প্রমীলার সাথে আমার একটা ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপার আছে, সেটি অবশ্য বেশ পরের ঘটনা। সেই ব্যাপারটা শুধু প্রমীলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; প্রমীলা থেকে সারা ক্লাসের মেয়েদের মধ্যে সেই ভুল বোঝাবুঝি ছড়িয়ে পড়েছিল, এমনও হতে পারে যে সকুলের সব মেয়েই আমার সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা করে নিয়েছিল।
তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি। ছুটির ঘন্টা পড়লে যথারীতি ক্লাস থেকে বেরিয়েছি। ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে মেইন রোডে ওঠার আগে বিশ-পঁচিশ গজ রাসতা। আমি সেই রাসতা ধরে মেইন রোডের দিকে এগোচ্ছি। এই জায়গাটুকুতে ছাত্র-ছাত্রীদের তখন প্রচুর ভিড়, একটি মাত্র মেইন গেইট দিয়েই সবাইকে বের হতে হয়। ঠেলাঠেলি করে হাঁটছি, এমন সময়ে আমার স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে গেল। কি যে বিড়ম্বনা, এক পাশে চেপে গিয়ে নিচু হয়ে কিছুক্ষণ গিঁঠু দিয়ে ফিতাটি আটকাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় অবশ্য ততক্ষণে কমে গেছে। অগত্যা জুতা জোড়া হাতে নিয়ে খাতার পাতা ছিঁড়ে কাগজে মোড়ালাম, তারপর বই-খাতার সাথে জড়িয়ে নিলাম।
গেইট পেরিয়ে মেইন রোডে পা ফেলেই দেখি রাসতার ওপারে আমাদের ক্লাসের সবগুলো মেয়ে দাঁড়িয়ে। ওরা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা কি বুঝতে পারছে যে আমার বই-খাতার নিচে কাগজে মোড়ানো ছেঁড়া স্যান্ডেল লুকানো আছে? আমি লজ্জাবোধ করতে লাগলাম। আবার বেশ পুলকিত বোধও করলাম, এতগুলো মেয়ের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হওয়া পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।
আমি গোবেচারা মানুষ, বড় লাজুক, তবুও আমার ঠোঁটের কোণে একটু হাসির ঝিলিক ফুটিয়ে দিলাম, মৃদু করে। প্রত্যুত্তরে ওরা কেউ হাসলো না। ওদের কি হয়েছে? আমি ভাবতে থাকি। প্রতিদিন এখান থেকে ওরা দু-দলে ভাগ হয়ে যায় - একদল যায় রাসতার দক্ষিণ দিকে, যাদের বাড়ি নারিশা, শিমুলিয়া, মেঘুলা, মালিকান্দা গ্রামে, যেমন মেহনাজ, সায়ন্তনী, বীনা সুলতানা, শামীমা এবং প্রমীলা। আরেক দল যায় উত্তর দিকে, যেমন নার্গিস, ঝিনুক, নাজনীন, শাহনাজ, বিউটি। ওদের গ্রামের নাম ঝনকী, সুতারপাড়া, মুন্সীকান্দা, গাজীরটেক, ইত্যাদি। আমি ভাবলাম, ওরা দুদিকের যাত্রী, এখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে কেন?
কিন্তু আমি তো আর যেচে ওদের কাছে এই কৌতূহল ব্যক্ত করতে পারি না। প্রথমত, মেয়েদের সাথে কথা বলার মত অতখানি চতুর ও বাকপটু আমি নই; দ্বিতীয়ত, ওদের সাথে অহরহ কথা বলার মত অত সাহসও আমার নেই, অতখানি ঘনিষ্টতা কিংবা সখ্যতাও গড়ে ওঠেনি।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ধীর পায়ে উত্তর দিকে মোড় নিয়ে হাঁটছি, তখনই দেখি সবগুলো মেয়ে এক যোগে উত্তরমুখী রওনা হলো এবং তখনো ওরা সবাই আমাকেই লক্ষ্য করে আছে।
না-হি-দ। খানিকটা রুক্ষ ও তীক্ষ্ণ কণ্ঠে সায়ন্তনী ডেকে উঠলা। বললো, আস্তে হাঁটো।
আমি আস্তে আস্তেই হাঁটছিলাম।
সায়ন্তনীর কঠিন দৃষ্টিতে আগুন ঠিকরে পড়ে। ওর ঠোঁটের কোণে বক্র ও বিদ্রূপাত্মক হাসির ঝিলিক, অন্তরে চাপা ক্ষোভ। লক্ষ্য করি, সবগুলো মেয়ের মধ্যেই তখন একরূপ।
সায়ন্তনী বললো, তোমার কাছে আমরা একটা সংজ্ঞা শিখতে চাই।
আমি মনে মনে গর্বের হাসি হাসলাম। আমি যে ক্লাসের সেরা ছাত্র মেয়েদের কাছে তাহলে আমার অন্তত এই স্বীকৃতি এবং দামটুকু আছে। ওরা আজকাল আমার কাছ থেকে সামান্য হলেও কিছু শিক্ষালাভ করতে চায়।
যুগপৎ আমি অবশ্য আরেকটি বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হলাম। ক্লাসের ছেলে মেয়েরা নিজেদের মধ্যে সব সময় তুই-তুকারি করেই কথা বলে, ওরা হঠাৎ করে আমার সাথে 'তুমি'তে চলে এল কেন?
আমি আড়ষ্ট মুখে জিঞ্চাসা করলাম, কিসের সংজ্ঞা?
সায়ন্তনী বললো, আচ্ছা, আমাদের একটু ভালো করে বুঝিয়ে দাও তো পদার্থ কাকে বলে?
আমি মনে মনে শব্দ (?) করে হেসে উঠলাম, ওরে নির্বোধ গণ্ডমূর্খের দল, গত পাঁচ বছর ধরে এই পদার্থের সংজ্ঞা পড়ছিস, আজও তার সঠিক সংজ্ঞা বুঝতে পারলি না? গর্দভের দল রে!
আমি বললাম, পদার্থের সংজ্ঞা পারছিস না? এর চেয়ে সহজ সংজ্ঞা তো মনে হয় সায়েন্সে নেই। ভালো করে শোন্, আমি বুঝিয়ে বলছি, যার ওজন আছে এবং কিছু পরিমাণ জায়গা দখল করার ক্ষমতা আছে, তাকেই পদার্থ বলে। মনোযোগ দিয়ে শোন্, আমি আবার বলছি...।
আর বলতে হবে না, সায়ন্তনী বললো, বলো তো, আমাদের কি ওজন আছে এবং আমরা কি কিছু পরিমাণ জায়গা দখল করে থাকি?
নিশ্চয়ই, আমি হেসে দিয়ে বললাম, তোদের একেক জনের ওজন তো মাশাল্লা কম করে হলেও চল্লিশ কেজি হবে। এবং পাঁচ হাত বাই চার হাত মাপের খাটটাও দখল করে থাকিস, অতএব....।
অতএব, আমরা সব্বাই পদার্থ, তাই তো? এবার বলো অপদার্থ কাকে বলে?
বিদ্ঘুটে প্রশ্ন তো? বিজ্ঞান বইয়ের কোন জায়গাতেই অপদার্থের সংঞ্চা দেয়া নেই। কিন্তু পদার্থের সংঞ্চা আছে তো। পদার্থের বিপরীত শব্দ হলো অ-পদার্থ, অর্থাৎ যা পদার্থ নয় তাই অপদার্থ।
আমার বুদ্ধিমত্তা খুব প্রখর, এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। আমি সাহিত্য ও বিজ্ঞান মিলিয়ে অপদার্থের সংজ্ঞা দিলাম, যা পদার্থ নয় তাই অপদার্থ, অর্থাৎ যার কোন ওজন নেই, জায়গা দখল করতে পারে না, তাকে অপদার্থ ছাড়া অন্য কোন কিছু বলা যায় না।
হঠাৎ সবগুলো মেয়ে প্রায় এক যোগে উচ্চস্বরে বলে উঠলো, তাহলে তোকে (খাঁটি সম্বোধনে ফিরে এসে) ব্যাখ্যা করে বলতে হবে যে প্রমীলা কোন্ অর্থে অপদার্থ।
ওদের ডামাডোলে মাথা আউলে গেল। বললাম, তোদের প্রশ্নটা বুঝতে পারিনি।
নাজনীন এবার ঘাড় উঁচু করে সামনে এগিয়ে এসে উত্তেজিত স্বরে জিঞ্চাসা করে, তোর পণ্ডিতগিরির কাঁথা পুড়ি, প্রমীলাকে অপদার্থ বললি কেন আগে তার জবাব দে।
নাজনীনের সংগে সংগে সবগুলো মেয়ে কলকলিয়ে তেড়ে উঠলো, আমি সম্পূর্ণ দিশেহারা হয়ে গেলাম। ওদের প্রশ্নের আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না।
আমাদের ক্লাসের পণ্ডিত অ-পণ্ডিত ছেলেগুলো অনেক দূর চলে গেছে। আমি একা ও অসহায়। তদুপরি, সিনিয়র ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র আমার অসহায়ত্বকে বেশ উপভোগ করছেন, আর মেয়েগুলোর পক্ষাবলম্বন করে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও মন জয় করার চেষ্টা করছেন। সায়ন্তনীদের পেছনে অবশ্য বেশ কয়েকজন অন্যান্য শ্রেণীর ছাত্রীও যোগ হয়েছে।
আমি বললাম, কে প্রমীলাকে অপদার্থ বলেছে?
তুই বলেছিস, তুই বলেছিস। ওরা চেঁচিয়ে উঠলো।
আমি ভীষণ ধাঁধায় পড়ে গেলাম। বললাম, কখন আমি প্রমীলাকে অপদার্থ বললাম? আমি কক্ষণো কাউকে অপদার্থ বলিনি।
খবরদার মিথ্যা বলবি না, অবশ্য অবশ্যই তুই প্রমীলাকে অপদার্থ বলেছিস। বল্, বলিসনি?
আমি বলিনি।
বলেছিস।
বলিনি।
চুপ মিথ্যুকের হাড্ডি- একশোবার বলেছিস।
কখন বললাম?
ঐ যে কিবরিয়া স্যার যখন আমাদের মেয়েদের বকছিলেন, তুই বলেছিলি প্রমীলা একটা অপদার্থ।
চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো, আমি বলিনি। বলিনি। প্রমীলাকে অপদার্থ বলিনি।
বিউটি বললো, প্রমীলার মত মেয়েকে যে অপদার্থ বলতে পারে তার শাস্তি না হয়ে পারে না।
নাজনীন ঝাঁঝালো স্বরে বললো, তোকে দশবার কান ধরে ওঠ্-বস্ করতে হবে।
ঝিনুক তেঁজে ফেটে পড়লো, বললো, তোর হাড়-মাংস আমরা চিবিয়ে খাব।
শামীমা বললো, আমরা তোর ঘাড় মটকাবো, হাড়-মাংস গুঁড়া করে ছাড়বো।
সায়ন্তনী বললো, তুই ছাড়া অন্য কেউ এ-কথা বললে তাকে আমরা জুতা দিয়ে পিটাতাম।
আমার কানের লতি পর্যন্ত জ্বলতে থাকলো। আমি রাঙ্গা হয়ে উঠলাম, লজ্জা ও অপমানে। আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে জিঞ্চাসা করলাম, তোরা কি নিজ কানে শুনেছিস যে আমি প্রমীলাকে অপদার্থ বলেছি?
এতক্ষণ প্রমীলা নিশ্চুপ ছিল। এবার সে অগ্রভাগে এসে বললো, নিশ্চয়ই বলেছিস, আমি স্পষ্ট শুনেছি তুই আমাকে অপদার্থ বলেছিস।
কিন্তু আমিও নিশ্চিত, আমার অন্তর্যামী সাক্ষী, শুধু প্রমীলা কেন, জীবনে এই 'অপদার্থ' শব্দটি দ্বারা আমি অন্য কাউকেই গালি দিইনি।
কিন্তু আমার মনের কথাটা ওদেরকে আমি বোঝাতে পারলাম না। ওরা বোঝার চেষ্টাও করলো না।
আসমা, যে আমাদের দু-ক্লাস সিনিয়র ছিল, বাল্য বিবাহের কারণে ইতোপূর্বে যার দু-বার ফল-বিপর্যয় ঘটেছিল বলে গত দু-বছর যাবত আমাদের ক্লাসেই আছে, মায়াবী চেহারার সেই শ্যামলা মেয়েটি সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে এল। বললো, তোমাকে কিন্তু শাস্তি পেতেই হবে (সে অবশ্য আগাগোড়া 'তুমি' করেই বলতো)।
নার্গিস সবচাইতে তীব্র আঘাত হানলো। বললো, আয়নায় তোর নিজের চেহারা কখনো দেখেছিস? দেখতে তো একেবারে বাঁদরের মত! সে কিনা আবার প্রমীলাকে বলে অপদার্থ।
নার্গিসের কথায় আমি খুব কষ্ট পেলাম। আমার অসহায় মুখাবয়ব ভীষণ ম্লান ও করুণ হয়ে গেল। আমার অন্তরে নার্গিসের জন্য একটা অন্য রকমের স্থান ছিল। কবির উদ্দিন আমার অন্যতম ঘনিষ্ট সহপাঠী। নার্গিস কবিরের ছোট বোন, একই শ্রেণীতে পড়ে। কবিরের বাসায় আমার হরহামেশাই যাওয়া-আসা হয়। কবিরের সাথে ওদের বাংলা ঘরে বসে কত গল্প করি, পড়াশোনার বাইরের জগত নিয়ে। মাঝে মাঝে নার্গিস সে ঘরে আসে। নার্গিসকে দেখলে আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ওর চেহারাটা ঠিক আমার কর্পুরা খালার মত। ও যখন সামনে দিয়ে হেঁটে যেত আমার নাকে একটা অদ্ভূত মিষ্টি ঘ্রাণ এসে লাগতো - আমার কর্পুরা খালার গায়ে এরকম ঘ্রাণ ছিল। আমার কর্পুরা খালা নেই। নার্গিসকে দেখে আমি খালার কথা ভাবতাম।
সেই নার্গিস, আমার কর্পুরা খালার ছায়া, আমার অন্যতম ঘনিষ্ট সহপাঠীর ছোট বোন, আমাকে এতখানি অপমান করে কথা বললো? আমি মাথা নিচু করে হাঁটছিলাম। নার্গিসের কথায় আমি ওর দিকে তাকাতেই দরদর বেগে আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। আমার করুণ চাহনি দেখে কেন যেন হঠাৎ ওদের মায়া হয়, আস্তে আস্তে শোরগোল থেমে গেল।
আসমা মুখে সহানুভূতির হাসি ফুটিয়ে বললো, আমার শাস্তিটা কিন্তু একটু অন্য রকমের।
আমি কথা বলতে পারলাম না। মেয়েদের কথার কিংবা কাজের প্রতিবাদ করার সাহস ও শক্তি কোনটাই আমার নেই। আমি তার দিকে তাকালাম।
আসমা বললো, শাস্তিটা হলো আমাদের সবাইকে আজ তোমাদের বাসায় বেড়াতে নিয়ে যাবে। পারবে না?
আমি শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে বললাম, ঠিক আছে।
আমরা কিন্তু রাতেও তোমাদের বাসায় থাকবো।
আমি বললাম, ঠিক আছে।
আচ্ছা, তোমাদের বাড়িতে কয়টা ঘর আছে?
একটা।
হায় আল্লাহ, ওই একটা ঘরে তো আমাদেরই জায়গা হবে না। তুমি থাকবে কই, তোমার মা-বাবা আর ভাই-বোনেরা কোথায় থাকবে?
রান্না ঘরে।
সবাই খিলখিল করে হেসে উঠলো।
সায়ন্তনী বললো, একটা কাজ অবশ্য করা যায়, রাতে থাকার দরকার কি? খেয়ে-দেয়ে সন্ধ্যার আগে আগেই চলে এলাম?
আমি ভাবছিলাম এতক্ষণ ওরা আমার সাথে ঠাট্টা করছিল। কিন্তু সায়ন্তনীর কথায় মনে হলো, না, ঠাট্টা নয়। ওরা সত্যি সত্যিই আমাদের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। তাহলে এই ছিল ওদের মনে? সম্পূর্ণ পূর্ব-পরিকল্পিত চাল!
আমি মনে মনে দারুণ বিপাকে পড়ে গেলাম। আমাদের ক্লাসের মেয়েদেরকে আপ্যায়ন করার মত আমাদের ঘর-দোরের অবস্থা নয়। দুটি মাত্র ঘর, তা-ও আবার কুঁড়ে ঘর। পড়ার ঘর বলতে আমার কোন ঘর নেই। বই-খাতা কলম বড় ঘরে একটা তাকে রাখি। পড়ার সময়ে শুয়ে শুয়ে পড়ি। খেজুর পাতার পাটিতে শুই, ঘরে কোন খাট নেই, চৌকি নেই, বসার জন্য একটা মোড়া কিংবা চেয়ার নেই। কাঠের পিঁড়িতে বসি। যখন লিখতে হয় পাটিতে বসে উঁবু হয়ে লিখি। টিনের থালা, মাটির বাসনে খাই, পিতলের একটি মাত্র বড় গেলাসে (দাদুর সম্পত্তি) সবাই মিলে পানি পান করি। এই যখন ঘর-দোরের অবস্থা, আমার ক্লাসের বান্ধবীরা এই হত-দরিদ্রের বাড়িতে এসে উল্টো ওরাই আরো লজ্জায় পড়ে যাবে না? আমি ভিতরে ভিতরে হাঁপিয়ে উঠলাম। একবার ভাবলাম, বলেই ফেলি, আজ আমার মা অসুস্থ। তোরা কাল আসিস্। আবার ভাবলাম, এতে না হয় আজ রক্ষা পাওয়া গেল, যদি ওরা কাল আসে? সত্যি কথাটাই বলে ফেলতে দোষ কই, না রে, আমরা খুব গরীব। আমরা তোদেরকে খাতির করতে পারবো না।
শামীমা বললো, তোদের বাড়িটা আর কতদূর?
আমি বললাম, আর বেশি দূর নেই। এই রাস্তায় ধাপারী খাল পর্যন্ত দশ মিনিট, তারপর ডান দিকে মোড়, ধাপারী খালের পার ধরে সুতারপাড়া গ্রামের ভিতর দিয়ে বিশ মিনিট, মাঝখানে অবশ্য শেরখান, জাহিদ আর বায়েজীদদের বাড়ি। তারপর আমাদের ডাইয়ারকুম গ্রাম। আমাদের গ্রামের উত্তর দিকটা অনেক সুন্দর, বিশাল সবুজ মাঠ, ধান হয়, পাট হয়, গম, আলু, সব হয়। আড়িয়াল বিল আছে না, ওটা কিন্তু আমাদের গ্রামের ঠিক পূর্ব দিকে। তোরা জানিস, আমাদের গ্রামের নাম ডাইয়ারকুম হলো কেন? 'কুম' একটা আঞ্চলিক শব্দ যার মানে হলো বিশাল ডোবা, গর্ত, যাতে সারা মাস পানি থাকে। গ্রীষ্মে সব খাল আর পুকুর-ডোবা শুকিয়ে গেলেও আমাদের গ্রামের কুমটিতে সারা মাস ধরে পানি থাকতো। আশেপাশের দশ গ্রামের মানুষ আসতো তখন এই কুমে গোসল করতে। 'ডাইয়া' শব্দটার অর্থ হলো শক্ত-সামর্থ, বলিষ্ঠ, আবার আরেক অর্থে পিঁপড়াও। আমাদের গ্রামের মানুষগুলো খুব শক্ত, বলিষ্ঠ, তরতাজা, সাহসী। ওরা এতই একতাবদ্ধ যে ও-গাঁয়ের কারো গতরে ভিন গ্রামের কেউ একটা টোকা দিলে ওরা হৈ হৈ রৈ রৈ করে একত্রে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদেরকে ঘায়েল করে ছাড়তো। এজন্য ওদেরকে আশেপাশের গ্রামের মানুষ খুব ভয় পেত, বলতো ডাইয়া। সেই থেকে গ্রামটার নাম হয়ে গেল ডাইয়ারকুম।
তোদেরকে আরেকটা কথা বলি। যাবার সময় তোদেরকে এক কবির বাড়িতে নিয়ে যাব। মিজানুর রহমান শমশেরী। সুতারপাড়ার শেষ মাথায় বাড়ি। দেখবি, কবি ভাই তোদেরকে দাঁড় করিয়ে রেখেই একের পর এক কবিতা লিখে ফেলছেন। তাঁর একটা বিখ্যাত কবিতা আছে, শোন্ ...
হঠাৎ আমার খেয়াল হলো, আরে, আমি এত কথা বলছি কেন? আসলে আমার অন্তরের ভিতর তখন আসন্ন লজ্জাকর পরিস্থিতির কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল, আমি মুখে কি বলছিলাম সে বিষয়ে আমার হিতাহিত কোন জ্ঞান ছিল না।
কথা বন্ধ করে ওদের দিকে তাকালাম। ওরা সবাই মিটিমিটি হাসছে। আমার মুখে কোন হাসি ফুটছে না। কি যে বিব্রতকর অবসহার সম্মুখীন হতে যাচ্ছি!
আর পঞ্চাশ গজ পরেই আমরা মেইন রোড থেকে নেমে ডান দিকে মোড় নিব। এ কথা ওদের জানানো মাত্রই ওরা একটু উজ্জ্বল ও সচকিত হলো।
আমি আগে আগে হাঁটছি। মোড়ের কাছে এসে থেমে বললাম, এবার ডান দিকে যেতে হবে। কিন্তু ওরা না থেমে ফিক ফিক করে হেসে উঠলো।
আমি বললাম, ব্যাপার কি, তোরা যাবি না?
নার্গিস বললো, যাব কি, যাবার আগেই তো ভয় পেয়ে গেছিস।
আমার মনের ভয় কিছুতেই বাইরে প্রকাশ পেতে দিব না। আমি গলায় জোর আনার চেষ্টা করে বললাম, তোদের অবশ্যই যেতে হবে, অবশ্যই। ওদের সামনে গিয়ে দুহাত প্রসারিত করে থামাবার চেষ্টা করতে থাকলাম। ওরা খিল খিল করে হাসতে থাকলো।
আসমা বললো, ঠিক আছে রে ভাই, তোমাদের বাসায় অবশ্যই যাব, তবে আজ না। আসলে আজ আমরা একটা বাসায় দাওয়াত খেতে যাচ্ছি। আজ বিউটির পুতুল বিয়ে তো, আমরা যাচ্ছি বাসর সাজাতে। বলতেই সবগুলো মেয়ে এক যোগে হেসে আমাকে পাশ কাটিয়ে টা-টা দিয়ে চলে গেল। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। যদ্দুর দেখা গেল, বেশ কয়েক জন পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো আমি তখনো তালগাছের মত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে কিনা। কিন্তু প্রমীলা? প্রমীলা একবারও তাকালো না। আমার মনের পর্দায় ওর জেদী, ত্রু²দ্ধ আর অহংকারী চেহারাটা বারবার ফুটে উঠতে থাকলো।
আমি বাড়ি যাচ্ছিলাম আর মনে করার চেষ্টা করছিলাম, আমি কি সত্যি প্রমীলাকে 'অপদার্থ' বলে গালি দিয়েছি? কখন দিয়েছি? অপদার্থ শব্দটাও এর আগে আমি কখনো উচ্চারণ করেছি বলেও মনে পড়লো না। তাহলে কি আমার বিরুদ্ধে বানোয়াট অভিযোগ? তা কি করে হয়? আমার সঙ্গে কৌতুক? তা-ও না। কৌতুক এত মারাত্মক ও অপমানকর হয় না। তাহলে ওরা এত ক্ষেপলো কেন? আমি কোন কূল কিনারা পাইনি।
প্রমীলাকে এই কথাটা জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পেলে কি ওকে জিজ্ঞাসা করবো? ওর কি মনে আছে সেই কথা? যদি ভুলে গিয়ে থাকে, তাহলে আবার মনে করিয়ে দিয়ে কি আরো আগুন জ্বালবো?
অন্তরবাসিনী, উপন্যাস, প্রকাশকাল একুশে বইমেলা ২০০৪
পর্ব-১
পর্ব-২
পর্ব-৩
পর্ব-৪
পর্ব-৫
পর্ব-৬
পর্ব-৭
পর্ব-৮
পর্ব-৯
পর্ব-১০
পর্ব-১১
পর্ব-১২
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০৭