দি টাইমস্
১০ আগস্ট, ১৯৭১।
নয়া দিল্লি ও মস্কোর মধ্যকার গতকালের 'বন্ধুত্ব, শান্তি ও সহযোগিতা'-র যে-চুক্তি হয়েছে, পরিহাসের বিষয় এই যে তা থেকে উপমহাদেশে কেবল শত্রুতা, যুদ্ধ ও ধ্বংসই বৃদ্ধি পাবে। একই ফলাফল আসবে ইয়াহিয়া খানের শেখ মুজিবকে নিয়ে গোপন সামরিক বিচারের ভয়ংকর সিদ্ধান্ত থেকে। ভারত ও পাকিস্তান সরাসরি সংঘাতের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে যোগাযোগবিহীন অবস্থায় মুজিব বন্দি থাকায়, পাকিস্তানের জন্য বুদ্ধি ফেরার ও সর্বগ্রাসী নীতি বিসর্জন দেবার একটি সুযোগ এসেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত ও অবিসংবাদিত নেতা মুজিবের সঙ্গে রফা করার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। আসন্ন বিচারের রায় কী হবে তা সবার জানা, এবং এটাই সেই সুযোগকে নষ্ট করে দিচ্ছে। ভারতের বিরুদ্ধে চীন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ালে ভারতের সামরিক বাহিনীকে ইয়হিয়া নিরস্ত্র করতে পারতো। কিন্তু গ্রোমিকোর সঙ্গে ভারতের সাম্প্রতিক চুক্তি সেই শক্তিকেও অনেক দুর্বল করে দিয়েছে। কারণ সেই চুক্তিতে উভয় দেশের জন্য যেকোনো 'হুমিক ও আক্রমণ'-এর সময়ে যৌথ 'কার্যকর পদক্ষেপ' গ্রহণের কথা বলা আছে। এধরনের আক্রমণের হুমকি কার কাছ থেকে আসতে পারে? পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে যুদ্ধ বাঁধলে কেবল চীনের আসার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু চীন কি সেই ঝুঁকি নেবে? সোভিয়েতের সঙ্গে পূর্বের সংঘাতের জের ধরে তার সীমান্তই কি অরক্ষিত হয়ে পড়বে না?
কেউই ভারতীয় সরকারকে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের জন্য দায়ী করছে না। আর সেদেশে যুদ্ধের পক্ষে মত দৃঢ় হয়ে উঠছে। গতকালের বিরাট মিছিল সেটাই নির্দেশ করে। আক্রমণ করার রাজনৈতিক চাপ প্রবল। কিন্তু সবচাইতে বেশি রয়েছে অর্থনৈতিক চাপ যার জন্য যুদ্ধ নাও এড়ানো যেতে পারে। ছয় বা সাত মিলিয়ন উদ্বাস্তুর স্থায়ী ভার নেয়া বেশিদিন সম্ভব নয় যেক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ খুবই কম। এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী যেকরম বাংলাদেশ চায় সেরকম বাংলাদেশে হয় (মুজিবের সমাধান হিসেবে) মুক্তভাবে দেশে ফিরে যাবে; অথবা ভারতীয় অধিকৃত ভূখণ্ডে ভারতীয় সৈন্যদের প্রহরায় ফিরে যাবে।
ভারতীয় জেনারেলরা যুদ্ধের যে পরিকল্পনা করতে পারেন তা তাদের জন্য খুবই আকর্ষণীয় হতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা নাই বললাম। উত্তর সীমান্ত থেকে সৈন্যডিভিশনকে পাঞ্জাবসীমান্তে নিয়ে আসা যেতে পারে যাতে সমতলে পাকিস্তানকে সামরিক অচলাবস্থার মুখোমুখি হতে হবে; এরপর সেনাবাহিনীকে পূর্বাংশে নিয়ে আসা যাবে -- প্যারাট্রুপারের সাহায্যে এয়ারপোর্টে সৈন্য নামানো, জলপথ অবরোধ করার মাধ্যমে এবং সম্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে প্রয়োজনীয় সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যাবে। কলকাতায় আওয়ামী লীগের নেতারা আছেন, তারা এভাবে ক্ষমতা পারলে খুশিই হবেন; বাঙালিদের মতামত যা পাওয়া যায় তাতে মনে হয় তাদের অনুপ্রবেশকারীদের স্বাধীনতাঅর্জনকারীরূপে অভ্যর্থনা জানাতে আপত্তি নেই।
এটি একটি অশুভ সময়। ব্যাপক রক্তপাতের সময়, ব্যাপক ঝুঁকির ও ভীতির সময়। কিন্তু একে কি থামানো যাবে? বিশ্বমত যদি ইয়াহিয়াকে থামাতে পারে তবে যেতে পারে। মুজিবকে যদি দোষী সাব্যাস্ত করা না হয় তবে -- ভারতকে যদি চূড়ান্ত হতাশ হবার দিন আসার আগেই যথাযথ ও ব্যাপক সাহায্য করা যায়। কিন্তু একে কি থামানো যাবে?
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১১:৪০