্ব বা বড়ত্ব ততোই বেশি। ভুলক্রমে অথবা ছাপাখানার বিড়ম্বনায় কোনো শব্দ বা বাক্য উলটপালট হয়ে গেলে কবিতার যে অর্থ-বিভ্রাট ঘটে, পাঠক তাতে জটিল সৃজনীশক্তির কাছে পরাস্ত হয়ে আমাকে কুর্ণিশ করবেন বৈকি!
কবিতা যদি পানির মতো তরল ও স্বচ্ছ হয়, তা সত্যিকারেই কোনো কবিতা হয় না বোধ হয়; আমাদের কিছু কবি তাই মনে করেন। জসীম উদ্দীনের কবিতা সেই বিবেচনায় ‘কবিতা’ কিনা তা এখন তাঁদের বিচার্য্য বিষয় বটে! শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ- এঁদের কবিতাকেও 'সরলরৈখিকতার' দোষে হালকা জ্ঞান করা হচ্ছে। কোনো কোনো আধুনিকতম পণ্ডিত কবি রবি-নজরুলের কবিতায়ও শিল্পমানের যথেষ্ট ঘাটতি দেখতে পেয়েছেন; বিশেষ করে চিত্রকল্প সৃষ্টিতে তাঁদের অপারঙ্গমত্ব তাঁদের কবিতাকে সরলরৈখিক করে ফেলেছে বলে এ পণ্ডিতবর্গ মনে করেন।
অতএব, কবিতা লিখা বোধ হয় নজরুল-রবীন্দ্র যুগের চেয়ে আজকাল অনেক অনেক সহজ হয়ে গেছে। কিছু সাবলীল ও কিছু অপ্রচলিত শব্দগুচ্ছ ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে পঙ্ক্তিবদ্ধ করে ছেড়ে দিলেই হলো; তার যদি একটা গূঢ়ার্থ থাকে তো ভালো, না থাকে তো আরো ভালো- বুদ্ধিমান পাঠকগণ জটিল ও দুরূহ গাঁথুনির ভেতর ঢুকে অমূল্য রত্নখনি তুলে এনে সগর্বে কবির সামনে উপস্থাপন করবেন। কবি অতিশয় চমত্কৃত হলেও হতে পারেন- এতো সৃষ্টিশীল ও শিল্পোত্তীর্ণ কবিতা- এতো বাঙ্ময়, এতো বহুব্রীহিময়- কবি নিজেও হয়তো কবিতা রচনার কালে ভেবে উঠতে পারেন নি। প্রকৃতপক্ষে, কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থোদ্ধারের দায়িত্ব পাঠকেরই, কবির নয়; পাঠকগণই গবেষণা করে বের করবেন রচিত কবিতার ‘মেসেজ’টা আসলে কী; সেই বাণী জ্ঞাত হয়ে কবি নিশ্চিত হতে পারেন- হ্যাঁ, আমি বোধ হয় এ-ই বলতে চেয়েছিলাম।
কবিকে কেবল একগুচ্ছ শব্দ সুগ্রন্থিত করতে হবে। তার অর্থ অথবা অর্থহীনতা অনুসন্ধানের দায়িত্ব পাঠকের। অর্থের ভেতর যেমন নানান অর্থ লুকায়িত, ‘অর্থহীনতা’ও অশ্রুতপূর্ব অর্থদ্যোতনায় ভাস্বর হয়ে উঠতে পারে।
সর্বোপরি এবং প্রায়শ, কবির চেয়ে পাঠকগণই কবিতা বিষয়ে অধিক জ্ঞান রাখেন।
বস্তুত কবিতার কোনো অর্থ হয় না। কবিতার সর্বজন-স্বীকৃত সারমর্মের অনুসন্ধানও যৌক্তিক নয়। কবিতার যদি কোনো অর্থ থেকেও থাকে, তা কেবল পাঠককল্পিত অর্থ, যা পাঠক ভেদে বহুবিধ।
আমি তাই বলি, একটা পুরো কবিতা লিখবারই বা কী দরকার? একটা একটা করে শব্দ একের পিঠে আরেক দাঁড় করিয়ে দিলে কেমন হয়? একটা ব্যাকরণগত সার্থক বাক্য না হোক, এরা পাশাপাশি বসে বা দাঁড়িয়ে কি কোনো ভাব বা আবহ সৃষ্টি করে? দৈবাত যদি একটা মাত্র শব্দও আপনাকে আমূল নাড়িয়ে দিয়ে যায়, যা একশ পঙ্ক্তির একটা কবিতাও পারে নি, ওটিই আপনার সবচেয়ে শক্তিশালী কবিতা। এভাবে শব্দের পর শব্দ বসিয়ে দেখুন, আপনিও পারেন কিনা শব্দকবিতা সৃষ্টি করতে- আমি এর নাম রেখেছি 'শব্দকবিতা’ : শব্দেই দৃশ্যানুভূতি।
আপনি রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। একটা জারুলগাছ, একটা শুকনো নদী, মানুষ, কিছু বাড়ি... প্রতিটা আলাদা আলাদা বস্তু বা এলিমেন্ট। এগুলোকে বাক্যবন্দি না করেও সুন্দর একটা ছবিবন্দি কি করা যায়... তা-ই শব্দকবিতা। কিছু শব্দ, এমনকি একটা শব্দও আপনার ভাবনাকে আমূল নাড়িয়ে দিতে পারে, এরূপ একগুচ্ছ শব্দ, সুচয়নকৃত, সুসজ্জিত.....একটা সুগভীর ভাবাবহের সৃষ্টি যদি করে, তা-ই শব্দকবিতা। শব্দকবিতায় একটা বাক্য ব্যাকররণগত ভাবে শুদ্ধ হবার প্রয়োজন নেই (কবিরা যেভাবে লিখেন, সেটাই কবিতার ব্যাকরণ; আমি প্রচলিত কবিতার ব্যাকরণের কথা বলছি না)।
উপরের আলোচনার সংক্ষিপ্তসার - শব্দকবিতার ধারণা
কবিতার একটা নির্দিষ্ট অর্থ থাকতেই যে হবে, তা নয়; শব্দাবলি বা শব্দগুচ্ছ একটা ব্যাকরণসিদ্ধ বাক্য গঠন করবেই, তা-ও নয়। একটা শব্দ আপনার ভেতর বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে; একটা শব্দ আপনাকে আমূল নাড়িয়ে দিতে পারে; একটা লেখা পড়তে পড়তে আপনি দারুণ উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন (এটা নতুন কিছু নয়), কিন্তু সঠিক ভাবটা আসছে না; তখন একটা কাজ করুন, প্রাণসঞ্জীবনী শব্দগুলো এলোপাথাড়ি লিখে ফেলুন, এবার আরেকটু গোছানোর চেষ্টা করুন।
এই বিদগ্ধ কবিদের মাঝে (যাঁরা বেশিরভাগই আমার অগ্রজ ও আমার থেকে সর্বাংশে পরিণত) খুব সাহস করেই শব্দকবিতার ধারণাটা ছাড়লাম। আপনাদের কটূ ও অকটূ মতামত পেলে নিজেকে ধন্য মনে করবো।
কবিতার দৈর্ঘ্য কি ছোট হয়ে আসছে না? কেন?
আজকালকার দিনে আমরা দৈর্ঘ্যে বড় কবিতা পড়তে কতোখানি ধৈর্য্যশীল?
এ মুহূর্তে যেগুলোর নাম মনে আসছে- রবীন্দ্রনাথের পুরস্কার, নিরুদ্দেশ যাত্রা, যেতে নাহি দিব, বর্ষাযাপন; নজরুলের বিদ্রোহী, পূজারিনী, সিন্ধু; জসীম উদ্দীনের 'কবর', 'নিমন্ত্রণ' - ধরুন এ মাপের কবিতা আজকের কোনো কবি লিখে ফেললেন- আমরা কতোখানি আগ্রহ নিয়ে তা পড়বো? রবীন্দ্র-নজরুল সমসাময়িক যুগের বেশির ভাগ কবিতাই দৈর্ঘ্যে বেশ বড়, আদতে ছোট আকারের কবিতা খুঁজে পাওয়াই ভার।
সেই যুগের তুলনায় আজকালকার বেশির ভাগ কবিতাই দৈর্ঘ্যে খুব ছোট। কবিতার আকার এতো ছোট হওয়ার কারণ কী? আমার মতে কবি তাঁর ভাবনাগুলোকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডাকারেই প্রকাশ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকেন; সামগ্রিকভাবে তা হয়ত একটা বৃহৎ কবিতায় পরিণত হতে পারতো। কবি নিজেও হয়তো বড় আকারের কবিতা লিখতে অধৈর্য্য হয়ে পড়েন, অন্যদিকে পাঠকও হয়তো অর্ধপৃষ্ঠার চেয়ে বড় আকারের কবিতা দেখলেই পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকেন।
তবে অধিকাংশ আধুনিক কবি হয়তো বলবেন আগের কবিগণের কবিতায় শব্দ ও অলঙ্কারের ব্যবহারে মাত্রাতিরিক্ত বাহুল্য ছিল; তাঁরা যতো বেশি বলতে পারতেন ততোই হয়তো কৃতিত্ব হতো। নজরুলের বিদ্রোহী, ধূমকেতু ইত্যাদি কবিতাগুলোর কথাই ধরুন। 'আমি' দোষে দুষ্ট, অধুনার কোনো কবি হয়তো এভাবে লিখবেনও না। ভাবপ্রকাশের ক্ষমতা একটা বড় ফ্যাক্টর আধুনিক কবিতায়- 'বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু' কথাটা খুব খাটে আধুনিক কবিতার বেলায়। খুব কম লিখে অনেক বেশি প্রকাশ করতে হবে। কাজটা সোজা নয়, তবে যিনি এ কাজে যতো দক্ষ তিনি ততো কুশলী।
ব্যাপারটা মনে হয় পরিষ্কার হলো না- কবিতার দৈর্ঘ্য ঠিক কী কী কারণে ছোট হয়ে আসছে। আমার মনে হয় পাঠকমনে মিডিয়া-ইফেক্টও আরেকটা কারণ- তাঁরা বড় কবিতা পড়বার সময় পান না, আর কবিগণ সেটা জানেন বলেই কবিতায় পাঠককে ধরে রাখতে কবিতার আকার বড় না করে ছোট ছোট, ক্ষুদ্র খণ্ডে কবিতা লিখে থাকেন, যার অনেকগুলো একত্র করলে হয়তো একটা দীর্ঘ বড় কবিতা হয়ে উঠতে পারে।
একটা ভালো কবিতার কী কী গুণ থাকা চাই?
কবিতা কেমন হওয়া উচিত? স্বচ্ছ কাঁচের মতো পরিষ্কার? নিস্তরঙ্গ পানির মতো অতি তরল? নাকি পাখির ভাষার মতো অভেদ্য? কবিতা কি একটা মিনি স্কার্টের মতো নয়? কবিতা কি নারীর মতো রহস্যাবৃতা নয়? (নারী কবিদের কাছে উপমাটা কী হতে পারে জানি না)। একটা ভালো কবিতার স্বরূপ কী রূপ হওয়া চাই? চলুন একটু আলোচনা করি।
পৃথিবীর যে কোনো ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর সহজবোধ্যতা বা প্রাঞ্জল্য। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়ও এ বিষয়টার উপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হয় কিভাবে প্রাঞ্জল ভাষায় লিখতে হবে। আর প্রাঞ্জল ভাষায় লিখতে পারার গুণ সবার থাকে না, এটা অনেকটাই আল্লাহ্ প্রদত্ত বলে আমার মনে হয়। সবাই সার্থক বক্তা যেমন হতে পারেন না, তেমনই সার্থক লেখক বা কবিও সবাই হতে পারেন না। 'সহজ করে যায় না বলা সহজে।' বক্তা যেমন অপরের উদ্দেশ্যে বলেন, কবি বা লেখকও। একজন কবি বা লেখককে তাঁর পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছতে হলে পাঠক যেভাবে চায় আপনাকে সেভাবে লিখতে হবে বইকি। না? নিজের জন্য, নিজের আত্মতুষ্টির জন্য লিখবেন? তা নিয়ে তো আর তাহলে পাঠকের কোনো সমস্যা নেই, যা পাঠকের হাতে পৌঁছলোই না, তা নিয়ে আর আলোচোনাও হয় না।
কবিতার দুর্বোধ্যতা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক বিদ্যমান। কবি সাজ্জাদ কাদির একবার বলেছিলেন, অনেকে কবিতা লিখেন যার অর্থ কবি নিজেই জানেন না। আমার এক বন্ধু দুটি উপন্যাস, দুটি কাব্যগ্রন্থ সহ ৬টি বইয়ের জনক। পত্রপত্রিকায় তাঁর বইয়ের ভূয়সী প্রশংসা দেখা যায়। তো, আমার একটা অতি ক্ষুদ্র সাহিত্যপত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে তাকে খুব শংকার মধ্যে থাকতে হয়, কারণ, আমি তাঁর কবিতা না বুঝলে নির্ঘাত ব্যাখ্যা চাই, এবং অবশ্যাম্ভাবীভাবে দেখতে পাই চয়নকৃত অনেক শব্দের অর্থ পর্যন্ত তার জানা নেই, অভিধান ঘাঁটতে ঘাঁটতে কিছু শব্দ তার চোখে পড়ে, কিছু তার এমনি মাথায় আসে, অমনি কবিতায় তা বসাতেই হবে, আর অনিবার্যভাবে প্রয়োগ ভুল বা অর্থহীন হয়ে যায়। আরেক উঠতি কবি একুশে বইমেলায় বই বের করবেন। পত্রিকায় পাঠালেই তাঁর কবিতা ছাপা হয়; হয়তো মেয়ে হবার সুবাদে কিছু বাড়তি সুবিধা তিনি পান (মাফ করবেন), নিজেও ছোটখাট পত্রিকা বের করেন, বড় পত্রিকার প্রতিনিধি, তাও একটা যোগ্যতা হতে পারে; (আবারও মাফ করবেন)। তাঁর বই এডিট করে দিতে হবে। কিন্তু কোনও শব্দ বা বাক্য কাটাকুটি করা যাবে না। তাহলে এডিট কী করবো? বানান। পান্ডুলিপি ফেরত নাও, আমি প্রুফরিডার নই। তিনি কিছু তালিম গ্রহণ করলেন আর এডিটেড কপি হাতে পেয়ে বললেন, 'এ কবিতা তো আমি লিখেছি বলে মনে পড়ে না। সেই 'কঠিন কঠিন' শব্দগুলো কোথায় গেল?'
একজন কবি বা লেখকের কাছে কঠিন শব্দ বলে কিছু নেই; সত্যিকার অর্থে কঠিন শব্দ বলে কি কিছু আছে? কবিতা হলো সাহিত্যের সম্রাজ্ঞী। বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু। কবিতা হলো সুচয়নকৃত শব্দমালার সুগ্রন্থিত রূপ, পঠনে যা শ্রুতিমধুর, পাঠ করলেই যা বুকের ভেতর ঢুকে এক অনির্বচনীয় আনন্দ দেবে। যা পাঠককে ভাবায়। কবিতা হতে হবে রসে টইটুম্বুর। এই বৈশিষ্ট্য কিন্তু যে কোনও লেখার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একগুচ্ছ অভিজাত শব্দ পাশাপাশি বসালেন, তা একটা ভাব বা অর্থ সৃষ্টি করলো বটে, কিন্তু শ্রতিমধুর হলো না, আমি এর বিপক্ষে।
কাব্যে দুর্বোধ্যতা বা জটিলতা বিগত প্রায় ত্রিশচল্লিশ বছরের বিতর্কের বিষয়, এর বেশি সময়েরও সম্ভব- কিংবা হয়তো কবিতা সৃষ্টির আদিকাল থেকেই। অনেকে দুর্বোধ্যতাকে বুদ্ধিমত্তার মাপকাঠি বলেন। কবিতা যত দুর্বোধ্য তত উত্কৃষ্ট। আমি নগণ্য এর বিরুদ্ধে। আমি যা বুঝি তা লিখি, প্রকাশের আগে কাছের কাউকে পড়তে দিই, ওটার অর্থ তার কাছে বোধগম্য হয়েছে কিনা। কবিতা একটা প্রেমপত্রের মতো আমার কাছে, যা খুব আবেগ দিয়ে লিখি, আর ভাবি, এই কথাগুলো সে পড়বে আর তার মরমে পৌঁছবে। যদি কখনও মনে হয় এই লেখাটা তার মর্ম স্পর্শ করবে না, ওটার রিভিউ আমি করতেই থাকি। আমার কবিতার পাঠক আমার আরাধ্য প্রেমিকার মতো। কবিমাত্রই প্রচারপ্রিয় (সবাই)। আমি পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছতে চাই, আপনাদের সবার মতোই।
আপনারা সবাই শক্তিমান কবি। আপনাদের কবিতার মান অনেক উপরে। এই সুপার টেকনোলজির যুগে সাহিত্যে পাঠক ধরে রাখাটাই কঠিন। বাংলাদেশে মানুষ বইয়ের দিকে যে ঝুঁকে আছে এখনও সেজন্য সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হুমায়ূন আহমেদের, তাঁর লেখার সহজবোধ্যতার জন্যই। আমাদের যেমন একজন সহজবোধ্য গদ্যকার আছেন, তেমন কিন্তু কোনো কবিতালেখক নেই। হুমায়ূন আহমেদের সহজবোধ্যতা তাঁকে কিংবদন্তিতুল্য পাঠকপ্রিয়তা এনে দিয়ে তাঁকে মাৎসর্য্যের শিকারে পরিণত করলেও তিনি গদ্যকে পাঠকের খুব কাছে নিয়ে গেছেন; আমার মনে হয়, দুর্বোধ্যতার কারণে আধুনিক কবিতা ধীরে ধীরে পাঠক হারাচ্ছে যেমন, হুমায়ূন আহমেদের মতো অনুরূপ একজন সহজবোধ্য কবিতালেখকেরও খুব প্রয়োজন ছিল, যিনি কবিতাকে পাঠকের আরো কাছে নিয়ে যেতে পারতেন।
কবিতার যন্ত্রণা - ব্যক্তিগত অনুভূতি
সর্বশেষ কবিতাটাই বোধ হয় কবিকে সর্বোত্তম তৃপ্তি দেয়; এরপর কবি ওটাকে যতোবার পড়েন, যতোই সময় যেতে থাকে, ওটার পর যতোগুলো কবিতা লেখেন, ঐ আগের কবিতার ভেতর থেকে ততোই অপূর্ণতা ও অসম্পূর্ণতা কবির কাছে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে; আর কবির ভেতরও অতৃপ্তির যন্ত্রণা ক্রমশ তূষের আগুনের মতো ছড়াতে থাকে, কবিকে অন্তর্দগ্ধ করে, কুরে কুরে খায়। একজন কবি কখনোই তাঁর লেখা নিয়ে পরিতৃপ্ত হতে পারেন না, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁকে এ যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হয়।
যদ্দূর মনে পড়ে, চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় কোনো এক সন্ধ্যায় কুপির আলোতে বিছানায় উপুর হয়ে বসে পেন্সিল দিয়ে ৩-৪ লাইনের ছড়া জাতীয় একটা কিছু লিখেছিলাম। কী লিখেছিলাম মনে থাকার কথা নয়; প্রায় ৩৪-৩৫ বছর আগের কথা।
এরপর ৮ম শ্রেণীতে উঠে। পাঠ্যবইয়ে একটা গল্প ছিল। সেটাকে কবিতা বানানোর চেষ্টা চলে প্রায় পুরো বছর ধরে, কিন্তু দু লাইনের বেশি এগুতে পারি নি।
এরপর ৯ম শ্রেণীতে উঠে হঠাৎ কবি হয়ে যাই, প্রেমট্রেম ছাড়াই। কবিতায় নজরুলের প্রকট ছায়া, শিকরা বলেন, ‘তুই তো নজরুলের পর আরেকটা বিদ্রোহী কবি হতে চলেছিস।’ গর্বে স্ফীত হই আমি।
প্রতিদিন চারপাঁচটা কবিতা লিখি। বন্ধুরা আরো বেশি লিখতে বলে। কখনো লিখিও। রবীন্দ্র-নজরুলের রেকর্ড ভাঙার স্বপ্ন দেখি।
কবিতার খাতায় ট্রাংক ভরে গেলো। চারদিকে কবিখ্যাতি ছড়ায় খুব দ্রুত।
আমি এর মধ্যে কবিতা কিছুটা বুঝতে শিখি। তাই, একদিন ট্রাংক থেকে গোটা বিশেক কবিতার খাতা বের করে ছোট ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলি, ‘এগুলো বেঁচে চানাচুর খেয়ে ফেলিস।’
মুদি দোকানদারের ছোট ভাই পরদিন দুপুরে হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে, ‘সর্বনাশ হইয়া গেছিল খলিল ভাই।’ সবগুলো কবিতার খাতা আমার সামনে রেখে সে বলে, ‘দেখেন, আপনার ছোট ভাই এইগুলো বেঁইচা আসছিল আমাগো দোকানে।’
আমি ওকে বলি, ‘এগুলো নিয়া যাও, এগুলো কবিতা না।’
আমার প্রায় সাড়ে চারশো কবিতা থেকে মাত্র ২০টার মতো রেখে বাকিগুলো ওভাবেই ফেলে দিয়েছিলাম।
কবিতা লেখার আরো কতো মজার কথা আছে, যেমন আছে আপনাদেরও।
যা লিখি, যখন লিখি, মনে হয় দারুণ একটা কিছু লিখে ফেলেছি। কিন্তু এই উত্তেজনা অতি সাময়িক। কোথায় যেন পড়েছিলাম, কবি আল মাহমুদ একদিন বিকেলে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তাঁর সহচরের সাথে আক্ষেপ প্রকাশ করছিলেন, আমার একটা কবিতাও কি রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো মানসম্পন্ন হয় নি? নিজেকে ছাড়িয়ে সেরাদের সাথে তুলনা সব কবির মধ্যেই হয়তো চলে আসে। আমিও কোনো এককালে ভেবেছি, অন্তত একটি কবিতা আমাকে লিখতে হবে, যার মান সুকান্তের কবিতার মতো। কিন্তু যতোই লিখি না কেন, প্রাণের ভেতর কখনো স্থির আত্মবিশ্বাস জন্মায় না, হ্যাঁ, আমার এই কবিতাটা হয়তো জীবনানন্দ বা নজরুলের অন্তত নিচের সারির একটা কবিতার পাশে দাঁড়াতে পারবে।
কবিতা লিখতে লিখতে সাময়িক তৃপ্তি বশত বইও মুদ্রিত হয়ে যায়। সুদৃশ্য মলাটবন্দি বইটি কিছুদিন প্রচুর আনন্দ দেয়; কিন্তু পরের বইটির গোড়াপত্তন হবার কালে আগের বইয়ের কবিতা পড়ে নিজের কাছেই বিষম লজ্জাবনত হতে হয়- আগের বইয়ের প্রতিটা কবিতায় খুঁত চোখে পড়ে; মনে হয়, এ কবিতাটা কেন ছাপা হলো, এ শব্দটার চেয়ে তো আরেকটা ভালো শব্দ এখানে বসানো যেতো, ইত্যাদি; আর ভালো লাগে না আগের বইটা, এর অনেকগুলো কবিতাও।
সর্বশেষ বই বেরিয়েছিল একুশে বইমেলা ২০০৭-এ। ২০০৯-এর বইমেলায় পরের বই বের করবো ভেবেছিলাম, কিন্তু বিগত দুই-তিন বছরে জমানো কবিতা পড়তে গিয়ে হতাশ হতে হলো, ওগুলোর একটাকেও আর কবিতা মনে হচ্ছে না। আরও কষ্ট বাড়লো, যখন আগের বইয়ের কবিতাগুলোকেও মনে হলো নিতান্ত অসাড়। এরূপ হতাশায় কবিতা লেখা বন্ধ থাকলো কিছুকাল, চলে যাই গদ্যে। গদ্যে দেখি হাত চলে না। আগের বইগুলো খুলে পড়ি, নিজের কাছেই ভীষণ বিব্রত হই, পরতে পরতে খুঁত; কী করে এমন লেখা বই আকারে ছাপিয়েছি! খুব লজ্জা! খুব যন্ত্রণা!
তবু লিখে চলি। বাঁচার তাগিদে কৃষককে লাঙল চালাতে হয়, আলস্য যতোই বাসা বাঁধুক।
করিম, জাহিদ, ইমরান আর শাহজাহান আমার যে কোনো লেখার প্রথম পাঠক- আগে ছিল। ওরা আজকাল খুব কর্মব্যস্ত, কেউ কেউ বিদেশে চলে গেছে চাকরির জন্য। এখন মূলত শাহনাজই আমার লেখাজোকার সামান্য সমঝদার ও প্রথম পাঠক। দূরত্বের কারণে তাও খুব নিয়মিত হয়ে ওঠে না। কিছুদিন আগে গত তিন বছরে লেখা সবগুলো কবিতা প্রিন্ট করে শাহনাজের কাছে পাঠালাম। রাতে শাহনাজের ফোন। পাণ্ডুলিপি হাতে পেয়েই সে ফোন করেছে। মোবাইলের অপর প্রান্তে সে, পাতা উল্টায় আর দু-চার লাইন করে পড়ে। ও খুব অভিভূত।
বিয়ের প্রথম দিকে বউকে খুব জ্বালিয়েছি। একটা কিছু লেখা হলেই তাকে দিয়ে বলতাম- পড়ো। বেচারী গৃহকর্ম সব ফেলে আমার লেখা পড়তো, আর প্রশংসায় পঞ্চ-ষষ্ঠমুখ হয়ে উঠতো। পরে সন্তানাদি আর সংসারে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আর তার সমালোচনাবিহীন একটানা ভালোলাগা একঘেঁয়ে হয়ে উঠলো। আমি শাহনাজ, শাহজাহান, ইমরান, করিম, জাহিদ, প্রমুখ বন্ধুদেরকে অবিরাম জ্বালাতন করতে থাকি।
ঐদিন রাতেই শাহনাজকে ফোন করি- কীরে, কবিতা পড়েছিস সবগুলো?
শাহনাজ ঝাঁঝালো স্বরে বলে, তুই কি পাগল হইছস? তোর এই তিনশো কবিতা কি এতো অল্প সময়ে পইড়া শেষ করন যায়? তবে বেশ কয়েকটা পড়ছি। ভালোলাগাগুলো পেনসিল মার্ক কইরা রাখছি।
কোন্গুলো ভালো লেগেছে, বল।
একটু দাঁড়া, খাতাটা (পাণ্ডুলিপি) হাতে নিয়া নিই।
ও একটা একটা করে বলতে থাকে ওর ভালোলাগা কবিতাগুলো।
এমনিতে প্রয়োজন না পড়লে শাহনাজকে মোবাইল করা হয় না, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস চলে যায়। কিন্তু পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে আমি অস্থির হয়ে গেলাম, সময়ে-অসময়ে, রাত-বিরাতে ফোন করি- শুধু জানার জন্য, আমার কবিতা পড়ে ওর প্রতিক্রিয়া ও মনোভাব কী।
অবশেষে শাহনাজ খুব আশার বাণী শোনালো। বললো, তোর এবারের কবিতাগুলো আগের কবিতার চাইতে অনেক ভালো হয়েছে। তুই অনেক ইম্প্রুভ করেছিস।
শাহনাজের কথায় আমি জ্বলে উঠি। আমি প্রস্তুতি নিই পরের কাব্য প্রকাশ করার।
গত দুদিন ধরে খাটা-খাটুনির পর আজ বিকেলে হাল ছেড়ে বসে পড়লাম। আমার হতাশা তুঙ্গে। প্রায় দেড়-দুইশো কবিতার মধ্যে বই আকারে প্রকাশ করার জন্য আমি কোনো কবিতাই পাচ্ছি না।
আমি জানি, আমার এই হতাশাও অতি সাময়িক। কোনো একটা ভালো সময়ে আগের বইয়ের সবগুলো কবিতাও যেমন মিষ্টি স্মৃতিময় মনে হবে, বক্ষ্যমাণ কবিগুলোকেও খুব উৎকৃষ্ট মনে হবে; সেটা একটা তুমুল আবেগ, আর সেই আবেগের ভেতর দিয়েই আমার পরের কাব্যগ্রন্থ মোড়কবন্দি হবে উন্মোচনের আশায়।
তারপর, আবারও ধারাবাহিক হতাশা, ধারাবাহিক আনন্দাবেগ। কবিতার যন্ত্রণা এমন চিরন্তন।
উপসংহার
কবি কী লিখলেন, পাঠক সেটাকে গ্রহণ করলেন কিনা সেটাই বড় কথা- কবি তা যেভাবেই লিখে থাকুন না কেন। কবি আত্মতৃপ্তির জন্য লিখেন বটে, কিন্তু শুধুই নিজের জন্য লিখেন না, লিখেন মূলত তাঁর পাঠকের জন্য। সব মানুষই মনে মনে কবি, স্বীকৃত কবি হলেন তিনি যাঁর লেখা আমরা পড়তে পাই, অর্থাৎ যিনি তাঁর লেখাগুলো আমাদের গোচরীভূত করেছেন। আমাদের প্রতিক্রিয়াই কবির প্রাণ কিংবা প্রয়াণ। অর্থাৎ কবি তাঁর নিজের জন্যই লিখেন নি। তাই লিখবার কালে তাঁকে পাঠকের কথাটা ভাবতে হবে- পাঠকের সম্মুখে উপস্থাপনযোগ্য এটা হচ্ছে কিনা।
কাল-মহাকাল হলো কবিত্বের সর্বোচ্চ বিচারক। এই মহাকালই আমাদের কাছে টেনে নিয়ে আসে কান্তপা, সরহপাদের; মহাকালই সামনে নিয়ে যাবে নজরুল-রবীন্দ্র, বর্তমানের নব্য ও আধুনিক কবিদের- কষ্টিপাথরে ঘঁষে ঘঁষে সোনাটাকে রেখে, আর সমস্ত জঞ্জাল সাগরে ফেলে দিয়ে।
আর যতোদিন লিখি, আসুন, শুধু নিজের তৃপ্তির জন্য নয়, পাঠকের জন্যও লিখি।