ভারতীয় টুর্নামেন্ট আইপিএল-এর আদলে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আয়োজিত হলো বিপিএল। ধীরগতির খেলা ক্রিকেটে আজ গতি এসেছে, ম্যাচের দৈর্ঘ্য হ্রস্ব হয়েছে আর খেলোয়াড়েরা হয়ে উঠেছেন মারদাঙ্গা। বুদ্ধি আর শৈলীর খেলায় দেখা মিলছে ঝড় আর তাণ্ডবের। তবে বেশ কিছু বছর ধরে ক্রিকেট কেবল জনপ্রিয় একটি খেলাই নয়, এর সঙ্গে কর্পোরেট স্পন্সরশিপ আর মিডিয়া সহযোগে একটা ত্রিধারার জঙ্গে পরিণত হয়েছে ক্রিকটে। এই আন্তঃসম্পর্ক এতই গভীর যে স্পন্সর ছাড়া কোনো টুর্নামেন্ট হয়না, টিভি স¤প্রচার ছাড়া ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন এখন অসম্ভব। ক্রিকেটের নিয়মকানুনের মধ্যে টেলিভিশনের উপস্থিতিকে নিশ্চিত করা হয়েছে। টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটকে ঘিরে ভারতে একরকম মিডিয়া-সংঘাতও হয়েছে, ক্রিকেটকে দখলে রাখার জন্য এই সংঘাত। জিটিভি আইসিএলের আয়োজন করলে, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সেটাকে বিদ্রোহী টুর্নামেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করে ও পাল্টা আইপিএলের আয়োজন করে এবং মিডিয়া স্পন্সরশিপ বিক্রি করে সনি টেলিভিশন ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড স্পোর্টস গ্রুপ-এর কাছে, ৮০০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে। খেলোয়াড়দের যেভাবে নিলামে তোলা হয় এবং তারা যেভাবে ‘বিক্রি’ হন, তাতে তাদের শেষপর্যন্ত কৃতী ও মানী মানুষ মনে হয়না, মনে হয় নির্জীব-প্রাণহীন একেকটি পণ্য। রিউয়েল ডেনি নামের এক পণ্ডিত বলেছিলেন মিডিয়াবাহিত প্রতিযোগিতায় ক্রীড়া তার গীতল রূপটি হারিয়েছে, পরিণত হয়েছে ‘স্পেক্টল’-এ -- এক জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনীতে। বিধ্বংসী ব্যাটিং-চিয়ার গার্ল-তারকা অ্যাম্বাসেডর-স্পন্সরশিপ কাঁচামালে যে-বটিকা প্রস্তুত করা হয়েছে তা না গিলে দর্শক যাবে কোথায়?
আইপিএলের মতো করেই বাংলাদেশে আয়োজিত হয়েছে বিপিএল। আয়োজক হিসেবে বাংলাদেশের নাম এসেছে, খুলনা-বরিশালের মতো শহরগুলোর নাম দেশের বাইরে ছড়িয়েছে এবং বহির্বিশ্বের ধারণা হয়েছে গরিব বাংলাদেশে ওড়ানোর মতো কিছু টাকাওয়ালাও রয়েছে। কিন্তু বিপিএলের কঙ্কালটাই কেবল ক্রিকেট, নয়তো এতে রয়েছে কর্পোরেট অর্থনীতি ও বিপণন বাণিজ্যের রক্ত-মাংস। বিপিএলের শিরোনামেই কেবল রয়েছে বাংলাদেশ কিংবা দলের নামে রাজশাহী-সিলেট, নয়তো এ এক গ্লোবাল গেইম। পুরো বিপিএলের স্পন্সরশিপ কিনেছে ভারতীয় একটি কোম্পানি, তারা আবার এর নানান অংশ যেমন টাইটেল স্পন্সর, মিডিয়া পার্টনারশিপ এবং সর্বোপরি ফ্র্যাঞ্চাইজ মালিকানা বিক্রি করেছে নানান জনের কাছে। আবার বিপিএলের মূল আকর্ষণ হলো বিদেশি খেলোয়াড়েরা, যাদের উচ্চমূল্যে কিনতে হয়েছে। আইপিএলে এক দলে বিদেশি খেলোয়াড় খেলতে পারে সর্বোচ্চ চারজন, আর বিপিএলে পাঁচজন। আর রয়েছে বিদেশি কনসাল্টেন্টবাহিনী, ধারাভাষ্যকারবাহিনী। টাইটেল স্পন্সরশিপ, মিডিয়া পার্টনারশিপ এবং ফ্র্যাঞ্চাইজ মালিকানা বাংলাদেশি হলেও, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যয়িত অর্থ যাবে ভারতীয় কোম্পানিটির অ্যাকাউন্টে। খেলোয়াড়-কনসাল্টেন্টের অর্থের প্রবাহপথও দেশ হতে বিদেশে। দেশীয় অর্থনীতির বর্তমান মন্দার সময়ে এই টুর্নামেন্ট তাই একটা খটকা, যান্ত্রিক সভ্যতার প্রতীক মোটরকার যেমন জীবনানন্দ দাশের কাছে খটকা হিসেবে হাজির হয়েছিল। দেশের লক্ষ লক্ষ শেয়ার ব্যবসায়ী যখন সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসার যোগাড়, তখন অর্থের ছড়াছড়ির এই রঙিলা টুর্নামেন্ট এক খটকাই বটে, যে টুর্নামেন্টে চিয়ার লিডারদের পাশাপাশি দলকে উজ্জীবিত করতে প্রায়শই বলিউডি তারকাদের আনাগোনা চলেছে।
বিপিএলের প্রথম আসরে নানান অভিযোগ-আশঙ্কা তৈরী হয়েছে। ম্যাচ ফিক্সিং-এর কালো ছায়া হানা দিয়েছে অন্তত দুইবার। পাকিস্তানি এক নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছে এই অভিযোগে। চট্টগ্রাম না বরিশাল, সেমিফাইনালে কে যাবে তা নিয়ে হয়েছে নাটক। টুর্নামেন্টের বাইলজ নিয়ে আয়োজকদের পরিস্কার ধারণা না থাকায় এমনটি হয়েছে। জাতীয় দলের অধিনায়ক অভিযোগ করেছেন যে চুক্তি অনুযায়ী খেলোয়াড়দের অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে না। অন্যদিকে অভিযোগ আছে যে, খেলোয়াড়দের অর্জিত অর্থ থেকে আয়কর আদায়ের ব্যবস্থা ঠিকঠাকমতো রাখা হয়নি।
তবুও মানুষ ক্রিকেট দেখে। কারণ তারা ক্রিকেটকে ভালবাসে। জাতীয় দল ক্রিকেট খেললে দর্শকেরা জাতীয়তাবোধ দ্বারা আক্রান্ত-আবেগমথিত হইয়া পড়ে। বিপিএলে জন্ম হচ্ছে স্থানীয়-আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের। রাজশাহীর জয়ে উদ্বেলিত হয়েছে পুরো উত্তরবঙ্গ, সিলেটের পরাজয়ে মুষড়ে পড়েছে সিলেটিরা। এ হলো ক্রিকেটের সঙ্গে মানুষের প্রণয়ের সম্পর্কের নমুনা। এই ক্রিকেটপ্রেমের কারণেই তাদের আবার বিক্রিও করে দেয়া হচ্ছে। এই যে বিশাল অর্থের লেনদেন, তা হচ্ছে কিন্তু মানুষের ক্রিকেটপ্রেমকে পুঁজি করেই। ফলে অনুমোদন প্রদানকারী আইসিসি, আয়োজক বিসিবি, প্রচারকারী টেলিভিশন চ্যানেল -- সবাই মিলে স্পন্সর-ব্র্যান্ড-বিজ্ঞাপনদাতার কাছে বিক্রি করছে মানুষকেই। মানুষ সবান্ধব স্টেডিয়ামে গিয়েছে, টেলিভিশনের সামনে বসেছে শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনায় অংশ নিতে আর প্রিয় দলকে বিজয়ী দেখতে -- এটা তার অধিকার যে এই আনন্দযজ্ঞে সে সামিল হবে। কিন্তু এই যজ্ঞের পেছনের রাজনৈতিক অর্থনীতিটি বুঝে নেবারও প্রয়োজন রয়েছে।
০২ মার্চ, ২০১২